একবার আঠার শিশির মধ্যে একটা আরশুলা পড়ে মরেছিল। আরশুলাসমেত আঠাগুলিকে এক স্থানে ঢেলে ফেলে দিয়েছিলাম। কিছুকাল পর দেখলাম আরশুলার মৃতদেহ সংগ্রহের নিমিত্ত লাল রঙের এক প্রকার ক্ষুদে বিষ-পিঁপড়ে আঠার চতুর্দিক ঘেরাও করেছে। কলকাতার সর্বত্র এই জাতীয় বিষ-পিঁপড়ে সর্বদাই দেখা যায়। দেখা গেল দু-চারটে পিঁপড়ে আরশুলার নিকট যাবার চেষ্টা করায় তরল আঠার মধ্যে বন্দী হয়ে তখনও হাবুডুবু খাচ্ছে। পাশ কাটিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য দেখে মনে মনে ভাবলাম বেশ হয়েছে — এবার আর আরশুলার দেহ উদরসাৎ করতে হবে না। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ফিরে এসে দেখলাম, তখনও তারা মৃত আরশুলার দেহটাকে উদরসাৎ করবার আশা পরিত্যাগ করে নি — বরং সেস্থানে পিঁপড়ের সংখ্যা পূর্বাপেক্ষা বেশি হয়েছে বলে মনে হলো। একটু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্ করতেই একটা অদ্ভূত ব্যাপার দেখে অবাক হয়ে গেলাম। পিঁপড়েগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁকর মুখে করে আঠার উপর জড়ো করেছে। আঠার উপর দিয়ে এইরূপ কাঁকরের পথ প্রস্তুত করতে তাদের প্রায় আরো দু-ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। কিন্তু সময়ের দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কোনো রকমে আরশুলাটা পর্যন্ত পথ নির্মিত হওয়া মাত্রই দলে দলে পিঁপড়েরা তার উপর দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদেই আরশুলার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেহ-খন্ড মুখে করে সার বেঁধে মহোল্লাসে বাসার দিকে অগ্রসর হতে দেখা গেল।
এই ঘটনার পর একদিন মেঝেতে বসে কাজ করছি। কতকগুলি কালো রঙের সুরসুরে-পিঁপড়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছিল। মেঝের উপর এক স্থানে অল্প খানিকটা জল পড়ে ছিল। তিন-চারটা সুরসুরে-পিঁপড়ে প্রায় একসঙ্গে ওই জলটার পাশ দিয়ে কয়েকবার ছুটে গেল। আবার এসে জলটার পাশেই ঘোরাফেরা করতে লাগলো। এদের স্বভাব অদ্ভূত — চলতে চলতে খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়ায় — কিছুক্ষণ হাত-পা আর শুঁড় পরিষ্কার করে — পরমুহুর্তেই আবার দ্রুতগতিতে ছুটতে থাকে। মেঝের উপর জলটুকুর পাশ দিয়ে দুটি একসঙ্গে ছুটে যাবার সময় অকস্মাৎ একটা পিঁপড়ে জলের সঙ্গে আটকে গেল। পিঁপড়েটা জল থেকে সরে আসবার জন্যে যতই চেষ্টা করে, জলটাও সঙ্গে সঙ্গে ততটা ছড়িয়ে পড়ে। মোটের উপর জলটা যেন তরল আঠার মত তার দেহের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। পিঁপড়েদের দলের মধ্যে কেউ মরে গেলে অথবা চলচ্ছক্তিহীন হলে তাকে অন্য পিঁপড়েরা অনেক সময়ই খাদ্য হিসেবে মুখে করে নিয়ে যায়; কিন্তু এরূপভাবে বিপন্ন হলে এক অন্যকে বড় একটা সাহায্য করতে দেখা যায় না। হয় তারা ব্যক্তিগত বিপদ সম্পর্কে উদাসীন নয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। যাহোক এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনাই লক্ষ করলাম। অপর পিঁপড়েটা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে জলমগ্ন পিঁপড়েটার শুঁড় ধরে তাকে জল থেকে অনেকটা দূর টেনে নিয়ে গেল এবং একটা শুকনো জায়গায় রেখে এক দিকে ছুটে চলে গেল। জলমগ্ন পিঁপড়েটা অনেকক্ষণ সেই স্থানে নির্জীবের মত পড়ে রইলো এবং শরীরের জল শুকাবার পর ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে পা, চোখ, মুখ পরিষ্কার করবার পর ছুটে পালালো। ঘটনাটা তুচ্ছ হলেও এটা যে পিঁপড়ের মতো নিম্নস্তরের প্রাণীর পক্ষে বিশেষ বুদ্ধিবৃত্তি ও সহানুভূতির পরিচায়ক, সে সম্বন্ধে বোধ হয় কেউ দ্বিমত হবেন না।
লাল-পিঁপড়েদের বাসা নির্মাণ, সন্তান পালন, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং খাদ্যসংগ্রহ প্রভৃতি অনেক কিছু অদ্ভুতে ব্যাপার লক্ষ্ করেছি ; কিন্তু সেগুলি কৌতূহলোদ্দীপক হলেও স্বাভাবিক সংস্কারের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় বলেই উল্লেখ করবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যাকে নিছক সংস্কারমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না এরূপ দু-একটা ঘটনার বিষয় বলছি।