ক্ষুদে-পিঁপড়ের ব্লিৎসক্রিগ
কেবল বিদ্যুত্গতিতে সৈন্য পরিচালনাই নয়, শত্রু-ঘাঁটির যাবতীয় বিধিব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা উত্পাদন এবং তত্সহ অবিরাম শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাত সহকারে প্রবল বন্যাপ্রবাহের মতো যান্ত্রিক বাহিনীর যুগপৎ দুর্ধর্ষ আক্রমণই ব্লিত্সক্রিগের বিশেষত্ব। আকাশ থেকে বোমারু বিমানের নিরবিছিন্ন অগ্নিবর্ষণ, সঙ্গে সঙ্গে প্যারাসুটিস্ট সৈন্যদের নগরাভ্যন্তরে অবতরণ এবং পঞ্চমবাহিনীর সহায়তায় পেট্রোল সরবরাহের আস্তানা, বিমান ঘাঁটি, যানবাহন চলাচল ও সংবাদ আদান-প্রদানের কেন্দ্রসমূহ দখল করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেই সাধারণ নাগরিকেরা ভীতিবিহ্বল চিত্তে প্রাণরক্ষার নিমিত্ত ইতস্তত ছুটাছুটি করে স্বপক্ষীয় সৈন্য চলাচলের বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং অনেকে দলিত ও পিষ্ট হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাতে বাধ্য হয়। ছোটোখাটো পাহাড়-পর্বত বা উচ্চভূমিতে বাধা পেয়ে বন্যার জল যেমন বর্ধিত তেজে ভীমগর্জনে প্রবাহিত হতে থাকে, যান্ত্রিক বাহিনীও সেইরূপ জীবন-মরণ তুচ্ছ করে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই হলো সমর-কৌশলের চমকপ্রদ অভিব্যক্তি। মানুষের পক্ষে এরূপ সমরনীতি বা ‘ব্লিত্সক্রিগ’ পরিচালনা সম্ভব হলেও মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে কোথাও যে এইরূপ কৌশল অনুসরণ করা সম্ভব নয় এটা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু পিঁপড়েদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এমন কয়েকটি লড়াই প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ ঘটেছিল যাতে তাদের এক পক্ষের রণকৌশল – সৈন্য-পরিচালন, সৈন্য-সংস্থান এবং অসতর্ক মুহূর্তে বিদ্যুত্গতিতে আক্রমণ প্রভৃতি ব্যাপার, বহুলাংশেই ‘ব্লিত্সক্রিগে’র অনুরূপ বলে মনে হয়। এমন কী ব্যাপক ধ্বংস ও লুন্ঠনাদি ব্যাপারের ভীষণতায় হয়তো তা মনুষ্যপরিচালিত ‘ব্লিত্সক্রিগকে’ও হার মানায়। এরূপ ‘ব্লিত্সক্রিগে’র এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলছি।
লড়াই বেধেছিল বিভিন্ন জাতীয় দুই দল পিঁপড়ের মধ্যে। একদল ক্ষুদে, অপর দল বৃহদাকৃতির নালসো পিঁপড়ে। বিভন্ন জাতীয় পিঁপড়ের জীবনযাত্রা প্রণালীর বিষয় যাঁরা সম্যক অবগত নন, তাঁদের বোঝবার সুবিধার জন্যে যুদ্ধমান পিঁপড়েদের মোটামুটি একটু পরিচয় দিচ্ছি। আমাদের দেশে প্রায় সর্বত্রই আম, জাম, পাকুড় প্রভৃতি গাছে লাল রঙের এক প্রকার দুর্ধর্ষ পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায়। কতগুলি পাতা একত্রে জুড়ে এই পিঁপড়েরা গাছের ডালে বড় বড় গোলাকার বাসা নির্মাণ করে থাকে। এদের স্বভাব অতিশয় উগ্র ; কাকেও বাসার নিকটে পেলেই দলে দলে ছুটে এসে আক্রমণ করে। মরে গেলেও কামর ছাড়ে না। এদের পরিবারের মধ্যে শ্রমিক, পুরুষ ও রানী – এই তিন রকমের পিঁপড়ে দেখা যায়। পুরুষ ও রানী উভয়েরই ডানা আছে ; কিন্তু শ্রমিকদের ডানা থাকে না। পুরুষের শরীরের রং কালো, রানীদের রং সবুজ ; কিন্তু একমাত্র শ্রমিকদের শরীরের রং লাল। রানীরা লম্বায় প্রায় এক ইঞ্চির মতো বড় হয়। পুরুষের শরীরের দৈর্ঘ্য আধ ইঞ্চির কিছু বেশি। শ্রমিকরা সিকি ইঞ্চি থেকে আধ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। শ্রমিকেরা তাদের সংসারের যাবতীয় কাজ করে থাকে। যুদ্ধের সময় সৈনিকের কাজও এরাই করে। এক একটি বাসার মধ্যে প্রায় শতাধিক রানী কয়েক শত পুরুষ এবং চার-পাঁচ হাজার বা ততোধিক শ্রমিক বাস করে। তাছাড়া বাসার মধ্যে থাকে হাজার হাজার ডিম, বাচ্চা ও পুত্তলী।