নিচের পোস্ট-টা মলিকুলার জেনেটিক্স গবেষক বেনি শিলো-র লেখা ‘Life’s Blueprint’ বইটার দ্বিতীয় অধ্যায়ের অনুবাদ। বইটা সম্বন্ধে আরো জানতে ভূমিকাটি দেখুন।
আমাদের দেহের বিভিন্ন ধরণের কোষের কথা ভাবলে তাজ্জব না হয়ে পারা যায় না। দেহে যে ধরণের কোষের যেরকম কাজ, সেইমতো সে তৈরী হয়েছে। স্নায়ুকোষ যেমন এক মিটার অব্দি লম্বা হতে পারে এবং মুহূর্তের মধ্যে তড়িৎ সংকেত কোষের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। আবার পেশীর কোষ হয় অন্যরকম। সেখানে একই এককের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। এককগুলো আসলে আণবিক মোটর, নির্দিষ্ট ট্র্যাকে চলাফেরা করলে তবে পেশীর সংকোচন হয়। পেশীতে এরকম হাজার হাজার কোষ জুড়ে তৈরী হয় একেকটা পেল্লায় নিরবচ্ছিন্ন কোষসমষ্টি যেটার দৈর্ঘ্য এক মিটার অব্দি যেতে পারে। লোহিত রক্ত কণিকার ভূমিকা আবার আলাদা। সে হিমোগ্লোবিন প্রোটিন বয়ে বেড়ায়, যে হিমোগ্লোবিন ফুসফুসে অক্সিজেন-এর সাথে যুক্ত হয়ে যায় আর সেই অক্সিজেন-কে দেহের বিভিন্ন কলায় ছেড়ে দিয়ে আসে। কোষের এতো যে বাহার, এটা তৈরী করার নির্দেশ কোথায় জমা থাকে, আর নির্দেশগুলো আসল কোষেই বা পরিণত হয় কিভাবে? উত্তরটা লুকিয়ে আছে আমাদের ডিএনএ-র ভিতর।
ডিএনএ থাকে কোষীয় নিউক্লিয়াস-এ এবং দুটো প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে। একেক ধরণের কোষ নির্মাণ করতে যে বিশেষ উপাদানের প্রয়োজন, সেগুলো বানাতে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। আবার একই সাথে গোটা জীবদেহে যে কোষের বৈচিত্র্য দেখা যায়, সেটা তৈরী করার সমস্ত তথ্যও ডিএনএ-র মধ্যে থাকে। এই তথ্য কোষ বিভাজনের সময় নকল হয় ডিএনএ প্রতিলিকরণের মাধ্যমে এবং সদ্যজাত দুটি কোষে চালান হয়। আবার এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মেও এই তথ্য চালান হয়ে থাকে যখন একটা শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলন হয়।
ডিএনএ-র চার রকমের গঠনমূলক একক বা বেস (base) রয়েছে। এগুলোকে সংক্ষেপে A, C, G আর T বলে। পুরো কথাগুলো অ্যাডেনিন (adenine), সাইটোসিন (cytosine), গুয়ানিন (guanine) আর থায়ামিডিন (thymidine)। এই এককগুলো জুড়ে জুড়ে ইয়ালম্বা ফিতে তৈরী হয়। একটা মানবকোষের ডিএনএ-তে তিনশো কোটি মতো একক রয়েছে, যার পাকানো ফিতেটাকে ছাড়ালে এক মিটার লম্বা দাঁড়াবে। কোষে এই জিনগত উপাদান আলাদা আলাদা করে ক্রোমোসোম (chromosome) নামক বস্তুর মধ্যে ঠাসা আছে এবং একেকটা ক্রোমোসোম-এ এই উপাদানের একেকটা অংশ রয়েছে। মানবকোষে এরকম ছেচল্লিশটা ক্রোমোসোম আছে।
ডিএনএ আকারে সাধারণত ডাবল হেলিক্স হয় (প্রথম অধ্যায়ের-এর ছবিটা দেখো)। হেলিক্স-এর একটা ফিতে অন্য ফিতেটার সাথে জোড় বেঁধে থাকে। প্রথম অধ্যায়ে যেটা বলেছিলাম, এই জোড় বাঁধতে পারার ফলেই কোষ তার মধ্যে থাকা ডিএনএ-র প্রতিলিপি বানিয়ে ফেলতে পারে। ডিএনএ-র কোন একক কার সাথে জোড় বাঁধবে, সেটা বাঁধা আছে: একটা ফিতের T অন্য ফিতের A-এর সাথে জোড় বাঁধে, আর G জোড় বাঁধে C-এর সাথে। তাই যখন প্রতিলিপি বানানোর সময় আসে, তখন একটা ফিতের থেকে অন্য ফিতেটার ছাড়াছাড়ি হয় বটে, কিন্তু একেকটা ফিতের মধ্যেই যথেষ্ট তথ্য থাকে অন্য ফিতেটার মতো আর একটা ফিতে বানিয়ে ফেলতে। এক কথায়, এক একটা ফিতে “ছাঁচ”-এর মতন কাজ করে। এই জটিল ব্যাপারটা এক ঝটকায় হয় না, ধাপে ধাপে এগোয়। অর্থাৎ, ডিএনএ-র দুটো ফিতে ধীরে ধীরে আলাদা হয় এবং তারপরই একেকটার প্রতিলিপি তৈরী হয়। অন্যভাবে বললে, একেকটা ফিতের ছাঁচে মুক্ত ডিএনএ-র একক (free base) গিয়ে জমা হয় এবং এককগুলো একে একে জুড়ে অন্য ফিতেটা তৈরী করে ফেলে।
ডিএনএ-র দুটো ফিতের এই পরস্পর-পরিপূরক চরিত্র আরেকভাবেও কাজে লাগে। ডিএনএ-তে জমা তথ্য থেকেই যে শেষমেশ কোষের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরী হয়, তার পিছনেও রয়েছে ডিএনএ-র এই পরস্পর-পরিপূরক চরিত্র। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলতে আসলে কোষের প্রোটিন-এর কথা বলা হচ্ছে। কোষে প্রত্যেকটা প্রোটিন তার নিজস্ব কাজ করে। ডিএনএ-র মতো প্রোটিন-এও কিছু এককের পুনরাবৃত্তি রয়েছে, কিন্তু সেই এককগুলোর চরিত্র ডিএনএ-র এককগুলোর থেকে একদম আলাদা। তাহলে ডিএনএ-র তথ্য ঠিক কিভাবে প্রোটিন তৈরীর কাজে লাগে? ডিএনএ-র লম্বা ফিতের মধ্যে কোন অংশটা ঠিক একটাই প্রোটিন তৈরীর কাজে নিয়োজিত হয়?
একটা প্রোটিন তৈরী করতে যতটা তথ্য প্রয়োজন, সেটা ডিএনএ-তে থাকা তথ্যভাণ্ডারের তুলনায় অনেক কম। এই তুলনামূলকভাবে স্বল্প তথ্য যার থেকে একটা প্রোটিন তৈরী হয় তাকেই আমরা জিন (gene) বলে থাকি। এখানে বলা রাখা প্রয়োজন যে একেকটা মানবকোষের নিউক্লিয়াস-এ তিনশো কোটি ডিএনএ একক বা বেস (base) থাকলেও তার একটা সামান্য অংশ, ৩ শতাংশ মতো, জিন-এর আওতায় পড়ে। ইঁদুর কিংবা মানুষের মতো জটিল প্রকৃতির জীবের মধ্যেও জিন-সংখ্যা তত বেশি নয়, আনুমানিক পঁচিশ হাজারের কিঞ্চিৎ কম। ভাবতে পারো, ডিএনএ একটা মরুভূমি, তাতে কয়েকটা মরুদ্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই মরুদ্যানগুলোই জিন, যার থেকে প্রোটিন সৃষ্টি হয়।
তাহলে, ডিএনএ-র বাকি “অতিরিক্তি অংশ”-টা কি করতে আছে? কিছুটা অংশ কখন কোথায় প্রোটিন বানাতে হবে, সেই নির্দেশ বহন করে। আবার কিছুটা অংশ এমন যার সাথে কোনো বিশেষ প্রোটিন-এর সম্পর্ক নেই। তারা জিন-কে আলাদা করতে কিংবা শুধুই ক্রোমোসোম-এর স্বাভাবিক কাজকর্ম অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে। আর কিছুটা বিবর্তনের ধারায় চলে আসা অতিরিক্ত বোঝা, কখনো বাইরে থেকে ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকে গেছিলো আর সেই থেকে রয়ে গেছে।
যাই হোক, জিন-এর প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। প্রোটিন তৈরীর দুটো ধাপ, প্রতিলিপিকরণ (transcription) আর অনুবাদ (translation), শুরু হয় একটা জিন থেকে। প্রথমে, ডিএনএ-র যে অংশটা জিন-এর কাজ করে, তার তথ্য আরেকধরণের অণু, আরএনএ-র (RNA) মধ্যে নকল করা হয়। আরএনএ রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (Ribonucleic Acid) কথাটার সংক্ষেপ। আরএনএ এমন এক ধরণের অণু যার এককগুলোর সাথে ডিএনএ-র একক-এর মিল রয়েছে এবং তারা একে অপরের সাথে জোড়ও বাঁধতে পারে। তাই, জিন-এর তথ্য ডিএনএ থেকে আরএনএ-তে নকল করা (প্রতিলিপিকরণ) অনেকটা ডিএনএ-র নিজের প্রতিলিপি বানানোর মতোই। এই প্রতিলিপিকরণ পদ্ধতিতে জিন-এর মধ্যে যে একক বা বেস-এর ক্রমবিন্যাস থাকে, সেটা ছাঁচের কাজ করে। একেকটা জিন-এর ছাঁচ থেকে হাজারে হাজারে আরএনএ তৈরী হতে পারে।
আগেই বলেছি যে কোষের মধ্যে ডিএনএ একটা বিশেষ ঘেরা জায়গার ভিতর রয়েছে, তার নাম নিউক্লিয়াস (nucleus)। কিন্তু প্রোটিন তৈরীর যন্ত্রপাতি রয়েছে এই নিউক্লিয়াস-এর বাইরে। এই বাইরের জায়গাটাকে বলে সাইটোপ্লাজম (cytoplasm)। আরএনএ তৈরী হয় নিউক্লিয়াস-এর ভিতর। সাধারণত কয়েক হাজার একক থাকে একেকটা আরএনএ-তে। এই আরএনএ চালান হয় সাইটোপ্লাজম-এ, যেখানে তার সাক্ষাৎ হয় প্রোটিন-তৈরীর যন্ত্র, রাইবোজোম-এর (ribosome) সাথে। শুরু হয় প্রোটিন তৈরীর দ্বিতীয় ধাপ, অনুবাদ (translation)।
রাইবোজোম আসলে একটা প্রকাণ্ড আণবিক যন্ত্র (molecular machine)। এই যন্ত্র আরএনএ-র তথ্যবিন্যাস প্রোটিন-এর ভাষায় অনুবাদ করার বিক্রিয়াতে অনুঘটকের (catalyst) কাজ করে। প্রোটিন তৈরী হয় অ্যামাইনো অ্যাসিড জুড়ে জুড়ে। অ্যামাইনো অ্যাসিড হতে পারে কুড়ি ধরণের। শুরুতে আরএনএ-তে ছিল সারিবাঁধা এক ধরণের তথ্য, রাইবোজোম সেই তথ্যকে প্রোটিন-এর সারিবাঁধা অ্যামাইনো অ্যাসিড-এর শৃঙ্খলে পরিণত করে। ট্রেনের কামরার মতোই অ্যামাইনো অ্যাসিড অণু সেঁটে যায় একে অপরের পিছনে। শেষে প্রোটিন-এর ভিতর অ্যামাইনো অ্যাসিড-এর যে সজ্জা দাঁড়ায়, সেটা কিন্তু শুরুর ডিএনএ-র তথ্যসজ্জাকেই প্রতিফলিত করে, যে তথ্যসজ্জা মাঝের আরএনএ-র মাধ্যমে চালান হয়েছে। যে প্রোটিনগুলো এইভাবে তৈরী হলো, তারা এক একটা আণবিক “যন্ত্র”, যে যন্ত্র কোষের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে। কিন্তু এরকম অ্যামাইনো অ্যাসিড-এর সরলরৈখিক শৃঙ্খল হিসেবে সেগুলো কাজ করতে পারেনা। তারা গুটিয়ে গিয়ে (fold) একটা ত্রিমাত্রিক কাঠামো তৈরী করে। এই কাঠামোর গঠন কিন্তু নির্ভর করে শুরুর শৃঙ্খলে কিরকম অ্যামাইনো অ্যাসিড-এর সজ্জা ছিল, তার ওপর। ধরো তুমি একটা উল-এর সুতো নিয়ে পাকাতে থাকলে। একেকবার কিন্তু একেক ধরণের জট তৈরী হবে। কিন্তু একটা প্রোটিন-এর মধ্যে অ্যামাইনো অ্যাসিড-এর শৃঙ্খল যখন গুটিয়ে যায়, সেটা কিন্তু প্রত্যেকবারই একই ত্রিমাত্রিক কাঠামো তৈরী করে কারণ সেই কাঠামো তৈরী করার নিয়ম তার শুরুর অ্যামাইনো অ্যাসিড-এর রৈখিক সজ্জাতেই গাঁথা ছিল। সেই নিয়মগুলো আবার অ্যামাইনো অ্যাসিড-এর মধ্যে জটিল সব পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে। তুলনার জন্য ভাবতে পারো, একটা বড়ো ডাইনিং টেবিলের চারিদিকে অতিথিদের বসাবে। কিন্তু সবাই সবাইকে একইরকম পছন্দ করে না আর তুমি চাও এমনভাবে বসাতে যাতে প্রত্যেকজন তার সবথেকে পছন্দের ব্যক্তির পাশে বসে। প্রোটিন-এর ত্রিমাত্রিক গঠন নির্ণয় করার সমস্যাটাও অনেকটা এইরকম। বাস্তবে এই গঠন নির্ণয় করা অতিথিদের বসানোর সমস্যাটার থেকে অনেক কঠিন কারণ অনেকধরণের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া এই গঠনের জন্য দায়ী । তাই আমাদের গণনার যন্ত্রগুলো যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, শুরুর অ্যামাইনো অ্যাসিড-এর সজ্জাটা জানলেও শেষের গঠনটা বলা খুবই দুরূহ কাজ, প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।
এইভাবে ডিএনএ-র মধ্যে জমে থাকা তথ্য মধ্যবর্তী আরএনএ-র মাধ্যমে চালান হয় এবং নির্দিষ্ট একটা ক্রমবিন্যাসে সাজানো প্রোটিন তৈরী করে। কিন্তু এই পদ্ধতির ভিত্তিতে কোষে কোষে তফাতের কারণ বোঝা যায় কি? বোঝা যায় কি, কেন স্নায়ুকোষ আর পেশীর কোষ আলাদা? মানবদেহে সব কোষই আখেরে সেই তথ্যই বয়ে বেড়ায় যেটা নিষেকের পর শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর ডিএনএ মিলিত হয়ে এসেছিলো। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট একটা কোষ সেই তথ্যের গোটাটা ব্যবহার করে না। সেইটুকুই ব্যবহার করে যেটা দেহের ভিতর তার বিশেষ ভূমিকার জন্য প্রয়োজন। তুলনার জন্য একটা বিশ্বকোষের (encyclopedia) কথা ভাবতে পারো। যখন যেরকম বিষয়ে জানতে চাও, শুধু সেই বিষয়ের পাতাগুলোই উল্টে পাল্টে দেখো, তাই না?
কোষ ঠিক কিভাবে ডিএনএ-র তথ্যের একাংশ বেছে নেয়? আসলে, বিশেষ কোনো এক ধরণের কোষের ভিতর কয়েকটা জিন-ই কাজে লাগে আরএনএ এবং অবশেষে প্রোটিন তৈরী করতে। বাকি জিনগুলো নীরব দর্শক হয়ে থাকে এবং সেই ধরণের কোষে ব্যবহৃত হয়না। কেন এক ধরণের কোষ অন্য ধরণের কোষের থেকে আলাদা, তার আড়ালে গূঢ় তত্ত্ব এটাই। আরএনএ তৈরীর জন্য জিন নির্বাচন করার পদ্ধতিটাও বেশ জটিল। শুধু কোন জিনগুলো আরএনএ তৈরী করবে তাই নয়, এটাও নির্ণয় করতে হয় একেকটা জিন আরএনএ-র কতগুলো প্রতিলিপি বানাবে এবং কোন জিন-এর পর কোনটা ব্যবহৃত হবে। ঠিক রান্না করার মতো, কি কি উপাদান লাগবে, তাদের কতটা লাগবে এবং কার পর কোনটা পড়বে, সব ঠিকঠাক হলে তবেই সাফল্য আসে।
আরএনএ তৈরীর এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আয়োজনকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় কিভাবে? ডিএনএ-র ওপর একদল প্রোটিন-এর যৌগ যন্ত্রের মতো চলে যায় এবং ডিএনএ-র তথ্য নকল করে আরএনএ বানাতে থাকে। এই যন্ত্র যে কোনো জিন থেকেই আরএনএ বানাতে সক্ষম। তাহলে সব জিন সবসময় সক্রিয় থাকে না কেন? দেখা যায় যে কোষ চিহ্নিত করে দেয় কোন জিন থেকে আরএনএ তৈরী হবে এবং এইভাবেই এক জায়গায় গিয়ে রাশ টেনে দেয়। প্রতিলিপিকরণ যন্ত্রের সাথে কিছু জিন-এর যোগস্থাপন করে আর বাকিদের আটকে দিয়ে কোষ নির্দিষ্ট করে দেয় নতুন-সৃষ্ট আরএনএ ঠিক কিরকম হবে।
এইবার আমরা আণবিক স্তরে বলতে পারবো স্নায়ুকোষ কেন পেশীর কোষের থেকে আলাদা। যদিও তাদের ডিএনএ-তে একই তথ্য থাকে, প্রত্যেক ধরণের কোষ আলাদা জিন প্রকাশ (express) করে এবং তার ফলে তাদের গঠন এবং ক্রিয়া নির্ণয় করে যে প্রোটিনগুলো, সেগুলোও আলাদা। ডিএনএ-র একটা সীমিত অংশই সক্রিয় জিন-এর আওতায় পড়ে, অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত প্রোটিন তৈরীর তথ্য যোগান দেয়। বাকি যে ডিএনএ পড়ে রয়েছে, তার কিছু অংশ জিন-এর প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করতে কাজে লাগে। জিন-এর প্রকাশ (gene expression) হলো সেই পদ্ধতি যার দ্বারা ডিএনএ-র তথ্য আরএনএ অণুতে চালান হয়। জিন-এর আশেপাশের অংশটা, যেটা আরএনএ-তে চালান হয়না, সেখানে ডিএনএ-র সাথে জুড়তে পারে এমন প্রোটিন গিয়ে নোঙর ফেলে। একদল প্রোটিনকে এইভাবে একটা জিন-এ বেঁধে দিতে পারলে সেই প্রোটিন-এর সাথে সংযুক্ত গোটা আরএনএ সৃষ্টিকারী যন্ত্রটাকেই ওই জিন-এর প্রতি আকৃষ্ট করা যায়। ভাবো, সিনেমা দেখতে লম্বা লাইন, তুমি উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সেই লাইনের দিকে যাচ্ছ। হঠাৎ লাইনে পরিচিত কাউকে দেখতে পেলে। সঙ্গে সঙ্গে তুমি তার দিকে পা বাড়াবে। তাহলে শুরুর প্রশ্নটা আরেকটু স্পষ্ট করা যায় এইভাবে – নিষেকের (fertilization) পর ডিম্বাণু থেকে একগোছা একই রকমের কোষ তৈরী হয়। সেখান থেকে শুরু করে কিভাবে তৈরী হয় ভ্রূণের সূক্ষ্ম কারুকার্য? যেখানে আছে শত শত কোটি কোষ, কয়েক হাজার ধরণের, যারা আলাদা আলাদা জিন প্রকাশ করছে?
ভ্রূণর নকশা তৈরীর পিছনেও যে জিন-এর একটা ভূমিকা রয়েছে , সেটা প্রথম দেখাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়। একই প্রজাতির ভিতর, ওপর ওপর দেখলে, সব ভ্রূণকেই কিন্তু একইরকম লাগে। অভিন্ন যমজদের (identical twin) মধ্যে যে অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখা যায়, তার থেকেও এটাই বলতে হয় যে ভ্রূণর নকশার একটা জিনগত ভিত্তি রয়েছে। সেই নকশা কেমন হবে, তার সিংহভাগটাই জিন এবং তার প্রকাশ নিয়ন্ত্রণকারী ডিএনএ-র অংশ, এদের মধ্যেই বলে দেওয়া থাকে। কিন্তু সেখান থেকে শুরু করে এই নকশাটা দাঁড়ায় কি করে?
আমাদের সমাজের মধ্যে সংগঠনগুলোর কথা যদি ভাবি, মোটের ওপর দুভাবে তারা পরিচালিত হতে পারে। একধরণের সংগঠনে মাথার উপর একজন উর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি থাকেন, তার মাথায় থাকে শেষের প্রোডাক্ট বা পণ্যটা কিরকম দাঁড়াবে। কর্তামশাই কর্মচারীদের সংগঠিত করেন, দলে দলে ভাগ করে দেন এবং একেকটা দলকে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ত্ব বুঝিয়ে দেন। যেমন, একটা এরোপ্লেন বানাতে, একদল পাখাগুলো বানাবে, একদল ইঞ্জিন, ইত্যাদি ইত্যাদি। গোড়া থেকেই কাজ শেষ হলে কি দাঁড়াবে, তার একটা পরিকল্পনা ছকে রাখতে হয়। পরিকল্পনাতে বলা থাকে, কিভাবে কর্মচারীরা প্লেন-এর একেকটা অংশ জড়ো করবে, একেকটা ছোট দলের কাজকর্মের খুঁটিনাটি পরিচালনার দায়িত্ত্ব কাদের হাতে থাকবে, সেইসকল ছোটকর্তাদের কোন বড়কর্তারা সামলাবেন। মানবসমাজের সাথে তুলনাটা চালিয়ে গেলে, আরেক ধরণের সংগঠনও হতে পারে। সেখানে সবাই সবার সমান। তারা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নেয় তাদের উদ্দেশ্যটা কি এবং একে ওপরের সাথে সম্পর্কটা কিরকম হবে, আদানপ্রদানগুলো কেমন হবে। এই পদ্ধতিটা ইম্প্রভ থিয়েটার-এ খুব চলে। সেখানে আগে থেকে সব ছকে দেওয়া থাকেনা। কিন্তু একটা এরোপ্লেন বানাতে গেলে এই পদ্ধতিটা চলবেনা। ভ্রূণ তৈরী হওয়াটা কি অনেকটা এরোপ্লেন তৈরীর মতো নাকি ইম্প্রভ থিয়েটার-এর মতো? ভ্রূণ একটা এরোপ্লেন-এর থেকে অনেক বেশি জটিল। কিন্তু তার পুরো পরিকল্পনাটা আগে থেকে ছকে দেওয়া থাকে না। এরকম হয়না যে একেকটা অংশ আলাদা করে তৈরী করা হলো, তারপর সেগুলো জুড়ে দেওয়া হলো। এরকম কোনো কর্তা-কোষ নেই যে প্রত্যেকটা কোষকে তার দায়িত্ত্ব পাখিপড়া করে দেবে। একটা অর্কেস্ট্রা-র (orchestra) কথা যদি ভাবো, সেখানে সামনে একজন কন্ডাকটর থাকেন যিনি ইশারায় বলে দেন কিসের পর কোন পর্ব আসবে। ভ্রূণ সৃষ্টি যতই জটিল হোক, সেখানে কোনো কন্ডাকটর নেই। সব কোষের ডিএনএ-র ভিতর একই তথ্য থাকে। কিন্তু এই তথ্যটা সরাসরি বলে দেয়না শেষের ভ্রূণটা কিরকম হবে। শুধু কোষেদের কোন নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে গন্তব্যে পৌঁছতে, সেটা বলে দেয়। নিয়মগুলো এতটাই স্পষ্ট এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলা থাকে যে সেগুলো মেনে চললে বারেবারে একই নকশা তৈরী হওয়া সুনিশ্চিত। অতএব আমাদের কাজ হলো এই নিয়মগুলোকে পাঠোদ্ধার করা। কিভাবে একইরকমের কিছু কোষ শুধু নিয়ম মেনে ভ্রূণের জটিল গঠনের তৈরী করার মতো একটা কাণ্ড করে বসতে পারে?
(‘Life’s blueprint’ বইটা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে ‘বিজ্ঞান’ টীম-এর অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং কুণাল চক্রবর্তী।)