সম্পাদকমণ্ডলী, ‘বিজ্ঞান’
প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে ‘বিজ্ঞান’-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষায় উন্নতমানের সহজবোধ্য বিজ্ঞানের প্রবন্ধের অভাব কিছুটা দূর করার আশা নিয়ে। কয়েকজনের প্রচেষ্টায় এই উদ্যোগের শুরু, তারপর চলার পথের সাথী হয়েছে বিশ্বের নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বহু বাঙালী বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানপ্রেমী। আমরা পেয়েছি অসাধারণ কিছু লেখা, উৎসাহিত হয়েছি বহু পাঠকের শুভেচ্ছায়, আর ‘বিজ্ঞান’ এগিয়ে চলেছে বাংলা ভাষায় এক অভূতপূর্ব উদ্যোগের নিদর্শন হয়ে।
বিজ্ঞানের ধর্ম প্রশ্ন করা। আত্মসমালোচনার মাধ্যমেই বিজ্ঞানের উন্নতি সম্ভব। ‘বিজ্ঞান’-এর প্রতিষ্ঠার মূলে যে প্রশ্নগুলো ছিল সেগুলো আমাদের নিরন্তর ভাবায়। ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র অষ্টম সংখ্যা প্রকাশের মুহূর্তে সেই ভাবনাগুলো নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।
‘বিজ্ঞান’ একটি পপুলার সায়েন্সের পত্রিকা। কিন্তু প্রশ্ন হল বিজ্ঞানের আদর্শ পাঠক কে? অর্থাৎ, আমরা কাদের জন্য লিখছি? ‘বিজ্ঞান’-এর লেখাগুলো সম্পাদনা করতে গিয়ে আমরা যেটুকু নিজেদের বুঝেছি তা তুলে ধরছি এখানে। পাঠক সহমত কিনা জানাবেন।
বিজ্ঞানের জগতের নতুন আবিষ্কারের কথা বাংলা খবরের কাগজে ছাপা হয়। যেমন, কিছুদিন আগে বিজ্ঞানীরা প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ধরতে পারল তাদের যন্ত্রে। একশো তিরিশ কোটি বছর আগে দুটি বিশালাকার ব্ল্যাক-হোলের মিলনের ফলে ‘স্থান-কালের চাদরে’ যে কম্পন তৈরি হয়েছিল তা এতদিন বাদে এসে আছড়ে পড়ল মানুষের বানানো কলে। বিশ্বের বহু খবর কাগজের মত বাংলা কাগজেও সে নিয়ে বহু লেখা দেখলাম। একই ভাবে যখন ক্যান্সার গবেষণা বা জীন প্রযুক্তির যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কার হয় সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে এসে যায় বহুল প্রচলিত খবরের কাগজে। যারা গবেষণার সাথে যুক্ত নন এই নতুন আবিষ্কারের খবর পড়ে উদ্দীপিত হন। এই খবর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় বহু লেখায় ব্যবহৃত হয় সহজ উপমা ও অলঙ্কার। অনেক সময়ই এতে লেখাটি সত্যভ্রষ্ট হয়। কিন্তু, তাও সমাজে বিজ্ঞান সম্বন্ধে আগ্রহ ছড়িয়ে দেয় বলে খবরের কাগজের বিজ্ঞান বিভাগের লেখাগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের আলোচনার মাঝে কখনো জায়গা করে নেয় বিজ্ঞান জগতের খবর, এটা আনন্দের কথা। ‘বিজ্ঞান’-এও আমরা নতুন আবিষ্কারের কথা লিখি, তবে প্রচলিত খবরের কাগজের সাথে ‘কে আগে খবর পরিবেশন করবে’ এই প্রতিযোগিতায় আমাদের আগ্রহ নেই। আমাদের উদ্দেশ্য সেই আবিষ্কারের গভীরে যাওয়া। আমাদের ধারণা, খবরের কাগজের চটজলদি লেখা আর গবেষণা পত্রের টেকনিক্যাল লেখার মাঝামাঝি প্রবন্ধের বিশেষ অভাব রয়েছে আমাদের মাতৃভাষায়।
এক উৎসাহী পাঠকের কথা ভাবা যাক। সে হয়ত হাই স্কুল শেষের পথে। মনের মধ্যে নানা বিষয় সম্বন্ধে আগ্রহ। রাতের তারাভরা আকাশ তার কৌতূহল জাগিয়ে দেয়। খবরের কাগজে পড়ে সে জানল, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কৃত হয়েছে। সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে হৈ চৈ। কিন্তু, আইনস্টাইন, ব্ল্যাক-হোল, মহাবিশ্বের আদি শব্দ – ইত্যাদি কিছু শব্দবন্ধ পড়ে তার আগ্রহ মিটছে না। সে আরও জানতে চাইছে। এই আবিষ্কারের পিছনে মূল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিটা ধরতে চাইছে। ঠিক যেমন চাইছে ক্যান্সার ঠিক কী জিনিস সেটা জানতে। কেন ক্যান্সার প্রতিরোধ করা শক্ত সেই জায়গাটা বুঝতে চাইছে। এইরকম এক পাঠকের জন্য বাংলা ভাষায় লেখা প্রবন্ধ কোথায়? আমাদের ধারণা বাংলা পপুলার বিজ্ঞানের জগতে ‘বিজ্ঞান’ এই অভাবটা খানিক পূর্ণ করছে। ‘বিজ্ঞান’-এর বেশিরভাগ লেখার লেখক সেই বিষয়ে গবেষণা করেন, বা অনেক ভাবনা চিন্তা করেছেন। তাই তাদের লেখা পাঠককে বিষয়ের গভীরে নিয়ে যায়, অথচ সহজ করে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত উপমা লেখার সত্যতাও নষ্ট করে না। সহজকরে সঠিক জিনিস বলার কাজটা কঠিন। তার জন্যেই আমাদের পরিশ্রম।
তার মানে এই নয় যে, ‘বিজ্ঞান’-এর লেখা পড়তে হলে আগে থেকে সেই বিষয়ে উৎসাহী হতেই হবে। লেখাগুলোর সম্পাদনার সময় একজন সম্পাদকের কাজ হল দেখা যে লেখাটি পড়ে অন্তত তার মূল বিষয়টা বেশিরভাগ পাঠক ধরতে পারেন। ‘বিজ্ঞান’-এর মধ্যে বহু ধরণের লেখা আছে। কিছু লেখা তুলনামূলকভাবে সহজ – বেশিরভাগ পাঠক একটানে পড়তে পারবেন, আবার কিছু লেখা সেই বিষয়ের বেশ গভীরে গিয়ে আলোচনা করেছে – উৎসাহিত পাঠকের কাছে এমন প্রবন্ধ বাংলা কেন যে কোন ভাষাতেই দুর্লভ।
‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত লেখার সংকলন ‘বিজ্ঞান পত্রিকা’-র এইবারের সংখ্যাটির জন্য আমরা তিনটি লেখা বাছাই করেছি। ‘বিজ্ঞান’-এ আমরা যে বিভিন্ন ধরণের লেখা প্রকাশ করি বিভিন্ন পাঠককে মাথায় রেখে, এই তিনটি লেখা তার নিদর্শন।
বিজ্ঞানী লিসা মাইটনারের উপর লেখাটি সহজপাঠ্য। ইউরোপে বিশ্বযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মহিলা ও ইহুদী এই বিজ্ঞানীর সংগ্রাম পাঠককে অনুপ্রাণিত করবে। লিসা মাইটনারের গবেষণার প্রসঙ্গ এখানে এসেছে অবশ্যই, কিন্তু এই লেখাটির মধ্যে যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে তা হল – “লিসা মাইটনার: এক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি কখনো তাঁর মনুষ্যত্ব হারান নি।”
‘সাবান’ এর উপর লেখাটি সহজবোধ্য রসায়নের লেখা। প্রশ্ন হল, সাবান কীভাবে ময়লা পরিষ্কার করে? লেখক, যে নিজে রসায়নের গবেষক, সহজ ভাষায় সাবানের বিজ্ঞানের জায়গাটা তুলে ধরেছে। আশা করি পাঠকের, বিশেষত স্কুলে পড়া ছাত্রছাত্রীদের লেখাটি ভাল লাগবে।
এই সংখ্যার সবথেকে বড় লেখা হল সুপারনোভার উপর একটি সাক্ষাতকার। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষকের কাছ থেকে আমরা জানতে চেয়েছিলাম সুপারনোভা সম্বন্ধে। এই লেখাটি প্রকাশ করে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, আর তার কারণ হল এই লেখাটিতে সহজ আলোচনার মাধ্যমে যে গভীরতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে তা ‘বিজ্ঞান’-এর অন্যতম লক্ষ্য। অনেক তারার জ্বালানী ফুরিয়ে এলে মৃত্যু হয় এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে – সুপারনোভা সম্বন্ধে এই প্রচলিত খবর আমরা অনেকেই হয়ত জানি। কিন্তু, এই আলোচনাটিতে আমরা এক মুগ্ধ ছাত্রের মত জেনেছি তারারা কীভাবে বেঁচে থাকে, কীভাবে এত তাপমাত্রায় তাদের মধ্যে আলোও চলাচল করতে বাধা পায়, কীভাবে তাদের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। আর কীভাবেই বা এতদূরে পৃথিবীতে বসে আমরা সেই মৃত্যুর খবর পাই। আরও উৎসাহিত হয়ে আমরা জানতে চেয়েছি কীভাবে একজন অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষক হওয়া যায়! এই লেখাটির মধ্যে আমরা ছুঁতে চেয়েছি অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের বেশ কিছু জটিল প্রশ্ন, কিন্তু পুরোটাই আড্ডার ছলে। আশা রাখি, অনুসন্ধিৎসু পাঠক লেখাটি পড়ে এই বিষয়ে গবেষণার আনন্দের জায়গাটা ধরতে পারবে।