স্বাগতাঃ আপনি রাইবোসোম নিয়ে কাজ করা শুরু করলেন কেন?
এডা ইয়োনাথঃ বিষয়টা মজার, তাই !
হঠাৎ রাইবোসোম-এর উপর কাজ করার অনুপ্রেরণা পেলেন কীভাবে?
নিজের উৎসাহ, কৌতূহল, যা বলবে। একটা বাইসাইকেল দুর্ঘটনায় আমি আহত হয়েছিলাম। সেরে ওঠার জন্য বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হয়। তখন অনেকটা ফাঁকা সময় পেয়েছিলাম বই পড়ার জন্য। ওর মধ্যেই উত্তরমেরুর মেরুভাল্লুক (polar bear) সম্পর্কে পড়ার সুযোগ হয়েছিল।
মেরুভাল্লুকদের শীতঘুম (hibernation) সম্পর্কে?
ওটা শীতঘুম নয়। আমি ওটাকে শুধু ঘুম বলি। শীতে ওরা ঘন্টার পর ঘন্টা খালি ঘুমোয়। শীতঘুমে শরীরের তাপমাত্রা বেশ কয়েক ডিগ্রী কমে যায়। কিন্তু মেরুভাল্লুকদের ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা মাত্র ১/২ ডিগ্রী কমে। তাই ওটাকে শীতঘুম না বলে শুধু ঘুম বলাই ভালো। ভালুক যখন ঘুমোয় তখন শরীরের ভেতর কী পরিবর্তন হয়? দেখা গেছে, শরীরের রাইবোসোমগুলি তখন কোষপর্দার ভিতর একত্রিত অবস্থায় (packed) এবং সুসজ্জিত থাকে। ঐভাবে যে রাইবোসোম সুসজ্জিত থাকতে পারে, এইটাই তখন ভাবা যায়নি। রাইবোসোম এই অবস্থায় পুরো শীতকালটা টিঁকে থাকে। যখন বসন্ত আসে, ভালুকের ঘুম ভাঙ্গে। জেগে উঠে সব কাজকর্ম করার জন্য তার প্রয়োজন প্রোটীন। এই প্রোটীন বানানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রাইবোসোম তাদের কাছে মজুত থাকে।
আমার মনে হলো যে নিশ্চয়ই এই একত্রিত অবস্থাই সক্রিয় রাইবোসোমকে ভেঙ্গে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এটাও মনে হলো যে এরকম ভাবনা অনুসরণ ক’রলেই হয়তো রাইবোসোমের গঠনের হদিশও পাওয়া যাবে। এটা বুঝলাম যে প্রকৃতির নিয়মে চাপ প্রয়োগ করলে রাইবোসোম সুশৃঙ্খল(orderly) অবস্থায় থাকার চেষ্টা করে। তাই যে সমস্ত রাইবোসোম চাপে টিঁকে থাকতে পারে সেগুলোর ওপর মনঃসংযোগ করলাম।
বর্তমান সময়ে যে বিজ্ঞানের একাধিক শাখা মিলিয়ে গবেষণা হয়, সে বিষয়ে আপনার মতামত কী?
বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যের সীমারেখা এখন মুছে গেছে, প্রায় নেই বললেই চলে। আমি রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম, সেগুলো সবই জীবনবিজ্ঞান বা জৈব-রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যা, ওই ঘেঁষা । আবার আমার কর্মপদ্ধতি পদার্থবিদ্যা ঘেঁষা। আমি যখন কাজের পরিকল্পনা শুরু করেছিলাম তখন আমায় প্রচুর অঙ্ক কষতে হয়েছিল। তাই আমার নিজের গবেষণা আন্তঃ-বিষয়ক (Interdisciplinary) তো বটেই।
ভারতে সাধারণ মানুষ ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে যে দূরত্ব আছে তা কীভাবে কমিয়ে আনা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
ভারতে বিজ্ঞানের গবেষণা এখন খুবই উচ্চ পর্যায়ের হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার সাথে সাধারণ মানুষের বিজ্ঞানমনস্কতার অনেক দূরত্ব রয়েছে। যদিও সেটা বিজ্ঞানীদের ত্রুটি নয়। আসলে প্রচুর ভারতবাসীর রোজকার জীবনযাপনটাই সেরকম। বুদ্ধিজীবিরা কী ভাবছেন, সেই নিয়ে মাথা ঘামানোর বা সেইদিকে কিছু করার সম্ভাবনা কম। তাই দূরত্ব অনেকটাই।
নোবেল পুরস্কার আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
পুরস্কার পেয়ে তো খুবই ভাল লেগেছিলো। কিন্তু সত্যিকারের উত্তেজনা আমি অনুভব করেছিলাম যেদিন প্রথম রাইবোসোমের গঠন দেখতে পাই। তবে অন্য অনেক দিক থেকে নোবেল পুরস্কার আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নোবেল পুরস্কার তোমাদের সবার সাথে মিলিত হবার সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে। অন্তত আমি ছোট ছেলেমেয়েদের আমার কাজের মাধ্যমে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।
আপনার জীবনে কাউকে পথিকৃৎ হিসেবে অনুসরণ করেছিলেন?
না, আমি কাউকে অনুসরণ করার বিপক্ষে। আমার মনে হয় তোমরা সবাই নিজের মতো করে শিখে থাকো এবং নিজের মতো করেই শেখা উচিতও। আমি তোমাদের উৎসাহিত করতে পারি বা বড়োজোর আমার অভিজ্ঞতা তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি। কিন্তু কাউকে রোল মডেল করা মানে তো তাকে নকল করা।
ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের কি আপনি কোন উপদেশ দিতে চান?
একটাই উপদেশ – কারোর কাছে উপদেশ চেয়ো না। তোমার যা করতে ভাল লাগে ও যা তোমার কাছে আকর্ষণীয়, সেটাই করো আর তবেই তুমি করতে পারবে।
বিজ্ঞান ছাড়া আপনার আর পছন্দের কাজ কী কী?
আমার পরিবার আছে, বন্ধুবান্ধব আছে। আমি তাদের সাথে দেখা করি, সময় কাটাই। আমি সাঁতার কাটি। আমি বই পড়তে ভালবাসি, ধ্রুপদী সঙ্গীত শুনতে ভালবাসি। এতে হবে?(হাসি)।
ইসরায়েলের ওয়েজম্যান ইন্সিটিউট অফ সায়েন্স(Weizmann Institute of Science)-এর এডা ইয়োনাথ ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল রাইবোসোমের গঠন ও কার্যকলাপ (রাইবোসোম হলো কোষের সেই অংশ যা জেনেটিক কোড পড়ে শরীরের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য প্রোটিন তৈরী করে)। বর্তমানে তাঁর গবেষণার মূল বিষয় হল পরিবেশবান্ধব অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা। বোস ইন্সিটিউট-এর ১০১তম প্রতিষ্ঠা দিবসে, ৭৯তম আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করতে বিজ্ঞানী এডা ইয়োনাথ কলকাতায় এসেছিলেন। সেইসময় আমাদের পক্ষ থেকে স্বাগতা ঘোষ তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।
উৎসাহী পাঠকদের জন্য
[১] এডা ইয়োনাথ-এর ওয়েবসাইট: https://www.weizmann.ac.il/YonathNobel/index.html
[২] অ্যানিমেশান-এর মাধ্যমে রাইবোসোমের কর্মপদ্ধতি: https://www.youtube.com/watch?v=Jml8CFBWcDs