চারদিক ঘুরে ফিরে দেখতেই নজরে পড়লো ক্ষুদে পিঁপড়েরা গাছের গোড়াটার চারদিকে আলগা মাটি তুলেছে। আগের যে সরু লাইনটি দেখেছিলাম, সেটি আজ অনেক চওড়া হয়েছে এবং ক্ষুদেরা উত্সাহভরে দলে দলে আনাগোনা করছে। লাইনটি শেষ হয়েছে গাছের গোড়ার কাছে মাটির নিচে। আলগা মাটির উপর এখানে-সেখানে কতকগুলি নালসোর মৃতদেহ পড়েছিল। আলগা মাটির নিচ থেকে অলক্ষিতে ক্ষুদেরা সেই মৃতদেহগুলি টেনে নিয়ে আসছিল। বুঝতে বাকি রইলো না যে, ইতিপূর্বে উভয় দলে একটা লড়াই হয়ে গেছে। ক্ষুদেরা হয়তো নালসোদের নিকট পরাজিত হয়ে মাটির আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। যাহোক, ক্ষুদে পিঁপড়েদের অত্যাচার থেকে নালসো-পিঁপড়েগুলিকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে গাছটার চতুর্দিকে পরিখার মত করে সেটাকে জলে ভর্তি করে দিলাম। গাছটার ডালপালার সঙ্গে অন্য কোনও গাছের যোগাযোগ না থাকায় নালসোদের অন্য কোথাও চলে যাবার উপায় ছিল না। এখন ক্ষুদে পিঁপড়েদের সঙ্গে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে গুঁড়ির উপর দিয়ে নিচের দিকে নেমে আসাতে মাটির উপর দিয়ে অন্যত্র পলায়ন করবার আশঙ্কা ছিল। গাছের গোড়ার চতুর্দিকে জলের বেষ্টনী দেবার ফলে এক দিকে যেমন নালসোগুলির অন্যত্র পলায়নের পথ বন্ধ হলো, ক্ষুদে পিঁপড়েগুলির পক্ষেও তেমনি জল অতিক্রম করে গাছের নিকট পৌঁছাবার উপায় রইল না।
বেলা প্রায় একটার সময় ফিরে এসে দেখি – বেষ্টনীর জলের প্রায় অর্ধেকটা মাটিতে শুষে গেছে। বেষ্টনীর অপর পাড় পর্যন্ত ক্ষুদে পিঁপড়ের লাইনটা পূর্বের মতই বজায় আছে, কিন্তু জলের বাধার জন্যে পিঁপড়েরা অনেকেই নতুন রাস্তা বের করবার জন্যে বাঁধটার নানা স্থানে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় এই যে, গাছের গোড়ায় মাটির নিচে যে পিঁপড়েগুলি লুকিয়ে ছিল, তারা নালসোদের সঙ্গে অভিনব পরিখা-যুদ্ধ আরম্ভ করে দিয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে একে পরিখা-যুদ্ধ না বলে সুড়ঙ্গ-যুদ্ধ বলাই উচিত। কারণ উইপোকারা যেমন সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে অগ্রসর হয়, এরাও সেরূপ মাটির বেষ্টনী তুলে গোড়াটার ৬।৭ ইঞ্চি উপর পর্যন্ত একটা দিক প্রায় ঢেকে ফেলেছে। নালসোদের সৈন্যসংস্থান পূর্বের মতোই রয়েছে বটে, কিন্তু পূর্বের অধিকৃত এলাকা থেকে প্রায় ৪।৫ ইঞ্চি পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। হাজার হাজার ক্ষুদে সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে কাজ করছিল ; সুড়ঙ্গের প্রান্তভাগে তাদের মুখ ও শুঁড়গুলি ছাড়া আর কিছুই বড় একটা দেখা যাচ্ছিল না। নালসো-প্রহরীরা অতি সতর্কভাবে তাদের দিকে দৃষ্টি রেখেছে। দৈবাৎ এক-একটি ক্ষুদে বাইরে এসে পড়লে ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে কেটে ফেলছে। সময় সময় দুই-একটা ক্ষুদে পিঁপড়েকে শুঁড় ধরে সুড়ঙ্গ থেকে টেনেও বের করছিল। তারা আবার পাল্টা আক্রমণে তার মুখে বা শুঁড়ে কামড়ে ধরছে। অবশেষে কামড়ের বিষে জর্জরিত হয়ে উভয়েই জড়াজড়ি করে নিচে পড়ে যাচ্ছে। এদিকে সুড়ঙ্গ ক্রমশ ঊর্ধ্ব দিকে অগ্রসর হয়ে চলেছে। বেলা তিনটার সময় সুড়ঙ্গটা প্রায় ১০ ইঞ্চি ঊর্ধ্বে উঠেছিল। এদিকে আর এক অদ্ভুত কাণ্ড দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বাঁধের জল প্রায় শুকিয়ে আসছিল। জলের মধ্যস্থলে খানিকটা উঁচু জায়গা দ্বীপের মতো জেগে উঠেছে। অপর পারের সেই ক্ষুদে পিঁপড়েরা একটা দুঃসাহসিক কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে। চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ না করলে এরূপ ঘটনার কথা হয়তো বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হতো না। ক্ষুদে পিঁপড়েরা একটার পিছনে আর একটা – এরূপভাবে সার বেঁধে জলের পাতলা আবরণের উপর দিয়ে অতি সন্তর্পণে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে দ্বীপটার উপর জড়ো হয়েছে। এখান থেকে গাছের গুঁড়ির দূরত্ব মাত্র দেড় ইঞ্চির কিছু বেশি ছিল। প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যে দেখতে দেখতে তারা সকলে জড়াজড়ি করে একটা মোটা লাইনের মতো জলের উপর ভেসে পড়লো ; কিন্তু ব্যবধানটুকু অতিক্রম করতে পারলো না।