মানুষের ভিড়ের পেছনে বয়ে চলেছে শ্লথ গতির লাভা স্রোত। ধোঁয়া উঠছে, চোখ জ্বলছে, তাও চোখ ফেরানো যাচ্ছে না এর থেকে। অদ্ভুত দৃশ্য! ভূবিজ্ঞানীদের কাছে এক আকাঙ্ক্ষিত সময়। গত মার্চ মাসে (২০২১) আইসল্যান্ডের ফাগ্র্যাডলসফিয়াতে (Fagradalsfjall) ৬০০০ বছর ধরে সুপ্ত থাকা আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত হয় [১]। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ছবি, ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়ঙ্কর সুন্দর ছবি [২,৩]। যদিও ফাগ্র্যাডেলসফিয়াত আইসল্যান্ডের রাজধানী শহর রেকিয়াভিকের (Reykjavík) ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত, এই আগ্নেয়গিরির লাভা স্রোত সেরকম বিস্ফোরক না হওয়ায় জনজীবনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ২০১০ সালে, আইসল্যান্ডের এইয়াফিয়াতলাইয়াকাটল (Eyjafjallajökull) পাহাড়ে আরো একটি আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়েছিল, যার ব্যাপক ধোঁয়ার নির্গমনের জন্য পৃথিবী ব্যাপী বিমান চলাচল বিক্ষিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু, তুলনায় ২০২১-এ ফাগ্র্যাডলসফিয়াতের আগ্নেয়গিরি শান্ত। কেন হয় এই অগ্ন্যুৎপাত? কোথায় হয়? আইসল্যান্ড, জাপান বা প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী দেশ গুলোতেই কেন শোনা যায় আগ্নেয়গিরির কথা?
গোড়ার কথা:
প্রথমে বলে রাখা ভালো, আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসা লাভা তরল হলেও পৃথিবীর ভিতরটা তরল এরম ভাবার কোনো দরকার নেই। পৃথিবীর অভ্যন্তরের বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে আরেকটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম “পৃথিবীর গভীর কথা” [৪]। সেখানে একবার চোখ বুলিয়ে নিলে পরিষ্কার হবে যে, গোটা পৃথিবীর মধ্যে একটা মাত্র তরল স্তর আছে, যাকে বলে বহিঃকেন্দ্রমণ্ডল (outer core)। এই স্তর রয়েছে প্রায় ৩০০০-৫১৫০ কিলোমিটার গভীরতায়। বাকি সমস্ত পৃথিবীর অভ্যন্তর কঠিন অবস্থায় রয়েছে। তাহলে লাভা কি এই বহিঃকেন্দ্রমণ্ডল থেকে আসে? একদম না। এই বিষয়ে অনেকেই মনে করে আগ্নেয়গিরির লাভা পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে উঠে আসে। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, আগ্নেয়গিরি থেকে যে লাভা আসে তার সাথে পৃথিবীর কেন্দ্রের কোনো যোগ নেই, বরং এর উৎস গুরুমণ্ডল বা ম্যান্টল (mantle), যা পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ১০০-৩০০০ কিলোমিটার গভীরতায় কঠিন অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু এবার প্রশ্ন হচ্ছে, এই কঠিন ম্যান্টলের থেকে লাভা তৈরী হচ্ছে কী করে?
এই বিষয়ে সহজ উত্তর হলো ম্যান্টলের পাথরের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়ে যদি গলিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তরল হতে পারে। কিন্তু, আদতে ব্যাপারটা এতো সহজ নয়। চট করে পৃথিবীর ভিতরের পাথরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় না। এমন কোনো কিছু ঘটতে পারে কি, যাতে পাথরের গলনাঙ্ক (melting point) কমে যেতে পারে?
আমাদের বাস্তব জীবন থেকে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। যদি কারো পাহাড়ে গিয়ে রান্না করার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে সে বুঝবে, সমতলে (ধরলাম সুন্দরবনে) যত তাড়াতাড়ি কুকারে ভাত বা মাংস রান্না করা যাচ্ছে, পাহাড়ে তত দ্রুত হচ্ছে না। এর কারণ হলো, সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছে জল ১০০ ডিগ্রিতে বাষ্পীভূত হয়, কিন্তু উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে জলের স্ফুটনাঙ্ক (boiling point) ক্রমে কমতে থাকে।মোটামুটি ভাবে প্রতি ৫০০ ফুট উচ্চতা বাড়লে ০.৫ ডিগ্রী স্ফুটনাঙ্ক কমে যায়। এবার দার্জিলিঙের উচ্চতা প্রায় ৬৭০০ ফুট। তাহলে স্ফুটনাঙ্ক কমে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৯৩.২ ডিগ্রীর কাছে। মানে জল অনেক আগেই ফুটে প্রেসার কুকারের সিটি বাজিয়ে দিচ্ছে, এদিকে পর্যাপ্ত তাপ না পাবার জন্য খাবার ঠিক করে সেদ্ধ হচ্ছে না। মোদ্দা কথা, যেকোনো পদার্থের গলনাঙ্ক, স্ফুটনাঙ্ক এই সব বৈশিষ্ট্যগুলো ধ্রুবক নয়, তারা পরিবর্তিত হয় একটি বিশেষ প্রাকৃতিক ধর্মের সাথে — তা হলো চাপ।
সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ যেখানে প্রায় ১০০ কিলোপাস্কালের কাছে, দার্জিলিঙের উচ্চতায় এই চাপ হয় প্রায় ৭৩ কিলোপাস্কালের কাছাকাছি। চাপ হ্রাসের কারণে কোনো পদার্থের তাপগতিবিদ্যা সংক্রান্ত যেকোনো ধর্ম (Thermodynamic properties), যেমন গলনাঙ্ক, স্ফুটনাঙ্ক, হিমাঙ্ক ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়। ঠিক এই কারণেই যদি কোনো ভাবে পাথরের ওপর চাপ কমিয়ে ফেলা যায়, তাহলে তার গলনাঙ্ক কমে যায় এবং উষ্ণতা না বাড়িয়ে তাকে গলিয়ে ফেলা যায়। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ধরলাম একটা পাথরের গলনাঙ্ক ১০০০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড এবং পাথরটি রয়েছে ৯০০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেডে। এই অবস্থায় পাথর গলবে না। কিন্তু যদি পাথরের ওপরের চাপ কমিয়ে তার গলনাঙ্ককে ৮০০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড করে ফেলা যায়, তাহলে ওই ৯০০ ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড উষ্ণতাতেই পাথর গলতে শুরু করবে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে যে কয়েকটি পদ্ধতিতে পাথর গলে লাভা তৈরী হয়, তার মধ্যে অন্যতম এই চাপ হ্রাসের প্রক্রিয়া। ভূবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ডিকম্প্রেশন মেল্টিং (decompression melting)।
আগ্নেয়গিরির জিওলোজি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি
কিন্তু কিভাবে চাপ কমে যায় পৃথিবীর অভ্যন্তরে? এই বিষয়ে জানতে গেলে ফিজিক্স থেকে জিওলজিতে আসতে হবে। আবার ফিরে যেতে হবে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠনের বর্ণনায়। পৃথিবীর উপরের প্রথম ১০০ কিলোমিটার স্তর ভীষণভাবে শক্ত এবং স্থিতিস্থাপক (rigid and elastic)। এই স্তরকে বলা হয় শিলামন্ডল বা লিথোস্ফিয়ার (lithosphere)। লিথোস্ফিয়ার আবার কতগুলো ছোটছোট ভাগে ভাগ হয়ে থাকে। ঠিক যদি একটা ডিমের খোলার ওপর ক্র্যাক তৈরী হয়, সেরকম ভাবে। এই এক একটা অংশকে বলা হয় প্লেট বা পাত (Tectonic plate) (চিত্র ১) [৫]।
প্রতিটা পাত আবার নিজস্ব গতিতে সঞ্চারিত হয়। কখনো তারা একে অন্যের থেকে দূরে সরে যায়, আবার কখনো নিজেদের মধ্যে ধাক্কা দেয়। যখন দুটি পাত পরস্পরের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে, তাকে বলে অপসারী পাত সীমানা (divergent plate boundary)।
চিত্র ২-তে দেখছি কী করে এই অপসারী পাত সীমানা তৈরী হয়। প্রথমে একটি সমান অবিভক্ত পাত (lithosphere) থাকে, ম্যান্টল তার নিচে।
এই পাতের দুই পাশে টান পড়লে এর মাঝখানের অংশ সরু হতে থাকে। ঠিক যদি একটা ময়দার লেচি নিয়ে দু’পাশ থেকে টানা হয়, লেচির ঠিক মাঝের অংশ সরু হতে দেখা যাবে। যখন মাঝের অংশ সরু হয়, নিচে থাকা ম্যান্টল ওপরে উঠে আসতে থাকে এবং চাপ কমতে থাকে। চাপ হ্রাসের ফলে ওই উষ্ণতাতেই ম্যান্টল-এর শক্ত পাথর গলতে থাকে। টান আরো বাড়লে একটা পাত ভাগ হয়ে গিয়ে দু’টি পাত তৈরী হয়, ঠিক যেমন ময়দার লেচি দুই টুকরো হয়ে যাবে। এই দুই পাতের মাঝখান থেকে গলিত লাভা ভূপৃষ্ঠের ওপর উঠে এসে অগ্ন্যুৎপাত হয়। চিত্র ২ থেকে বোঝা যেতে পারে, এই লাভার উৎস মোটেও গভীর না। পাতের নিচে ৫ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে থেকেই এই গলিত পাথর উঠে আসে।
আমরা যদি পৃথিবীর টেক্টোনিক ম্যাপ দেখি, তাহলে দেখতে পাবো, আইসল্যান্ডের অবস্থান ঠিক এই রকম একটা অপসারী পাত সীমানার ওপর (চিত্র ১)। উত্তর আমেরিকা আর ইউরোপ একসময় এক পাতের ওপর ছিল। পরবর্তীকালে এরা বিচ্ছিন্ন হয় এবং মাঝখানে আটলান্টিক মহাসাগর তৈরী হয় এই ডিভারজেন্ট পাত সীমানা বরাবর। গোটা আটলান্টিকের মাঝ বরাবর যে পাত সীমানা আছে, তাকে বলা হয় মিড-আটলান্টিক রিজ (Mid-Atlantic ridge) বা মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরা। এই রিজে সারা বছর অগ্নুৎপাত হতে থাকে এবং সমুদ্রের নিচেই লাভা জমাট বাঁধে।
কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। গোটা আটলান্টিকের রিজ জুড়ে ডিকম্প্রেশন মেল্টিং হলেও, আইসল্যান্ড এর মধ্যে ব্যতিক্রম। আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির উৎস অনেক গভীরে। ভূরসায়ন এবং ভূপদার্থবিদরা বহু গবেষণা করে দেখেছেন আইসল্যান্ডে যে লাভা বা লাভাজনিত পাথর পাওয়া যায় তার রাসায়নিক উৎস গুলো ভূপৃষ্ঠের ৫-৪০ কিলোমিটারের মধ্যে পাওয়া যায় না। হিলিয়ামের আইসোটোপ (3He/4He) থেকে নির্ণয় করা যায়, এই লাভার উৎস অনেক গভীর, প্রায় ২০০০ কিলোমিটারের বেশি, হয়তো কেন্দ্র-ম্যান্টল সীমানার (core-mantle boundary) কাছাকাছি থেকে উঠে এসেছে। কেন্দ্র-ম্যান্টল সীমানার কাছে পৃথিবীর উষ্ণতা পৌঁছায় প্রায় ১৫০০ – ১৯০০ কেলভিন [৬]। এই উষ্ণতায় ম্যান্টলের পাথরের ঘনত্ব কমে যায়, এই ঘটনাকে বলে বৈপরীত্য ঘনত্ব বা ডেনসিটি ইনভার্শন (density inversion) — অর্থাৎ ওপরে বেশি ঘনত্বের পাথর, আর নিচে কম ঘনত্বের (চিত্র ৩)।
যদি একটা কাচের গ্লাসে প্রথমে তেল দিয়ে তারপর ওপর থেকে জল ঢালা হয়, তাহলে দেখা যাবে জল নিচে চলে যাচ্ছে, আর তেল ওপরে চলে আসছে। এটাই ঘনত্বের বৈশিষ্ট্য। বেশি ঘনত্বের জিনিস সবসময় অভিকর্ষের টানে নিচের দিকে যেতে চাইবে এবং পারিপার্শ্বিক কম ঘনত্বের বস্তু উপরে উঠে আসবে। তাই যখন কেন্দ্র-ম্যান্টল সীমানার ডেনসিটি ইনভার্শন হয়েছে, তখন নিচের হালকা (কম ঘনত্বের) পাথর উপরে উঠে আসবে এবং ভারী পাথর নিচে নেবে যাবে। এই ঘটনাকে বলে রেলি-টেলর ইনস্টেবিলিটি (Rayleigh-Taylor Instability) (চিত্র ৩)। যদি ঘনত্বের পরিবর্তন উপযুক্ত হয়, তাহলে কেন্দ্র-ম্যান্টল সীমানা থেকে কম ঘনত্বের পাথর একদম পৃথিবী পৃষ্ঠ পর্যন্ত উঠে আসতে পারে। এদের বলে ম্যান্টল প্লিউম (চিত্র ৩)। বৈজ্ঞানিকদের ধারণা, এই ম্যান্টল প্লিউম থেকেই আইসল্যান্ডের অগ্নুৎপাত হয়। পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র স্থান যেখানে অপসারী পাত সীমানার মধ্যে দিয়ে প্লিউম উঠে আসে — আশ্চর্যচকিত, অভূতপূর্ব ব্যাপার!
আরো আছে, জাপান বা দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল জুড়ে যে অসংখ্য আগ্নেয়গিরি রয়েছে — যাদের বলা হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলা (Pacific ring of fire), তাদের লাভা তৈরী হয় সম্পূর্ণ অন্য ভাবে এবং এই জটিল পদ্ধতি বর্ণনা করা বেশ শক্ত। পাত সঞ্চারণের দিক থেকে এই স্থানগুলি অভিসারী বা কনভার্জেন্ট (Convergent) সীমানা। এখানে প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত সমগ্র জাপান, ওশিয়ানিয়া মহাদেশের দ্বীপপুঞ্জগুলির নিচে অবনমিত হচ্ছে, অন্য দিকে নাজকা পাত দক্ষিণ আমেরিকার নিচে অবনমিত হচ্ছে। এই অঞ্চল গুলিকে বলা হয় নিমজ্জন বলয় (subduction zone) (চিত্র ৪)।
অবনমিত পাতের ওপর চাপ ও তাপের পরিবর্তনের কারণে কিছু বিশেষ মিনারেল তৈরী হয়, যেমন সার্পেন্টিন (serpentine) (চিত্র ৪)। যেহেতু সারাক্ষণ সমুদ্রের জলের সাথে এই পাত সংযুক্ত থাকে, এইখানে রূপান্তরিত মিনারেল গুলো নিজেদের রাসায়নিক গঠনের মধ্যে জল ধরে রাখতে পারে, এদের বলা হয় স্ট্রাকচারাল ওয়াটার (structural water)। পাতের অবনমন ঘটলে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের নিচে নামতে থাকলে চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। অতিরিক্ত চাপের কারণে সার্পেন্টিন জাতীয় মিনারেলের স্ট্রাকচারাল ওয়াটার বেরিয়ে আসতে থাকে এবং পার্শ্ববর্তী ম্যান্টলকে সিক্ত করে। তাপগতিবিদ্যার পরীক্ষায় দেখা গেছে জলের প্রবেশ ঘটলে পদার্থের গলনাঙ্ক কমে যায়। তাই সিক্ত ম্যান্টল সহজেই গলতে শুরু করে এবং লাভা উৎপন্ন হয় যা আগ্নেয়গিরির মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসে (চিত্র ৪)।
উপসংহার
কঠিন ম্যান্টল যে তিন ভাবে গলিত হয়, তার আলোচনা করা হলো উপরে। এবার কিছু টার্মিনোলোজিতে আসা যাক। যখন গলিত পাথর ভূপৃষ্ঠের ওপর বেরিয়ে আসতে পারে, তখন তাকে লাভা বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই গলিত পাথর পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপর আসতে পারে না। পৃথিবীর মধ্যে অবস্থিত এই গলিত পাথরকে ম্যাগমা বলা হয়। যেহেতু লাভা পরিচিত শব্দ, তাই বর্ণনা করার সময় আমি লাভা এবং ম্যাগমার মধ্যে পার্থক্য করে বিভ্রাট তৈরী করিনি। দ্বিতীয় কথা, পাথরের গলনাঙ্ক ব্যাপারটি জটিল। যেমন করে লোহার একটি নির্দিষ্ট গলনাঙ্ক আছে — ১৫৩৮ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড (স্বাভাবিক চাপে, STP), যার ওপর গেলে সমস্ত লোহা তরল হয়ে যাবে। পাথরের এই রকম কোনো নির্দিষ্ট গলনাঙ্ক নেই। যেহেতু অনেক মিনারেল দিয়ে তৈরী হয়, পাথর একটা উষ্ণতার পরিসরের মধ্যে গলতে থাকে। যেমন, ব্যাসল্ট নামের একটি পাথর একটি নির্দিষ্ট চাপে ১০০০ ডিগ্রী থেকে গলতে শুরু করে, এবং ১২০০ ডিগ্রীতে গিয়ে সম্পূর্ণ তরল হয় (চিত্র ৫)। এই ১০০০ ডিগ্রীকে বলা হয় পাথরের সলিডাস (solidus), অর্থাৎ যার নিচের উষ্ণতায় পাথরটি সম্পূর্ণ ভাবে কঠিন অবস্থায় থাকবে এবং ১২০০ ডিগ্রীকে বলা হয় লিকুইডাস (Liquidus) অর্থাৎ, এর অধিক উষ্ণতায় পাথর সম্পূর্ণ ভাবে তরল হয়ে যাবে। ১০০০-১২০০ ডিগ্রীর মাঝামাঝি উষ্ণতায় ব্যাসল্ট কিছু কঠিন এবং কিছু তরল অবস্থায় থাকে। পাথরের এই রকম গলন অবস্থাকে আংশিক গলন বা পার্শিয়াল মেল্টিং (partial melting) বলে। এই প্রবন্ধে যত বার পাথরের গলনাঙ্কের কথা বলা হয়েছে, তা আসলে পাথরের সলিডাস-কে বুঝিয়েছে।
জলের প্রভাবে সলিডাসের (প্রবন্ধে গলনাঙ্ক) পরিবর্তন কিভাবে হয় তা নির্ধারিত হয় ক্ল্যাসিউস-ক্লাইপেরণ সমীকরণের (Clausius-Clapeyron equation) মাধ্যমে। এই সমীকরণ আসে তাপগতিবিদ্যার প্রথম এবং দ্বিতীয় সূত্র থেকে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা দেখতে পারো এই সমীকরণের মানে কী। এমনিতে বোঝা সহজ। সমীকরণটি চাপ এবং তাপের মধ্যে নতি (slope) নির্ধারণ করে। অর্থাৎ চাপ বাড়লে তাপ কিভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে, তার ধারণা পাওয়া যায় এর মাধ্যমে। নিমজ্জন বলয়ে (subduction zone) জল প্রবেশ করলে ক্ল্যাসিউস-ক্লাইপেরণ সমীকরণের নতি ঋণাত্মক হয়ে যায়, যা পার্শ্ববর্তী ম্যান্টলের সলিডাসকে অনেক কম করে দেয় এবং আংশিক গলন শুরু করে।
চিত্রগ্রহণ ব্রায়ান এমফিঙ্গার , টুইটার: @brianemfinger
তথ্যসূত্র:
- https://earthobservatory.nasa.gov/images/148079/volcanic-eruption-lights-up-iceland
- https://www.youtube.com/watch?v=ELxreGeefOg
- https://volcanochaser.com
- https://bigyan.org.in/2020/11/13/inside-the-earth/
- https://www.annualreviews.org/doi/full/10.1146/annurev-earth-040809-152521
- https://www.annualreviews.org/doi/abs/10.1146/annurev.earth.24.1.15