শিবপুরের বাগানে কীট-পতঙ্গ সংগ্রহ করবার সময় একদিন দেখলাম — মাটির উপরে কতকগুলি উইয়ের সুড়ঙ্গ প্রকাণ্ড একটা গাছের গুড়ি অবধি বরাবর চলে গেছে। গাছটার লম্বা গুড়ির এখানে-সেখানে অনেকগুলি নালসোকে এদিক-ওদিক ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে দেখলাম। তাদের গতিবিধি অনুসরণ করে দেখা গেল, অনেক পিঁপড়ে মাটিতে নেমে উইপোকার সুড়ঙ্গের আশেপাশে প্রায় নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা কি বুঝতে না পেরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করবার পর ওঠবার উপক্রম করছি, এমন সময় একটু দূরে একটা লাল-পিঁপড়ে যেন কিছু খুঁটে খাচ্ছে বলে মনে হলো। কাছে গিয়ে দেখি — প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা একটা ছোট্ট উইয়ের সুড়ঙ্গের উপর নালসোটা সুড়ঙ্গের মাটি সরিয়ে গর্ত করবার চেষ্টা করছে। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই দু-এক টুকরো মাটি সরিয়ে সুড়ঙ্গের উপরের দিকে সে ছোট্ট একটা গর্ত করতে সক্ষম হলো। গর্ত হবার পর প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ সেকেন্ড পরেই সুড়ঙ্গের ভগ্ন স্থানের মধ্যে দিয়ে একটা উইপোকাকে মুখ বাড়াতে দেখা গেল। উইপোকাটা শ্রমিক শ্রেণীর, গর্ত বোজাবার জন্যেই এসেছিল। এদিকে নালসোটা শুঁড় উচু করে গর্তের মুখে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়েছিল। উইপোকাটাকে নজরে পড়বামাত্রই তাকে শক্ত চোয়ালের সাহায্যে ধরে গাছের দিকে ছুটে চললো। এই ঘটনার পর আরও অনেক ক্ষেত্রে এরূপ ব্যাপার লক্ষ্ করেছি। উইপোকা নালসোদের অতি উপাদেয় খাদ্য।
এই ঘটনার কিছুদিন আগে ঐ বাগানেই একদিন দেখলাম — একটা ফলসা গাছের কচি ডালের ডগার পাতাগুলি মুড়ে নালসোরা একটা বাসা নির্মাণ করেছে। বাসাটাকে আরও বড় করবার জন্যে তারা বোধহয় অনেক চেষ্টা করেছিল — কিছু সুবিধে করতে পারেনি, কারণ পরস্পর সন্নিহিত পাতাগুলি সবই ইতিপূর্বে মুড়ে ফেলেছে। কাছাকাছি হলেও খানিকটা কোঁকড়ানো একটা মাত্র পাতা বাকি ছিল। সেটাকে বাসার সঙ্গে জুড়ে দেবার জন্যে অনেকগুলি পিঁপড়ে মিলে প্রাণপণে চেষ্টা করছিল। সে পাতাটাকে ছিঁড়ে ফেলে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেল — নতুন কিছুই দেখা গেল না। আরও কিছুকাল অপেক্ষা করবার পর দেখা গেল — পিঁপড়েরা ডালটার নিচের দিকে স্তূপাকারে একত্রিত হয়ে ঝুলে পড়বার চেষ্টা করছে। উপরের ডালটার সমান্তরালে নিচের দিকে আরেকটা সরু ডাল ছিল। বাসা থেকে তার পাতাগুলির ব্যবধান ছিল প্রায় আট-দশ ইঞ্চির মত। ঐ পাতাগুলিকে কাছে টেনে বাসার সঙ্গে জোড়বার উদ্দেশ্যেই তারা শিকল গাঁথবার মতলব করছিল। প্রায় অধ ঘণ্টার মধ্যেই শত শত পিঁপড়ে পরস্পর জড়াজড়ি করে প্রায় ১/৪ ইঞ্চি মোটা ও ফুটখানেক লম্বা একটা শিকল তৈরি করে নিচের ডাল পর্যন্ত ঝুলে পড়লো এবং সঙ্গে সঙ্গেই নিচের ডালের একটা পাতার প্রান্তভাগ কামড়ে ধরে পুনরায় ক্রমশ শিকলের দৈর্ঘ্য কমাতে লাগলো। প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের প্রাণপণ চেষ্টার ফলে তারা নিচের পাতাটাকে বাসার উপরে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর পাতাটাকে বাসার সঙ্গে জুড়ে দেবার পালা। বয়নকারী শ্রমিক পিঁপড়েরা তখন শূককীট অর্থাৎ লার্ভা মুখে করে তাদের সাহায্যে বয়নকার্য শুরু করে দিল।