পার্থের আগুন ঝরানো সবুজ পিচ।
প্রথম টেস্টে জয়ের পর ইন্ডিয়া টিমের দ্বিতীয় টেস্ট অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে! প্রথম ইনিংস-এ দেড়শো-র আগে অস্ট্রেলিয়ার তিনটে উইকেট পড়ে গেছে।
ইশান্ত শর্মা দৌড় শুরু করলেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান পিটার হ্যান্ডসকম্ব।
মাঠে পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যায়, এই রকম টান টান উত্তেজনা!
একই রকম উত্তেজনা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরেও।
টুকটুকির বাড়ির বৈঠকখানায় টিভির সামনে সবাই প্রায় হামলে পড়েছে। পাশের স্কুলের ফিজিক্সের রাকিবুল স্যারও আছেন। টুকটুকি ছোট থেকে রাকিবুল স্যারকে জেঠু বলে ডাকে ও নিজের জেঠুর মতনই ভালোবাসে।
ইশান্ত দৌড় শুরু করলেন। শর্ট-পিচ বল, অফ-এ যাচ্ছে। হ্যান্ডসকম্ব একটা কাট করলো। ব্যাটের কানায় লেগে বল স্লিপের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বল যদি স্লিপের বাধা অতিক্রম করতে পারে, তাহলেই অবধারিত বাউন্ডারী!
তখনই সেই অতিমানবিক ঘটনা ঘটল!
অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় বিরাট কোহলি মাটি থেকে প্রায় তিন হাত লাফিয়ে উঠে চকিতে বল তালুবন্দি করলেন, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যেন গোটা ভারতবর্ষ থেকে একশ তিরিশ কোটি লোকের তৈরী এক বিরাট শব্দব্রহ্ম পাক খেতে খেতে আকাশে উপরের দিকে উঠে গেল ।
টুকটুকি তো লাফাতে শুরু করেছে, সঙ্গে রাকিবুল স্যার, থুড়ি জেঠুও। আনন্দে জেঠু স্থান, কাল, নিজের বয়সও ভুলে গিয়েছেন। শুধু দুহাত তুলে বলে চলেছেন “নর্ম্যাল ফোর্স কা কামাল! নর্ম্যাল ফোর্স কা কামাল!”
টুকটুকি একটু ধাতস্থ হয়ে ভাবলো, আনন্দের চোটে জেঠুর মাথাটা গেল নাকি? সে কাছে গিয়ে জেঠুকে একটু ঝাঁকিয়ে বললো, – জেঠু, ও জেঠু, এসব কি বলছ? এর মধ্যে আবার নর্ম্যাল ফোর্স এল কোথা থেকে?
নরমাল ফোর্স কি ওজনের সমান
রাকিবুল স্যার এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন। টুকটুকির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “তোরা তো দেখলি বিরাট কোহলি কতটা লাফিয়ে উঠে ক্যাচটা তালুবন্দি করল! লাফানোর ঠিক আগের মুহূর্তে কোহলির উপর নরমাল ফোর্স বা লম্ব প্রতিক্রিয়া বল যদি ওর ওজনের থেকে বেশি না হত, তাহলে কি ও লাফাতে পারত ? আর তা যদি না পারত, তাহলে ক্যাচটাই বা ধরত কি করে?”
টুকটুকি একটু খাবি খেয়ে আমতা আমতা করে বলল, “নরমাল ফোর্স ওজনের থেকে বেশি! তা কি করে হবে? তুমি যে আমাকে সেদিন পড়ালে ওজন আর নরমাল ফোর্স নিয়ে। যদি বিরাট কোহলি খাড়াভাবে মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকে, তার উপর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ অর্থাৎ ওজন সোজা নিচের দিকে কাজ করবে। মাটি উল্টোদিকে একই বল প্রয়োগ করবে কোহলির উপর। নিউটনের তৃতীয় সূত্র তো তাই বলে। তাহলে? আর লাফালাফির সঙ্গে নরমাল ফোর্সের কি সম্পর্ক?”
“আচ্ছা, আগে বল, নরমাল ফোর্সের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়েছে কিনা তোর কাছে? www.Bigyan.org.in এর লেখাটা ভালো করে পড়তে বলেছিলাম, মনে আছে? নরমাল ফোর্স যে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের ওজনের প্রতিক্রিয়া নয়, সে কথা ওখানে ভালো করে বোঝানো আছে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দুটো আলাদা জিনিসের উপর কাজ করে। এখানে দুটো বলই কাজ করছে কোহলি-র উপর।” বললেন টুকটুকির জেঠু।
ওহ হ্যাঁ, তাও বটে! তাহলে নরমাল ফোর্স-এর ওজনের সমান হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আজ মাঠে লাফাতে লাফাতে মনে হচ্ছিলো বটে – মাটির প্রতিক্রিয়া স্থির থাকছে না, লাফানোর সময় বদল হচ্ছে। এরকমই কিছু বলছো কি?
আলবাত। ভালোই লক্ষ্য করেছিস। তুই অন্তত ঠারেঠোরে বুঝতে পেরেছিস। চল একেবারে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলি।
আচ্ছা জেঠু, লাফানোর সময় বিভিন্ন অবস্থায় মেঝেতে কত বল পড়ছে এটা যদি মাপা যেত, তাহলে আর ঝামেলাই ছিল না, তাই না?
না! মানতে হবে। তোর বুদ্ধি বেশ ধারালো হয়েছে দেখছি। সত্যিই লাফানোর ক্ষেত্রে কিছু বিজ্ঞানী ঠিক এই কাজটাই করেছেন, বল-প্লেট (force plate) কাজে লাগিয়ে [1]। তাঁরা যা কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, তা কিন্তু বল মেপেই।
বলের মাপজোখ
এই বল-প্লেট (force plate) টা আবার কি?
টুকটুকি, নাম থেকে অন্তত অনুমান করতে পারছিস যে, বল প্লেট (চিত্র ১) দিয়ে বল মাপা যায়। বল প্লেট সাধারণ ভাবে একটা ধাতব প্লেট যাতে কয়েকটা সেন্সর লাগানো থাকে। প্লেটের ওপর কোনো ওজন চাপালেই ওই সেন্সরগুলো কাজ শুরু করে আর আউটপুট হিসেবে একটা বৈদ্যুতিক সিগন্যাল তৈরী করে। ওজন যত বেশি হয়, সিগন্যাল এর বিস্তারও তত বাড়ে।
এরকম প্লেট কিসে কাজে লাগে?
বল প্লেট একটা বায়োমেকানিক্স ল্যাব-এ খুবই প্রয়োজনীয় জিনিস। এইসব ল্যাবে হাঁটার বা দৌড়ানোর সময় মাটি যে প্রতিক্রিয়া বল দেয়, সেটা হামেশাই মাপতে হয়।
হাঁটার সময় কিভাবে পা চলে সেটা ভাব। একটু পিছনের দিকে ঠ্যালে, তারপর মাটি ছেড়ে ওঠে। গোটা সময়টা ধরে জমির থেকে উপরদিকে যে বল আসছে সেইটা মাপা যায় এই বল প্লেটে। অর্থাৎ, প্রতি মুহূর্তে জমির বলের তারতম্য সব এতে ধরা পড়ে। একটা ব্যাপার হলো, জমির বলটা কিন্তু একটু তেরছা, তাই ওর একটা উল্লম্ব উপাংশ (vertical component) আর একটা অনুভূমিক উপাংশ (horizontal component) আছে। বলটা তেরছা কেন? আসলে হাঁটার সময় মাটি যে বল দেয়, তার ক্রিয়ারেখা (line of action) প্রায় সময় ভারকেন্দ্রের (center of gravity) কাছাকাছি থাকে, যাতে টর্ক কম হয় ও ব্যালান্স থাকে। তাই বলটা একেবারে উল্লম্ব না হয়ে একটু তেরছা হয়।
বল প্লেট থেকে দেখা যায় [1], বলের উল্লম্ব উপাংশের () মান শূন্য থেকে বেড়ে প্রথমে মানুষের ওজনের () প্রায় সমান সমান হয় (চিত্র ২)। পেছনের পা আস্তে আস্তে মাটি থেকে উঠে গেলে ও সাথে সাথে সামনের পা বেশি করে মাটি ছুঁতে থাকলে প্রতিক্রিয়া বাড়তে থাকে। তারপর মাঝে কিছুটা সময় ওজনের থেকে কমে যায় ও পরের পদক্ষেপ পড়লে আবার ওজনের সমান হয় । এরপর প্লেট থেকে মানুষটা নেমে এলে ঐ উপাংশ আবার শূন্য হয়। অর্থাৎ, জমির নরমাল ফোর্স যে ওজনের সমান, এটা হাঁটার ক্ষেত্রে গোটা সময়টা ধরে সত্যি নয়।
ওরে বাবা, এতো কান্ড ঘটে? কিন্তু কি করে? আচ্ছা, তুমি বরঞ্চ বিরাট কোহলির লাফের ঘটনায় এসো। ওটা আগে শুনি। আমার আর তর সইছে না।
তুইই বল দেখি, বিরাট কোহলির লাফানোর সময় বল-প্লেটের প্রতিক্রিয়া গ্রাফ কেমন হতে পারে? তারই সূত্র ধরে তাহলে আমি আলোচনা শুরু করবো।
আচ্ছা ! (ভেবে কিছুক্ষণ পরে) ব্যাপারটা তো কঠিন নয় বলেই মনে হচ্ছে। বিরাট কোহলি যতক্ষণ মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবে ততক্ষণ প্রতিক্রিয়া ওজন –র সমান হবে। শূন্যে ভেসে থাকার সময় প্রতিক্রিয়ার মানও শূন্য হয়ে যাবে। আবার শরীর মাটি ছুঁলে প্রতিক্রিয়া সেই হবে (চিত্র ৩)।
বাহ্, ভালোই ভেবেছিস। স্বাভাবিক ভাবে এমনই মনে হওয়ার কথা! কিন্তু পুরোটা ঠিক হলো না। সেইজন্যই তো বলছি, নরমাল ফোর্সে অনেক চমক লুকিয়ে আছে। একটা বল-প্লেটের উপর বিরাট কোহলি বা যে কেউ লাফালে সময়ের সাথে প্রতিক্রিয়া বলের যে ধরণের গ্রাফ বা লেখচিত্র (চিত্র ৪) পাওয়া যাবে, তা অনেকটা নিচের ছবিটার মতো [2,3]। বাস্তবে যেটা হয়, সেটা লাল রঙে দিয়েছি, আর ভালো করে বোঝার জন্য তোর বলা গ্রাফটাও ড্যাশ দিয়ে একসাথে রেখেছি।
এবারে লাল রঙের গ্রাফ-টা বোঝাই। ছবিতে (১) থেকে (৭) এই সংখ্যাগুলো এক একটা বিশেষ সময়ে নরমাল ফোর্সের মান নির্দেশ করছে। সেই সময়ে কোহলির সম্ভাব্য দৈহিক ভঙ্গিমা কেমন হবে, পরের ছবিতে তাও দেখানো হয়েছে [2]। পরপর এক এক করে ধাপগুলোতে আসছি।
লাফ দেওয়ার আগে
তাই হোক। শুরু করো প্রথম ধাপ থেকে। ওই ধাপটা তো পরিষ্কার। কোহলি দাঁড়িয়ে আছে বল-প্লেটের উপর। তাই এক্ষেত্রে বল-প্লেট যে নরমাল ফোর্স (Ground Reaction Force = ) দেবে তা হবে ওজনের সমান, অর্থাৎ হবে।
ঠিক বলেছিস! কোহলির সেই মুহূর্তে উপরদিকে কোন ত্বরণ (acceleration) নেই। কোহলির উপর উল্লম্ব দিকে শুধুমাত্র দুটো বল কাজ করছে: এক, মাধ্যাকর্ষণের ফলে নিচের দিকে ওজন, আর দুই, উপরের দিকে মাটির নরমাল ফোর্স। যেহেতু কোহলির কোন ত্বরণ নেই, তাই নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী এই দুই বলের মাপ সমান হতেই হবে, তাই না!
আচ্ছা ছোট একটা হিসেব কষা যাক। ধরা যাক, কোহলির ভর () ৭০ কিলোগ্রাম ও অভিকর্ষজ ত্বরণ () ১০ মি/সে২। তাহলে নরমাল ফোর্স হলো ৭০০ নিউটন। সেটাই চিত্র ৬ এর ১ নম্বর বিন্দুতে দেখাচ্ছে।
এবার ২ নং ধাপে কি হবে বলতো?
মনে হচ্ছে, কোহলি লাফানোর সুবিধার জন্য হাঁটু ভাঁজ করে হাতদুটোকে কোমরের দিকে টেনে নিচ্ছে।
একেবারে ঠিক। কোহলি লাফানোর সুবিধের জন্য শরীরের ভারকেন্দ্র নিচের দিকে নামিয়ে আনছে। ওই সময়টা কোহলির ভারকেন্দ্রের নিচের দিকে একটা ত্বরণ (acceleration) থাকছে। নিচের দিকে ত্বরণ মানে কোহলির উপর নিট বল নিচের দিকে। অর্থাৎ, নরমাল ফোর্সকে ওজনের থেকে কম হতেই হবে। সেটাই আমরা দেখছি চিত্র ৭ এর ২ নম্বর বিন্দুতে।
ধরা যাক, বল-প্লেটে এরকম সময়ে নরমাল ফোর্স -এর মান দেখাচ্ছে ৬৮০ নিউটন। নরমাল ফোর্স আর ওজনের তফাৎ কিংবা লব্ধিবল হলো:
এর কারণে ঠিক সেই সময়ে যে ত্বরণ তৈরী হবে, সেটার মান হলো:
বল / ভর = ২০/৭০ = ০.৩ মি/সে২
উপরের অঙ্কটা যেকোনো একটা মুহূর্তের অবস্থাটা বোঝাচ্ছে। বলটা কিন্তু মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টাচ্ছে, অর্থাৎ, । যেকোনো একটা মুহূর্ত -তে কোহলির গতিবেগ বার করতে হলে ওই মুহূর্ত অব্দি ভরবেগের পরিবর্তনটাকে ধরতে হবে:
যেখানে শুরুতে () ও সময়ে বেগ যথাক্রমে ও । এই সমীকরণের ডানদিকের অংশটা অর্থাৎ সময়ের সাথে বলের পরিবর্তন, সেটাই বল প্লেট থেকে পাওয়া যায়। ওটাকে সমীকরণে বসালে সেখান থেকে এর মান আমরা সহজেই পেতে পারি।
দারুণ ব্যাপার তো। এভাবে তো ভাবিনি। আমরা তো ভাবতেই বেশি অভ্যস্থ। আচ্ছা, একসময় তো কোহলির নিচের দিকে নামার গতি কমে আসবে, তাই না? তার মানে তখন নিচের দিকে মন্দন (retardation) বা অন্যভাবে বললে উপরেরদিকে ত্বরণ (acceleration) হচ্ছে। একসময় নিচের দিকে গতি থামবে, দিয়ে আবার উপরে ওঠা শুরু হবে। এইসময়েও ভারকেন্দ্রের ত্বরণ উপরের দিকে।
এই তো ঠিক ধরেছিস টুকটুকি! তাহলে তৃতীয় ধাপে, মানে ঠিক লাফিয়ে ওঠার আগের মুহূর্তে শরীরের ভারকেন্দ্রের ত্বরণ উপরের দিকে। আর ত্বরণ উপরের দিকে মানেই নিট বল উপরের দিকে। সুতরাং নরমাল ফোর্সকে ওজনের থেকে বেশি হতেই হবে। সেটাই চিত্র ৮-এর গ্রাফে ৩ নম্বর বিন্দুটা দেখাচ্ছে।
আচ্ছা জেঠু, একসময় ত্বরণ ছিল নিচের দিকে, হঠাৎ হয়ে গেল উপরের দিকে। মাঝখানে কখনো একটা শূন্য হবে তো, তাই না?
একেবারে ঠিক। তাই দ্যাখ, চিত্র ৮ এ ২ নম্বর বিন্দু থেকে ৩ নম্বরে যাওয়ার পথে এক মুহূর্তে ওজন আর নরমাল ফোর্সের মান এক হয়ে গিয়েছে। তার মানে ঠিক সেই মুহূর্তের পর থেকে শরীরের নিচের দিকে যাত্রায় এবার বাধা পড়তে শুরু করবে।
পুরো জলবৎ তরলং ! দারুন বুঝলাম। ৪ নম্বর বিন্দুর ব্যাপারটা কিন্তু আমি নিজেই ভালোমতো বুঝতে পারছি জেঠু। ঐ সময় তো কোহলির শরীরের কোনো অংশই বল-প্লেট ছুঁয়ে নেই। অর্থাৎ ঐ সময় বল-প্লেটে কোনো নরমাল ফোর্স কাজ করবে না। চিত্র ৯ এর গ্রাফেও দেখ – ৪ নম্বর বিন্দুতে নরমাল ফোর্স শূন্য দেখাচ্ছে। কি গো ঠিক বলছি তো জেঠু?
একবারে ঠিক বুঝেছিস মা! কোনো সন্দেহ নাই।
ক্যাচ ধরে মাটিতে পদার্পণ
তাহলে ৫ নম্বর বিন্দুতে কি ঘটছে, সেটাও তোর বুঝে যাওয়ার কথা। বল শুনি।
চেষ্টা করছি।
কোহলি শূন্যে লাফিয়ে উঠে ক্যাচ তো ধরলো। কিন্তু সে তো আর আবহমান কাল ধরে শূন্যে ভেসে থাকতে পারে না, তাই না? তাকে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে আবার মাটিতে নেমে আসতে হবে।
অতখানি উপর থেকে নামার মুহূর্তে যখন তার পা মাটি ছুঁলো, তখন তার ভারকেন্দ্রের বেশ ভালো একটা গতিবেগ আছে। কিন্তু মাটি ছোঁয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেই গতিবেগ শূন্য হয়ে গেল। তাহলে ঐ সময়ের জন্য ভারকেন্দ্রের নিচের দিকে বেশ বড় মাপের একটা মন্দন হচ্ছে। নিচের দিকে মন্দন মানে উপরের দিকে ত্বরণ। আর উপরের দিকে ত্বরণ মানেই নরমাল ফোর্সের মান ওজনের থেকে বেশি হতেই হবে। ঠিক সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি ৫ নম্বর বিন্দুর ঠিক আগে চূড়া থেকে।
একদম ঠিক। একটু অংক কষে দেখলে বোধ হয় আর একটু সহজে বোঝা যাবে। যতক্ষণ উপরের দিকে ত্বরণ আছে, ততক্ষণ নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী:
সময়ের সাথে সাথে যখন কোহলির পায়ের পুরো অংশ ক্রমে বল-প্লেট স্পর্শ করবে, উর্ধমুখী a এর মান আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। এক সময় এর মান সবচেয়ে বেশি হবে, ধরি তখন । নরমাল ফোর্সও হবে সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ । ১০ নম্বর চিত্রে ৫ নম্বর বিন্দুর ঠিক আগে লেখচিত্রের যে সর্বোচ্চ বিন্দু তা এখানে নির্দেশ করছে।
এরপরে কি হবে, তুই কি কিছু আন্দাজ করতে পারছিস?
এই তো জেঠু, তুমি নিজে আমাকে বোঝানোর বদলে আমাকে দিয়েই উত্তর দেওয়ানো করাচ্ছো! যখন শরীর খুব তাড়াতড়ি নামতে নামতে একটা জায়গায় মুহূর্তের জন্য থামে, তখন হঠাৎ করে এক বড়সড় মানের মন্দন সৃষ্টি হয়। ফলে নরমাল ফোর্স চূড়া স্পর্শ করে। এটা বুঝলাম। কিন্তু তারপর তা আবার চূড়া থেকে নেমে এলো কেন – এটা ভাবতে হবে। আচ্ছা কেউ তো লাফিয়ে মাটিতে নেমেই একবারে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে না। আচ্ছা কেউ তো লাফিয়ে মাটিতে নেমেই একবারে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে না। মাটি স্পর্শ করার পরে নিজের শরীরের ব্যালান্স রাখতে পা ভাঁজ করে কিছুটা নিচু হয়ে যায়। বোধহয় ওই লাফানোর আগের পাঁ ভাঁজ করার মতোই কিছু হচ্ছে।
বাঃ!! আমি টোটালি ইম্প্রেসড। পা ভাঁজ করে কোহলি আবার আগের মতো একটা নিম্নমুখী ত্বরণ পেতে শুরু করেছে, এই ত্বরণ আবার আবার সময়ের সাথে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকছে। ত্বরণ নিচের দিকে মানে নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র মেনে আমরা বলতে পারি নিট বল নিচের দিকে। কিন্তু নিম্নমুখী ত্বরণ ক্রমশ বাড়তে থাকছে বলে নরমাল ফোর্সও সময়ের সাথে ধীরে ধীরে কমছে (৫ নম্বর বিন্দু)। আর গ্রাফে দেখা যাচ্ছে একটা সময় তা ওজনের থেকে কমে যাচ্ছে।
নরমাল ফোর্স কমতে কমতে ১১ নম্বর চিত্রের ৬ নম্বর ধাপের একটু আগে যে খাদটা দেখতে পাচ্ছিস, সেখান অব্দি নামবে।
বেশ বুঝলাম কিন্তু! তারপর ১২ আর ১৩ নম্বর চিত্রের ৭ নম্বর ও ৮ নম্বর বিন্দু (গ্রাফে নেই) দেখলে বোঝা যাচ্ছে, সময়ের সাথে সাথে শরীর আস্তে আস্তে স্থির হচ্ছে। বল-প্লেট যে প্রতিক্রিয়া বল দিচ্ছে, সময়ের সাথে তার মান কোহলির ওজনের () একেবারে কাছাকাছি হবে।
আর শুধু লাফানোর ক্ষেত্রেই নয়, দৌড়োনোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
দৌড়ানোর সময় (চিত্র ১৪) দেখ, যখন দৌড়বিদের সামনের পা মাটিতে নামছে, তার ঠিক আগের মুহূর্তে তার গোটা শরীরটা শূন্যে ছিল। তার গোড়ালি মাটি স্পর্শ করার পর থেকে প্লেটের ফোর্স সেন্সরের প্রতিক্রিয়া বাড়তে থাকে। তার পর সেটা সর্বোচ্চ মানে পৌঁছয়, এবং আস্তে আস্তে নামতে থাকে। পেছনের পা যে মুহূর্তে যখন মাটি ছাড়ে তখন প্রতিক্রিয়া শূন্য হয়ে যায়।
ওরে বাবা, হাঁটা, দৌড়োনো, লাফানো সবেতেই নরমাল ফোর্স! শেষ একটা প্রশ্ন ! তুমি এই যে বিরাট কোহলির ক্যাচ ধরার জন্য লাফানোর বা দৌড়োনোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যে এতো কথা বললে, মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও কি সেটা সত্যি?
আলবৎ! ১৫ নম্বর ছবিটা দেখ। ব্যাঙ, হরিণ, কিংবা ঘোড়া যে প্রাণী বলিস, তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যাখ্যা সমান ভাবে প্রযোজ্য।
“আলোচনা বেশ জমে গেছিল আজ। চল, উঠি রে মা আজকে, দেরি হয়ে গেলো। বেরোতে হবে।”
এই বলে রাকিবুল স্যার গাত্রোত্থান করলেন, আর টুকটুকিও এক্কা-দোক্কা খেলতে খেলতে ছড়া কাটলো:
এপাং ওপাং ঝপাং
হরিণ কিংবা ব্যাঙ,
লাফায় যখন ড্যাং-ড্যাং,
চেক্ নরমাল ফোর্স অন দেয়ার ঠ্যাং!
তথ্যসূত্র:
[1] R.Cross, Am. J. Phys. 67 (1999) 304-309
[2] https://www.thehoopsgeek.com/the-physics-of-the-vertical-jump/ (ভিডিওটি দেখা যেতে পারে)
[3] http://people.brunel.ac.uk/~spstnpl/LearningResources/VerticalJumpLab.pdf (Flight Time Method ও Impulse-Momentum Method দেখে এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপযোগী ভৌতরাশিগুলি মাপা শেখা যেতে পারে)