পরীক্ষার উদ্দেশ্যে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম বাসায় লাল-পিঁপড়ে পুষেছিলাম। হলদে রঙের ক্ষুদে-পিঁপড়েরা এদের ভীষণ শত্রু। সুবিধা পেলেই এরা লাল-পিঁপড়ের ডিম, কীড়া, পুত্তলী, পুরুষ ও রানী পিঁপড়েগুলিকে উদরসাৎ করবার চেষ্টা করে। কৃত্রিম বাসার চতুর্দিকে প্রশস্তভাবে জলের বেষ্টনী দেওয়া ছিল। একবার দেখলাম — ক্ষুদে পিঁপড়েরা জলের উপর দিয়ে অতি সন্তর্পণে হেঁটে গিয়ে লাল-পিঁপড়ের বাসায় যাবার চেষ্টা করছে। সাত-আট দিনের চেষ্টায় তারা জলের উপর দিয়ে লাইন করে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এই বেষ্টনীর জল সর্বদাই স্থিরভাবে থাকে বলে আর একবার পিঁপড়েগুলিকে অভিনব উপায়ে পার হতে দেখেছিলাম। প্রথমবার জল অতিক্রম করতে গিয়ে কতকগুলি ক্ষুদে পিঁপড়ে জলে ডুবে মারা যায়। তাদের মৃতদেহগুলি সেই স্থানেই ভাসতে থাকে; আবার কতকগুলি অগ্রসর হয়। তাদেরও অনেকেই মারা যায় এবং বাকিগুলি ফিরে আসে। এইভাবে ক্রমশ মৃতদেহের একটা লাইন অগ্রসর হতে থাকে। এই মৃতদেহের ফাঁকে ফাঁকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শুকনো ঘাসের টুকরো এনে তারা সুন্দর একটি ভাসমান রাস্তা তৈরি করেছিল। এই রাস্তার উপর দিয়েই ক্ষুদে পিঁপড়েদের ডিম, বাচ্চা, পুত্তলিগুলিকে অপহরণ তো করলোই, অধিকন্তু পিঁপড়েগুলিকে মেরে ফেলে মৃতদেহগুলিকে খণ্ড খণ্ড করে নিজেদের বাসায় নিয়ে গেল।
আমাদের দেশের সোলেন্পসিস্ জাতীয় লাল রঙের এক প্রকার ক্ষুদে-পিঁপড়ে মাঠে-ঘাটে মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে বাস করে। সময়ে সময়ে এরা গর্তের চারদিকে বেশ উঁচু মাটির স্তূপ সাজিয়ে রাখে। বর্ষার সময় অতি বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট জলে ডুবে গেলে এদের দুর্দশার সীমা থাকে না। দুর্দশা যতই হোক — জলমগ্ন হয়ে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়াটাই প্রধান সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের জন্যে তারা এক অদ্ভূত উপায় অবলম্বন করে থাকে। গর্তে জল ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গেই সকলে মিলে জড়াজড়ি করে এক-একটা ডেলা পাকিয়ে জলের উপর ভেসে বেড়ায়। ডেলার নিচের দিকে যারা থাকে, তারা যাতে শ্বাসরুদ্ধ না হয়, সে জন্যে প্রত্যেকেই ডেলাটাকে আঁকড়ে উপরের দিকে উঠতে চেষ্টা করে। ফলে ডেলাটা জলের উপর ধীরে ধীরে গড়াতে থাকে। এতে একটি পিঁপড়েরও প্রাণহানি ঘটে না। জল নেমে গেলেই আবার পুরাতন বাসায় ফিরে যেতে পারে। স্থানভ্রষ্ট হলে নতুন বাসার পত্তন করে। উটপাখিরা তাড়া খেলে যেমন বালিতে মুখ গুঁজে আত্মগোপন করেছে বলে নিশ্চিন্ত মনে অবস্থান করে — আমাদের দেশীয় কাঠ-পিঁপড়েদের মধ্যেও এরূপ ব্যাপার দেখতে পাওয়া যায়। শত্রুর আগমন টের পেলেই তারা এমন নিশ্চলভাবে অবস্থান করে যে, সহজে খুঁজে বের করা যায় না। কিন্তু শত্রু অনুসরণ করলে এরা ছুটতে ছুটতে কোনও কিছুর আড়ালে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। শুধু মুখটা আড়ালে পড়লেই মনে করে — সে যেমন কাকেও দেখতে পাচ্ছে না, শত্রুও বোধহয় সেরূপ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কাজেই সেই অবস্থায় সে নিশ্চল ভাবে অবস্থান করে। উপরের আবরণটি সরিয়ে নিলেও সে নিশ্চিন্ত মনেই চুপ করে থাকে।
আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে উপরিউক্ত কৌশল দুটি কৌতুহলোদ্দীপক হলেও নিঃসন্দেহেই তা সংস্কারমূলক। কিন্তু অন্যান্য ঘটনাগুলি বুদ্ধিবৃত্তির পরিচায়ক কিনা তাই বিবেচ্য।
পিঁপড়ে-সমাজে খাদ্য-সংগ্রহ, সন্তানপালন, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি যাবতীয় কাজ কর্মীরাই করে থাকে। উল্লিখিত ঘটনাগুলিতে কর্মীদের কথাই বলা হয়েছে। আকৃতি, প্রকৃতিতে কর্মীরা পুরুষ ও স্ত্রী-পিঁপড়ে থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। স্ত্রী ও পুরুষের ডানা গজায়, কিন্তু কর্মীদের ডানা নেই। আবার এমন এক সময় আসে যখন স্ত্রীদেরও ডানা থাকে না। যাঁরা এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণে আগ্রহী তাঁদের পক্ষে এদের স্ত্রী, পুরুষ, কর্মী, ডিম, বাচ্চা ও পুত্তলি সম্বন্ধে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
__________________
প্রবাসী, আশ্বিন, ১৩৪৯