পর্ব ২: সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
লীউবেন্হোক, লুই পাস্তুর, ফার্দিনান্দ কহন, রবার্ট কক্ বা আলেক্জান্ডার ফ্লেমিং এর কথা সাধারণত আমরা নানা জায়গায় শুনে থাকলেও সে তুলনায় উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন ডাচ বিজ্ঞানী মার্টিনাস বেয়্য়েরিন্ক (Martinus Beijerinck)। ভাইরাস এর আবিষ্কার করে তিনি জীবাণু বিজ্ঞানে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। তাঁর এই আবিষ্কারের আগে জীবাণু বলতে কেবল মাত্র ব্যাকটেরিয়াকেই বোঝানো হত। ১৮৯৮ সালে তিনি প্রমাণ করেন যে তামাক গাছের (tobacco) সংক্রামক রোগের কারণ এক ক্ষুদ্র জীবাণু কিন্তু তার আকার ব্যাকটেরিয়ার থেকে বেশ কয়েক গুণ ছোট। নতুন আবিষ্কৃত এই জীবাণুদের তিনি নাম দেন ভাইরাস (Tobacco Mosaic Virus:TMV)।
সেই সময় তাঁর ধারণা ছিল ভাইরাস অনেকটা জেলির মত বা তরল জৈবকণা। তবে তৎকালীন অনুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসদের দেখা কার্যত অসম্ভব ছিল। পরবর্তীকালে, ১৯৩১ সালে জার্মান বিজ্ঞানী নল ও রুস্কার (Max Knoll, Ernst Ruska) ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র আবিষ্কারের পর ভাইরাসের গঠন সম্পর্কে আরো অনেক নতুন তথ্য জানা সম্ভব হয়। এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি আর ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্র এর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকে ১৯৪১ সালে প্রথম বোঝা যায় যে ভাইরাস আসলে নির্দিষ্ট গঠন যুক্ত কণা। ভাইরাস বিজ্ঞান বা ভাইরোলজি নিয়ে নানা গবেষণার থেকে অনুমান করা হয় যে পৃথিবীতে আনুমানিক দশ লক্ষাধিক রকমের ভাইরাস আছে। আগেই বলেছি পৃথিবীতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা আনুমানিক ৫ x ১০৩০, আর ভাইরাসের মোট সংখ্যা এর প্রায় দ্বিগুণ! একটা কথা মনে রাখা উচিত, যদিও ভাইরাসকে অনেক পাঠ্য পুস্তকে জীবাণু (জীব+অণু) বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে, প্রকৃত অর্থে ভাইরাস এর মধ্যে জীব-অণুর সমস্ত গুণ দেখা যায় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ভাইরাসের কোনো কোষ বা অনুরূপ গঠন নেই। ভাইরাসের জৈব প্রক্রিয়ার (যথা বিভাজন) অস্তিত্ব কেবল মাত্র কোনো জীবিত কোষে সংক্রমণ এর পরেই দেখা যায়। অন্যথায়, প্রকৃতিতে ভাইরাস জড় পদার্থের মত দীর্ঘ সময় সুপ্ত অবস্থায় থাকে। সম্প্রতি ফ্রান্স এর একদল বিজ্ঞানী এক প্রকার নতুন ভাইরাস আবিষ্কার করেছেন যেগুলি গত দীর্ঘ ৩০,০০০ বছর ধরে সুপ্ত অবস্থায় সাইবেরিয়ার বরফের চাদরে ঢাকা ছিল কোনো জৈব প্রক্রিয়া ছাড়াই। কিন্তু আশ্চর্য্যজনকভাবে ল্যাবরেটরি তে এককোষী অ্যামিবার সংস্পর্শে আসতেই বোঝা যায় তারা এখনো বিভাজন প্রক্রিয়ায় সক্ষম! তাই ভাইরাসকে সঠিক অর্থে জীবাণু না বলে, জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী বস্তু বা জীবনের বাহক বলাই বেশী যুক্তিযুক্ত! ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়ার গঠনগত বৈশিষ্ট্য ও নানা জৈব প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরবর্তী পর্ব গুলোতে আমরা বিশদে আলোচনা করব।
ব্যাকটেরিয়া প্রধানত এককোষী (ব্যতিক্রম: সায়ানোব্যাকটেরিয়া) এবং ওদের কোষের মধ্যে কখনই সংঘটিত নিউক্লিয়াস বা আবরণ পরিবেষ্টিত (membrane-bound) কোষীয় অঙ্গানু (organelle) থাকে না। ব্যাকটেরিয়াকে তাই প্রোক্যারিওট বলা হয়ে থাকে। ঠিক এখানেই প্রোটোজোয়া আর ছত্রাক জীবাণু হলেও ব্যাকটেরিয়ার থেকে আলাদা।
ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া প্রোটোজোয়া ছত্রাক
প্রোটোজোয়া প্রধানত এককোষী হলেও ছত্রাক এককোষী বা বহুকোষী হয়ে থাকে। উভয়ের ক্ষেত্রেই অবশ্য সংঘটিত নিউক্লিয়াস এবং আবরণ পরিবেষ্টিত (membrane-bound) কোষীয় অঙ্গাণুর (organelle) উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রোটোজোয়া ও ছত্রাক কে তাই ইউক্যারিওট শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। ইউক্যারিওটদের কোষীয় গঠন প্রোক্যারিওটদের থেকে অনেক উন্নত, তাই বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না যে বিবর্তন এর ইতিহাসে প্রোক্যারিওটদের আবির্ভাব-ই আগে হয়েছে। বিবর্তন এর সময় সরণীতে ব্যাকটেরিয়ার (প্রোক্যারিওট) আবির্ভাব হয়েছিল আনুমানিক ৩,৬০০,০০০,০০০ বছর আগে এবং প্রোটোজোয়ার ও ছত্রাকের (ইউক্যারিওট) আবির্ভাব হয় তার অনেক পরে আনুমানিক ১,৫০০,০০০,০০০ বছর আগে। প্রোটোজোয়া ও ছত্রাক ইউক্যারিওট শ্রেণীভুক্ত; ওদের কোষের আভ্যন্তরীণ গঠন ও কোষীয় প্রক্রিয়া তাই অনেকটা উন্নততর ইউক্যারিওটদের (যেমন মানুষ: Homo sapiens) মতই হয়ে থাকে। ইউক্যারিওট কোষের নানাবিধ দিকগুলি আমাদের স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকে অনেক বিশদে আলোচনা করা হয় তাই সে বিষয়ে শেখার অনেক বেশী সুযোগ থাকে। সে তুলনায় প্রোক্যারিওট ও ভাইরাসদের বিষয়ে স্কুলের বই গুলিতে যে পরিমান তথ্য দেওয়া থাকে তা আশ্চর্যরকম ভাবে অপ্রতুল। শুধু তাই নয়, প্রদত্ত তথ্যের একাংশ সময়ের সাপেক্ষ্যে অপ্রাসঙ্গিক এবং ভুল! একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। আমি স্কুল এর গন্ডি পেরিয়ে এসেছি সে প্রায় একদশকের বেশী সময় হলো। তখন ব্যাকটেরিয়ার সংজ্ঞা পড়েছিলাম “ব্যাকটেরিয়া হলো একটি উত্সেচক পূর্ণ ব্যাগ!”। গত এক দশকে গঙ্গায় কম জল বয়ে যায়নি! কয়েকমাস আগে হঠাৎ-ই একটা স্কুলের বই হাতে এসে পরেছিল। পাতা উল্টে অবাক হয়ে দেখলাম ব্যাকটেরিয়ার সংজ্ঞা কিন্তু পাল্টায়নি! অথচ বিগত দুই দশকে নানা দেশের বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণার ফলে আমরা আজ ব্যাকটেরিয়াদের সম্পর্কে অনেক বেশী জানি এবং তাদের কেবল মাত্র উত্সেচক পূর্ণ ব্যাগ বলে বর্ণনা করা নিশ্চিত ভাবে অবমূল্যায়ন!
নিজের মনে একটা প্রশ্ন করে দেখো, ব্যাকটেরিয়া যদি কেবল মাত্র উত্সেচক পূর্ণ একটা নিরীহ ব্যাগ হত তবে আজকের এই বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও কেন আমরা অতিশয় ক্ষুদ্র সেই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমন থেকে নিজেদের রক্ষা করার উপায় বার করতে পারলাম না? এখনো প্রতিবছর কলেরা (Vibrio cholerae) আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩০-৪০ লক্ষ (মৃত্যু লক্ষাধিক), টিউবারকিউলোসিস (Mycobacterium tuberculosis) আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৭০-৮০ লক্ষ (মৃত্যু দশ লক্ষাধিক) আর টিটেনাস (Clostridium tetani) আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫-১২ লক্ষ (মৃত্যু পঞ্চাশ হাজার এর বেশী)। শুধু এখানেই শেষ না, এর পরে নিউমোনিয়া, ডিপথেরিয়া, মেনিনজাইটিস, গনোরিয়া, ব্রংকাইটিস, যক্ষা, টাইফয়েড, প্লেগ আরো কত যে মারাত্মক রোগের কারণ ব্যাকটেরিয়া সে কথা বলে শেষ করা যাবে না! তাই একথা বলাই বাহুল্য যে ওদের সম্পর্কে আরো ভালো করে জানা এবং বোঝা বিশেষ প্রয়োজন! ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস এর গঠনগত বিষয়ে এখন আমরা কি কি জানি, ওদের সাথে আমাদের কোষের পার্থক্য কোথায়, কেনই বা ওদের বিরুদ্ধে যথার্থ্য প্রতিষেধক তৈরী করা যাচ্ছে না এছাড়াও নানা বিষয়ে জানতে পরের পর্ব গুলো তে নজর রেখো।
প্রচ্ছদের ছবিটির উৎস: https://guardianlv.com/wp-