রূপক (বিজ্ঞান): আশীষদা, আড্ডার মূল বিষয়ে ঢোকার আগে ‘আপনার হয়ে ওঠা’ নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন আছে। সেটা হলো, নিজের পড়াশোনা আর কাজের জায়গা হিসাবে বিজ্ঞানের ইতিহাসকে বেছে নিলেন কেন? এর সঙ্গে কি আপনার বেড়ে ওঠা বা তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক আছে?
আশীষ লাহিড়ী: হ্যাঁ, বিষয়টা খুবই আগ্রহজনক এইজন্য যে আমি একটার সঙ্গে অন্যটার কোনো যোগাযোগ দেখতে পাই না! (হাসি) আমি যা কিছু জীবনে করেছি বা হয়েছি তার কোনোটাই হবো বলে খুব কোমর বেঁধে লাগিনি। মানে, ঘটনাচক্রে চলতে চলতে, গড়াতে গড়াতে যা হাতের সামনে এসেছে বা সুযোগ পেয়েছি এবং যেটা মনে হয়েছে কিছুটা পারি অথচ জানিই না ব্যাপারটা কী, তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি এবং সাঁতার কাটতে কাটতে মনে হয়েছে বাহ্ খানিকটা তো সাঁতার কাটতে পারছি! এরম ভাবেই আমার সবকিছু হয়েছে জীবনে।
তবে এই চুয়াত্তর বছর বয়সে এসে ছোটোবেলার কথা চিন্তা করলে বুঝতে পারি যে আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে সর্বত্রই পড়াশোনা করে কেরিয়ার তৈরি করবার যে একটা স্বাভাবিক প্রবণতা সে ব্যাপারটা আমার মধ্যে কখনোই ছিল না। পরে হয়তো আমি রাজনৈতিক কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থেকে সরে থেকেছি, কিন্তু ওই ক্লাস সিক্স-সেভেনে তো সে ব্যাপারটা ছিল না! আমার আজও আমাদের বাড়ির একটা স্ট্যান্ডিং রসিকতার কথা মনে পড়ে…
সেটা কী রকম আমরাও একটু শুনি!
(হাসি) হ্যাঁ, ওই যে পঁচিশ নম্বরের ইতিহাসের প্রশ্ন হতো না, আকবর কী করিয়া তাহার রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন সবিস্তারে লেখো, সে প্রশ্নে আমার উত্তর হতো এক লাইনের, ‘আকবর ছলে বলে কৌশলে তাহার রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন!’; ব্যস শেষ! মাষ্টারমশাই আমায় একটা চড় মেরেছিলেন এবং এক নম্বর দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন “তুই বেসিকালি ঠিকই বলেছিস!” সামহাউ এটা আমাদের বাড়িতে একটা স্ট্যান্ডিং রসিকতা হয়ে ওঠে! এমনও হয়েছে যে ভেবেছি আজকে ইংরেজি পরীক্ষা গিয়ে দেখলাম বাংলা পরীক্ষা! স্কুল, বন্ধু-বান্ধব এসব ভালো লাগলেও পরীক্ষার প্রতি একটা বিতৃষ্ণা ছিল, যার জন্য আমি বাড়িতে মারধোরও খেয়েছি! তবে কোনো কিছুতেই আমার বিশেষ তাপ-উত্তাপ ছিল না। (হাসি)
তবে মাষ্টারমশাইরা বলতেন যে আমার ইংরেজি আর বাংলার হাতটা ভালো, আমি নিজেও বুঝতাম সে কথা। ভাষা দুটোর প্রতি আমার একধরনের অভিনিবেশ ছিল, মোট কথা ভালো লাগতো, কারণ ওগুলো মুখস্তের ব্যাপার নয়।
শৌর্য (বিজ্ঞান): আচ্ছা, বিজ্ঞান সত্তা আর সেই বিজ্ঞানের সামাজিক দিকটাকে অনুবাদের মাধ্যমে আপনার বাংলা ভাষায় নিয়ে আসা, এর মধ্যে আপনার কি কখনও মনে হয়েছিল যে এই দুই সত্তার মধ্যে সত্যিই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে? বলতে চাইছি, আমাদের চারপাশে এইরকম কথাই তো মূলত শোনা যায়। আমরা প্রায় সবাই সে শুনেই বড়ো হয়েছি। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি তো সত্যিই পিপলজ লিটরেচার হয়ে উঠতে পারেনি তাই না? এখানে আর একটা কথা যোগ করি, নিজের মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা করতে গেলে নিজে প্র্যাক্টিসিং সায়েন্টিস্ট হওয়া কতটা জরুরি বলে আপনার মনে হয়?
খুব ভালো প্রশ্ন করেছো। প্রথম কথা হচ্ছে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দ্বন্দ্বটা অনুভব করি না। কারণ আমি নানান দিক থেকেই একটু এক্সেপশান। আমার বরাবরের ঝোঁক সাহিত্যের দিকেই, আমার ইংরেজি পড়ারই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওই বাড়ির আর্থিক সমস্যার কারণে বাবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য জোর করেছিলেন। কাজেই এই ‘অত-এব’ সায়েন্স পড়তে গিয়ে আমার কেরিয়ারের বারোটা বেজে গেল। কিন্তু যেটা হলো, আমার সাহিত্যের দিকের ঝোঁকের সঙ্গে আমার গায়ে একটা বিজ্ঞান-বিজ্ঞান গন্ধ লেগে গিয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তো সেটা হয় না। যে ইংরেজি পড়ছে বা সাহিত্য পড়ছে সে তো সাহিত্যই পড়ে। তার ঝোঁকটা সেইদিকেই। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তাই।
কাজেই প্রশ্নটা হচ্ছে, বিজ্ঞান নিয়ে বাংলায় আমি কি ধরনের লেখা লিখবো? আমি খুব পরিষ্কার করেই বলতে চাই যে বিজ্ঞান-চর্চা আর বিজ্ঞান নিয়ে লেখালিখি দুটো আলাদা জিনিস। প্রথমটা বাংলায় কোনোদিনই বিশেষ হয়নি, হবেও না। সত্যেন্দ্রনাথ বসু নিজে এতবার একই কথা বলেও কি নিজে একটা পেপারও বাংলায় লিখেছেন? তাঁর কোনো ছাত্রও কি লিখেছে? কারণ লেখা যায় না। এইখানে আবার ইতিহাস চলে আসে। আধুনিক জগতের সঙ্গে বাংলা ভাষার যে সম্পর্ক, ব্রিটিশরা ইচ্ছে করেই সেটাকে এত বেশি লিটরেচার ওরিয়েন্টেড করে রেখেছিল যে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বিজ্ঞানের জগতে যাবার জন্যে বাঙালিদের একটু এক্সট্রা চেষ্টা করতে হয়েছে। ফলে যেটা হয়েছে, যে মানুষ সাহিত্যের চর্চা করেন তিনি বিজ্ঞান দেখলে খানিকটা এড়িয়েই গেছেন বা ভয়ই পেয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে— ও বাবা, ওটাতো বিজ্ঞান, ওটা আমার জিনিস নয়। এ্যান্ড ভাইসি-ভার্সা। ফলে একটা আড়ির সম্পর্ক যে তৈরি হয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এখনও আমরা কথায় কথায় বলি, দেখুন উনি ফিসিক্সের ছাত্র কিন্তু কী সুন্দর কবিতা লেখেন। এই তোমাদের নিয়েই লোকে বলবে যে দেখুন একজন সায়েন্টিস্ট সে প্রবন্ধ লিখছে বাংলায়। কেন যে বলে আমি জানি না! কিন্তু এই কথার মধ্যে রিয়েলিটির পার্ট হচ্ছে, ইংরেজি ভালো করে না জানলে, ইংরেজিতে বিজ্ঞান চর্চা না করলে, বিজ্ঞান এগোবে না। এই যেমন ধরো, আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও তো ফ্রেঞ্চ একটা মেজর ভাষা ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তা আজ কি সত্যি? আমি স্ট্যাটিসটিক্স দেখছিলাম। পৃথিবীতে যত ইম্পরট্যান্ট পেপার লেখা হয় তার 70 শতাংশের বেশি ইংরেজিতে বেরোয়। হ্যাঁ এখনও জার্মান বা ফরাসিতে নিশ্চয়ই বেরোয়, কিন্তু ক্রমশ তার সংখ্যাটা কমছে। এবং আরো বেশি করে আমেরিকার জন্যে।
আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা আরো বড়ো। ইউরোপ বা আমেরিকায় সায়েন্স মাথার উপর চাপিয়ে দেওয়া একটা জিনিস নয়। সেটা তাদের কালচারের একটা অঙ্গ। আর আমাদের এখানে? আমার বাবা আমায় বলেছিলেন, “ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় সায়েন্সে ভালো নম্বর পেয়েছিস, এটার মূল্য বুঝিস।” কাজেই আমরা যখন বিজ্ঞান চর্চা করছি আমাদের যেন বলেই দেওয়া হচ্ছে যে সেটা বাঁধা-পথের বাইরের একটা জিনিস। বিজ্ঞান আমাদের সাধারণ সংস্কৃতি মানে সিনেমা-থিয়েটার-গল্প-কবিতার থেকে আলাদা। এরপর যদি উলটো জিনিসটা আনতে হয়, মানে একজন বিজ্ঞানের মানুষ যদি বাংলায় কিছু লিখবেন বলে ভাবেন, ততদিনে তিনি ওই কমিউনিকেট করার প্রসেসটা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছেন। কারণ নিজের নিজের জায়গায় অসাধারণ কাজ করা সত্ত্বেও সেটা ইংরেজিতে করে এসেছেন। বাংলাতেও তিনি কথাগুলো ইংরেজি থেকে বাংলা করে লিখছেন। অর্থাৎ ভাবছেন ইংরেজিতে। এবং সেটাই স্বাভাবিক!
মানে সায়েন্সের টেকনিকাল টার্মগুলোর কথা বলছেন?
না, আমি একেবারেই শুধু টেকনিকাল টার্মসের কথা বলছি না। বাক্যের গঠন বা স্ট্রাকচারও ইংরেজি থেকে যাচ্ছে। এবং সেই ধরনের বাক্য কোনো অবস্থাতেই মানুষের মনে ঢুকতে পারবে না।
কাজেই আমার জীবনে যেটা বাই-চান্স ঘটে গেছে সেটাকে যদি একটা স্ট্যান্ডার্ড রূপ দেওয়া যায়, মানে একজন সাহিত্যের ছাত্রকে যদি বোঝানো যায় যে সে সাহিত্য পড়ছে মানে বিজ্ঞান বা টেকনোলজি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না, মানে ওগুলো ছাড়া তোমার সাহিত্যও অচল, তাহলে একটা কাজের কাজ হতে পারে। ভেবে দেখো, আগেকার দিনে একটা পত্রিকা বার করতে হলে লেটার-প্রেসে হা-পিত্যেশ করে বসে থাকতে হতো। আর আজ কত সহজেই না ছাপা হয়ে যায়। এটা তো শুধুমাত্র টেকনোলজির জন্যেই সম্ভব, তাই না? কাজেই আমাদের স্কুলের পাঠ্যক্রমে, নিচু ক্লাস থেকেই, সাহিত্য যে টেকনোলজি নিরপেক্ষ নয় সেটা যদি বোঝানো যায় এবং এই জায়গায় অক্ষয় দত্ত বা রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং অফ কোর্স রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষদের যদি ঠিকভাবে আনা যায় তাহলে কাজ হবে বলেই আমার মনে হয়। তুমি ভেবে দেখো অক্ষয় দত্ত বা রবীন্দ্রনাথের তো কোনো ডিগ্রী ছিল না, তাই না? সেক্ষেত্রে বিশ্বপরিচয় কীভাবে লেখা হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো যদি তোলা যায় তাহলে বিজ্ঞানে ইম্মার্সড একজন ছাত্রের কখনও মনে হবে না যে সে চাইলেও কখনও বাংলা লিখতে পারবে না। এখন সেই সমস্যাটা হচ্ছে।
আরও একটা ব্যাপার এখানে বলা দরকার। এই আইটি আসার পর ব্যাপারটা আরো বেড়েছে। একটা সত্যি গল্প বলি। একটি মেয়ে কোলাঘাট এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রী ছিল, ওর নিজের মুখেই শোনা। ক্যাম্পাসিং-এর বাকি সব কিছু হয়ে যাওয়ার পর ও পড়াশোনা ছাড়া আর কী করে সেটা জানতে চেয়েছে ইন্টারভিউয়ার। তো ও বলেছে যে, বাড়িতে গানবাজনার আবহাওয়া আছে তাই একটু-আধটু শিখি আর তাছাড়া বই পড়ি। যারা ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন, বাঙালিই সব, তাদের একজন জানতে চাওয়ায় ও বলেছে আমি শিবরাম চক্রবর্তী পড়ি। এই কথা শুনে প্রায় সকলেরই মুখটা না বাংলার পাঁচের মতো হয়ে গেল, এমনকি একজন তো বলেই ফেললেন— “তুমি একটা কেরিয়ার গড়তে চলেছো আইটিতে, আর তুমি শিবরাম চক্রবর্তী পড়ো?” এই জিনিসটাকে সচেতনভাবে ভেঙে দেওয়া প্রয়োজন। শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে কম্পিউটার এঞ্জিনিয়ারিং-এর কোনো শত্রুতা নেই।
এইটা দারুণ একটা জরুরি কথা বলেছেন!
হ্যাঁ আমারো মনে হয় এইটা আমাদের আলোচনা থেকে উঠে আসা সব থেকে জরুরি কথা!
(হাসি) কাজেই সায়েন্স আর আর্টস যে তেমন আলাদা কোনো ব্যাপার নয়, কারো এটা ভালো লাগে তো কারো ওটা, এই বোধটা যদি একেবারে নিচু ক্লাস থেকে গড়ে তোলা যায়, এবং সব থেকে বড়ো কথা যেটা— ‘যারা সায়েন্স পরে তারা খুব সুপিরিয়র’ এই মিথটা যদি ভাঙা যায়, তাহলে একটা কাজের কাজ হবে। এই গেল এক নম্বর। আর দু-নম্বর, যেটা খানিকটা কন্ট্রাডিকটারি শোনাতে পারে (হাসি), সেটা হচ্ছে, আমরা ভাষাকে বাদ দিয়ে মিডিয়ামের উপর বড্ডো জোর দিয়েছি। আমি তো নিজে বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি, আমার তো কই ইংরেজিতে কথা বলতে কোনোদিন কোথাও কোনো অসুবিধা হয়নি! কাজেই মিডিয়ামটা বড়ো কথা নয়, ভাষাটা বড়ো কথা। আমার মতে মিডিয়ামটা হবে মাতৃভাষা এবং ইংরেজিটা আরো ভালো করে শেখাতে হবে। ইংরেজি ভাষার মান এখন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল হলে হবে কী, আমরা আমাদের বাংলা ইস্কুলে যে কোয়ালিটির ইংরেজি শিখতাম সেটা এখনকার ছেলেমেয়েদের সাধারণত শেখানো হয় না।
সুতরাং, বাংলা ভাষার সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধটা প্রথমত ঘোচাতে হবে, এবং তার সঙ্গে ইংরেজিটা ভালো করে শেখালে যেটা হবে তা হলো এই— যে কোনো ছাত্র একটা ইংরেজি গল্পের বই বা ইংরেজিতে লেখা একটা পপুলার সায়েন্সের বই অনেক চটজলদি পড়তে পারবে। এই দুইয়ে মিলে বাংলার প্রতি অনীহা এবং ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞানের বইয়ের দুর্বোধ্যতা দুইই এ্যাড্রেস করা যায়। আরে তুমি বাংলার ছাত্র না হতেই পারো কিন্তু তুমি বাঙালি তো?
আচ্ছা এই গোটা সমস্যাটা মফস্সল বা ছোটো শহরের তুলনায় কলকাতা বা বড়ো শহরে অনেকাংশে বেশি এইরকম আপনার কখনও মনে হয়েছে কি?
দেখো মফস্সলে একটানা থাকার অভিজ্ঞতা আমার তেমন একটা নেই। আমি একেবারেই বর্ন এ্যান্ড ব্রট-আপ ইন কলকাতা। তবে অল্পস্বল্প অভিজ্ঞতায় মফস্সলের সমস্যাটা আমার একটু অন্যরকম মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে কলকাতার ছেলে-মেয়েদের তুলনায় মফস্সলের ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজির দুর্বলতাটা বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেখানো হয়। এবং তারা নিজেরাও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। ফলে একটা সময়ে তারা খুব র্যাপিডলি মেক-আপ করতে চায়। এটা আমি একাধিকবার লক্ষ্য করেছি। খুব কম্পিটিটিভ হয়ে পড়তে দেখেছি অনেককেই। একদিক থেকে নিজের কেরিয়ারের ক্ষেত্রে এটা খুব ভালো জিনিস। কিন্তু ব্যাপার হলোভাষা ব্যাপারটা খুব দ্রুত আয়ত্তে আনা যায় না। ব্যক্তিগতভাবে সিপ বাই সিপ যে ভাষা আমার মধ্যে ঢুকেছে সেই ভাষাটা নিয়ে আমি কিছু ক্রিয়েটিভ কাজ করে উঠতে পারি বলে আমার মনে হয়েছে। কিন্তু ওই পদ্ধতিতে ক্রিয়েটিভ কিছু করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। ফলতো এটা করতে গিয়ে মফস্সলের অনেকেই বাংলার উপর দখলটাও হারিয়ে ফেলেছেন। কাজেই এই অতিরিক্ত দ্রুততা বা পেস খুব ভালো জিনিস বলে আমি মনে করি না, বিশেষ করে ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে।
আরেকটা গল্প বলি। গতকাল সাহিত্য সংসদে গিয়েছিলাম। ওঁরা তো 50-60 বছর ধরে ডিকশনারি করে আসছেন। তাই গত পনেরো বছরে কীভাবে ডিকশনারির সেল কমেছে তার একটা হিসেব দেখাচ্ছিলেন। ভাবো, বলছেন— যে সুবোধ সেনগুপ্তর এডিট করা ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারির প্রিন্ট অর্ডার আগে বছরে 50000 কপি ছিল সেটা এখন সারা বছরে 15000-এর বেশি ওঁরা ছাপছেন না। কেন? ওই প্রযুক্তি। আজকাল নিমেষের মধ্যে একটা শব্দের মানে দরকার হলে মোবাইলেই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে একটা ডিকশনারি দেখলে আমরা যে সেই নির্দিষ্ট শব্দ ছাড়াও তার ভাষাগত নানান আনুষঙ্গিক দিকের ব্যাপারে জানতে পারছি সেটা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই কম্পিউটার আমায় দিতে পারছে না। এই যে একটা শব্দের সঙ্গে অন্য অনেকগুলো শব্দের এ্যাসোসিয়েশান সেটাও পাচ্ছি না। ভাষা ব্যাপারটাকে এইভাবে এবং নানান ভাবে কম গুরুত্ব দেওয়াটা বাংলায় বিজ্ঞান রচনাকে এ্যাফেক্ট করেছে সেটা আমার কেবলই মনে হয়। আমাদের সময়েও ‘বাংলা শিখে কেউ চাকরি পাবে না’ কথাটা চালু ছিল, কিন্তু তা বলে বাংলাকে আমরা কখনো ছোটো করতাম না। আমাদের উলটে বলা হয়েছে যে বাংলা খুব উচ্চ মানের ভাষা। বাংলা যারা পড়ে তারা সেইরকম মেধার লোক। এখন ব্যাপারটা উলটো হয়ে গেছে।
এর ফলে বাংলায় সিরিয়াস রাইটিং-এর জায়গাটা মার খেয়ে যাচ্ছে।
এখানে আরো একটা কথা বলি। বিজ্ঞানের লেখা জনপ্রিয় না হওয়ার পিছনে হিউমারের অভাবটাও একটা প্রধান কারণ। এবং শুধু বিজ্ঞান নয়, যে কোনো লেখাতেই একটা চাপা হিউমার যদি না থাকে সে লেখা কোনোদিনই পাঠককে টানতে পারে না। দু-নম্বর ব্যাপার হলো, বিজ্ঞান মানেই একটা ভারী বিষয়— এই ইনহিবিশানটা থেকে যাওয়ার কারণে তা নিয়ে হিউমার করার কথাটাও বিশেষ কেউ ভাবছেন না। আর তিন নম্বর হচ্ছে, আমরা যথেষ্ট ভালো বাংলা জানিই না। একটা রসিকতা বা পান্ করতে হলে সেটা খুব দরকার। যেমন ধরো রাজশেখর বসু এই কথাটা ওমুক ভাবে বলেছেন, আমি সেই কথাটাকে একটু অন্যভাবে খেলাতে চাইলাম, কিন্তু আমি তো রাজশেখর বসু পড়িই না, তো খেলাবো কী করে? আমি তো জানিই না ত্রৈলোক্যনাথ কে? রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর লাইনে লাইনে যে উইট রয়েছে, যদিও উনি সাধু ভাষায় লিখতেন…
রাজশেখর বসুও তো পরের দিকে আর সাধু ভাষায় লেখেননি!
সেই বলছি! অথচ প্রতিটা শব্দের মধ্যে তাঁর রসিকতা তাঁর উইট সারাক্ষণ পাঠককে টেনে নিচ্ছে। কাজেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটাকে অবশ্যই আনতে হবে। আর সেটা আনার প্রাক-শর্তই হলো প্রথমত বাংলা ভাষাটাকে ভালো ভাবে জানতে হবে। অনেক বয়স্ক বিজ্ঞানীকে আমি চিনি যাঁদের নিজেদের বিষয়ে খুব ভালো কাজ আছে, তাঁদের হঠাৎ বয়সে পৌঁছে মনে হলো, এবার বাংলা ভাষার জন্য কিছু করি। যেন তাঁরা বাংলা ভাষাকে কৃতার্থ করে দিচ্ছেন! তিনি কোনো টপিক নিয়ে লেখার আগে সে বিষয়ে আগে বাংলায় কী কাজ হয়েছে একবার খোঁজও নিচ্ছেন না! তাঁর ধারণা তিনিই ওই কাজটা ভূ-ভারতে এই প্রথম বাংলায় করছেন! এবং এটা করতে গিয়ে, বাংলা ভাষায় তাঁর দীর্ঘ অনুশীলনের অভাবের ফলে কাজটা যা দাঁড়াচ্ছে তা আসলে ইংরেজির প্রায় আক্ষরিক অক্ষম অনুবাদ। এই ধরনের বিজ্ঞান রচনা কিন্তু মূলত অনুবাদ, কোনোটা বলে, কোনোটা না-বলে। ইংরেজি হোক, হিন্দি হোক, ফরাসি হোক, বাংলা হোক, সব ভাষারই একটা ছন্দ আছে তো? বিজ্ঞান বা অন্য যে কোনো বিষয়ে লেখার ক্ষেত্রেই সেই ছন্দটা ধরে রাখতে না পারলে সে লেখা পাঠককে টানবে না। আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডবল ডিসএ্যাডভান্টেজ হলো, এই যে সেখানে প্রিসিশান ইস এ মাস্ট! কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্যিই এমন বিষয় বাংলায় আনতে হয় যেটা একেবারেই বাংলায় কেউ কোনোদিন লেখেনি। বিজ্ঞানে তো সত্যি সত্যিই হামেশাই এমনটা হচ্ছে। সেই রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন যে আমাদের পথে চলতেও হবে আবার পথ বানাতেও হবে। আমাদের অবস্থাটা খানিকটা সেইরকম। সঙ্গে যেন স্টিম রোলার রাখতে হবে। আমি এখান থেকে শ্যামবাজার যাবো, আমায় পথটা বানিয়ে তারপর যেতে হবে! এটা তো হয় না আসলে!
কিন্তু যারা লিখছেন বা পড়ছেন তাঁরা তাহলে এই খটোমটো জায়গাগুলোকে এ্যাপ্রোচ করবেন কীভাবে? কিম্বা আপনি যে ইতিহাস চেতনার কথা বললেন সেই জায়গা থেকে কী ধরনের পড়াশোনা করলে এই ধরনের সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করায় সুবিধা হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
আমার ইদানীং খুব মনে হয় যে এই কন্টেক্সটে বিজ্ঞানের ইতিহাস ব্যাপারটা খুব জরুরি। একটা উদাহরণ দিই। ধরো রাজশেখর বা রামেন্দ্রসুন্দর যে সময়ে লিখছেন সে সময়কার আধুনিক সাবজেক্ট কী কী? রামেন্দ্রসুন্দর 1919-এ মারা গেছেন। 1916 সালে জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বের হয়। রামেন্দ্রসুন্দর সে বিষয়ে একটা অক্ষরও লেখেননি। কেন লেখেননি? এগুলো বিজ্ঞানের ইতিহাসের প্রশ্ন কিন্তু। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। শ্যামল সেনগুপ্ত এই প্রশ্ন তুলেছেন যে— তিনি ফিলোসফিকালি ব্যাপারটা মানতে পারেননি বলেই কি লেখেননি? নাকি তখনও পর্যন্ত নিউটোনিয়ান মেকানিক্সকে এ্যাবসোলিউট বলে প্রচার করে আসা বাংলার বিজ্ঞান রচনা কীভাবে হঠাৎ করে ‘স্পেস ব্যাপারটাই বেঁকে যায়’ বলতে পারে তা বুঝে উঠতে পারেননি? ইন ফ্যাক্ট ইউরোপ আমেরিকাতেও এই নিয়ে প্রচুর তর্ক হয়েছে। নিকোলা টেসলার মতো লোক বলেছিলেন যে আমাকে কেটে ফেললেও আমি বিশ্বাস করতে পারবো না — এ কী রকমের তত্ত্ব যা বলে যে স্পেস ব্যাপারটাই বেঁকে যায়? (হাসি) অথচ ওই একই সময়ে অন্য অনেক নতুন জিনিস নিয়ে কিন্তু রামেন্দ্রসুন্দর দিব্যি ট্যাকল করছেন।
অন্যদিকে জগদীশচন্দ্র বসুর কথা ভাবো। অসাধারণ বাংলা লেখা। উনি তড়িৎ-চুম্বক তরঙ্গ বা ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক রে না বলে অদৃশ্য-আলো বলছেন! অদৃশ্য-আলো! মানে এটাও আলো, কিন্তু অদৃশ্য! (হাসি) এখানে কিন্তু একটা কনসেপ্ট পরিষ্কার ভাবে চলে এলো। তার মানে একটা নতুন ধারণাকে মানুষের জানা কনসেপ্টের উপর দাঁড় করিয়ে ডিল করছেন। কাজেই এই ধরনের এ্যাপ্রোচ যদি আমরা নিতে পারি…যদিও সেটা সব সময় সম্ভব হয় না।
আমিও ঠিক এই কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম।
হ্যাঁ সেসব ক্ষেত্রে বিষয়টাকে সরাসরি আনতে হবে। কারণ অনেক জিনিসই যখন প্রথম চালু করা হচ্ছে তখন খটোমটো থাকে। যেমন ধরো তেজস্ক্রিয় শব্দটা নিয়ে একসময় প্রচুর আপত্তি ছিল। আজ তো হরদম বলা হচ্ছে। আমি নিজে বার্নাল অনুবাদের সময় তেজস্ক্রিয়তা না বলে তেজস্ক্রিয়া লিখেছিলাম। আমাদের অভিজিৎ, মানে অভিজিৎ লাহিড়ীকে জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল হ্যাঁ দিব্যি চলে। কিন্তু যেহেতু টেক্সট বইতে বাচ্চারা পড়েনি ওইজন্য চলবে না। যেমন রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয়ে এমন অনেক কিছু নতুন চালু করেছিলেন যেগুলো চলেনি। তার মধ্যে আবার অনেকগুলো ভালোও নয়— যেমন বেগনি পারের আলো (আলট্রা-ভায়োলেট)। ওটা সায়েন্টিফিক দিক থেকে ভালো হলেও শুনতে মোটেই ভালো লাগে না। আবার অতি-বেগুনি বললেও সেটা নিয়ে তাত্ত্বিক সমস্যা আছে! আলট্রা কি সত্যিই অতি? এই যে আগ্নেয়গিরি কথাটা আমরা ব্যবহার করি এটা অক্ষয় দত্তর করা বাংলা। উনি মারা যাওয়ার পর জিওলজিস্ট প্রমথনাথ বোস আপত্তি করেছিলেন। উনি নিজে যেহেতু জিওলজিস্ট, ওঁর যুক্তি ছিল যে— এটা তো সবসময় গিরি নয়, অনেক ক্ষেত্রেই ভলক্যানো তো গহ্বর। আর অক্ষয় দত্ত লাভাকে যে ভস্ম বলেছিলেন সেক্ষেত্রেও প্রমথবাবু আপত্তি করেন। বলেছিলেন ভস্ম বলতে তো আমরা ধোঁয়া জাতীয় জিনিস বুঝি, এটাতো চূর্ণ। এইখানেই সেই প্রিসিশানের কথাটা চলে আসে। তা সত্ত্বেও আগ্নেয়গিরি দাঁড়িয়ে গেল। তার মানে ভাষার শ্রুতিমাধুর্যের একটা ব্যাপার আছে। আর বার বার ব্যবহার করতে করতেও খটোমটো ভাবটা চলে যায়। মাধ্যাকর্ষণ বেশ কঠিন একটা বাংলা তো? আমরা এতবার ব্যবহার করেছি বলে তার খটোমটো ভাবটা চলে গেছে। আবার এই অক্ষয় দত্তই সেন্ট্রিপেটালকে বলেছিলেন কেন্দ্রাপসরণী! আজ ওটা শুনলে কেউ মানবে না। আমার কথা হচ্ছে এই ক্ষেত্রে সেন্ট্রিপেটাল ব্যবহার করলে কী এসে গেল?
আরেকটা মজার গল্প বলি শোনো। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির সঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর হৃদ্যতা যেমন ছিল তেমনই তর্ক বিতর্কও খুব হতো। তো এক জায়গায় যোগেশবাবু লিখছেন যে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ক্লোরিনের বাংলা পরিভাষা করেছিলেন ‘হরিণ’। আমার শুনে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। তবে ব্যাপারটা শুনতে যতটা হাস্যকর ততটা ঠিক নয়, ক্লোরিনের সবুজ রঙ থেকে উনি নামটা ভেবেছিলেন। হরিত — মানে সবুজ। যাই হোক, এই অবধিও বোঝা গেল। এরপর ক্লোরাস-এ্যানহাইড্রাইডের বাংলা উনি করলেন দগ্ধ-হরিণ! (হাসি) ওই এ্যানহাইড্রাস থেকে দগ্ধ নিয়েছিলেন উনি। গরম করে জল উবিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ্যাবসার্ড! এই জিনিস কখনও চলবে না। এই ব্যাপারটাকেই সমালোচনা করেন যোগেশচন্দ্র এবং পরে রামেন্দ্রসুন্দর সেটা মেনেও নেন। কাজেই এই ধরনের শব্দের ক্ষেত্রে মূল ইংরেজিটা ব্যবহার করে আমরা যদি বাংলা গদ্যের শৈলীটা ঠিক রাখি তাহলে অর্ধেক সমস্যা ওইখানে মিটে যাবে। পরিভাষার কথা ভুলে যান, যে ভাষায় কথা বলি গদ্যের স্ট্রাকচারটা তার মতো রাখলেই হলো।
আর যোগেশ বিদ্যানিধি খুব সুন্দর একটা কথা বলেছিলেন, উনি বলেছিলেন যে যখনই ইউরোপে নতুন কোনো আবিষ্কার হলো অমনি এখানকার বাঙালি পণ্ডিতরা উঠেপড়ে তার একটা বাংলা করতে লেগে গেল। (হাসি) উনি ইউরেনাসের উদাহরণ দিচ্ছেন। অনেকেই সে সময় বলেছিলেন বরুণের সঙ্গে এর মিল আছে! মানে আমাদের মিথোলজির বরুণ দেব! এবং শুধু তাই নয়! এই নিয়ে নাকি পাতার পর পাতা প্রবন্ধও বেরিয়েছিল! উনি বলছেন, আসল সমস্যা হলো আমরা তো বিজ্ঞানটা চর্চা করছি না, আমরা ধরেই নিচ্ছি যে বিজ্ঞানটা ইউরোপের লোকেরাই চর্চা করবে, আবিষ্কার-টাবিষ্কার ওরা করবে, আমরা শুধু শব্দটা খুঁজে বার করে বলবো— কিরম দিলাম! এই এ্যাপ্রোচ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার! লেট সায়েন্স বি আওয়ার সাবজেক্ট! সায়েন্সের কোনো দেশ নেই! কাজেই ইউরেনাসকে ইউরেনাস বললে কোনো সমস্যা নেই। জিনের বাংলা বংশাণু করা হয়েছিল। খুব ভালো বাংলা! কিন্তু চলেনি। কারণ জিন শব্দটা উচ্চারণ করা সহজ, মনে রাখাও সহজ। আর তাছাড়া জিনও তো ইংরেজি শব্দ নয়। তা ইংরেজ বা আমেরিকানরা যখন ব্যবহার করছে তখন আমাদেরই বা সমস্যা কোথায়? এখানে শব্দ নয় বিজ্ঞানটা ইমপর্ট্যান্ট! আর এইখান থেকেই একটা অন্য প্রশ্ন উঠে পড়ে…ওয়াট ইস সায়েন্স?
আপনি কি বিজ্ঞানের দর্শনের কথা বলছেন?
হ্যাঁ। এটা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা জিরো। বিজ্ঞানের বিরাট উন্নতি বলতে আমরা হাত তুলে স্মার্টফোন দেখিয়ে দিই। কিন্তু সেটা তো টেকনোলজি! এর পিছনে যেটা আছে সেটা বিজ্ঞান। সেই বিজ্ঞানটা না থাকলে এই ফোনটা আসতেই পারতো না। সায়েন্স এ্যান্ড টেকনলোজি বলা মানেই কিন্তু সায়েন্স ইস ইকুয়াল টু টেকনোলজি হয়ে যাচ্ছে না। এটা আমাদের সময়ের একটা বড়ো সমস্যার জায়গা। সায়েন্স মানে প্রিন্সিপল অফ ডুইং থিংস, আর টেকনোলজি ইস ওয়াট উই ডু উইথ দোস প্রিনসিপলস! সে কারণেই ইতিহাসের কথা এসে যায়। জগদীশচন্দ্র বোস, প্রফুল্লচন্দ্র রায় সকলেই খাঁটি বাঙালি, কিন্তু তাঁরা কতগুলো ভাষা জানতেন! জগদীশ বোসের হাইনরিজ হার্টজকে টপকে 5-6 মিলিমিটার তরঙ্গের আবিষ্কারটা কি পরিষ্কার বাংলায় লেখা আছে বলোতো? আমাদের মুশকিলটা হয়ে গেছে যে আমরা আমাদের নিজেদের ভাষাটাই শিখছি না। ফলে যখন আমাদের সদিচ্ছা জাগছে, তখন আমরা বুঝতে পারছি যে উই আর ইনকেপেবল।
কিন্তু এই সমস্ত সমস্যাগুলোকেই একভাবে এ্যাড্রেস করা যায় যদি স্কুলে, এই ধরো ক্লাস এইট-নাইন থেকে, বিজ্ঞানের ইতিহাসকে পাঠ্য করা হয়। এই যে হঠাৎ করে একদিন নিউটন আপেল পড়া দেখলেন আর মাধ্যাকর্ষণ বুঝে গেলেন, ব্যাপারটা যে একেবারেই তা নয়, এই প্রক্রিয়াটা আমরা একদম বুঝি না। মানে হাউ সায়েন্স ওয়ার্ক্স — সে সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। বিজ্ঞানীরা ল্যাবের অভ্যন্তরে ঠিক কী করেন সে সম্বন্ধে সাধারণ পাঠকের কোনো ধারণাই নেই। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের ইতিহাসটা চর্চা করলে এই বড়ো সমস্যার সমাধান হতে পারে।
আমাদের এই কথার মাঝেই একটা জরুরি কমেন্ট এসেছে, সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক। অর্ণব রায় লিখছেন, “বিজ্ঞানের লোকেরা সাহিত্যকে অবহেলা করে। এটা বাঙালির সংস্কৃতিতে হয়েছে এখন। আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার, বাংলায় কিছু লেখালেখি করি। আপনার বই পড়েছি, আপনার সঙ্গে কয়েক বছর আগে বইমেলায় আলাপও হয়েছিল। যথার্থ বলেছেন ইংরেজি মিডিয়াম নিয়ে। বাংলা সাহিত্য বন্ধ হয়ে যাবে কি? যে হারে ইংরেজি মিডিয়ামের পড়ুয়ারা বাংলাকে হেলাফেলা করছে। এর বদল কীভাবে সম্ভব? সাহিত্য না পড়লে লেখার সৃজনশীলতা আসবে কী করে? বিজ্ঞানও আসলে সাহিত্যের মতোই এক সংস্কৃতি- তা বোঝাবে কে?” উনি বোধহয় দায়িত্ববোধের জায়গাটা ধরতে চাইছেন।
খুব সুন্দর বলেছেন। বিজ্ঞানও আসলে একটা সংস্কৃতি! এই ব্যাপারটাই আমাদের মধ্যে মিসিং। আমরা বিজ্ঞানকে কেরিয়ার হিসাবে দেখি, উপরে ওঠার সোপান হিসাবে দেখি, তার অর্থনৈতিক দিকটার কথা মনে রাখি, কিন্তু বিজ্ঞান যে একটা সংস্কৃতি এইটা মনে রাখি না। মানে রাখতে দেওয়া হয় না। অর্ণববাবু খুব ভাইটাল কথাটা বলেছেন এবং আমার মনে হয় এই জায়গাটাকে আলাদা করে এ্যাড্রেস করা দরকার। আমি আমার মতো করে কিছু কিছু জায়গায় চেষ্টা করি। ‘অন্য কোনো সাধনার ফল’ বইটায় আমি এইটা আনার চেষ্টা করেছিলাম। বলতে চেয়েছিলাম আমরা সায়েন্স পড়ি কিন্তু বিজ্ঞান পড়ি না। অর্থাৎ সায়েন্স আমার কেরিয়ারের সোপান। তাকে আমি আমার জীবন-দর্শনের দিকে গ্রহণ করছি না। ফলে ল্যাবোরেটরিতে হয়তো আমি কোনো উচ্চমানের কাজ করছি, কিন্তু ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসেই হয়তো কোনো সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়লাম। যেমন ধরা যাক কোনো জ্যোতিষীর কাছে চলে গেলাম! ফলে আমাদের এক কাজের সঙ্গে অন্যের যে কোনো সাযুজ্য থাকছে না সে সম্বন্ধে অনেক সময়েই আমরা খুব ওয়াকিবহাল নই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডিফেন্ড করার চেষ্টাও করি। বিজ্ঞান যিনি পড়ছেন, তিনি যদি ধর্মপ্রাণও হন, তিনি তাঁর চিন্তাকে র্যাশনাল করবেন এইটুকু তো আমি আশা করবো? তাঁর কথায় যুক্তির ভুল থাকলে আমি তার সঙ্গে তর্ক করবো! কিন্তু কোনোকিছুই না করে ঘাড়ে চাপানো কুসংস্কারকে— এটাই নিয়ম বলে মেনে নেওয়াটাকে তো বিজ্ঞানের কথা বলা যায় না। অন্যদেশে ধর্ম বা কুসংস্কার নেই আমি বলতে চাইছি না, তবে এই জায়গাটা আমাদের দেশে র্যাম্প্যান্ট! এইটা কেন হবে? মানে আমার বাবাও ল্যাবে ঢোকার আগে শীতলা মন্দিরে পুজো দিতেন তাই আমিও দিই, এইটা তো কোনো র্যাশনাল কথা হলো না! এইখান থেকে যে করে হোক বেরোনো দরকার। প্রয়োজনে এর জন্য আলাদা করে আন্দোলন হওয়া প্রয়োজন বলেই আমি মনে করি। এবং এটা করতে গেলে, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয়ের শুরুতে যে কথাটা বলেছিলেন, সেই বিজ্ঞানের রস উপভোগের কথাটা বলা দরকার। সাংস্কৃতিক ভাবে এমনকি দার্শনিক ভাবেও এর গুরুত্ব বোঝার প্রবণতাটা আমাদের এখানে কোথায়?
অর্ণব বাবুর কথায় ফিরে আরেকটা কথা না বলে পারছি না। বুক ফেটে গেলেও মানতে হবে যে আমাদের এখানের অধিকাংশ বাংলা মিডিয়াম স্কুল অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে। মানে শুধু বাংলা পড়ানো নিয়ে বলছি না, সেখানে যে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, সেখানে যে ইতিহাস পড়ানো হয়, যারা পড়ান, যেভাবে পড়ান, ইট ইস এ ডিসগ্রেস! এইখানেই ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ব্যাবসা করার ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিচ্ছে এইসব বাংলা মিডিয়াম স্কুল!
আচ্ছা বিজ্ঞানের রসাস্বাদন নিয়ে যে কথাটা হচ্ছিলো সে প্রসঙ্গে আমার একটা জিনিস খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে। আগের প্রশ্নটা ছিল মূলত লেখকের দিক থেকে, আর আমার প্রশ্নটা পাঠকের দিক থেকে। আমরা যখন কোনো বিজ্ঞান সাহিত্য পড়ি তখন অনেক সময়তেই হয় যে কোনো খটোমটো লেখা হলে আমাদের নিজেদের আগ্রহটা হারিয়ে যায়। তাছাড়া বাংলার কল্পবিজ্ঞানে যত পরিমাণ বিজ্ঞান থাকে তার তুলনায় বিদেশি কল্পবিজ্ঞানের বেশিরভাগেই বিজ্ঞানের পরিমাণ অনেকাংশেই বেশি। কথাটা প্রফেসর শঙ্কুর ক্ষেত্রেও সত্যি। সে লেখার বিজ্ঞানের মান এ্যাসিমভের কাজের তুলনায় প্রায় কিছুই নয়। সে কারণেও এ্যাসিমভের লেখা অনেক বেশি কঠিন। কাজেই এই সমস্যাটা পাঠকের দিক থেকে কীভাবে ট্যাকেল করা যায়? আর এই দুর্বোধ্যতাও কি একটা কারণ যে কারণে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক বা বিজ্ঞান সাহিত্যিকরা ইন্টেনশানালি সায়েন্সটাকে খানিকটা বাদই দিয়ে গেছেন?
না, এটা আসলে একটা দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। পাঠক ও লেখকের দিকটা এইভাবে ঠিক আলাদা করা যায় না। লেখক বলবেন দেখুন ওইসব লিখলে পাঠক পড়বে না, আর পাঠক বলবে যে বাপরে কি খটোমটোই না করে দিয়েছেন! (হাসি) এটা কিন্তু কথা নয়! কথাটা হলো, ওয়াট ইস দি টোটাল কালচার? সত্যজিৎ রায় যে প্রফেসার শঙ্কু লিখলেন্, সেটাকে সায়েন্স ফিকশান বলার কোনো মানে হয় না। সোনার কেল্লা, এত অসামান্য ছবি, আমি কতবার যে দেখি, কিন্তু তার মূল ব্যাপারটা কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছে? আলটিমেটলি মুকুল জাতিস্মর হিসাবে যা যা বলেছিল সেরকম একটা বাড়ি কিন্তু পাওয়া গেল! এবং শেষ পর্যন্ত জাতিস্মর আছে না নেই সেই প্রশ্নটা কিন্তু রিসল্ভ হলো না। বরং— যেন থাকলেও থাকতে পারে এইরকম একটা সংশয় নিয়ে দর্শক বা পাঠক বেরিয়ে আসে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি লিখুন না, তিনি ওই বিষয়েই ছবি করুন, কিন্তু তাঁকে বলে দিতে হবে যে ব্যাপারটা হয় না।
যেমন ধরো ভূত। ব্যাপারটা নিয়ে মজা করা যেতেই পারে। যোগেশ বিদ্যানিধির বইতে যেমন দেখলাম কত রকম ভূত হয় তার তালিকা দেওয়া! (হাসি)
আমরা সেই লিস্ট থেকে দু-তিনটে নাম কি জানতে পারি?
(হাসি) একটা যেমন ছিল ‘গোমুয়া ভূত’! সেটা নাকি ব্রাহ্মণ-শিশুর অকাল মৃত্যুর পর ভূত হয়েছে। সে নাকি এই রকম গোলা পাকিয়ে পাকিয়ে সন্ধে বেলা দুটো পায়ের ফাঁক দিয়ে যায়, আর যদি ছুঁয়ে ফেলে সব্বোনাশ! তা এই রকম প্রচুর আছে। এগুলো তো সংস্কৃতির অঙ্গ। ফেলে দেওয়ার প্রশ্নই নেই। তিনি অত বছর আগে বলছেন — আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো এই ভূতের গল্পগুলোকে সব আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতাম! আমি এ কথা মানি না। কিন্তু ওঁর কথার পিছনে লজিক ছিল, আর কারণ হলো গল্পগুলোতে দেখানো হয়েছে যে ভূতটা সত্যিই আছে!
এটাই সমস্যা। মানে সত্যজিতবাবু বা অনেকেই যেটা করেছেন তাতে, কল্পবিজ্ঞানে কল্পটাই প্রধান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। আমার বন্ধু সলিল বিশ্বাস, যিনি মারা গেছেন, আমার সঙ্গে ছবিও আছে, ও আমায় দিয়ে আমাদের অন্বেষা পত্রিকায় বেশ কয়েকটা অনুবাদ করালো। আর ও নিজে এই ব্যাপারে একেবারে এক্সপার্ট ছিল, রিচার্ড শেলডনের লেখা, আইজ্যাক এ্যাজিমভ তো আছেনই, এঁদের সকলের লেখাতেই কিন্তু বিজ্ঞান থাকে, মানে এখনকার বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না এমন জিনিসও থাকে, কিন্তু তার দ্বারা এখনকার বিজ্ঞানটা মিথ্যা হয়ে যায় না। এই সেন্সটা আনা দরকার। মানে আমরা অনেক কিছুই এখনও জানি না জানবো ভবিষ্যতে। এই সলিলের কল্পবিজ্ঞান নিয়ে একটা বইই আছে, দু-তিনটে নিজের লেখা, কয়েকটা অনুবাদ, আর তার একটা ভূমিকা আছে যার বেসিসে অনায়াসে পিএইচডি থিসিস হতে পারে। মানে ওয়াট কন্সটিটিউটস এ সায়েন্স ফিকশান? এবং বাংলায় সেটা কেন নেই? এর একটা কারণ ওই বিজ্ঞান সংস্কৃতির অভাব। অধিকাংশ জায়গাতে যার অভাব, আর এখানে সেখানে থাকলেও তা অতি ক্ষীণ। সেটা না থাকার ফলে একদিকে পাঠকের মনেও সেটা নেই, আর অন্যদিকে যিনি সায়েন্স ফিকশান লিখছেন তার মনেও ঠিক ভাবে নেই হয়তো! আর যদিবা থাকে তিনি ভয় পাচ্ছেন যে বিজ্ঞানের দিকটা আরেকটু বাড়ালে পাঠক পড়বে না।
কাজেই দু-দিক থেকেই ব্যাপারটা এ্যাপ্রোচ করা দরকার। একদিকে যারা লিখবেন তাঁদের নিয়ে একটা স্কুলিং করা যায়। বলা যায় যে বিজ্ঞান বাদ দিয়ে কল্পবিজ্ঞান হয় না। অন দি আদার হ্যান্ড এই বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতিটাকে বাড়ানো দরকার। আমরা সিনেমা, নাটক, গল্প, কবিতা এসব কিছুর টার্মসে যখন রিয়েলিটিকে দেখছি তখন বিজ্ঞানের টার্মসেও দেখবো না কেন? থিয়োরি অব রিলেটিভিটি নিয়ে রাজশেখর বসু সেই কবে মজা করে গেছেন যে— আমি এখন গ্যাড়া-তলায় আছি, আমার এই ওজন, এখান থেকে পটলডাঙায় গেকেই আমার ওজন পালটে যাবে! যে প্রশ্নটা নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করলাম, যারা বিজ্ঞান বা কল্পবিজ্ঞান লিখবেন তাঁরা বিজ্ঞানী না হলেও বিজ্ঞান অবহিত তো অবশ্যই হতে হবে। এবং অবহিত হওয়ার নানান পদ্ধতি রয়েছে যার মধ্যে একটা অবশ্যই বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতি।
এখানেই টু কালচার্সের কথাটা চলে আসে।
মানে আপনি সি পি স্নো-র ‘দ্য টু কালচার্স এ্যান্ড দ্য সায়েন্টিফিক রেভলিউশান’-এর কথা বলছেন?
হ্যাঁ! ইংল্যান্ডের মতো দেশে ’50-এর দশকে স্নো প্রচুর ইন্টারভিউ নিয়ে এসে বলছেন— আমি এক নাক উঁচু সাহিত্য সম্মেলনে কারো সেকন্ড ল অফ থার্মোডায়নামিক্স সম্বন্ধে ধারণা আছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাতে যেভাবে সকলে ওঁর দিকে তাকিয়েছিল যে তাঁর মনে হয়েছিল তিনি বোধহয় অন্য কোনো গ্রহ থেকে এসেছেন। কথাটা উলটোদিকেও সত্যি। সেকন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় প্রচুর ইয়ং সায়েন্টিস্টদের উনি এ্যাপয়েন্ট করেছিলেন। উনি প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করতেন— তুমি তোমার নিজস্ব ক্ষেত্রের বাইরে কি পড়ো? তাতে একজন বলেছি— হ্যাঁ, বই খুব সুন্দর জিনিস, কারণ বই সঙ্গে থাকলে সেটাকে টেবল হিসাবে ব্যবহার করা যায়। আরেকবার জিজ্ঞেস করেছিলেন— তুমি ইম্পোর্ট্যান্ট সাহিত্য কি পড়েছো? তাতে একজন মাথাটাথা চুলকে বলেছিল, হ্যাঁ একবার ওই ডিকেন্সের একটা লেখা পড়বার চেষ্টা করেছিলাম। 50-এর দশকে এই যদি ইংল্যান্ডের অবস্থা হয়, তাহলে আমরা খুব বেশি দোষ নিজেদের দেবো না।
আবার এর উলটো দিকটাও আছে। ফ্রান্স, জার্মানি বা রেস্ট অফ ইউরোপে কিন্তু এই ফারাকটা অনেক কম ছিল। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে মূলত সত্যি। এমনকি তাদের স্কুল লিভিং পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে জ পল সার্ত্র ও জাক মোনোর মধ্যে কমিউনিসম ভার্সাস হিউম্যানিসিমের যে তর্ক হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন আসতো। এটা কি আমরা ভাবতে পারি? এই কালচারটা কিন্তু ওখানে ছিল। দর্শন, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এগুলো ওইরকম ওয়াটার টাইট কম্পার্টমেন্ট নয়। আমাদের এখানে তাই হয়ে গেছে। আর তাছাড়া আমাদের দর্শন তো সাধনার পথ, কাজেই ভারতীয় দর্শন বললেই পুজো আচ্চার কথা মনে পড়ে যায় আমাদের। (হাসি) যদিও সাংখ্য দর্শন ঈশ্বর বিরোধী। ব্যাপারটা অক্ষয় দত্ত পড়ে জানতে পেরেছিলাম। তখন আমার মনে আমাদের দর্শন সম্বন্ধে নানান প্রশ্ন জেগেছিল, যে— সত্যিই কি আমাদের দর্শন মনোলিথিক? কোনোভাবেই না! বেদান্তর সঙ্গে বৈশেষিকের কি মিল আছে? পুরনো সাংখ্যর সঙ্গে পূর্বমীমাংসার কি মিল আছে? এমনকি বেদান্তর মধ্যেও অনেকগুলো ধারা আছে। আমরা এগুলো নিয়ে সচেতন নই, অথচ এই ধারণাগুলোই সংস্কৃতিটা গড়ে দিচ্ছে, যেটা বিজ্ঞান বিরোধী। ঈশ্বর বিশ্বাসী বলে নয়— ঈশ্বর তো একটা ধারণা যে যেভাবে ইচ্ছা গড়ে নিচ্ছে, ডাস নট ম্যাটার।
এখানে অন্য একটা গল্প বলি, আমাদের সুব্রমনিয়াম চন্দ্রশেখরের কথা ভাবো! তাঁর তো বইই আছে। ট্রুথ এ্যান্ড বিউটি। তাতে বেঠোফেনের ওপর, শেক্সপিয়ারের ওপর, শেলির ওপর প্রবন্ধ রয়েছে। এবং তাতে উনি একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করেছেন। বলছেন, ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সায়েন্সের একেবারে ইপক মেকিং যেসব কাজ সেগুলোর অধিকাংশই সায়েন্টিস্টরা খুব অল্প বয়সে করে ফেলেছেন। উদাহরণ দিয়ে দিয়ে দেখিয়েছেন। তারপর বলছেন সাহিত্য বা মিউসিকের ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা অনেক অন্য জিনিস দেখি। উনি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কথা বলেছেন, আমি হলে অবশ্য শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের কথা বলতাম। ভাবো তো আশি বছর বয়সে কী লিখছে লোকটা! প্রফুল্লচন্দ্র রায়েরও তো শেক্সপিয়ারের ওপর বই আছে। যাই হোক, বিজ্ঞানের মানুষদের ক্ষেত্রে কিন্তু অনেক বয়সে বিরাট মাপের কাজ বড়ো একটা দেখা যায় না, সে কথা অনেকেই বলেছেন।
এমনটা কেন সে ব্যাপারে কিছু চন্দ্রশেখর বলেছেন কি? আমার পড়া নেই।
হ্যাঁ! এইখান থেকে উনি আর্ট এবং সায়েন্সের কাজ ও পদ্ধতির তফাতটা কোথায় সেই জায়গায় চলে যাচ্ছেন। একজন কবির মন, একজন সঙ্গীতজ্ঞের মন, একজন বিজ্ঞানীর মন একইসঙ্গে ক্রিয়েটিভ হয়েও কীভাবে আলাদা সে কথা বলছেন। আমরা কি এইটা বোঝবার চেষ্টা করেছি কোনোদিন?
সত্যেন বোস এসরাজ বাজাতেন। তাতে তিনি নতুন রাগের ঠাট তৈরি করতেন। সি ভি রামন তো তানপুরা নিয়ে কাজ করেছিলেন, কেন এবং কীভাবে ওই চারটে তারে ওই আওয়াজটা হয় সে নিয়ে। বা তবলা, এই যে তার ধারে একরকম আওয়াজ, মাঝে একরকম আওয়াজ এবং বাজালে যে একটা সম্পূর্ণ আলাদা আঙ্গিক তৈরি হয় তার ওপর তো পেপারও আছে। গান-বাজনার সঙ্গে সায়েন্সের এই সাযুজ্য তো পিথাগোরাসের আমল থেকে এস্টাব্লিশড! তার মানে তফাতটা কোথায়? তফাত নেই, ওটা আমরা বানিয়ে তুলেছি। গ্যারি ওয়ের্স্কির ‘দ্য ভিসিবল কলেজ’ বলে একটা বই আছে। 1930 সালে কেম্ব্রিজে সব ডিপার্টমেন্টের ছাত্ররা মিলে একটা পত্রিকা বার করতো। সেখানে আর্টস ভার্সাস সায়েন্সের বৈঠকে প্রায় গালাগালির বন্যা বইতো। সায়েন্সের লোকেরা অন্যদলের লোকেদের arties বলতো। কাজেই সমস্যাটা শুধু আমাদেরই দেশে নেই। তার সঙ্গে টেকনিকাল সমস্যা তো রয়েছেই। সায়েন্টিস্টের মন আর কবির মন তো একভাবে কাজ করে না। তবে আইডিয়েশানের মুহূর্তে দু-জনের বিশেষ তফাত নেই। কিন্তু এক্সিকিউশানের পদ্ধতি দুটোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই হঠাৎ আলোর ঝলকানি সমস্ত জায়গাতেই এক।
তাহলে, আপনার মূল কথাগুলো এক জায়গায় করলে আমরা দুটো জিনিস পাচ্ছি। প্রথমত, পশ্চিমি এ্যালিয়েনেশান, বা সি পি স্নো টু কালচারে যা নিয়ে কথা বলেছিলেন সেই সাংস্কৃতিক ভাঙনটা আমাদের ইন্ট্রিনসিক ইনক্লিনেশান নয়, তাইতো?
আমি এর সঙ্গে এটুকুও যোগ করবো যে আধুনিক সায়েন্স ব্যাপারটাই তো আমাদের ইন্ট্রিনসিক নয়! ডেভেলপমেন্টটা ওয়েস্টার্ন ইউরোপে হয়েছিল, আমাদের ক্ষেত্রে সেটা ভায়া কলোনিয়ালিসম আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া একটা জিনিস। এইখানে একটা বিরাট তফাত আছে।
সেই জায়গাটা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি বলেই আপনি মনে করেন, তাই কি?
আমার তাই ধারণা ।
বেশ, এবং দ্বিতীয়ত শিল্প বা তথাকথিত অর্থে যাকে আমরা শিল্প বলি তার সঙ্গে বিজ্ঞানের আইডিয়া জেনারেশনের জায়গায় কোনো তফাত নেই। পদ্ধতিগত দিক থেকে কিছু পার্থক্য নিশ্চয় আছে।
আশিষঃ শুধু তাই না। একজন সরোদ বা সেতার বাজিয়ে যে ফিসিকাল রেওয়াজের মধ্যে দিয়ে যান একজন কবিকে কি তার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়? আলি আকবর খাঁ একটা ভুল করলে তার বাবার কাছে বিরাট ঠ্যাঙানি খেতেন, একজন কবির ক্ষেত্রে কি সেটা শুনেছো? তা সত্ত্বেও ক্রিয়েটিভিটির লেভেলে দুটো কোথাও গিয়ে এক হয়ে যাচ্ছে। এইটাই বলতে চাইছি। কাজেই খালি আর্টস আর সায়েন্স নয় প্রত্যেকটা স্ট্রিমই পদ্ধতিগত দিক থেকে আলাদা।
মানে শুরু এবং শেষটা এক, রাস্তাগুলো আলাদা!
এগজ্যাক্টলি!
সম্পূর্ণ ইন্টারভিউ: