আমরা প্রত্যেকেই কখনো না কখনো শরীর খারাপ হলে ওষুধ খেয়েছি। কিন্তু ভেবে দেখেছ কি সেই ওষুধ তৈরী হয় কী করে? একেকটি ওষুধ তৈরী হতে প্রায় ১০ বছর লেগে যেতে পারে। প্রথমে কোনো একটা অণুকে সম্ভাব্য ওষুধের উপাদান হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এই শনাক্তকরণ শুরু হয় ল্যাবে কালচার করা কোষের উপর প্রভাব দেখে। তারপর সেই অণুকে প্রয়োগ করা হয় কোনো প্রাণীর উপর। সেখানে নিরাপদ এবং কার্যকরী প্রমাণিত হলে পর তিন দফা পরীক্ষা হয় মানুষের উপর (human clinical trials)। এইসব পরীক্ষায় কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার মানুষের উপর ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। দেখা হয়, মানুষের উপর কতটা কাজ করছে বা কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে কিনা।
এই গতানুগতিক পদ্ধতিতে ৯০% ওষুধই এই বিভিন্ন দফার পরীক্ষা পার হতে পারে না। তাই বাতিল হতে হতে প্রতি ১০ টি ওষুধের মধ্যে একটি হয়ত অন্তিম ধাপ পেরিয়ে অবশেষে বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এইরকম হারে ওষুধগুলোর অসফল হবার অন্যতম কারণ হিসাবে বলা যায় – কোনো ওষুধ বা জীবাণু মানুষের শরীরে কী কী প্রভাব ফেলবে তা প্রাণীদের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষায় পুরোপুরি বোঝা যায় না।
এর একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। অ্যামায়োট্রপিক ল্যাটারাল স্কেলোরিস (ALS) হল একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। যে নিউরনগুলি আমাদের শরীরের মোটর ফাংশন (motor function ) বা বিভিন্ন গতিবিধি (activities) নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলি এই রোগের প্রভাবে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মানবদেহে মাংসপেশীর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে পক্ষাঘাত এবং মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ইঁদুরের ক্ষেত্রে এই রোগের প্রভাবে মাংসপেশী নষ্ট হতে দেখা গেলেও মৃত্যুর কারণ দেখা যায় অন্য — আন্ত্রিক গোলযোগ (a blockage in the gut)। এর থেকে বোঝা যায় যে একই রোগ মানুষ এবং অন্য প্রাণীর মধ্যে ভিন্ন পন্থায় কাজ করতে পারে। এইরকমই আরো পরীক্ষা থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে মানুষের কোষের উপর ভিত্তি করে মডেল সিস্টেম (model system) বানানো প্রয়োজন যাতে মানুষের জটিলতাকে পুরোপুরি ধরা যায়।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আজ এমনই কিছু মডেল সিস্টেম তৈরি করা গেছে, যেমন অরগ্যানয়েড (organoid) অথবা অর্গ্যান্স-অন-চিপ (organs-on-chip)। এগুলোতে মানুষের স্টেম কোষ (stem cell) ব্যবহার করা হয়, এবং মানুষের শারীরিক গঠন ও কার্যপ্রক্রিয়াকে অনুকরণ করে একটি বা একাধিক অঙ্গের মডেল ছোট স্কেলে (smaller scale) নির্মাণ করা হয়।
অর্গ্যানয়েড (organoid) হলো মানব অঙ্গের একটা ত্রিমাত্রিক খুদে সংস্করণ। আসল অঙ্গে কী হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা তার হদিশ পেতে পারেন এই ধরণের অর্গ্যানয়েড নিয়ে কাটাছেঁড়া করে। এগুলো তৈরী করা হয় স্টেম কোষ থেকে। স্টেম কোষকে বিশেষ কিছু বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক (growth factor) দিয়ে কালচার করলে সেগুলি কোনো একটি নির্দিষ্ট অঙ্গের কোষে পরিণত হয়। এরকম অনেকগুলি কোষ একসাথে থাকলে তারা নিজেরাই জড়ো হয়ে একটা বিশেষ সংগঠন তৈরী করে। ঠিক যেমনটা থাকে মানুষের দেহের ভিতর। যেহেতু এই গঠনটি ত্রিমাত্রিক এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ধরণের কোষ থাকতে পারে, এই অর্গ্যানয়েড-গুলি সাধারণ কালচার করা কোষের থেকে অনেক বেশী কাজের। কালচার-এ তৈরী কোষগুলো দুই মাত্রায় সীমিত থাকে, কোষের রকমফেরও থাকে না তাতে। বিশ্বজুড়ে বৈজ্ঞানিকরা ইতিমধ্যেই অনেক ধরণের অরগ্যানয়েড তৈরি করে ফেলেছেন, যেমন ফুস্ফুস, মস্তিষ্ক, হৃদয়, বা যকৃত-এর অরগ্যানয়েড।
অর্গ্যান্স-অন-চিপ (organs-on-chip) আরেক ধরণের মানবভিত্তিক মডেল সিস্টেম। ছোট AA ব্যাটারির সাইজের এই যন্ত্রগুলি একধরণের স্বচ্ছ নমনীয় আয়তাকার পলিমারের তৈরী। পলিমারের ভিতরে ফাঁপা নলাকার প্রকোষ্ঠ (channel) কাটা থাকে। তার ভিতরের দেওয়ালগুলোতে লাগানো থাকে দেহের কোনো অঙ্গের কোষ আর রক্তনালী। উদ্দেশ্যটা হলো, দেহের কোনো কলা বা অঙ্গের ভিতর যা দেখতে পাও, এই প্রকোষ্ঠগুলিতেও সেরকম দেখতে পাবে। এই ধরণের যন্ত্র দিয়ে দেহের ভিতর রক্ত চলাচল বা কলাগুলির মধ্যে ক্রিয়াবিক্রিয়া, এগুলি নকল করা সম্ভব। বুঝতেই পারছো কী ভয়ানক ক্ষমতা হাতে এসে গেছে! ধমনীতে কিছু আটকে গেলে বা ফুসফুসে টিউবারকিউলোসিস হলে, এমনকি কোন ওষুধের কিডনিতে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে, এইসবের খুঁটিনাটি এই নকল অঙ্গের সাহায্যে বোঝা যায়।
অর্গ্যানয়েড (organoid) আর অর্গ্যান্স-অন-চিপ (organs-on-chip) মানবদেহের সমস্ত শারীরবৃত্তীয় কার্যপ্রণালীর ক্ষুদ্র স্তরে অনুকরণ করে বানানো হয় বলে এদের “মাইক্রোফিসিয়োলজিক্যাল সিস্টেমস” (microphysiological systems) বলা হয়। এই দুই সিস্টেমের সাহায্যে মানুষের বিভিন্ন অঙ্গের স্বাভাবিক গঠন এবং কার্যপ্রণালী, এমনকি রোগাক্রান্ত হলে সেসব অঙ্গে কী কী পরিবর্তন আসে, সবকিছুই অধ্যয়ন করা যায়। এছাড়াও এদের উপর শরীরে বিষক্রিয়ার, রোগজীবাণুর, বা পরীক্ষারত ওষুধের প্রভাবও অধ্যয়ন করা হয়।
এই সিস্টেমগুলিকে সুদূর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বলে মনে হলেও, গোটা দুনিয়ায় কিন্তু রোগব্যাধি নিয়ে গবেষণা আর ওষুধ (drug) তৈরির জন্য এগুলির ব্যবহার ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। যেমন, একটি গবেষণায় প্যাঙ্ক্রিয়াটিক ডাক্ট অ্যাডিনোকারসিনোমা (pancreatic duct adenocarcinoma) রোগীর শরীরের কোষ থেকে তৈরি করা অরগ্যানয়েডের উপর নানান ওষুধ পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। অর্গ্যানয়েডের উপর পরীক্ষায় যেসব ড্রাগ ভাল ফল দেয়, দেখা গেছে যে সেই ড্রাগগুলো রোগীদের উপর প্রয়োগ করলে তাদের বাঁচার হারও যায় বেড়ে। এরকম আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। জিকা ভাইরাসের (Zika virus) সঙ্ক্রমণের ফলে গর্ভবতী মহিলাদের মাইক্রোসেফালি (microcephaly) নামের এক রোগ হয় যাতে ভূমিষ্ঠ বাচ্চার মাথা স্বাভাবিকের থেকে ছোট হয়। জিকা ভাইরাস আর মাইক্রোসেফালির এই যোগসূত্রের প্রথম প্রমাণও কিন্তু মস্তিষ্কের অরগ্যানয়েডের উপর পরীক্ষার মাধ্যমেই মেলে।
এতকিছু সত্ত্বেও মানুষের কোনো অঙ্গের বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হুবহু অনুরূপ সিস্টেম তৈরি করাটা এখনো একটা চ্যালেঞ্জ। এখনও গবেষণা চলছে যাতে এসব সিস্টেমের মধ্যে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system), ভ্যাস্কুলেচার (vasculature), এবং মাইক্রোবায়োটা (microbiota) ইত্যাদিও সামিল করা যায়। আরও একটি বিষয় হচ্ছে, মানব দেহের মধ্যে অঙ্গ আর কলার তো আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, বরং একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে। গবেষণাকারীরা এখন মানবদেহের মতই অর্গ্যান্স-অন-চিপ-গুলোকে জোড়ার চেষ্টা করছেন। এই সংঘবদ্ধ সিস্টেমকে বলা হয় “হিউম্যান-অন-চিপ” (human-on-chip )। এর উপর পরীক্ষা করেই সম্যক ধারণা করা সম্ভব হবে, বিভিন্ন অঙ্গের সম্মিলিত নেটওয়র্ক কোনো জীবাণু বা ওষুধের প্রবেশে সংঘবদ্ধ ভাবে কীভাবে সাড়া দেবে।
তাই সঙ্গতভাবেই, গোটা পৃথিবীতে এবং সেই সঙ্গে ভারতেও, বিভিন্ন গবেষণাগারে আর বায়োটেক কোম্পানিতে এই রকম মডেল সিস্টেম তৈরি উত্তরোত্তর ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। বিগত দশকে গবেষণা আর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রভুত উন্নতির ফলে এই মডেলগুলির নির্মাণ মানবদেহ নির্ভর বায়োমেডিকাল গবেষণা আর ওষুধ আবিষ্কার পদ্ধতিকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এই মডেলগুলোকে নিখুঁত করাই এখন আমাদের সামনে এক বিরাট লক্ষ্য।
(মূল লেখাটি ইংরাজিতে SciTales-এ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি বাংলায় করেছেন সুচন্দ্রিমা চৌধুরী ও অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।)