আন্টার্কটিকার আমাণ্ডসেন উপকূলে রয়েছে দুটি বড় হিমবাহ (glacier): দোয়েটস আর হাইনস। তাদের চারিদিকে প্রহরীর মত ঘিরে আছে একটা ভাসমান হিমচর বা আইস শেলফ (ice shelf)। হিমবাহ যখন গড়িয়ে গড়িয়ে সমুদ্রের জলে নামে, এই আইস শেলফগুলি জন্মায়। আর জন্মদাতা হিমবাহগুলিকে আগলে রাখে গলে যাওয়া থেকে। এই সপ্তাহের দুটো আলাদা আলাদা গবেষণা থেকে বেরিয়েছে : দোয়েটস আর হাইনসের আইস শেলফ ক্ষয় হতে হতে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এই হিমবাহগুলির সম্পূর্ণভাবে গলে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এই আইস শেলফ-এর ক্ষয়ের পিছনে রয়েছে নিচের অক্ষাংশ বা ল্যাটিচুড থেকে আসা গরম জলের ধারা। গ্লোবাল ওয়ার্মিঙ্গের প্রকোপ আমাদের অগোচরেই কখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
না, এটা শুধু ফাঁকা আওয়াজ নয়। প্রশ্নটা ছিল, এই আইস শেলফের রক্ষাকবচ ক্ষয়ে গেলে হিমবাহগুলি কোনভাবে টিকবে কি না। হিমবাহের মধ্যে জলের অণুগুলি চ্যাপটা স্তরে সাজানো। এই চ্যাপটা স্তরগুলি থাকে থাকে জুড়ে হিমবাহগুলি তৈরী হয়। অনেকটা এক সেট তাসের মত। এবার এই তাসের সেটটাকে একটা ঢালের উপর গড়াতে দিলে, পুরো সেটটা তো আর একটা বাক্স হয়ে গড়াবে না। উপরের তাসগুলো খানিক বেশি এগোবে, নিচের গুলো পিছিয়ে পড়বে। এবার ঢালের নিচে যদি জল থাকে, উপরের তাসগুলো আগে পড়বে সেই জলে। এই উপরের তাসগুলোই দাঁড়ায় আইস শেলফ হয়ে। জলের উপর ভেসে থেকে বাকি হিমবাহের গতিকে থিতিয়ে রাখে।
কিন্তু, এই আইস শেলফের নিচে ক্রমাগত গরম জল এসে একে ক্ষইয়ে দিচ্ছে গোড়া থেকে। এই ক্ষয়ের ফলে হিমবাহ যেখানে জমির সাথে জুড়ে আছে, যাকে বলে গ্রাউণ্ডিং লাইন, সেটা আরো ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। এবং এই ভিতরে ঢুকে যাওয়াটা যে সমান হারে হচ্ছে, তাও নয়। গ্রাউণ্ডিং লাইন যত ভিতরে ঢোকে, তত তার ভিতরে ঢোকার হার বেড়ে যায়। একে বলে মেরিন আইস ইনস্টেবিলিটি। কোনো এক সময় আইস শেলফ ভেঙ্গে যায়, বিছিন্ন হয়ে যায় হিমবাহ থেকে। আইস শেলফের সুরক্ষার অভাব আর ক্রমাগত গরম জলের আক্রমণ, এই দুয়ে মিলে বেচারা হিমবাহ মিলিয়ে যায় সমুদ্রে। সায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটা গবেষণাপত্রে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সিমুলেশন করে দেখিয়েছেন, এই ইনস্টেবিলিটিকে আটকাতে পারে বলে যেসব বিপরীতগামী উপায়ের কথা ভাবা হচ্ছে, তারা কেউ ঠেকাতে পারবে না অবশ্যম্ভাবীকে। একবিংশ শতাব্দীতে হঠাৎ বরফ জমার হার কোনো কারণে সামান্য বেড়ে গেলেও না, গরম জলের অনুপ্রবেশ সামান্য কমে গেলেও না। শুধু তাই নয়, তাঁদের মডেল অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ অব্দি যতটা বরফের হ্রাস হিসেব করা যাচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে তার কাছাকাছিই হ্রাস হয়েছে। অর্থাৎ, সর্বনাশের শুরু হয়ে গেছে।
দোয়েটস আর হাইনস হিমবাহ পুরো গলে গেলে সমুদ্রের জল বিশ্বব্যাপী আনুমানিক দশ ফিট বা তার বেশি বেড়ে যেতে পারে। সত্যিই, আমরা পৃথিবীকে যে কতরকম ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, তার পুরো হিসেব পেতে পেতে হয়ত আর কিছুই করার থাকবে না!
ছবি: নিউ ইয়র্কার ব্লগ