পিঁপড়ের বুদ্ধি
নিম্নশ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে পিঁপড়েদের বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কিছু শুনে থাকবেন। কিন্তু অনেকের ধারণা – যতই কৌতূহলোদ্দীপক হোক না কেন, এরা প্রত্যেকটি কাজই স্বাভাবিক প্রেরণা বা সংস্কারবশেই করে থাকে। আমাদের দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর বহু জাতীয় পিঁপড়ে দেখা যায়। এদের বিচিত্র জীবনযাত্রা প্রণালীর মধ্যে এমন কোনো কোনো ঘটনা ঘটে, যাতে এরা যে প্রত্যেকটি কাজই সংস্কারবশে করে থাকে, এমন কথা বলা যায় না। বিভিন্ন জাতীয় পিঁপড়ের বাসস্থান নির্মাণ ও সন্তানপালনের কৌশল, শৃঙ্খলা ও বিবেচনাশক্তি স্বাভাবিক প্রেরণার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে; কিন্তু যুদ্ধবিগ্রহ, আত্মরক্ষা এবং খাদ্য সংগ্রহ প্রভৃতি ব্যাপারে সময়ে সময়ে এমন দু-একটি কৌশল অবলম্বন করতে দেখা যায়, যা স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন প্রাণীর পক্ষেই সম্ভব। এস্থলে আমাদের দেশের বিভিন্ন জাতীয় পিঁপড়ে সম্বন্ধে নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে উল্লেখ করছি। এ কি অন্ধসংস্কার না স্বাধীন বিচারবুদ্ধির ফল, তা পাঠকবর্গই বিচার করবেন।
এক দিন সকাল নটা সাড়ে-নটা সময় পল্লীঅঞ্চলের রাস্তা দিয়ে চলেছি। সকাল থেকেই শিশিরবিন্দুর মত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। কিছু দূর অগ্রসর হতেই রাস্তার এক পাশে পরিষ্কার স্থানেই একটা সুপারি গাছের উপর নজর পড়লো। কতকগুলি নালসো ( লাল পিঁপড়ে ) সার বেঁধে গাছটার উপরের দিক থেকে নিচের দিকে ছুটে আসছিল। অবশ্য দু-চারটা পিঁপড়ে উপরের দিকেও উঠছিল। নালসোরা সাধারণত গাছের উপরেই চলাফেরা করে, নেহাৎ প্রয়োজন না হলে মাটিতে বা নিচু জায়গায় বড় একটা নামতে চায় না। তাছাড়া সুপারি গাছের উপর এদের সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না। কাজেই ব্যাপারটা কি দেখবার জন্য কৌতূহল হলো। কাছে গিয়ে দেখলাম — গাছটার এক পাশে মাটি থেকে প্রায় এক ফুট উপরে, কালো রঙের একদল ক্ষুদে পিঁপড়ে ছোট্ট একটা গুবরে পোকাকে আক্রমণ করে নিচে নামাবার জন্যে তার ঠ্যাং ধরে প্রাণপণ টানাটানি করছে। উপর দিক থেকে আবার পাঁচ-ছয়টা নালসো তার সামনে দুটো পা ও ঘাড় ধরে এমন ভাবে টান হয়ে রয়েছে যেন আরেকটু হলেই ছিঁড়ে যাবে। গুবরে পোকাটার কাছ থেকে নিচের দিকে গাছটার গোড়ার উপর এখানে-সেখানে আরও অসংখ্য ক্ষুদে পিঁপড়ে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছিল। সুপারি গাছটা প্রকাণ্ড একটা আমগাছের উপর হেলে পড়েছিল। আমগাছটাতেই ছিল নালসোদের বাসা। সেখান থেকে সুপারি গাছটার উপর দিয়ে দু-একটা টহলদার পিঁপড়ে নিচের অবস্থা তদারক করতে আসায় হয়তো শিকারটা নজরে পড়ে যায়। তার ফলেই খুব সম্ভব উভয় দলে শক্তি পরীক্ষা চলেছে। লক্ষণ দেখে বোধ হলো — ক্ষুদেরাই প্রথম শিকারটাকে আক্রমণ করে তাকে অনেকটা কাবু করে এনেছিল – তারপর এসেছে এই নালসোর দল। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই যে এই কাণ্ডটা চলছিল, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু উভয় পক্ষের টাগ-অব-ওয়ারটা চলছে অল্পক্ষণ ধরে। কারণ জায়গাটায় তখনও অধিক সংখ্যক নালসো জমায়েত হয় নি। তারা এদিকে-ওদিকে দুচারটা খাড়া পাহারা মোতায়েন করেছে মাত্র। এই পাহারাদার শাস্ত্রীরা শুঁড় উচিয়ে, মুখ হাঁ করে, নিশ্চল ভাবে অপর পক্ষের গতিবিধির দিকে লক্ষ রেখেছে। পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে বাকি রইলো না যে, শীঘ্রই একটা গুরুতর ‘পরিস্হিতি’র উদ্ভব হবে।