বসন্তকাল সমাগত। পুরুষ মৌমাছিরা উড়ে বেড়াচ্ছে এদিকে-ওদিকে। মহিলাদের এখনো পাত্তা নেই – হয়তো সাজগোজ সারা হয়নি তাদের মিলনঋতুর জন্য। এমন সময় কোনো পুরুষ মৌমাছির শুঁড়ে একটা গন্ধ এসে লাগে – এই গন্ধ তার চেনা নয়, কিন্তু তার জন্মগত কোনো এক আদিম প্রবৃত্তি তাকে বলে দেয় যে এই গন্ধের উৎস কোনো স্ত্রী মৌমাছি। গন্ধের দিকে উড়তে থাকে পুরুষ মৌমাছি, দেখতে পায় তার লক্ষ্যকে। প্রবৃত্তি-তাড়িত পুরুষটি সোজা গিয়ে বসে তার সম্ভাব্য সঙ্গিনীর ওপরে, উদ্দেশ্য – তাকে নিজের শুক্রাণু (sperm) দিয়ে বোঝাই করা। কিন্তু, এখানে বাধ সাধে প্রকৃতি। পুরুষ মৌমাছির অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাকে ঠকিয়েছে আরেকটি প্রাণী – হয়তো শুনে সবার অবাক লাগবে, এই প্রাণীটি আসলে উদ্ভিদ।
নানা প্রজাতির অর্কিড ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। এদের মধ্যে একটি প্রজাতির নাম ওফ্রিস (Ophrys)। এদের দেখা যায় প্রধানত ইউরোপে। এই প্রজাতির বিশেষত্ব এদের ফুলের আকারে আর গন্ধে। যেমন ধরা যাক মিরর অর্কিডের কথা। মাটি থেকে এক ফুট মত ওপরে একটা ডাঁটির মাথায় কয়েকটা ফুল, যাদের দেখে ফুল বলে ভাবতে একটু কষ্ট হয়। একটা বেশ বড়সড় ডিম্বাকৃতি চকচকে নীলচে-বেগুনি পাপড়ি, তার ধার দিয়ে রয়েছে লাল রোঁয়াওয়ালা একটা হলুদ দাগ। দুপাশে দুটো ছোট পাপড়ি, অনেকটাই ডানার মত। ফুলগুলোকে দেখতে অবিকল ওই অঞ্চলের কিছু মৌমাছি আর বোলতার মত। কিন্তু কেন এই বিচিত্র সাজ? এর পেছনে রয়েছে প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম – পৃথিবীর যে কোনো প্রাণীর সাফল্যের মাপকাঠি তার প্রজনন ক্ষমতায়। যে যত উত্তরসূরি রেখে যেতে পারবে, তার জন্ম তত বেশি সার্থক।
গাছেদের যৌন অঙ্গের আধার ফুলেরা। নানা রং আর গন্ধের সাহায্যে ফুলেরা ছোট-বড় কীট-পতঙ্গ, এমনকি পাখিদেরও আকর্ষণ করে। এরা আসে ফুলের মধুর লোভে, আর ফুলেরা তাদের ব্যবহার করে অন্য ফুলেদের কাছে নিজের রেণু পৌছে দিতে। এই ‘রেণুবাহক’ (pollinator)-দের ছাড়া অনেক ফুলেরই প্রজনন অসম্ভব। কিন্তু, এদের সবার প্রয়োজন এক নয়, তাই তাদের পছন্দও আলাদা, আর সেই সব পছন্দের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে কাজ হাসিল করতে হয় ফুলেদের, তাই চারিদিকে এত রকমারি ফুলের বাহার। বেশিরভাগ ফুলই তাদের রেণুবাহকদের মধু দিয়ে, বা কখনো ডিম পাড়ার অনুকূল জায়গা দিয়ে, এমনকি রেণু দিয়েও পুরষ্কৃত করে। কিন্তু, বিবর্তনের খেলায় এমন কিছু ফুল তৈরী হয়েছে যারা তাদের রেণুবাহকদের বিনা পারিশ্রমিকে ব্যবহার করে। ওফ্রিস অর্কিডরা এই সুবিধেবাদী দলের এক বড়সড় অংশ।
যে মিরর অর্কিডের কথা বলেছিলাম, তারা শুধু যে তাদের রেণুবাহকদের মত দেখতে তাই নয়, এই অর্কিডরা নকল করে তাদের গন্ধও। পুরুষ মৌমাছি (বা বোলতা) দূর থেকে দেখে এই অর্কিডকে নিজের প্রজাতির স্ত্রী-মৌমাছি ভাবে, কারণ এদের গন্ধ প্রায় অবিকল তাদের সেক্স ফেরোমোন (sex pheromone)১ বা যৌন আকর্ষকের মত। এই বর্ণ-গন্ধের আকর্ষণে পুরুষ মৌমাছি গিয়ে বসে অর্কিডের ওপরে, আপ্রাণ চেষ্টা করে তার সাথে মিলিত হতে, কিছুটা চেষ্টার পর হতাশ হয়ে উড়ে যায় সঙ্গিনীর খোঁজে। কিন্তু এই ফাঁকে অর্কিড তার কাজ সেরে নিয়েছে – একগাদা রেণু মাখিয়ে দিয়েছে মৌমাছির মাথায়। কী করে? মিরর অর্কিডের রোঁয়া নিচের দিকে ঝুলে থাকে, তাতে মৌমাছির মনে হয় যে তার এই ভুয়ো সঙ্গিনী ফুলের উপর ঝুলে রয়েছে ওপরের দিকে মুখ করে। সে এসে ফুলের বড় পাপড়ির ওপরে বসে নিচের রোঁয়াগুলোর ভেতরে নিজের যৌনাঙ্গ গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই চাপে ফুলের ওপরের দিক থেকে শুঁড়ের মত যৌনাঙ্গ নেমে এসে মৌমাছির মাথায় একজোড়া পলিনিয়া (pollinia) বা রেণুর থলি সেঁটে দেয়। এই মৌমাছি যখন পরের মিরর অর্কিডে গিয়ে বসে, তখন এই পলিনিয়া চলে যায় সেই ফুলের স্ত্রী-অঙ্গে, আর নতুন একজোড়া পলিনিয়া আবার এসে জুটে যায় বেচারা মৌমাছির মাথায়। বেশ কয়েকবার এইভাবে ঠকতে হয় পুরুষ-মৌমাছিদের, আর সেই সুযোগে নিজেদের কাজ হাসিল করে নেয় অর্কিডরা।
কিন্তু মৌমাছি যদি এক অর্কিড থেকে উড়ে তার স্বজাতি অর্কিডে গিয়ে না বসে, তাহলে? তার ব্যবস্থাও করেছে প্রকৃতি। কিছু অর্কিড হলো বিশেষজ্ঞ বা স্পেশালিস্ট। কখনো দেখা যায় যে একটি প্রজাতির অর্কিড বিশেষ একটি প্রজাতির স্ত্রী-মৌমাছিকে নকল করে, তাই শুধু সেই প্রজাতির মৌমাছিরাই আকৃষ্ট হয় এই অর্কিডদের দেখে। আবার কখনো একই অঞ্চলে যেসব অর্কিড পাওয়া যায়, তাদের গর্ভকেশর (stigma) আর পুঙ্গকেশর (anther) এমনভাবে সাজানো যে মৌমাছির গায়ের আলাদা আলাদা অংশকে তারা ব্যবহার করতে পারে নিজেদের কাজে। যেমন মিরর অর্কিড কাজে লাগায় মৌমাছির মাথাকে, আর সেই একই মৌমাছির শরীরের পেছনের অংশকে কাজে লাগাতে পারে অন্য কোনো অর্কিড – একজন রেণুবাহককে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে দুই প্রজাতি। তাহলেই আর কোনো সমস্যা রইলো না। আবার কোনো ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিডদের ফুল ফোটার সময় হয় আলাদা, যাতে মৌমাছিরা ভুল করেও এক প্রজাতির রেণু অন্য প্রজাতির গায়ে না চাপাতে পারে। সুন্দর ব্যবস্থা নয় কি?
ফিরে আসি আমাদের প্রথম দেখা সেই মৌমাছির কাছে। সে বেচারার ভাগ্য কি এতই খারাপ যে তার কপালে জুটবে শুধুই অর্কিডের প্রতারণা? না, সে অত বোকা নয়। প্রথম প্রথম একটু আনাড়ি ছিল বলে তাকে সহজেই বোকা বানাতে পেরেছিল অর্কিডরা। কিন্তু নেড়া বেলতলায় যেমন একবারই যায়, তেমন মৌমাছিরাও বারবার ভুল করে না। আর স্ত্রী মৌমাছিরাও এবারে দেখা দিতে শুরু করে। তাদের সাথে টেক্কা দিতে পারেনা অর্কিডরা। অল্প একটু সময়ের ফাঁকে প্রকৃতি মৌমাছি আর অর্কিডদের নিয়ে একটা সুন্দর লুকোচুরির খেলা খেলে নেয়, আর সেই খেলার ঘুঁটি অর্কিডদের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হই আমরা।
লেখার উৎস ও অন্যান্য টুকিটাকি:
[১]: ফেরোমোন হলো কোনো প্রাণীর শরীরে তৈরী হওয়া রাসায়নিক ‘গন্ধ’, যা হাওয়ায় ছড়িয়ে দিয়ে সেই প্রাণী তার স্বগোত্রীয়দের সাথে ‘কথা বলতে’ পারে সাংকেতিক ভাষায়।
[২]: Schiestl FP (2005) On the success of a swindle: Pollination by deception in orchids. Naturwissenschaften 92:255–264
[৩]: Kullenberg B (1961) Studies in Ophrys Pollination (Almquist & Wiksells Boktryckeri, Uppsala, Sweden)
[৪]: Schiestl FP, et al. (1999) Orchid pollination by sexual swindle. Nature 399:421–422
[৫]: Mant JG, et al. (2005) Cuticular hydrocarbons as sex pheromone of the bee Colletes cunicularius and the key to its mimicry by the sexually deceptive orchid Ophrys exaltata. J Chem Ecol 31:1765–1787
[৬]: Schiestl FP, Peakall R, Mant J, Ibarra F, Schulz C, Francke S, Francke W: The chemistry of sexual deception in an orchid wasp pollination system. Science 2003, 302:437-438