ছবি : Butterflies of India
দুধলতা প্রজাপতির জন্মকথা
রূপকথার ব্যাং যেমন রাজকন্যা সকাশে তার কুত্সিত আবরণটা পরিত্যাগ করে রাজপুত্রের রূপ ধারণ করতো, প্রাণী-জগতে কিন্তু এরূপ সত্যিকার দৃষ্টান্তের অভাব নেই ! আমাদের আশেপাশে অহরহ কত বিচিত্র বর্ণের সুদৃশ্য প্রজাপতিকে উড়ে বেড়াতে দেখতে পাই। তাদের জন্ম ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলেই তার সত্যতা প্রমাণিত হবে। এস্থলে আমাদের দেশীয় লালচে, হলদে রঙের দুধলতা প্রজাপতির জন্ম কথা বলছি।
কলকাতার আশেপাশে বনে-জঙ্গলে বড় গাছ বা বেড়ার গায়ে অযত্ন-বর্ধিত এক প্রকার বন্য লতার প্রাচুর্য দেখতে পাওয়া যায়। এদের পাতাগুলি একটু গোলাকার ধরনের, প্রায় প্রত্যেকটা গাঁট থেকে এক-একটা লম্বা বোঁটার ডগায় এক জোড়া কাঁটাওয়ালা সরু মুখ ফল ধরে। ফলগুলি শুকিয়ে ফেটে যায় এবং ঝাঁটার মত সূক্ষ্ম তন্তু সমন্বিত বীজ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, পাতা বা ডাঁটা ছিড়লে দুধের মত রস ঝরতে থাকে। এই জন্যেই বোধ হয় এগুলিকে দুধ্লতা বলা হয়ে থাকে। একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেই এই লতার গায়ে অদ্ভুত আকৃতি-বিশিষ্ট এক প্রকার অজস্র শোঁয়াপোকা দেখতে পাওয়া যাবে। এই শোঁয়াপোকাগুলি প্রায় এক ইঞ্চি থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। গায়ের উপরিভাগে হলদে ও কালো রঙের ডোরাকাটা। দেহের সম্মুখভাগে পিঠের উপর দুই জোড়া এবং পিছনের দিকে এক জোড়া কালো রঙের লম্বা শুঁড় আছে। মুখটা শাদা-কালো ডোরায় চিত্রিত। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এরা রাতদিন এই দুধলতার পাতা ও ডাঁটা কুরে কুরে খাচ্ছে, এক দণ্ডও বিশ্রাম নেই ; লম্বালম্বিভাবে পাতার ধার থেকে আরম্ভ করে নিচের দিকে প্রায় আধ ইঞ্চি স্থানের অতি সূক্ষ্ম অংশ কেটে খায়। খাবার সময় দেখা যায় যেন মুখটাকে কেবল বারবার উপর থেকে নিচের দিকে নামাচ্ছে। এদের চেহারা দেখতে ভীষণ হলেও অন্যান্য সাধারণ শোঁয়াপোকার মত এরা বিষাক্ত নয়। অন্যান্য সাধারণ শোঁয়াপোকা মানুষের গায়ে লাগলেই চামড়ার মধ্যে শোঁয়াগুলি গেঁথে যায় এবং সে স্থানে প্রদাহ – এমন কী সময় সময়ে ক্ষতেরও সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই শোঁয়াপোকার গায়ে মোটেই শোঁয়া নেই। এরাই দুধলতা প্রজাপতির বাচ্চা বা কীড়া। এই কীড়া বা শোঁয়াপোকাই কালক্রমে অমন সুন্দর প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত এই দুধলতা প্রজাপতিই যেখানে-সেখানে বেশির ভাগ নজরে পড়ে। দিনের বেলায় উড়ে বেড়াবার সময় এদের যৌন মিলন ঘটে। এই মিলনের কিছুকাল পরেই স্ত্রী প্রজাপতি দুধলতার পাতার গায়ে এখানে-সেখানে একটা একটা ক’রে কতকগুলি ক’রে ডিম পেড়ে চলে যায়। দিন দশ-পনেরো পরে ডিম ফুটে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শোঁয়াপোকা বেরিয়ে আসে। তখন তাদের গায়ের রং থাকে কতকটা ছাইয়ের রঙের মতো। ডিম ফুটে বাচ্ছা বের হবার কিছুক্ষণ বাদেই খেতে শুরু করে দেয়। কিন্তু তখন পাতার সমস্ত অংশটাই খেতে পারে না, কেবল সবুজ অংশটুকুই কুরে কুরে খায়। আর একটু বড় হলেই পাতা বা ডাঁটার সমস্ত অংশ কেটে কেটে খেতে আরম্ভ করে। প্রায় দশ-পনেরো দিন এরূপ খেতে খেতে বড় হয়ে হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবংকিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে ফিরে শক্ত একটা ডাঁটা নির্বাচন করে শরীরের পশ্চাদ্ভাগ থেকে এক প্রকার আঠালো পদার্থ বের করে ঐ ডাঁটার গায়ে মাখাতে থাকে।