প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই অবস্থা সঙিন হয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে আরও অনেক নালসো এসে পোকাটাকে ক্ষুদে-পিঁপড়েদের কবল থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল এবং প্রায় এক ইঞ্চি উপরে শিকারটাকে টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। শিকার হাতছাড়া হয় দেখে ক্ষুদেরা এবার সার বেঁধে দলে দলে অগ্রসর হতে লাগলো। সংখ্যাধিক্যের জোরে পরক্ষণেই তারা পোকাটাকে প্রায় তিন-চার ইঞ্চি নিচে টেনে আনলো। সঙ্গে সঙ্গেই উভয় দলের মধ্যে ‘হাতাহাতি লড়াই’ শুরু হয়ে গেল। সে এক ভীষণ কাণ্ড, এক-একটা লালপিঁপড়েকে প্রায় দশ-বারোটা ক্ষুদে-পিঁপড়ে এক সঙ্গে আক্রমণ করে কাবু করবার চেষ্টা করছিল। পায়ে, শুঁড়ে, চোখে-মুখে সর্বত্র এতগুলি পিঁপড়ে একটা লাল পিঁপড়েকে কামড়ে ধরলে সে আর কতক্ষণ টিকতে পারে ? দু-চারটা মাত্র কালো পিঁপড়েকে ছিন্ন-ভিন্ন করে এক-এক করে লাল-পিঁপড়েরা পিঠের দিকে উল্টোভাবে ধনুকের মত বেঁকে গিয়ে জীবনলীলা শেষ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর লাল-পিঁপড়েরা বেগতিক দেখে শিকার ছেড়ে দিল, কিন্তু লড়াই থামলো না। গাছটার গোড়ার উপর এখানে-সেখানে তুমুল লড়াই চলছিল। অসংখ্য ক্ষুদে-পিঁপড়ের আক্রমণে লাল পিঁপড়েগুলির পরাজয় যে আসন্ন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রইলো না। কিন্তু অনেক সৈন্য ক্ষয়ের পর তারা বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে, এভাবে আর চলবে না। তারা যেন নতুন ‘প্ল্যানে’ অগ্রসর হবার ব্যবস্থা করছিল। এতক্ষণ নালসোরা যুদ্ধ করছিল একক ভাবে, এখানে-সেখানে। কাজেই এক-একটা নালসো ক্ষুদে-পিঁপড়ে অপেক্ষা পাঁচ-সাতগুণ বড় এবং শক্তিশালী হলেও দশ বারোটা ক্ষুদের বিষাক্ত দংশনে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু বরণ করছিল। এবার নালসোরা আক্রমণ ক্ষান্ত করে দলে দলে সে স্থানটায় সমবেত হতে লাগলো। অবশ্য এই সমবেত হওয়াটা খুব সুশৃঙ্খল না হলেও সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল ছিল না। এ অবস্থায় দু-একটি ক্ষুদে পিঁপড়ে দল ছেড়ে তাদের লাইনের নিকট উপস্থিত হওয়া মাত্রই সেগুলিকে ধরে সাঁড়াশির মত ধারালো চোয়ালের সাহায্যে খণ্ড খণ্ড করে ফেলতে লাগলো। এই নতুন কৌশলে ক্ষুদেরা ক্রমশই নিচের দিকে হটতে বাধ্য হচ্ছিল। ইতিমধ্যে এক দল ক্ষুদে-পিঁপড়ে শিকারটাকে টেনে নিয়ে অনেক নিচে চলে গিয়েছিল এবং বাসার ভিতরকার শ্রমিক পিঁপড়েরা গাছের গোড়ার একাংশে চার-পাঁচ ইঞ্চি স্থান জুড়ে প্রায় ১/৪ ইঞ্চি খাড়াই একটা মাটির দেয়াল গেঁথে তুলেছিল। এই জাতীয় পিঁপড়েরা কিন্তু সাধারণত মাটির দেয়াল নির্মাণ করে না। এরা মাটির নিচে গর্তের মধ্যে বিভিন্ন কুঠুরি নির্মাণ করেই বসবাস করে। বাইরে ক্ষুদ্র একটি মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। যাহোক লাল পিঁপড়েদের ধারালো সাঁড়াশি ও বিষাক্ত গ্যাসের আক্রমণে ক্ষুদেরা ক্রমশ হটে গিয়ে সেই নবনির্মিত দেয়ালের আড়ালে আত্মগোপন করে অবস্থান করতে লাগলো। এদিকে শ্রমিকেরা দেয়ালটাকে ক্রমশ উপরের দিকে গেঁথেই তুলছিল। ভিজা মাটির জন্যে দেয়াল গেঁথে তুলতে তাদের বিশেষ সুবিধাই হয়েছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যাপারটা তখন ট্রেঞ্চ লড়াইয়ের আকার ধারণ করলো । দেয়াল গাঁথবার সময় মাঝে মাঝে দু-চারটা শ্রমিক-পিঁপড়েকে নালসোরা ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু তার সংখ্যা খুবই কম। বলা বাহুল্য, দেয়াল গেঁথে অগ্রসর হবার পরে নালসোরা শত্রুপক্ষের আর তেমন কোনও অসুবিধে সৃষ্টি করতে পারে নি। এ পর্যন্ত দেখে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। প্রায় সাড়ে বারোটার সময় ফিরে গিয়ে দেখি — নালসোরা অনেকেই তখন বাসায় ফিরে গেছে। যদিও কিছু লাল-পিঁপড়ে দলছাড়া ভাবে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছিল, তথাপি, তাদের সেই লড়াইয়ের ‘মুড’-টা যেন আর ছিল না। ক্ষুদে পিঁপড়েরা ইতিমধ্যে সুপারি গাছের গোড়াটার অনেকটা স্থান জুড়ে ছয়-সাত ইঞ্চি উপর অবধি লম্বা দেয়াল তুলে গুবরে পোকাটাকে সেই দেয়ালের নিচে ঢেকে ফেলেছে।