ক্রমশ লড়াই এমন ভীষণাকার ধারণ করলো যে, দু-তিন হাত প্রশস্ত স্থানের মধ্যে প্রায় সর্বত্র এরূপ টানাটানি কামড়াকামড়ি চলতে লাগলো। এখন শুধু টানাটানি নয়, কামড়াকামড়িই যেন বেশি দেখা যেতে লাগলো। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই বিষ-বাষ্পের অবাধ প্রয়োগ। এতগুলি পিঁপড়ের দেহনিঃসৃত বিষাক্ত রসের উগ্র গন্ধে যেন নাক জ্বলে যাচ্ছিল। কামড়াকামড়ি করতে করতে জড়াজড়ি করে শত শত পিঁপড়ে ঝুপ ঝুপ করে নিচে পড়ছিল। নিচে মাটির উপর চেয়ে দেখলাম – প্রায় পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে উভয় পক্ষের এত পিঁপড়ে মারা গেছে যে, ঘাসপাতাগুলি তাদের মৃতদেহের নিচে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। মনে হলো উভয় পক্ষের সৈন্য সংখ্যা প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। যারা তখনও ছুটাছুটি করছিল, তাদের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ করে দেখলাম – প্রায় প্রত্যেকেরই শুঁড় অথবা পায়ের সঙ্গে মরণ-কামড় দিয়ে ঝুলে রয়েছে শত্রুদের ছিন্ন মস্তক অথবা দেহের সম্মুখাংশ। বেড়ার উপরের পিঁপড়েরা সর্বদাই চেষ্টা করছিল, যাতে বাসাটাকে গিয়ে দখল করতে পারে। এত লড়াইয়ের পরেও দেখলাম তাদের উত্সাহ কিছুমাত্র কমে নি। তাদের বাসা থেকে নতুন নতুন সৈন্য এসে পূর্ণোদ্যমে আবার আক্রমণ শুরু করলো। এবার যেন তারাই জয়ী হয়েছে বলে বোধ হলো। ঝুলন্ত বাসার সৈন্যদের সংখ্যা আর বেশি দেখা যাচ্ছিল না। বিশেষত উভয় পক্ষের সৈন্যদের আকৃতি একই প্রকার বলে বিশেষ কিছু বুঝতে পারছিলাম না যে, কে শত্রু কে মিত্র। কিন্তু এরা পরস্পর শুঁড়ে শুঁড় ঠেকিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে শত্রু-মিত্র চিনে নিচ্ছিলো। এদিকে বাখারীর উপরের দল দুই চারটি করে করে ক্রমে ক্রমে বাসার উপরে এসে জড়ো হতে লাগলো, কিন্তু তারাও যে বেশ ভয়ে ভয়ে ইতস্তত করে অগ্রসর হচ্ছিল, তাও বেশ বোঝা গেল। কিছুক্ষণ বেশ চুপচাপ। বাসার সৈন্য সামন্ত যেন ক্রমশ বিরল হতে লাগলো। ঝুলন্ত বাসার পিঁপড়েরা যে যুদ্ধে হেরে গেছে, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বাসাটার খুব কাছে গিয়ে কান পেতে শুনলাম – ভিতরে যেন অজস্র পিঁপড়ের একটা খস্ খস্ আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট এভাবে কেটে গেল, তার পরেই দেখি – গুটিকয়েক পিঁপড়ে বাসার ভিতর থেকে অপরিণতবয়স্ক বাচ্চাগুলিকে মুখে নিয়ে বেরিয়ে এলো। পিছনে তাদের একদল সৈন্য যেন পাহারা দিতে দিতে চলেছে। বাচ্চাবহনকারীরা কোনও দিকেই ভ্রূক্ষেপ না করে গাছের ডাল ও বাখারীটার উপর দিয়ে অতি দ্রুতগতিতে পালিতা-মাদারের খুঁটিটার উপর যেতে লাগলো। সৈন্যরাও তাদের অনুসরণ করছিল। এই ব্যবধানটুকুর মধ্যে শত্রুরা বিশেষ কিছু বাধা দেবার চেষ্টা করলো না, কেবল দু-একটা সৈন্যকে ধরে টানা দিয়ে রাখল মাত্র। বিশেষত তখন সেস্থানে শত্রুর সংখ্যাও খুব কমই ছিল। যারা ছিল তাদের অধিকাংশই যেন মারামারি করা অপেক্ষা বাসাটা লুট করবার উত্সাহে সেই দিকেই ছুটছিল। খানিক পরে দেখা গেল, আরও অনেক ডিম ও বাচ্চাগুলিকে মিখে নিয়ে দলে দলে বাসা থেকে ছুটে বের হয়ে সেই গাছটার দিকেই প্রাণপণে ছুটছে। তন্মুহূর্তেই আবার ভীষণ লড়াই শুরু হয়ে গেল। বাসার ভিতরে এতক্ষণ অসংখ্য সৈন্য যেন দম নেবার জন্যে চুপ করে বসেছিল – এবার তারা দলে দলে বেরিয়ে এসে শত্রুদের খণ্ড খণ্ড করে ফেলতে লাগলো। এদিকে ফাঁকে ফাঁকে তারা বাসার ডিম ও বাচ্চাগুলিকে সরিয়ে নিচ্ছিল। সেই গাছটার উপর শত্রুরা এবার সত্যসত্যই পৃষ্ঠভঙ্গ দিল।