বাচ্চাগুলিই পিঁপড়েদের প্রধান সম্পত্তি। এগুলিকে রক্ষা করবার জন্যে শ্রমিকেরা প্রাণ বিসর্জনেও কিছুমাত্র ইতস্তত করে না। বাচ্চা না হলে এদের বাসা তৈরি করা সম্ভব হয় না। বাচ্চার সাহায্যে সুতা বুনে বাসা নির্মাণ করে। এদের যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ধারালো সাঁড়াশীর মতো একজোড়া শক্ত চোয়াল এবং একপ্রকার বিষাক্ত গ্যাস। যুদ্ধ বাধবার উপক্রম হলেই শরীরের পশ্চাদেশ উঁচু করে শত্রুর প্রতি অনবরত গ্যাস ছুড়তে থাকে। তারপর শুরু হয় কামড়াকামড়ি। এই পিঁপড়েগুলিকে সাধারণত লাল-পিঁপড়ে বলা হয়। বাংলাদেশে এরা নালসো পিঁপড়ে নাম পরিচিত।
আমাদের দেশে বহু জাতীয় ক্ষুদে পিঁপড়ে দেখা যায়। তাদের মধ্যে এক জাতীয় ক্ষুদে পিঁপড়ের শরীরের সম্মুখভাগ লালচে হলুদ বর্ণের, কিন্তু পশ্চাদভাগ কালো। এরা দেড় থেকে দুই মিলিমিটারের বেশি বড় হয় না। এগুলিকে প্রায়ই সুদীর্ঘ লাইন করে উঁচু জমি, ঘরের দেওয়াল বা বড় বড় গাছের উপর বিচরণ করতে দেখা যায়। এক-একটি ফাটল বা গর্তে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদে পিঁপড়ে বসবাস করে। নালসো-পিঁপড়ে অপেক্ষা এরা অনেক ধীরগতি সম্পন্ন। ক্ষুদে পিঁপড়েরা নালসো-পিঁপড়ে এবং তাদের ডিম ও বাচ্চাগুলিকে অতি উপাদেয় বোধে উদরসাৎ করে থাকে। ক্ষুদে পিঁপড়েদের দংশন অতি বিষাক্ত, বিশেষত নালসোদের পক্ষে এই বিষ অতি মারাত্মক বলেই মনে হয়। নালসোদের সম্পত্তি লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে ক্ষুদেরা তাদের সঙ্গে লড়াই বাধায় এবং শত্রুকে পর্যুদস্ত করবার জন্যে বিবিধ কৌশল অবলম্বন করে। নালসোদের সঙ্গে এদের যুদ্ধ প্রায়ই দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। সময় সময় উভয় পক্ষে একটা সামরিক সন্ধিও হতে দেখা যায়। নালসোরা প্রায়ই চুক্তিভঙ্গ করে না ; কিন্তু ক্ষুদেরা সুযোগ বুঝলেই যখন-তখন চুক্তিভঙ্গ করে নালসোদের আক্রমণ করে থাকে।
পিঁপড়েদের জন্মরহস্য বড়ই জটিলতাপূর্ণ। এই জন্মরহস্যের প্রকৃত তত্ত্ব নির্ধারণের জন্যে কিছুকাল থেকে নালসো-পিঁপড়ে নিয়ে পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হয়েছিলাম ! আনুবীক্ষণিক পরীক্ষার জন্যে বহুসংখ্যক পিঁপড়ের দেহ ব্যবচ্ছেদ করার প্রয়োজন হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কলকাতার আশেপাশে নালসো-পিঁপড়ের প্রাচুর্য লক্ষিত হলেও শহরের অভ্যন্তরে যথেষ্ট গাছপালার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কোথাও এদের সন্ধান পাওয়া যায় না। এই অসুবিধার জন্যে কিছুকাল পূর্বে শিবপুরের বাগান থেকে পিঁপড়ে সমেত বড় বড় বাসা থলেয় পুরে নিয়ে এসে পরীক্ষাগারের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছোট্ট একটা আমগাছে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, পিঁপড়েরা নতুন বাসা বেধে গাছটাতে উপনিবেশ স্থাপন করবে। প্রথমত একটা থলের মুখ খুলে বাসাটাকে বের করে গাছের একটা নিচু ডালে আটকে দিয়েছিলাম। পাতলা সাদা কাগজের মতো পর্দার সাহায্যে পাতাগুলিকে পরস্পর জুড়ে নালসোরা বাসা নির্মাণ করে। দূরবর্তী স্থান থেকে থলেয় পুরে আনবার সময় জোড়া মুখের পর্দা ছিঁড়ে বাসাগুলি স্বভাবতই কিছু না কিছু জখম হয়েছিল। তাছাড়া বাসার পাতাগুলি শুকোতে শুরু হতেই বাসাটা ক্রমশ বাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। বাসাটা ভাঙবার লক্ষণ দেখেই সহজাত সংস্কারবশে পিঁপড়েরা নতুন পত্র-পল্লবের মধ্যে নতুন বাসা নির্মাণ করতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে বিপদ-আপদ সংঘটিত হলে সাধারণত এদের এরূপ কার্যপ্রণালীই অনুসরণ করতে দেখা যায়। এই ভরসাতেই পত্র-পল্লবের মধ্যে বাসাটাকে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।