পশুজগতের অনেক প্রাণীর শ্রবণশক্তি আমাদের তুলনায় প্রখর, কিন্তু বাদুড়ের কেসটা একেবারেই আলাদা। সে নিজের ডাকের প্রতিধ্বনি শুনে ঠাওর করতে পারে, মক্কেল কত দূরে, কি তার গতি। আলোর দৌলতে আমরা যতটা স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করি, বাদুড় ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে এই প্রতিধ্বনির সাহায্যে হয়ত একটু বেশীই করতে পারে। ছোঁ মেরে পোকা ধরতে পারে নিমেষের মধ্যে, এতটাই নিখুঁত তাদের দিশা-নির্ধারণ ক্ষমতা। শ্রবণ, দৃষ্টি — এই কথাগুলো গুলিয়ে যায় বাদুড়দের কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলে।
এদ্দূর শুনে খোকন নিশ্চই এবার প্রশ্ন করবে — সে তো হলো, কিন্তু একজাতের অনেকগুলো বাদুড় এসে জুটলে তখন ? রামবাদুড় ডাক ছাড়ল আর শ্যামবাদুড় তার প্রতিধ্বনি শুনে বুঝে গেল লক্ষ্য কোথায়, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। শ্যামকে অন্তত নিজের ডাক ফেরত পেতে হবে। কিন্তু শ্যাম বোঝে কি করে কোনটা নিজের ডাক আর কোনটা রামের ? এক জাত হলেও সবার ডাক কি তাহলে আলাদা আলাদা ?
দেখা যায়, ঠিক তা নয়। একটা বাদুড় নিজের ডাকের মাপজোখ — বিভিন্ন কম্পাঙ্কে (frequency) কতটা প্রসার (amplitude) — সেটা পালটাতে পারে যাতে জাতভাইয়ের সাথে তার ডাক ঘেঁটে না যায়। এই নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। একে বিজ্ঞানীদের ভাষায় বলে, ‘jamming avoidance response’। সেলফোনের সিগনাল যেমন জ্যাম করে দিলে সেটা ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যায়, বাদুড়ের-ও সেই দশা। তাই বিবর্তনের সাথে সাথে তাদের জ্যামিং এড়ানোর ক্ষমতাও গজিয়েছে।
এবার প্রশ্ন হলো, স্বেচ্ছায় বাদুড় যখন নিজের ডাক পালটাতে পারে জ্যামিং এড়াতে, তখন উলটোটা হতেই বা বাধা কোথায়? ইচ্ছে করে অন্য বাদুড়ের ডাক ঘেঁটে দিয়ে তাকে শিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজে থাবা বসাতেই বা দোষ কি?
দুই বিজ্ঞানী — Aaron Corcoran ও William Conner — এই প্রশ্নটা তুললেন। একটা বিশেষ প্রজাতির বাদুড় — Mexican free-tailed বাদুড় (T. Brasiliensis) — নিয়ে তাঁরা গবেষণা করছিলেন। এই প্রজাতির বিশেষত্ব হলো: প্রতিধ্বনি-ভিত্তিক দিশা-নির্ধারণ ক্ষমতা আছে এমন প্রজাতির মধ্যে এদের কলোনীতেই বাদুড়সংখ্যা সবথেকে বেশি। তাই বাদুড়দের সামাজিক আচরণগুলি লক্ষ্য করার সুযোগ-ও বেশি।
অন্তত খান পনেরটা আলাদা ধরণের ডাক এই প্রজাতির মধ্যে তাঁরা সনাক্ত করতে পারলেন। তার মধ্যে বিশেষ একটা ডাক নিয়ে আগে পড়াশোনা হয়নি। এর বর্ণচ্ছটার চরিত্র দেখে এর নাম দেওয়া হলো sinFM ডাক। প্রাথমিক কিছু পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা গেল — এই ডাকটা তখনই বার হয় যখন অন্য কোনো বাদুড় খুব দ্রুত একের পর এক ডাক ছাড়ছে। অর্থাৎ শিকারের পেছনে ধাওয়া করছে। এই দ্রুত ডাক ছাড়া কে বলে feeding buzz। বিজ্ঞানীদের মনে প্রশ্ন জাগলো — এই sinFM ডাক-এর উদ্দেশ্য কি? প্রতিযোগী বাদুড়কে চমকে দেওয়া? ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর চেষ্টা? নাকি এই sinFM ডাক প্রতিযোগী বাদুড়ের feeding buzz কে ঘেঁটে দিতে পারে?
অনেকগুলো জিনিস লক্ষ্য করা গেল, যাতে মনে হয় শেষেরটাই। sinFM ডাক আর প্রতিযোগী বাদুড়ের feeding buzz একে অপরের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। যেমন, sinFM ডাকের একটা পুরো চক্কর (cycle) প্রতিযোগী বাদুড়ের ডাক ছাড়া আর প্রতিধ্বনি শোনা, এই সময়টুকুর মধ্যে গুঁজে দেওয়া যায়। তারপর sinFM ডাকের বর্ণচ্ছটার চরিত্র প্রতিযোগী বাদুড়ের ডাক জ্যাম করে দেওয়ার জন্য আদর্শ।
এরপর বিজ্ঞানীরা একটা মজার পরীক্ষা করলেন। sinFM ডাক রেকর্ড করে বাদুড়ের শিকারকালে চালিয়ে দেখলেন কি হয়। দেখা গেল, বাদুড়ের feeding buzz-এ কোনো ফারাক হয়না sinFM ডাক চালালে। অথচ শিকার ধরার সাফল্য কমে যায় প্রায় ৭০ শতাংশ। অর্থাত ওই ডাকে বাদুড় ভয় পায় না, ঘাবড়েও যায় না। ক্রমাগত ডাক ছেড়ে যায়, অথচ প্রতিধ্বনি ঘেঁটে যাওয়ায় শিকার ঠাওর করতে পারে না।
আর একটা পরীক্ষা করলেন বিজ্ঞানীরা। sinFM-এর বদলে একই কম্পাঙ্কের শব্দ এবং সব কম্পাঙ্কের খিচুড়ি একটা কোলাহল-মার্কা শব্দ, এই দুটো চালালেন বাদুড়ের শিকার ভাঙ্গতে। শিকারের সাফল্যে কোনো হেরফের হলো না। অর্থাত sinFM ডাক শুধু চমকে ধ্যানভঙ্গ করে তাই নয়। তাহলে ধ্যানভঙ্গ এতেও হত। শিকার ধরার সাফল্য কমত।
সব মিলিয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন তারা যে Mexican free-tailed প্রজাতির বাদুড় জেনেবুঝে তার জাতভাইয়ের ভাত মারার তোড়জোড় করে। তার সিগনাল জ্যাম করে পারতপক্ষে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধই করে দেয় তাকে। আরো গবেষণার প্রয়োজন। তবে এই সিদ্ধান্ত যদি ঠিক হয়, তাহলে পশুসমাজে এইভাবে প্রতিযোগীর ইন্দ্রিয়ের সাথে ছিনিমিনি খেলার উদাহরণ বোধহয় এই প্রথম।
ছবি: National Geographic