এদের দূর্ধর্ষ কোপন স্বভাবের ফলে, অন্যান্য পিঁপড়েদের সঙ্গে হামেশাই ঝগড়া-ঝাঁটি লেগে থাকে – এমন কি, বিভিন্ন দলের স্বজাতীয়দের মধ্যে সময় সময় ভীষণ লড়াই বেঁধে যায়। এই জন্যেই বোধ হয় অন্যান্য জাতের পিঁপড়েরা এদের নিকট থেকে যথাসম্ভব দূরে দূরেই অবস্থান করে। তবে দলে ভারী বলেই হোক বা উগ্র বিষের ভয়েই হোক ক্ষুদে পিঁপড়েদের সঙ্গে কিন্তু এরা কিছুতেই এঁটে উঠতে পারে না। ক্ষুদেরা কোনও রকমে সন্ধান পেলে নালসোদের সমূলে ধ্বংস না করে ছাড়ে না। এই জন্যেই যে সব স্থানে ক্ষুদে পিঁপড়ের আস্তানা আছে, সেখানে কখনো নালসো পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায় না। ক্ষুদে, ডেঁয়ো ও ছোট ছোট কালো বিষ পিঁপড়ের সঙ্গে এদের লড়াই অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি ; কিন্তু এদের স্বজাতীয়ের পরস্পরের মধ্যে দল ভাঙার যে ভীষণ লড়াই প্রত্যক্ষ করেছিলাম, সেটা সত্যই ভয়াবহ।
একবার বিকালের দিকে কলকাতার সন্নিহিত সোনারপুর অঞ্চলের একটা বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। বাগানের চার দিকে পালিতা মাদারের মোটা মোটা ডাল পুঁতে তার গায়ে খুব ফাঁক করে বাঁশের বাখারী এঁটে এমনভাবে বেড়া দিয়ে রেখেছে যেন গরু-বাছুর ভিতরে ঢুকতে না পারে। বাগানের গাছপালার অবস্থা দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারা গেল যে, আগের দিন সেখানে বেশ ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। আর একটু অগ্রসর হতেই নজরে পড়লো – খুব বড় একটা পিঁপড়ের বাসা সমেত ছোট একটা আমের ডাল একটা খুঁটির খুব কাছেই বাখারীর সঙ্গে ঝুলে রয়েছে। মনে হলো ঝড়ের বেগে ডালটা ভেঙে বেড়ার গায়ে পড়ে আটকে গিয়েছিল। খুব কাছে গিয়ে দেখলাম ছিন্ন-বিছিন্ন বাসাটার ভিতরে সহস্র সহস্র পিঁপড়ে অবস্থান করছে। কতকগুলি পিঁপড়ে বাসার উপরে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে আর কতকগুলি একবার ডালটার গা বেয়ে উপরের দিকে উঠছে আবার নেমে আসছে। তাদের গতিবিধি দেখে পরিস্কার বোঝা গেল যে, তারা ঐ ঝুলন্ত ভাঙা বাসা থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও যাবার রাস্তা খুঁজছে। কিন্তু একটু লক্ষ করতেই বুঝতে পারলাম, তাদের বাইরে যাবার রাস্তা বন্ধ। কারণ যে বাখারীটার সঙ্গে বাসাটা ঝুলছিল, সেই বাখারীটার উপর দিয়ে বরাবর এক সার লাল-পিঁপড়ে যাতায়াত করছে। বাগানের কোণে একটা ঝোপের ভিতর পূর্ব থেকেই আর একদল লাল-পিঁপড়ে বাসা তৈরি করে বসবাস করছিল। তারাই বাখারীর উপর দিয়ে প্রায় ২৫।৩০ ফুট লম্বা লাইন করে একটা সদ্যকর্তিত কচ্ছপের খোলা থেকে মাংসের কণা সংগ্রহ করে বাসায় তুলছিল। ঝুলন্ত বাসার পিঁপড়েরা ডাল বেয়ে বাখারীর কাছে এসে উক্ত পিঁপড়ের দল দেখেই আর অগ্রসর হতে সাহসী হয় নি। বাখারীর উপরের পিঁপড়েদের অতিক্রম না করে তাদের অন্যত্র যাবার কোনই উপায় নেই। ছিন্ন-বিছিন্ন ভগ্ন বাসাতেও বেশিদিন বাস করা অসম্ভব। একে তো শত্রু নিকটে, তার উপর পাতা শুকিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বাসা কুচকে যাবে, নয়তো শুকনো পাতার জোড়া মুখ খুলে গিয়ে বাসাটার স্থানে স্থানে ফাটল দেখা দেবে। কাজেই এই বাসা পরিত্যাগ করে অন্যত্র নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করতেই হবে। বিশেষত বাসার ভিতরে অসংখ্য ডিম ও বাচ্চা রয়েছে তাদের নিরাপদ স্থানে রক্ষা করা দরকার। এইসব নানা ব্যাপারে বিব্রত হয়ে ঝুলন্ত বাসার অধিবাসীরা বিষম উত্তেজিতভাবে ইতস্তত ছুটাছুটি করছিল। বাখারীর উপরে যারা যাতায়াত করছিল, তারাও এই আগন্তুক দলের সন্ধান পেয়েছিল বোধহয়, কারণ তাদের ভিতরেও উত্তেজনার ভাব লক্ষিত হচ্ছিল। তারাও ক্রমে ক্রমে ঝুলন্ত ডালটার কাছাকাছি এসে ভিড় জমাচ্ছিল। প্রায় আধ ঘন্টার উপর দাঁড়িয়ে উভয় দলের এই তোড়জোড় লক্ষ করছিলাম। একমাত্র উত্তেজিত ভাব বা একস্থানে দলে দলে জমায়েত হওয়া ব্যতিরেকে লড়াইয়ের আর কোনও লক্ষণই দেখতে পাই নি। ঝুলন্ত বাসার পিঁপড়েরা কিরূপ কৌশল অবলম্বন করে বাখারীর উপরের পিঁপড়েদের লাইন অতিক্রম করে যায় – কেবল সেটাই দেখবার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আরও দশ-পনেরো মিনিট এ ভাবেই কাটলো।