ড: অরুণিমা রায়
প্রথমেই একটি প্রকারভেদ করা যাক।
আবেগ শব্দের অর্থ আলাদা করে বলছি না, তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু কিছু আবেগ ঠিক আবেগের পর্যায়ে থাকে না – তা আমাদের চরিত্রের অংশ হয়ে ওঠে।
যেমন ধরো রাগ আমরা কোনও না কোনও সময়ে সকলেই করে থাকি। কিন্তু পাড়ার বদমেজাজি কাকু – সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইলেও চোটপাট করবেন, ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বাড়ির বাগানে বল ঢুকে গেলে তা নিয়েও পাড়া মাথায় করবেন।
তেমনি আবার ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে বসা মুখচোরা ছেলেটি।
আমরা অনেক জায়গাতেই একটু একাকীত্ব পছন্দ করি, হয়ত যখন কোনও জটিল থিওরেম ভাবছি, বা যখন অফিসের ধকল সামলে বাড়িতে এসে নেটফ্লিক্সে প্রিয় অনুষ্ঠান দেখছি। কিন্তু অন্তর্মুখী বা বহির্মুখী হওয়া – তা কিন্তু এরম বিচ্ছিন্ন ঘটনা না, তা চরিত্রের গোড়ার ব্যাপার।
এবার প্রশ্ন হলো, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য (personality traits) আর আবেগ (emotional traits), কোনটার কতটা জন্মগত, কতটাই বা অর্জিত। এই বিষয়টা নিয়ে গবেষণা চলছে। আমরা খুব স্পষ্টভাবে জানি না।
কিছু জিনিস অবশ্য জানা গেছে।
প্রথম হল, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গড়ে তোলার মালমসলার শতকরা ৪০-৬০ শতাংশ জন্ম থেকে পাওয়া। আবেগের ক্ষেত্রে তা একটু কম, শতকরা ২০-৫০ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে শতাংশের হিসেবটা খুবই কাঁচা, জানার চেয়ে অজানার পরিধিটাই এখানে অনেক বেশি।
এখানে প্রাসঙ্গিক, আবেগ চরিত্রের মজ্জাগত ব্যাপার নয় বটে, কিন্তু আবেগ আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ফারাকটা খুবই সূক্ষ্ম – ডিপ্রেশন, anxiety এইসবের প্রভাব চরিত্রের ওপর পড়তে পারলেও ব্যাপারগুলিকে emotional trait বা আবেগ হিসেবেই ধরা হয়। এদের treatment আছে; anxiety বা clinical depression অনেক সময়েই সেরে যায়। কিন্তু অন্তর্মুখী হওয়া কোনও রোগ না। আগেও যেমন বলা হয়েছে, অন্তর্মুখীতা আমাদের চরিত্রের প্রতিফলন।
অনেকটা সেইকারণেই অনেক বিজ্ঞানী অনুমান করেন যে আবেগের ক্ষেত্রে অর্জিত উপকরণ বেশি।
চরিত্র একটা খুবই লম্বা সময় ধরে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অপরিবর্তিত থাকে। খুব আকস্মিক বা তীব্র পরিবর্তন না এলে চরিত্র পালটায় না। যে ছেলে ভারতে মুখচোরা, সে বাইরের দেশে Ph.D. করতে এসে হটাৎ ভীষণ মিশুকে আর প্রগলভ হয়ে যাবে, এরম ঠিক হয় না।
আবেগ কিন্তু সেই তুলনায় সদা পরিবর্তনশীল। কোনোদিন মুড ভালো, যেমন ধরো অফিসে প্রমোশন হবার পর। কোনোদিন একদমই মুড অফ। বসের সাথে প্রচুর ঝামেলা হবার পর বা ইন্ডিয়া বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল হেরে যাওয়ার পর। তাই যদিও অখন্ডনীয় প্রমাণ পাওয়া যায় নি, আবেগের উপর পরিস্থিতির চাপ স্পষ্ট।
অর্জিত ও জন্মগত উপকরণ সময়ের সাথে সাথে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যতে কতটা প্রভাব ফেলে তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেকের মতে জন্মগত উপকরণের প্রভাব সময়ের সাথে প্রায় অপরিবর্তনীয় [১]। অন্যদিকে, অর্জিত উপকরণের প্রভাব গোড়ার দিকে শূন্য। তা বয়সের সাথে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ৩০ বছর বয়সের পর চরিত্রে যা পরিবর্তন, তার প্রায় সবটুকুই অর্জিত – পারিপার্শ্বিক অবস্থার দরুন।
কিন্তু ৩০ বছরের আগে কীরকম? অনেক বাবা-মাই ভাবেন বয়ঃসন্ধিকাল চরিত্র গঠনের মূল সময়। ছেলেমেয়ে বখে যায় বয়ঃসন্ধিতেই। তা কতটা সত্যি?
কিছুটা সত্যি তো বটেই। পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছিল বেশ কয়েকজন যমজ বোনের বয়ঃসন্ধি থেকে যৌবনে বেড়ে ওঠার কালে। মনোবিজ্ঞানীরা এরম `twin study’ প্রায়ই করে থাকেন। বিজ্ঞানীরা তাদের চরিত্রের নানা দিক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন [২]।
বেড়ে ওঠার সময়কালকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে [২] – বয়ঃসন্ধির অবসানকাল (১৭ – ২৪ বছর), আসন্ন যৌবনকাল (২৪ – ২৯ বছর), ও যৌবনকাল (২৯ বছর)। দেখা গেছে চরিত্রগঠনে প্রথম পর্যায়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। পরের পর্যায়গুলি মোটামুটি স্থিতিশীল।
আরও একটা মজার জিনিস লক্ষ করেছিলেন এঁরা। এই যে রাগ, কান্না, হাসি, লজ্জা, ঘেন্না – এই সব কিছুর অবদান নিয়ে একটা variable ডিফাইন করা হয়ে থাকে – নাম negative affectivity। কম negative affectivity মানে সে খুব শান্তশিষ্ট, ধীর, স্থির – সহজে রেগে যায় না। বেশি মানে সেই পাড়ার বদমেজাজি, খিটখিটে কাকু। তা বয়সের সাথে সাথে নাকি negative affectivity কমতে থাকে। মানে যে ছেলেটি বয়ঃসন্ধিকালে চালচুলোহীন, বদমেজাজি – যে কিনা রকে আড্ডা, বাড়িতে লুকিয়ে সিল্ক কাট খাওয়া, কলেজ বাঙ্ক করে সিনেমা দেখা, কিছুই বাকি রাখেনি – সেই কিন্তু তিরিশ পেরলে দায়িত্ববান সংসারী ও চাকুরীজীবী।
এই যে বারবার জন্মগত শব্দটা ব্যবহার করছি, ঠিক কোন জিনগুলি এঁর জন্য দায়ী? তা নিয়েও অনেক গবেষণা আছে [৩]। এই যে বিভিন্ন আবেগের সমাহার, প্রত্যেকটির জন্য একটি করে জিন আছে। অনেকগুলি আবেগ আবার গভীরভাবে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। বহির্মুখীরা নাকি বেশ সহানুভূতিশীল হয় – ওই জিন-এর জন্যই। কয়েকটি আবেগ – এই যেমন খামখেয়ালী (neurotic) হওয়া – নাকি পুরোটাই জিনগত, পরিপার্শ্বের খুব একটা প্রভাব নেই সেগুলিতে।
শেষ করি দুটি মজার থিওরি দিয়ে। আগেই বলেছি প্রচুর গবেষণা এখনো হয়ে চলেছে প্রশ্নটি নিয়ে, যা শতকরা হিসেব দেওয়া হয়েছে, তা খুবই কাঁচা। তা একদল বিজ্ঞানী মনে করেন চরিত্রের ক্ষেত্রে জন্মগত প্রভাবেরই আধিপত্য – তাঁদের hypothesis এর নাম intrinsic maturation hypothesis। আরেকদল মনে করেন প্রভাবগুলি অর্জিত – যা কিনা life-course hypothesis।
জিন না পরিবেশ? এই মূল তর্কটি আসলে অনেক পুরনো, শুধু মনস্তত্ব নয়, দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান – অনেক কিছুতে এর প্রভাব। ছোট্ট একটি নামও দেন অনেকে – nature versus nurture। তুমি কোন দলে? দুই দলের যুক্তিগুলি বিশদে পড়ে দেখতে পারো।
Bibliography:
[১] “Genetic and Environmental Continuity in Personality Development: A Meta-Analysis”, Briley et al.
[২] “Genetic and environmental influences on personality trait stability and growth during the transition to adulthood: A three wave longitudinal study”, Hopwood et al.
[৩] “Genome-wide analyses for personality traits identify six genomic loci and show correlations with psychiatric disorders”, Lo et al.
ড: তনয় মাইতি
জন্মগত না অর্জিত – কোনটা বড়? বিজ্ঞানীরা আজ বলেন দুটোই বড়। প্রমাণ তাই বলছে। বিজ্ঞান বহুমুখী, তাই একই ঘটনার বিভিন্ন প্রকারের ব্যাখ্যা সম্ভব।
আবেগ শরীর, মননক্ষমতা, ও আচার-আচরণের বহিঃপ্রকাশ। মনোবিজ্ঞানীরা আবেগ ছাড়াও আরও দুটি ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট শব্দ ব্যাবহার করে থাকেন। একটি হল `temperament’ বা স্বভাব। স্বভাব দিয়ে মূলত খুব ছোট বাচ্চাদের মনস্তত্ত্ব বোঝা যায়। অন্যটি `personality’ বা ব্যক্তিত্ব। তা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।
স্বভাব মূলত জন্মগত, জেনেটিক থিওরি দিয়ে প্রায় পুরোটাই ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথম দিকে বাচ্চাটি কি খাচ্ছে, কার সাথে কিভাবে কখন কী কথা বলছে, কখন কাঁদছে, কখন কোথায় কতটা মনোযোগ দিচ্ছে – প্রায় সবই জিনের কারসাজি, বাবা-মার থেকে পাওয়া।
স্বভাবের থেকেই সময়ের সাথে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। কেউ তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে কিভাবে মিশছে, তা ব্যক্তিত্বের বিকাশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জিনের প্রভাবও কিন্তু আছে। ব্যক্তিত্বের জাতিগত প্রকারভেদের জন্য জিন ও পরিবেশ দুটোই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। সেরোটোনিন ট্রান্সপোর্টার জিন, অক্সিটোসিন রিসেপ্টর জিন ও ডোপামিন রিসেপ্টর জিন আচরণে ও মনস্তত্ত্ব বিকাশে সাহায্য করে। বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে জিনগুলি বিভিন্ন রূপে ব্যাক্ত হয়, যাকে `genetic polymorphism’ বলে। স্বভাবের ক্ষেত্রেও এদের প্রভাব আছে। শুধু এই দুই জায়গাতেই না, অক্সিটোসিন রিসেপ্টর জিনের প্রভাব আরও অনেক বিচিত্র জায়গায় দেখা গেছে – যেমন বাচ্চাদের কাঁদার ক্ষেত্রে, আত্মমর্যাদার বিকাশের ক্ষেত্রে, কারো বহির্মুখী বা অন্তর্মুখী হওয়ার ক্ষেত্রে, কোনও কিছু নিয়ে আশাবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে, কোনও পরিবেশে একাকীত্ব অনুভব করার ক্ষেত্রে।
এক কথায় বলতে গেলে আমাদের চরিত্রের বিকাশ দুই সমান্তরাল প্রক্রিয়ার পরিণাম – প্রথমটি জিনের অভিব্যাক্তি, দ্বিতীয়টি পরিবেশের চাপ। অভিভাবক বা বংশের পূর্বপুরুষরা তাই কিছুটা দায়ী – জন্মগত উপাদানগুলি সবই তাঁদের থেকেই। তবে বাকিটা কিন্তু পরিবেশ।
ছবির ঋণ স্বীকার : https://www.shutterstock.com/