অন্যান্য রবিবারের মত সেদিনও আমি আর মা গল্প করছিলাম। পারিবারিক এটাসেটা, অফিসের পিএনপিসি, পরের সপ্তাহের পরিকল্পনা, এই নিয়ে গল্প চলছিল। মা সম্প্রতি শুনেছিল যে জেনেটিক টেস্টিং করে নাকি আগে থেকে রোগ বলে দেওয়া যায়। সেই নিয়ে বলতে শুরু করলো। কথার পিঠে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে আমরা অনেক গভীরে ঢুকে গেলাম।
রাঁধুনি, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, এই নিয়ে আমাদের পরিবার। সেই পরিবারে আমি প্রথম জীববিজ্ঞানী। পিএইচডি করছি হিউম্যান জেনেটিক্স নিয়ে। তাই জীববিজ্ঞান কিংবা ওষুধ নিয়ে কথা উঠলেই প্রশ্ন আসে আমার দিকে। মা পেশায় শিক্ষিকা, সব কিছু নিয়েই প্রশ্ন তার। মায়ের একটা অসুখ আছে, তার নাম অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস (ankylosing spondylitis)। এটা যাকে বলে স্বতঃঅনাক্রম্য রোগ (autoimmune disease)। এই রোগটা হলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শিরদাঁড়ার মধ্যে নিজের কোষগুলোকেই আক্রমণ করে বসে। অনেকক্ষণ ধরে বীভৎস ব্যথার মধ্যে থাকলেও মা বীরদর্পে যুদ্ধ চালিয়ে যায়, হাল ছেড়ে দেয় না। কাজ, যোগব্যাম, ডিস্কো, সবই চালু রেখেছে। কিন্তু এটাও মনেপ্রাণে প্রার্থনা করে যে সন্তানদের যেন এই রোগ না হয়।
অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস রোগটার HLA-B27 জিনের একটা পরিবর্তনের সাথে যোগসাজশ আছে বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ, রোগটার একটা জিনগত উৎস রয়েছে। মা জানে যে জিন-টা আমাদের মধ্যে যদি চালান করে দিয়ে থাকে, তাহলে শত প্রার্থনা করেও কোনো লাভ হবে না। কিন্তু জেনেটিক টেস্ট আমাদের কাজে লাগতে পারে কিনা সেইটা মা জানতে চায়।
ডাইরেক্ট-টু-কনসিউমার জেনেটিক টেস্টিং (direct-to-consumer genetic testing বা DTC GT) গত কয়েক বছরে খুব চালু হয়েছে। এই যে আমরা অনলাইন নিজেদের জন্য জেনেটিক টেস্ট অর্ডার করতে পারি, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন নেই, এটাই বেশ রোমহর্ষক ব্যাপার। আমরা আলোচনা করতে বসলাম এই ধরণের জেনেটিক টেস্ট কী প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে, আর আসলে কী জানা যায় তার থেকে। মায়ের প্রশ্ন ছিল, এই ধরণের জেনেটিক টেস্ট করে রোগ ঠেকিয়ে রাখা যাবে কিনা। প্রশ্নটা শুনতে সোজা; কিন্তু, আমি যেটা বুঝলাম, উত্তরটা বেশ প্যাঁচালো।
আমাদের জেনেটিক তথ্য আসলে আমাদের দেহ গঠনের একটা নির্দেশিকা। IKEA কোম্পানির ফার্নিচার তৈরির নির্দেশিকাগুলোর মতো আমাদের দেহ গঠনের এই নির্দেশিকা পড়ে তার মর্মোদ্ধার করতে অনেকটা বেগ পেতে হতে পারে। তবে কয়েকটা ক্ষেত্রে হ্যাঁ-না উত্তর দেওয়া সোজা। কিছু জিনগত পরিবর্তনের ফলে প্রোটিন-এর গঠন পাল্টে যায়, এগুলোকে ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। যেমন, সিকেল সেল রোগ (Sickle Cell disease) একটা জিনগত রোগ যেটা হিমোগ্লোবিন জিন-এর একটা বিশেষ পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকে। এই পরিবর্তনের কারণে পরিবর্তিত হিমোগ্লোবিন সমৃদ্ধ লোহিত রক্তকণিকাগুলো (red blood cell) গোলাকার হওয়ার বদলে কাস্তের মত হয়ে যায়। আকার পরিবর্তনের ফলে এরা একসাথে জমাট বেঁধে রক্ত চলাচল ব্যাহত করে। এখন কেউ যদি বাবা মা দুজনের থেকেই এই রোগের জিন পেয়ে থাকে, তাহলে তার রোগ হওয়া অবধারিত। তার কাছে এই রোগটা আটকানোর আর কোনো উপায় নেই, অন্তত এখনো অব্দি নেই।
কিছু জিনগত সমস্যার কারণে প্রোটিন তার কাজে অক্ষম হয়ে যেতে পারে, প্রোটিন উৎপাদন কমে যেতে পারে বা দেহের কোনো একটা বস্তুর সাথে প্রোটিন বিক্রিয়ায় অক্ষম হয়ে যেতে পারে। আগে থেকে জানা থাকলে সঠিক চিকিৎসা করা সম্ভব বা রোগের কবলে পড়া থেকে এড়ানোও সম্ভব। যেমন, জেনেটিক টেস্টিং থেকে বলা যায় একজন ব্যক্তির ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স (lactose intolerance) জন্মানোর আশঙ্কা আছে কিনা। ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকলে দুধ জাতীয় জিনিসে ল্যাকটোজ নামক যে শর্করা পাওয়া যায়, দেহ সেটাকে নিতে পারে না। এর কারণ হলো, বিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচক ল্যাকটেজ পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন হয়না। আমরা সবাই শরীরে ল্যাকটেজ উৎপাদনের ক্ষমতা নিয়ে জন্মাই, কিন্তু বয়সের সাথে সাথে এই ক্ষমতা কমতে থাকে। যদি উৎপাদন একেবারেই কমে যায়, তখন দুধ জাতীয় জিনিস সেবনের ফলে বিপাকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আগে থেকে যদি এই সম্ভাবনার কথা জানা থাকে, তাহলে সমাধান-টা খুব সোজা: দুধ জাতীয় জিনিস থেকে দূরে থাকো।
কিন্তু অপরদিকে, অনেক অসুখ, যেমন অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস, টাইপ ২ ডায়াবেটিস এবং কয়েক প্রকারের ক্যান্সার, এগুলো “জটিল রোগ”-এর (complex disease) আওতায় পড়ে। এগুলো একাধিক জিন এবং পরিবেশজনিত কারণের প্রভাবে বিশেষ পথে সৃষ্টি হয়। এর মানে, জিনগত কারণে যদি কারো এরকম রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েও থাকে, হয়তো সে কখনোই সেই রোগে পড়বে না যদি ঠিকঠাক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়। সেক্ষেত্রে, আগে থাকতে জিনগত আশঙ্কাটা জানা থাকলে একটা লাভ আছে।
তবে এসব “জটিল রোগ”-এর ক্ষেত্রে জিনগত কারণে রোগের আশঙ্কা কতটা, সেটা নির্ণয় করা মোটেও সোজা নয়। ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাওয়ার সাথে কয়েকশো জিন-এর যোগসাজশ পাওয়া গেছে। একজন ব্যক্তিবিশেষের ডায়াবেটিস-এর আশঙ্কা কতটা, সেটা বুঝতে জিন-এ ক্ষতিকারক এবং সুরক্ষামূলক পরিবর্তন যেগুলো আছে, দুটোকে মিলিয়ে একটা স্কোর দেওয়া হয়। এটাকে বলে পলিজেনিক রিস্ক স্কোর (polygenic risk score)। কোন জিনগুলোতে পরিবর্তন হলে আশঙ্কা আছে আর কোন জিনে সুরক্ষা দেয়, সেসব খুঁজতে বিপুল হারে গবেষণা করতে হয়। তাতে কয়েক লাখ লোক অংশগ্রহণ করে। তবে এই গবেষণার বেশিরভাগটাই হয়েছে ইউরোপীয় জনসংখ্যার উপর। এর থেকে যে রিস্ক স্কোর পাওয়া যায়, সেটা অন্যান্য জায়গার জনসংখ্যার মধ্যে রোগের ভবিষ্যদ্বাণী করতে কিছুদূর অব্দিই সার্থক হতে পারে। কতটা সার্থক হবে, সেটা নির্ভর করে সেই জনসংখ্যার সাথে ইউরোপীয়দের কতটা মিল রয়েছে তার উপর।
একটা গবেষণায়, ১০০০-এর বেশি এশীয় জিনোম-এর উপর কাজ করে প্রোটিন তৈরিতে অংশগ্রহণকারী যেসব রূপান্তরিত জিন দেখা গেছে, তার ২৩ শতাংশ এর আগের কোনো জিনোম ডাটাবেস-এ ছিল না। বলাই বাহুল্য, সেসব ডাটাবেস-এ ইউরোপ এবং এশিয়া-র বাইরের প্রতিনিধিত্বই বেশি ছিল। অতএব, একটা জেনেটিক স্কোর ইউরোপীয়দের মধ্যে রোগের আশঙ্কা বলে দিতে পারলেও ভারতীয়দের ক্ষেত্রে কার্যকরী হবে এমনটা আশা করা উচিত না। এশিয়া এবং আফ্রিকার জনসংখ্যার তথ্যগুলো এখনো সেভাবে সংগ্রহ করা হয়নি। তাই ভারতীয় হলে জেনেটিক টেস্টিং-এর (DTC GT) রিপোর্টগুলোকে সাবধানে গ্রহণ করা উচিত। যে কোম্পানি থেকে টেস্টিং করাচ্ছেন, তাদের তথ্যের সূত্র নিয়ে জিজ্ঞেস করবেন। তারা যে সিদ্ধান্তে আসছে, সেটা আপনি যে জনসংখ্যার অংশ, তার ভিত্তিতে নেওয়া কিনা, সেটাও জানতে চাইবেন। তাহলে বুঝতে পারবেন রিপোর্ট-এর কথাগুলোকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
বাপরে! মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে থামিয়ে দিল। মোটামুটি বোঝা গেছে, এমন ভাব করে পরের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আমার দিকে, “আচ্ছা, এটা নাহয় বুঝলাম যে আমার মধ্যে জিনগত রোগ দেখা দেবে কিনা, তার উপর আমার হাত নেই। রোগ হওয়া আটকাতেও পারবো না হয়তো। কিন্তু রোগটা যাতে আমার সন্তানের মধ্যে না যায়, সেইটা কি আটকাতে পারবো? বা, আমাদের ক্ষেত্রে যা হওয়ার সেটা তো হয়েই গেছে, অন্তত এটা কি জানতে পারি কোন জিনগত সমস্যাগুলো চালান করলাম?”
আমি বোঝাতে লাগলাম, যদি নিজের জেনেটিক টেস্ট করে দেখা যায় কোনো একটা রোগের আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে সন্তানের টেস্ট করেও দেখা যায় সেই আশঙ্কাটা তার মধ্যে গেছে কিনা। কিছু রোগ, যেমন সিকেল সেল রোগ বা থ্যালাসিমিয়া, এগুলো হয় যখন একজন ব্যক্তি তার বাবা মা দুজনের থেকেই অনভিপ্রেত জিন-টা পেয়ে থাকে। যদি একজনের থেকে সেই জিন-টা আসে, তাহলে রোগ হবে না। এরকম একটা জিন যে সন্তান বয়ে বেড়াচ্ছে, সেটাও হয়তো সে টের পাবে না। কিন্তু সেই সন্তান আর তার সঙ্গী দুজনেরই যদি অনভিপ্রেত জিন-টা থাকে, ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে যে তাদের সন্তান দুজনের থেকেই জিন-টা পাবে, সেটা হলে রোগ অবধারিত। তাই সন্তানধারণের আগে হয়তো জেনে নেওয়া উচিত বাবা মা দুজনেই ক্ষতিকারক জিন পরিবর্তনের বাহক কিনা। তাহলে সন্তানের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারণ রোগ চালান করা থেকে আটকানো যায়। কিন্তু, যেসব জটিল রোগ একাধিক জিনগত পরিবর্তন এবং পরিবেশজনিত কারণের মিলিত প্রভাবে হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই ধরণের প্রতিরোধমূলক টেস্টিং এখনো সম্ভব নয়।
মা তখন ভাবতে বসলো, যারা এখনো অব্দি জেনেটিক টেস্টিং করিয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা কী রকম, তারা এই টেস্টিং করে লাভবান হয়েছে কিনা। আমি ইন্টারনেট ঘাঁটতে বসলাম, পেলাম বিভিন্ন জাতের উত্তর। দেখলাম, অনেকেই জিনগত আশঙ্কার কথা শুনে রোগ ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, যেমন পরিবর্তন এনেছে নিজেদের জীবনযাত্রায়। বাকিরা তুমুল উদ্বিগ্ন হয়েছে এই শুনে যে ব্রেস্ট ক্যান্সার-এর মত রোগ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। অনেকে আবার টেস্ট রিপোর্ট-এর অস্পষ্ট ভাষায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রিপোর্টে যেহেতু সম্ভাবনা (probability) এবং তুলনামূলক আশঙ্কার (relative risk) কথা লেখা থেকে, সেটাকে কীভাবে নেওয়া উচিত, সেইটা তারা ঠাওর করতে পারছেন না। বোঝাই যাচ্ছে যে এই রিপোর্ট-গুলোকে কার্যকরী এবং ব্যবহারযোগ্য হতে গেলে এখনো অনেকদূর যেতে হবে।
তথাপি আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-এর ওয়েবসাইটে একটা লেখা থেকে জানা যায়, ২০২১-এই প্রায় দশ কোটি লোক এরকম DTC জেনেটিক টেস্টিং করিয়েছে [২]। অতএব, এই ধরণের টেস্টিং-এর জনপ্রিয়তা যে বাড়ছে, তাতে সন্দেহ নেই।
“আচ্ছা, এই যে আমার সব জিনগত তথ্য এই কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দিচ্ছি, এরা কি সেটার দুর্ব্যবহার করতে পারে?”, মায়ের মনে নতুন আশঙ্কা। এর উত্তর খুঁজতে কয়েকটা DTC জেনেটিক টেস্টিং কোম্পানির পলিসি ঘেঁটে দেখলাম। সবার নিজস্ব পলিসি আছে যেখানে স্পষ্ট লেখা থাকে কোন তথ্য অন্যত্র শেয়ার করা হতে পারে এবং সেজন্য অনুমতিও চাওয়া হয়। অতএব, জেনেটিক টেস্টিং করার আগে এই পলিসিগুলো দেখে নেওয়া আবশ্যক। এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে এই ধরণের টেস্টিং ভারতে সদ্য সদ্য চালু হয়েছে, তাই এগুলো এখনো ভারতের মেডিকেল এজেন্সীগুলোর নিয়ন্ত্রণে আসেনি [৩]। একটু ভয়ে ভয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এতসব বোঝার পর তুমি কী ভাবছো, জেনেটিক টেস্টিং করাবে?” উত্তরে মা নিজের অতিপ্রিয় গানটা গেয়ে শোনালো:
“Qué será, será
Whatever will be, will be
The future’s not ours to see
Qué será, será
What will be, will be”
(মূল লেখাটি SciTales এ প্রকাশিত হয়েছিল। লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করেছে “বিজ্ঞান” টীম-এর অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়।)
তথ্যসূত্র ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১] The GenomeAsia 100K Project enables genetic discoveries across Asia, Nature, 576, 106-111 (2019), https://www.nature.com/articles/s41586-019-1793-z
[২] Protect sensitive individual data at risk from DTC genetic tests, American Medical Association blog, https://www.ama-assn.org/delivering-care/patient-support-advocacy/protect-sensitive-individual-data-risk-dtc-genetic-tests
[৩] Direct-to-consumer Genetic Testing: Position Statement of the Society for Indian Academy of Medical Genetics (SIAMG), http://www.iamg.in/PS2.html