ধরুন, সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে আপনি ফোনটা চেক করতে গিয়ে এরকম একটা হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড পেলেন। ফরওয়ার্ড-এর শুরুটা এইরকম:
Covid 19 নিয়ে এই মুহূর্তে সবচাইতে আলোচিত Lancet report। Lancet পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ Science Journal। এটি New York থেকে প্রকাশ হয়। Covid সংক্রান্ত বহু বহু তথ্য এখানে নিয়মিত প্রকাশ হয়। সারা পৃথিবীর সব দেশ, WHO, UNICEF ইত্যাদি সবাই Lancet report কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। 12 April 2021 এর এই report এ বহু বহু তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে, যে Covid19 বায়ু দ্বারা সংক্রামিত হয়। অন্য কোনো ভাবেই নয়। প্রসঙ্গত বলা উচিৎ, July 2020 এর এই Lancet journal এই 22 টি দেশের প্রায় 223 জন বিখ্যাত বিজ্ঞানী (যাঁদের মধ্যে 45 জন নোবেলজয়ী) জানিয়েছিলেন যে Covid নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সম্ভবতঃ ভুল পথে যাচ্ছে। Lock down, Sanitization এসব করে এই Super spread রোখা যাবেনা। এতে বিপর্যয় বাড়বে। তখন এটা প্রমাণ করার মতন Data তাঁরা পাননি, এটা একটা hypothesis ছিল। এখন বিশাল তথ্য, data দিয়ে আরো বহু বিজ্ঞানী এটা প্রমাণ করেছেন। যাঁদের আগ্রহ আছে Duck Duck Go বা Google করে এই report পড়তে পারেন। খুব সহজবোধ্য ভাবে বোঝানো হয়েছে।
লম্বা ফরওয়ার্ড-এর অনেক কথার মধ্যে এইগুলো আপনার নজর কাড়লো:
লক ডাউন এই রোগ নিয়ন্ত্রণে কোনো উপকারী তো নয়ই, বরং দীর্ঘদিন ঘরে বন্দী থেকে শহর এলাকায় এই রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই ঘরে আবদ্ধ দশা না কাটালে সামনে ভয়াবহ রূপ দেখা যাবে, যা এখনো কল্পনার বাইরে।
লকডাউন-এর চোটে ঘরবন্দী হয়ে হয়তো আপনার দমবন্ধ হয়ে এসেছে। এই ফরওয়ার্ড-টা দেখে আপনি চমকে গেলেন। উত্তেজিত হয়ে পরিবারের অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন: “এই দেখো, কী বলছে!” সাড়া না পেয়ে আপনি ফরওয়ার্ড-টা সিলেক্ট করে নিচের এই চিহ্নে touch করলেন:
প্রথমে ফরওয়ার্ড-টা পাঠালেন পরিবারের গ্রুপে, তারপর অফিসের, তারপর পাড়ার ক্লাবের, তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে ফরওয়ার্ড-টা ভালো করে পড়তে শুরু করলেন। আপনি লোকজনকে সচেতন করতে পেরেছেন, এই ভেবে হয়তো মনে একটু স্বস্তিও হলো।
মাস তিনেক পর দেশে মহামারীর প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে যখন লকডাউন জারি করা হলো, এবং একটা বিক্ষোভ জন্মালো তার বিরুদ্ধে, সেই বিক্ষোভের পিছনে আপনার ওই একটা সামান্য কাজ কতটা দায়ী, সেই ধারণা আপনার আছে কি? (এরকম লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ কিন্তু মনগড়া কাহিনী নয়, আমেরিকার অনেক রাজ্যে এটা হয়েছে।)
এই ধারণা থাকা সম্ভব নয়, কারণ হোয়াটস্যাপ সেই উপায় দেয় না। আপনি যেমন একদিকে শুধু এটুকুই জানেন আপনার ফরওয়ার্ড-টা কোত্থেকে এসেছে, অন্যদিকে আপনি এটাই জানেন যে ফরওয়ার্ড-টা আপনি কাদের পাঠালেন। ফরওয়ার্ড-এর সূত্রপাত কোত্থেকে বা শেষ অব্দি কদ্দুর পৌঁছচ্ছে, সে সম্বন্ধে ধারণা করার উপায় হোয়াটস্যাপ আপনাকে দেয়নি। শুধু তাই নয়, end-to-end encryption-এর ফলে হোয়াটস্যাপ-এর নিজেরও ক্ষমতা নেই একটা ফরওয়ার্ড-এর চেন-এ কারা আছে, সেটা উদ্ধার করার।
কিন্তু, ধরুন যদি সেই উপায় থাকতো এবং তিন মাস পর জানতে পারতেন যে আপনি ওই ফরওয়ার্ড-এর চেন-এ একটা মূল লিঙ্ক, অর্থাৎ আপনি ওই ফরওয়ার্ড-টা এগিয়ে না দিলে ওটা বেশিদূর যেত না, তাহলেও কি আপনি অতটাই স্বস্তিতে থাকবেন? যে তথ্যটা ফরওয়ার্ড করলেন, তার দায়িত্ত্ব নিতে কি আপনি রাজি আছেন?
হোয়াটস্যাপ-এর বিতর্কিত ফরওয়ার্ডগুলোর বিশেষত্ত্ব
উপরে যে হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড-টা দেওয়া হলো, এরকম ফরওয়ার্ড আমরা হামেশাই পেয়ে থাকি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটা লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো:
[১] এদের বিষয়বস্তু একটু বিতর্কিত হয়। সাধারণভাবে consensus বা ঐক্যমত যেকথা বলছে, এগুলো সাধারণত তার বিরুদ্ধে যায়।
[২] যেহেতু বিষয়টা বিতর্কিত, তাই এর স্বপক্ষে কিছু expert বা বিশেষজ্ঞের নাম দেওয়া হয়। উপরের ফরওয়ার্ড-এ যেমন Lancet জার্নাল-এর নাম এবং ২২৩ বিজ্ঞানী, যার মধ্যে ৪৫ জন নোবেলজয়ী, তাদের কথা বলা হয়েছে।
তবে এই দু’টো ছাড়াও আরেকটা লক্ষ্যণীয় বিষয় থাকে। সেটা হলো, এগুলোতে কোনো পরিচিত site -এর হাইপারলিংক (hyperlink) থাকে না। বেশিরভাগ সময়ই কোনো হাইপারলিংক-ই থাকেনা। অর্থাৎ আপনি চট করে তথ্যটার সত্যতা যাচাই করতে পারবেন না। আপনাকে একটু খাটতে হবে। সকালবেলা চা খেতে খেতে বা কাজের অবসরে ফোন চেক করতে করতে সেই খাটনিটা যে বেশিরভাগ লোকেই খাটবে না, সেই ভরসাতেই এই মেটেরিয়াল-গুলো বানানো। কয়েকজন বিশেষজ্ঞের নাম বা জার্নালের নাম, এইগুলোই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভরসা অর্জন করতে যথেষ্ট।
কেন এইরকম ফরওয়ার্ড
এই ফরওয়ার্ড-গুলো যদি ডাহা মিথ্যে হয় বা সত্যিমিথ্যে মেশানো হয়, এরকম জিনিস তৈরী করার পিছনে অভিসন্ধিটা কী? এর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিসন্ধিটা হয়তো রাজনৈতিক। আপনাকে খুব আলতো করে কোনো একটা দলের মতাদর্শের প্রতি ক্রমাগত ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অনেকসময় একটা ফরওয়ার্ড-এর কারণে কোন রাজনৈতিক দলের কী উদ্দেশ্যসাধন হচ্ছে, সেটাও স্পষ্ট নয়। ধরা যাক, অমুক রাজ্যে সরকার লকডাউন-এর পক্ষপাতী। প্রশাসন-পুলিশ সেই কাজে নামিয়েছে। উপরের ফরওয়ার্ড-টার মতো রাজনীতির সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন একটা ফরওয়ার্ড সেই সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।
আবার এরকমও হতে পারে যে ফরওয়ার্ড-টার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্কই নেই। কোনো এক দিকগজ ব্যক্তি একটা মস্ত ষড়যন্ত্রের খোঁজ পেয়েছেন এবং তাঁর আবিষ্কারগুলো তিনি চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে সবাইকে জানাতে চান। এখানেই হোয়াটস্যাপ-এর মজা। যেহেতু ফরওয়ার্ড-এর সূত্রটা বেশিরভাগ লোকেই জানতে পারছে না, তার উপর যে কোনো আঁচ আসবে, সেই সম্ভাবনা কম। একটা ওয়েবসাইট-এ গেলে তার About অংশে দেখা যায় কারা সেই ওয়েবসাইট-এর সাথে জড়িত। একটা facebook রিপোস্ট-এ দেখা যায় কোথায় post-টা হয়েছিল। একটা হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড-এ সেসবের বালাই নেই। অচিরেই ফরওয়ার্ড-এর জন্মদাতার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়না (খোঁজ পেতে হলে পুলিশ লাগিয়ে ধরে ধরে সূত্রে যেতে হবে, আর ভুয়ো খবর দেওয়ার বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই, অতএব সেসবের ভয় নেই)। অতএব ফরওয়ার্ড-এর জন্মদাতাকে কোনো জবাবদিহিও করতে হয়না। ফরওয়ার্ড-টা আমার-আপনার কাঁধে চড়ে নিজে নিজেই এগোতে থাকে।
হোয়াটস্যাপ-এর মতো প্ল্যাটফর্ম-এ এই যে আড়ালে থেকে খুব চট করে অনেকের কাছে পৌঁছে যাওয়া যায়, এটা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কাজেরও। অনেক সময়, এই আড়ালে থাকতে পারার ফলেই কিছু দেশের সাধারণ নাগরিক অত্যাচারী সরকারের চোখ এড়িয়ে একটা বড়সড় বিক্ষোভমিছিল-এর আয়োজন করতে পারে। আবার ভুয়ো খবর ছড়ানোর বিরুদ্ধে যে জেল-জরিমানা-সমৃদ্ধ আইন করা উচিত, এটাও স্পষ্ট নয়। সেই আইন কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, সেটাও আমরা জানি না।
ফরওয়ার্ড-এর দৌরাত্ম্য কীভাবে কমানো যায়
যেহেতু আপনি এই ফরওয়ার্ড-এর চেন-এ একটা লিঙ্ক, আপনাকেই আরেকটু দায়িত্ত্ব নিতে হবে। উপরের ফরওয়ার্ড-টার মতো কোনো ফরওয়ার্ড পেলে সেটাকে এগিয়ে দেওয়ার আগে আরেকটু খোঁজখবর করুন। বেশিরভাগ ভুয়ো খবরের ক্ষেত্রেই একটু গুগল সার্চ করলেই তার সারশূন্যতা বেরিয়ে যায়। কোনো ফরওয়ার্ড এগিয়ে দেওয়ার আগে ওই সামান্য সার্চটুকু আপনার করা উচিত। সার্চের উদ্দেশ্য হলো, অন্তত মতামতের মূল সূত্রটা খুঁজে বার করুন (এবং পারলে, পড়ুন)। মূল সূত্রটা যদি একটা কঠিন গবেষণাপত্র হয়, সেগুলো সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়ার মতো অনেক সাইট থাকে, সেগুলো ঘেঁটে দেখুন। (‘বিজ্ঞান’-এও আমরা এরকমই চেষ্টা করি, সহজ করে গবেষণার ফলাফল বোঝাতে।) ইন্টারনেট-এ সার্চ করে যদি চট করে কিছু না মেলে, যে আপনাকে ফরওয়ার্ড-টা করেছে, তাকে জিজ্ঞেস করুন। হয়তো সে-ও সকালবেলা চা খেতে খেতে বেশি না ভেবে ফরওয়ার্ড-টা করেছে এবং আপনার প্রশ্নের ফলে পরের ফরওয়ার্ড-টা করার আগে সে-ও তার সত্যতা যাচাই করার ন্যূনতম চেষ্টাটা করবে।
আগামী বেশ কিছু লেখাতে বা পডকাস্টে আমরা বিশেষ বিশেষ কিছু ফরওয়ার্ড নিয়ে আলোচনা করবো। আপনি যদি এরকম বিতর্কিত ফরওয়ার্ড পেয়ে থাকেন এবং সেই সংক্রান্ত প্রশ্ন আপনার থাকে, আমাদের ই-মেল পাঠান [email protected] – এ বা নিচে কমেন্ট-এ লিখুন। এটাও জানাতে পারেন, আপনি কীভাবে বুঝলেন, হোয়াটস্যাপ-এ পাওয়া খবরটা ভুয়ো। আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের পাঠকদের কাজে লাগবে।
It’s not only a very essential information but responsible one in this challenging time.