আকাশবাণীতে যোগ দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই অনুষ্ঠান তৈরির প্রথম দায়িত্ব পেলাম। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জাতীয় সম্মেলন। নিমন্ত্রণপত্র হাতে নিয়ে, গাড়ির ব্যবস্থা করে যখন কলেজ প্রাঙ্গণে পৌঁছলাম তখন সামান্য দেরি হয়ে গিয়েছে। হুড়মুড় করে বেকার হলে ঢুকে সংবাদমাধ্যমের জন্য নির্দিষ্টিকৃত জায়গায় বসলাম। মঞ্চে তখন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো এক বক্তা। ছোটখাটো, শীর্ণ শরীর তাঁর কিন্তু বক্তব্যের তেজ চোখ-কান টেনে রাখার মত। ঠিক কী কী বলেছিলেন তিনি তা এখন আর স্পষ্ট মনে নেই তবে এটুকু মনে আছে যে প্রেসিডেন্সি কলেজে নিজের লেখাপড়া করার সময়টা কেমন উত্তাল ছিল, নকশাল আমলের অশান্ত পরিস্থিতি কতটা প্রভাব ফেলত পড়াশোনায় তা আলোচনা করেছিলেন তিনি। এছাড়া সভার উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তো ছিলই। বক্তব্য শেষে যখন হাততালিতে ফেটে পড়ছে সভাঘর তখন পাশে বসা সাংবাদিকের কাছে বক্তার নাম জানতে চাইলাম। কথা না বলে তিনি নিমন্ত্রণপত্রের একটা নামের উপর তর্জনী রাখলেন। এন সি রানা। নারায়ণচন্দ্র রানার সঙ্গে সেই প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ আমার। বাকিটা জেনেছি বই পড়ে আর তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষজনের কাছ থেকে।
সাউড়ি থেকে শহর কলকাতা
রাজেন্দ্রনাথ রানা আর নাকফুড়ি দেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান নারায়ণচন্দ্র রানার জন্ম ১৯৫৪ সালের ১০ই অক্টোবর। তাঁর গ্রামের নাম সাউড়ি, বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। পিতল সহ নানা ধাতুর শিল্পকর্ম করতেন রাজেন্দ্রনাথ। একইসঙ্গে নিজের বাড়িতে চালাতেন একটা পাঠশালা। রানার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি সেখানেই। পঞ্চম শ্রেণীতে সে এসে ভর্তি হল সাউড়ির ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরে। ঝকঝকে হাতের লেখা আর অঙ্ক কষায় তার নিপুণ দক্ষতা নজর কাড়ল সবার। এই স্কুলে দুটো বছর কাটতে না কাটতেই সঙ্কট দেখা দিল পরিবারে। নিউমোনিয়ায় ভুগে বাবা মারা গেলেন, শুরু হল অর্থের টানাটানি। রানার লেখাপড়া অবশ্য এতে থেমে যায়নি। শত কষ্টের মধ্যেও ভালো ফল করতে থাকল সে। অষ্টম শ্রেণীতে রানা আর তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু গৌরকিশোর রাউত মিলে এক দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করলো। নাম দেওয়া হলো ‘কিশোর’। এব্যাপারে সবরকম সাহায্য করতেন মাস্টারমশাই মহীতোষ দাস। নিজের লেখাপড়ার বাইরে সহপাঠীদের সাহায্য করতে হত রানাকে। নীচু ক্লাসের ছাত্ররাও তাঁর কাছে আসত পড়া বুঝতে। এমনকি কখনও-সখনও তাঁকে দু’ একটা ক্লাস নিতেও বলা হত। কিছুদিন পরে বিদ্যালয়ে এসে যোগ দিলেন বিজ্ঞানের শিক্ষক মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ি। ন্যূনতম আসবাবপত্র নিয়ে তাঁর ঘর, সেখানে ছিল ছাত্রদের অবাধ যাতায়াত। মণিবাবু রাতের আকাশ খুঁটিয়ে দেখতে শেখাতেন ছাত্রদের। তবে এ ব্যাপারে অন্য সবার থেকে এগিয়ে থাকত রানা, সে ছিল তাঁর প্রিয় ছাত্র। সহপাঠীদের কখনও মনে হত যেন রানা আর মণিবাবু দুই বন্ধু। কারও মনে হত রানা তাঁর মানসপুত্র। সে যাই হোক না কেন, রানার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পিছনে সবথেকে বেশি অবদান যে মণিবাবুর তা এক বাক্যে স্বীকার করেন সবাই।
রানার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পিছনে সবথেকে বেশি অবদান যে মণিবাবুর তা এক বাক্যে স্বীকার করেন সবাই।
১৯৬৯ সালের স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় রানা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। গৌরকিশোর রাউত পেয়েছিল পঁচিশতম স্থান। অর্থের অভাবে এরপর হয়তো লেখাপড়া এগোতো না যদি না স্কুলের কয়েকজন মাস্টারমশাই দায়িত্ব নিয়ে এই দুই কৃতী ছাত্রকে বেলঘরিয়ার রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যার্থী আশ্রমে নিয়ে যেতেন। বিনা খরচে থাকা, খাওয়া আর পাঠাগার ব্যবহারের সুযোগ পেল দু’জন। শহরের পরিবেশে বড় হতে থাকলো তারা। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রি-ইউনিভার্সিটি কোর্সে ভর্তি করে দেওয়া হলো দু’জনকে। সেখানেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে রানা ভর্তি হলো প্রেসিডেন্সি কলেজে, পদার্থবিজ্ঞানে সাম্মানিক সহ। পড়াশোনার অভিমুখ পাল্টে রাউত গেল নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে এম বি বি এস পড়তে। প্রেসিডেন্সিতে অন্যান্য অনেক মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে রানা পেল কসমোলজির পথিকৃৎ অমল কুমার রায়চৌধুরীকে। প্রত্যাশিতভাবেই তাঁর অত্যন্ত প্রিয় একজন ছাত্র হয়ে উঠল রানা। পরবর্তী জীবনে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার তালিমটা সেরা মানের হল এভাবেই। প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতক হওয়ার পর রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজ থেকে এম এস সি করলেন রানা। তবে কলেজে থাকতে থাকতেই শ্বাসকষ্টে ভোগা শুরু হলো। অল্প হাঁটাহাঁটিতে হাঁপিয়ে পড়া, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে বারবার থেমে যাওয়া তাঁর আগামী জীবনের দুর্বিষহ কষ্টের ঈঙ্গিত দিচ্ছিল।
রানার গবেষণা
১৯৭৭ সালে Tata Institute of Fundamental Research (টি আইএফ আর)এ ঢোকার জন্য আবেদন করেন তিনি। গৌরকিশোর রাউত জানিয়েছেন যে তাঁর পরীক্ষা নিয়েছিলেন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার। ২৫৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন রানা। নারলিকারের অধীনেই গবেষণার সুযোগ হল। বিষয় – Cosmic Microwave Radiation। এ প্রসঙ্গে একটু পরেই আলোচনায় ঢোকা যাবে। এই সময় থেকেই অবশ্য রানার শারীরিক অসুস্থতা বাড়তে থাকে। মিশনের মহারাজদের চেষ্টায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আর এন চ্যাটার্জির কাছে চিকিৎসা শুরু হয় রানার। ১৯৭৮ সালের ২২শে অক্টোবর তাঁর বুকে পেসমেকার বসানো হয়। চিকিৎসার খরচ বাড়ছিল হু হু করে কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় টি আই এফ আর কর্তৃপক্ষ। ১৯৮১ সালে রানা লাভ করেন পি এইচ ডি। এর দু’ বছরের মধ্যে তিনি ভূষিত হন Indian National Science Academy-র দেওয়া Young Scientist Medal-এ। এই বছরেই তিনি পোস্ট ডক্টরাল কাজের জন্য চলে গেলেন বিলেতের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে প্রখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী Arnold Wolfdaleএর তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করলেন তিনি। ওখানেও তিনি নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। দু’টো আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পান। ডারহ্যামে একজন মেধাবী ছাত্র D A Wilkinson রানার অধীনে গবেষণা শুরু করেন। গুরু-শিষ্য মিলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র লিখেছেন। ১৯৮৫ সালের অক্টোবরে রানা বম্বেতে ফিরে আসার পরে উইলকিনসন এদেশে এসে নিজের থীসিস শেষ করেন। ১৯৮৬ সালে পুনায় IUCAA প্রতিষ্ঠিত হলে নারলিকারের সঙ্গে এসে যোগ দেন রানা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন তিনি।
এবারে রানার গবেষণার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করা যাক। রানার পাঠ ও গবেষণার ক্ষেত্র জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান। বিংশ শতকে নব নব আবিষ্কারের ফলে এই ক্ষেত্রের মধ্যে আরও ছোট ছোট ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। রানা এর অনেকগুলোতেই নিজের অবদান রেখেছেন। গত শতকের মাঝামাঝি, ঠিক করে বলতে গেলে ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ খৃষ্টাব্দে মহাবিশ্বের উদ্ভব আর তার বিবর্তন নিয়ে দুটো তত্ত্ব এল বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। এর মধ্যে পরের তত্ত্বটার পরিচিতি বেশি। জর্জ গ্যামোর দেওয়া এই তত্ত্ব বিগ ব্যাং (Big Bang) নামেই পরিচিত। তিনি বলেন যে এই বিশ্ব অনাদি নয়, এর একটা সৃষ্টিবিন্দু আছে। অর্থাৎ কোনো একটা সময় থেকে শুরু করে বিবর্তনের পথ ধরে আজ মহাবিশ্ব পৌঁছেছে এই জায়গায়। অন্য যে তত্ত্বটা একইভাবে আলোড়ন ফেলেছিল বিজ্ঞানীদের চিন্তাজগতে তা হল এডুইন হাবলের দেওয়া মহাবিশ্বের প্রসারণ তত্ত্ব। সংগৃহীত তথ্য থেকে হাব্ল ধারণা করেছিলেন যে মহাবিশ্বের বস্তুপুঞ্জ একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই অপসরণের হার দুটো বস্তুপুঞ্জের মধ্যেকার দূরত্বের সমানুপাতিক। গ্যামো বললেন, একদিকে মহাবিশ্ব সমদৈশিক (isotropic) আর সমসত্ত্ব (homogeneous), অন্যদিকে তা প্রসারিত হচ্ছে। তার মানে প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্বের ঘনত্ব কমছে। তাহলে অতীতে নিশ্চয়ই এই ঘনত্ব বেশি ছিল। আরও পিছিয়ে গেলে বলা যেতে পারে যে এক সময় সব বস্তু ঠাসা ছিল একটা বিন্দুতে এবং তার ঘনত্ব ছিল কল্পনার অতীত। সেই বিন্দু থেকে এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে মহাবিশ্ব, ঘটে চলেছে তার প্রসারণ। গ্যামো হিসাব করে বললেন যে এই প্রসারণ শুরু হয়েছে এক হাজার থেকে দু’ হাজার কোটি বছরের মধ্যবর্তী কোনো একটা সময়ে। এই শুরুর মুহুর্ত পরিচিত বিগ ব্যাং নামে।
গ্যামোর ভাবনা লোকসমক্ষে আসার বছরখানেক আগে ফ্রেড হয়েল, হারমান বন্ডি এবং টমাস গোল্ড মহাবিশ্ব সৃষ্টির যে তত্ত্ব দেন তাতে সৃষ্টিবিন্দুর কোনো ধারণা ছিল না। তাঁরাও মহাবিশ্বের সমদৈশিক ও সমসত্ত্ব ধর্মকে কাজে লাগান। Steady State Theory নামে পরিচিত তাঁদের তত্ত্বের বক্তব্য ছিল, মহাবিশ্ব মোটামুটি অপরিবর্তিতই আছে এবং ছোটখাটো পরিবর্তন বাদ দিলে এমনই থাকবে। দুটো তত্ত্বই কিছু পরিমাণে সফল হলো মহাবিশ্বের অবস্থা এবং বিবর্তন সম্পর্কিত নানা প্রশ্নের জবাব দিতে। সমানে-সমানে যখন প্রতিযোগিতা চলছে তখনই ১৯৬৫ সালে হঠাৎ করে সামনে আসা একটা আবিষ্কার গ্যামোর তত্ত্বের পাল্লা ভারী করে দিল। আর্নো অ্যালান পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন রেডিও অ্যান্টেনা নিয়ে কাজ করার সময় দেখলেন যে মহাবিশ্বের সব দিক থেকে একটা বিকিরণ আসছে। রেডিও অ্যান্টেনা যেদিকেই ঘোরানো যাক না কেন, বিকিরণ থাকছে একইরকম। পরম শূন্য তাপমাত্রার ডিগ্রী তিনেক উপরে কোনো বস্তুর তাপমাত্রা রাখলে সেটার থেকে যে বিকিরণ হয় তেমনই বিকিরণ আসছে চারদিক থেকে। পৃথিবীর আবহমন্ডলের গড় তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় চট করে ধরা যায় না এই বিকিরণ। পেনজিয়াস ও উইলসনের আবিষ্কার বিগ ব্যাং-কে যেন একটা দৃঢ় ভিত্তি দিল। এই মতের অনুসারীরা বললেন যে মহাবিশ্বের আদিতম তল থেকে আসছে এই অবশিষ্ট বিকিরণ (relict radiation)। পশ্চাৎপটের এই বিকিরণ পরিচিত হল Cosmic Microwave Background হিসেবে। মনে করা হলো, হয়েল-বন্ডি-গোল্ডের তত্ত্ব এবার অবান্তর হয়ে গেল।
কিন্তু এত সহজে একটা তত্ত্বকে বিসর্জন দেন না প্রবক্তারা। এখানে খেয়াল রাখতে হবে, টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে নারায়ণ চন্দ্র রানা গবেষণা শুরু করেন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের অধীনে এবং গবেষণার বিষয় ছিল Cosmic Microwave Radiation। অর্থাৎ সেই একই পশ্চাৎপট বিকিরণ যা নিয়ে আলোচনা করছি আমরা। একইসঙ্গে আরও একটা কথা মনে না রাখলেই নয়। নারলিকার ছিলেন ফ্রেড হয়েলের ছাত্র এবং হয়েলের প্রবর্তিত বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে তাঁর গবেষণা তথা অবদানও ছিল উল্লেখযোগ্য। ফলে সামগ্রিকভাবে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র এবং গবেষক হলেও রানা কাজ শুরু করলেন Steady State Theory-র শিবির থেকে।
টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে নারায়ণ চন্দ্র রানা গবেষণা শুরু করেন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের অধীনে এবং গবেষণার বিষয় ছিল Cosmic Microwave Radiation।
পশ্চাৎপট বিকিরণের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন হয়েল ও নারলিকার। শুধু তাই নয়, তাঁরা নিজেদের তত্ত্বের কিছু পরিবর্তন করে নাম দেন Quasi Steady State Theory। পরিবর্তনের বিস্তারিত আলোচনা এই প্রবন্ধের পরিসরে সম্ভব নয়। আমরা যেটা করতে পারি তা হলো পশ্চাৎপট বিকিরণের যে ব্যাখ্যা উপস্থিত করেছিলেন এই বিজ্ঞানীরা তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা। রানা নিজে উৎসাহী ছিলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে। বহু পথিকৃৎ বাঙালি বিজ্ঞানীর মত তিনি নিজেও চেষ্টা করতেন সহজ ভাষায় মানুষের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিতে। ১৯৮৩ সালে লেখা তাঁর এক প্রবন্ধের নাম ‘মহাবিশ্বের উৎস সন্ধানেঃ সাম্প্রতিক বিতর্ক’। সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখছেন,
‘… স্থিরাবস্থা মডেলের প্রবক্তারা অবশ্য তাঁদের মডেলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মহাজাগতিক ক্ষুদ্রতরঙ্গের ব্যাকগ্রাউন্ডের উৎস সম্পর্কে বিকল্প ব্যাখ্যা দেওয়ার জোরদার চেষ্টা চালালেন। তাঁরা দেখালেন যে, ছায়াপথের নক্ষত্রের আলোর যা জোর রয়েছে তা দিয়ে নক্ষত্রের মধ্যে হাইড্রোজেন, হিলিয়ামে রূপান্তরিত হতে পারে। শুধু তাই নয়, নির্গত নক্ষত্রালোক ছায়াপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কার্বন বা লৌহকণিকার দৌলতে অপেক্ষাকৃত কমজোরি হয়ে সম্ভবত ঐ ক্ষুদ্রতরঙ্গের ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরির ক্ষমতা রাখে।’ গবেষক রানা নিজেও পশ্চাৎপট তৈরির ব্যাখ্যা হিসাবে কার্বন ও লৌহকণিকার আলো শোষণ এবং পুনরায় বেতার তরঙ্গ হিসাবে বিকিরণের কথা বলেন। ১৯৮০ সালে লেখা এর পরের দুটো গবেষণাপত্রে বিষয়টার খুঁটিনাটি আলোচনা করেন তিনি। সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে স্থিরাবস্থা মডেলের পক্ষ নিয়ে উপস্থিত করা এই সব ব্যাখ্যা তেমন গৃহীত হয় নি জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে। কিন্তু রানার উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা স্বীকৃত হয়েছে।
স্থিরাবস্থা মডেলের পক্ষ নিয়ে উপস্থিত করা এই সব ব্যাখ্যা তেমন গৃহীত হয় নি জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে। কিন্তু রানার উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা স্বীকৃত হয়েছে।
নক্ষত্রের অভ্যন্তরে নতুন নতুন মৌলিক পদার্থ সৃষ্টি সম্পর্কেও রানার গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৬ সাল নাগাদ হয়েল দেখাতে সক্ষম হন যে ভারী, বিশালাকার নক্ষত্রের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব, দুটোই এত উচ্চ মানে পৌঁছোয় যে সেখানে ভারী মৌল যেমন লোহাও সৃষ্টি হতে পারে। সুপারনোভা জাতীয় বিস্ফোরণের সঙ্গে এই সব মৌল ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যে। এর আগে মৌলিক পদার্থের সৃষ্টি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না বিজ্ঞানীদের কাছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে নক্ষত্রের মধ্যে মৌলের সৃষ্টি ব্যাপারটা আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁরা বরং জর্জ গ্যামোর তত্ত্বে আস্থা রেখেছিলেন যে মহাবিশ্ব সৃষ্টির পরে এক লহমায় তৈরি হয়েছিল নানা মৌল। বস্তুতপক্ষে অনেকের বক্তব্য হলো যে গ্যামো বিগ ব্যাং মডেলের জন্ম দিয়েছিলেন মৌলের সৃষ্টি এবং মহাশূন্যে তা ছড়িয়ে পড়া ব্যাখ্যা করতে। পি এইচ ডি পর্ব থেকেই নারলিকার তাঁর গাইড ফ্রেড হয়েলের এই সব ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই প্রভাব রানার মধ্যেও দেখা দিয়েছিল। কিন্তু যথার্থ বিজ্ঞানী কোনো প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে গবেষণার পথ ধরেন না। গ্যামো এবং হয়েল, দু’জনের তত্ত্বেরই আংশিক সাফল্য এবং আংশিক ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করেছিলেন রানা। পাশাপাশি নিজে মহাবিশ্বে মৌলের বন্টন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিশ্লেষণ করেন। গ্যালাক্সির রাসায়নিক গঠন তথা বিবর্তন নিয়েও তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।
প্রেসিডেন্সির সেই সভা
খালি চোখে রাতের আকাশে চাঁদ, গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু ইত্যাদি দেখে অগাধ আনন্দ পেতে পারেন একজন মানুষ। নিজের চর্চাকে আর একটু নিবিড় করতে পারলে তিনি ঢুকে পড়তে পারেন শখের জ্যোতির্বিদদের দলে। এমন শখের জ্যোতির্বিদদের দেওয়া তথ্যে বহুবার সমৃদ্ধ হয়েছে পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জ্ঞানভান্ডার। আজও সেই ধারা বহমান। এই অপেশাদার চর্চাকে বৈজ্ঞানিক করে তুলতে অনেক সময়ই সহযোগীর প্রয়োজন অনুভব করেন একজন জ্যোতির্বিদ। সেই তাগিদ থেকেই বিশ্বের নানা জায়গায় তৈরি হয়েছে অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের সংগঠন। তাতে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরাও থেকেছেন। ভারতে এমন সংগঠন প্রথম তৈরি হয় কলকাতায় ১৯১০ সালে, হ্যালির ধূমকেতু পর্যবেক্ষণকে কেন্দ্র করে। এর পরেও বিচ্ছিন্নভাবে দেশের নানা প্রান্তে গড়ে উঠেছে এমন সংগঠন।
সরকারি অর্থানুকূল্যে ১৯৯০ সালে পুনায় Inter University Centre for Astronomy and Astrophysics (IUCAA) নামে এক স্বশাসিত সংস্থা গড়ে ওঠে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের তত্ত্বাবধানে। পরের বছর এই সংস্থাই প্রথম সারা ভারত জ্যোতির্বিদ্যা সম্মেলনের আয়োজন করে। এর পরের দুটো বছরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যথাক্রমে ওয়ার্ধা এবং নাগপুরে। চতুর্থ বছরে এই সম্মেলন হয় কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। দায়িত্ব নিয়েছিল যে ট্রাস্ট তা গঠন করেছিলেন রানা নিজেই, তাঁর শিক্ষক মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ির স্মৃতিতে। পরমপ্রিয় শিক্ষক যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন তখন তিনি IUCAAর সহযোগী অধ্যাপক। কিন্তু গুরুর অসুস্থতার কথা শুনে সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছিলেন। হুগলির গুড়াপে সাতদিন ধরে মণিবাবুর পাশে থাকলেন। ১৯৯১ সালের ৫ই জানুয়ারি মণিবাবুর মৃত্যুর দু’ মাসের মধ্যে সাউড়িতে স্থাপিত হল ‘মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ি স্মৃতি বিজ্ঞান মন্দির’। এরই পরের ধাপে ১৯৯৩ সালে কলকাতায় তৈরি হয় মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ি অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্রাস্ট।
অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের এক ছাতার নীচে নিয়ে আসার উদ্যোগের সঙ্গে রানা জড়িত ছিলেন প্রথম থেকেই। IUCAAতেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের দায়িত্বে।
সেই ট্রাস্টের উদ্যোগেই ১৯৯৪ সালের ২১ ও ২২শে জানুয়ারি কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল 4th All India Amateur Astronomers’ Meet। প্রেসিডেন্সি কলেজে আসা ছাত্রছাত্রীদের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত যাবতীয় কৌতূহল মেটালেন রানা। অন্যেরা তাকিয়ে দেখলেন মুগ্ধ হয়ে। তৈরি হল Confederation of Indian Amateur Astronomers। নিজে রইলেন বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে। আসলে অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের এক ছাতার নীচে নিয়ে আসার উদ্যোগের সঙ্গে রানা জড়িত ছিলেন প্রথম থেকেই। IUCAAতেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের দায়িত্বে। অপেশাদারদের সংগঠনের যাতে একটা দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রচিত হয় তার জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় সম্মেলনে সারা ভারতের অপেশাদার জ্যোতির্বিদদের গুণগত মান নির্ধারণের জন্য একটা উদ্ভাবনী সমীক্ষা করেন। এটা পরবর্তী সময়ে বেশ কাজে এসেছে বলে অনেকের অভিমত।
সূর্যগ্রহণ ও রানা
রানার আরও একটা উদ্যোগকে সামনে আনা দরকার যেখানে তিনি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠানের চার দেওয়ালের বাইরে থাকা মানুষের সঙ্গে মিশেছিলেন। স্থান দিল্লি-জয়পুর হাইওয়ে এবং সময় ১৯৯৫ সালের ২৪শে অক্টোবর। সেবারের সূর্যগ্রহণকে ব্যবহার করে ব্যাপকভাবে জনসচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন। ছাপা হয়েছিল পুস্তিকা, বিতরণ করা হয়েছিল নিরাপদে সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য উপযুক্ত চশমা। রানা নিজেও বাংলায় একটা প্রবন্ধ লেখেন যার শিরোনাম ছিল সাদামাটা – পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। প্রবন্ধ শুরু হচ্ছে এইভাবে,
‘আগামী ২৪ অক্টোবর ১৯৯৫ সকালে ভারতের রাজস্থান থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় উপত্যকার উপর দিয়ে যাওয়া চাঁদের প্রচ্ছায়াপথের অন্তর্গত কোন স্থানে যদি থাকা যায়, তবে এমন একটি দৃশ্য দেখা যাবে যাকে নিঃসন্দেহে প্রকৃতির সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ দৃশ্য বলা যায়। …’
সূর্যগ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার যা এমনকি বিজ্ঞানীদেরও প্রভাবিত করে তার আলোচনা করেছেন রানা … কিন্তু মানুষকে বোঝানোর কাজে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি এমন একটা উদ্যোগ নেন যা সম্ভবতঃ এদেশে অভূতপূর্ব।
এই সূর্যগ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার যা এমনকি বিজ্ঞানীদেরও প্রভাবিত করে তার আলোচনা করেছেন রানা। একইসঙ্গে সূর্যগ্রহণের খুঁটিনাটি এবং নিরাপদে তা দেখার পদ্ধতি জানিয়েছেন। কিন্তু মানুষকে বোঝানোর কাজে সীমাবদ্ধ না থেকে তিনি এমন একটা উদ্যোগ নেন যা সম্ভবতঃ এদেশে অভূতপূর্ব। বিংশ শতকের শেষ দুটো দশকে কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণায় বলা হয় যে বিগত কয়েক শতকে আপাতভাবে সূর্যের ব্যাসের একটা পরিবর্তন হয়েছে। এ নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও সূর্যের ব্যাস সরাসরি মাপার উপরেই জোর দেন সবাই। সূর্যগ্রহণ এই পরিমাপের জন্য একটা দারুণ সুযোগ তৈরি করে। পদ্ধতিটা এইরকম – প্রচ্ছায়া (umbra) অঞ্চলের সীমানায় দাঁড়াতে হবে পর্যবেক্ষকদের। এবার Baily’s Beads এর প্রত্যেকটা ‘পুঁতি’ তৈরি হওয়ার এবং অদৃশ্য হওয়ার নির্দিষ্ট সময়গুলো মাপতে হবে। এই দৃশ্য এবং অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা যেন একটা বিন্দুর এগিয়ে যাওয়াকে নির্দেশ করে। এভাবে পাওয়া পরিমাপকে ব্যবহার করে সূর্যের আপাত ব্যাস নির্ণয় করা সম্ভব। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন যে এই পদ্ধতি ত্রুটিমুক্ত কিন্তু সমস্যা এখানেই যে এক-একটা পরিমাপের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয় যেহেতু দুটো পূর্ণ সূর্যগ্রহণের মধ্যে অনেকটাই সময়ের ব্যবধান থাকে।
রানা নিজে এই ‘মুক্তোমালা’ সম্পর্কে জনপ্রিয় ভাষায় কী লিখেছেন দেখি,
‘চাঁদের দেহের আড়ালে সূর্য পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যাওয়ার সময় চাঁদের পূর্বপ্রান্ত ঘিরে একটি সরু আলোর রেখা আর মাঝে মাঝে আলোকবিন্দু দেখা যায়। একে বলে Baily’s Beads, বাংলায় বলা যেতে পারে মুক্তামালা। ১৮৩৬ সালের গ্রহণকালে জনৈক ইংরেজ বিজ্ঞানী বেইলি (Baily) প্রথম এর বর্ণনা দেন। দ্বিতীয় স্পর্শকালে পাহাড় পর্বত ঘেরা চাঁদের দেহ সূর্যের সর্বশেষ অংশ আবৃত করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পাহাড়ের উপত্যকা অংশের ফাঁকা স্থান দিয়ে সূর্যের আলোর ঝলক বাইরে আসে। … … তৃতীয় স্পর্শকালে অপর পাশ দিয়ে সূর্যদেহ উন্মুক্ত হতে শুরু হওয়ার ঠিক প্রাক্কালে অনুরূপ কারণে আবার মুক্তামালা দেখা যায়।’
১৯৯৫ সালের ২৪শে অক্টোবর তিনি এই মুক্তোমালা ব্যবহার করার জন্য ঢালাও ব্যবস্থা করলেন। দিল্লী-জয়পুর হাইওয়ের দু’পাশে শখের জ্যোতির্বিদ এবং ছাত্রছাত্রীরা যোগ দেয় এই পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের কাজে। এ যেন ছিল বিজ্ঞানের এক উৎসব! কিন্তু একটা সূর্যগ্রহণের তথ্য দিয়ে তো আর কাজ হবে না। ফলে লক্ষ্য রইল পরের সূর্যগ্রহণ।
অকালে চলে গেলেন রানা
১৯৯৯ সালে সেই সূর্যগ্রহণ অবধি অবশ্য বেঁচে থাকতে পারলেন না রানা। কথাটা এভাবে বলতে হচ্ছে তার কারণ রানা চেয়েছিলেন অনেকদিন বাঁচতে এবং আরও অনেক কাজ করতে। কিন্তু যে দুরারোগ্য হৃদযন্ত্রের অসুখ তাঁর জন্মগত, যার জন্য কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ থেকে শুরু করে বিলেতের ডারহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি তাঁর শেষ কর্মস্থল IUCAAতে তাঁর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হয়েছিল সেই ব্যাধি ছিনিয়ে নিল তাঁকে। রোগের ডাক্তারি পরিভাষা হল Idiopathic Hypertrophic Subaortic Stenosis with complete left Bundle Branch Block। যে রোগের জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তাঁকে অতি সন্তর্পণে সিঁড়ির এক-একটি ধাপ ভেঙে ক্লাসে পৌঁছতে হত, সেই শারীরিক সমস্যাই তাঁর মৃত্যু ডেকে আনল ১৯৯৬ সালের ২২শে অগাস্ট। মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে বিদায় নিলেন রানা। কিন্তু এমন বিজ্ঞানীর কি সত্যিই মৃত্যু হয়! তাঁর কাজেই তো বেঁচে আছেন তিনি।
রানার সমাজ–ভাবনা
বিজ্ঞানের গবেষণা তাঁর মূল পরিচিতি হলেও শুধুমাত্র সেখানেই সীমাবদ্ধ নন নারায়ণচন্দ্র রানা। বিজ্ঞানের সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের যে যোগাযোগ, স্থানভেদে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ ইত্যাদি নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন রানা। এর পর বাস্তব পরিস্থিতি যখন তুলে ধরেছেন তখন তিনি কঠোর সত্যবাদী। বাঙালি তথা পূর্ব ভারতের মানুষদের এবং বিজ্ঞান পড়ুয়াদের সম্পর্কে রানার মনোভাবের উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁরই কয়েকটা লেখায়। ‘বিজ্ঞান মনীষা’ পত্রিকার জুলাই ১৯৮৩ সংখ্যায় তিনি লিখছেন,
‘যে কারণেই হোক, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণায় ভারতের পূর্বাঞ্চল বরাবরই পিছিয়ে থেকেছে। এখনও পর্যন্ত দু-একটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জায়গায় দু একজনের চেষ্টা ছাড়া বিশেষ উন্নতির লক্ষণ মেলেনি। …’
ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি বা সেখানকার গবেষকদের সঙ্গে তুলনা করে তির্যক মন্তব্য করছেন বাঙালির আয়েসী মনোভাবের প্রতি। এখানে যেন তাঁকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উত্তরসূরী মনে হয়!
আবার ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি বা সেখানকার গবেষকদের সঙ্গে তুলনা করে তির্যক মন্তব্য করছেন বাঙালির আয়েসী মনোভাবের প্রতি। এখানে যেন তাঁকে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উত্তরসূরী মনে হয়! আবার এখানেই বোঝা যায়, একজন নিবেদিত গবেষক হওয়ার পাশাপাশি তিনি সমাজের গতিবিধি সম্পর্কে ভাবনার জন্যও সময় ব্যয় করতে চাইতেন। রানার বিজ্ঞান বলা বা জনপ্রিয় ভাষায় লেখার যে ধারাবাহিকতা সেটাও এই সমাজ-ভাবনারই ফসল। সমাজে বৈজ্ঞানিক মানসিকতার প্রসার চাইতেন তিনি। ঠিক এই শিরোনামে অর্থাৎ ‘বৈজ্ঞানিক মানসিকতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি পথের বাধাগুলো যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তা অত্যন্ত মনোগ্রাহী এবং বাস্তবসম্মত। প্রবন্ধের শেষে দেশের আশানুরূপ উন্নতির অভাব তিনি বর্ণনা করেছেন এইভাবে,
‘…যে শিক্ষিত সমাজের উপর একটা দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, সেই সমাজ নিজেদের সমালোচনা কিংবা নিজেদের উপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেও ভুলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত শিক্ষকের ভূমিকা কে নিতে পারেন? সার্থক রূপকারের অভাবে ভারতবর্ষের কটা পরিকল্পনাই বা আজ পর্যন্ত ঠিক রূপান্তরিত হয়েছে?’
এই বিশ্লেষণের সঙ্গে সম্ভবত কেউ দ্বিমত প্রকাশ করবেন না।
প্রচ্ছদের ছবি: Philosophy of Science Portal
সূত্রঃ
১। দীপককুমার দাঁ সংকলিত ও সম্পাদিত এবং মণীন্দ্র-নারায়ণ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্রাস্ট প্রকাশিত ‘জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা’, ডিসেম্বর ২০১৭
২। Utpal Mukhopadhyay, Saibal Ray, N C Rana: Life and His Contributions in Astrophysical Science, Indian Journal of History of Science, 51.3 (2016) 531-547
৩। Cirkovic, M. M., & Perovic, S. Alternative explanations of the cosmic microwave background: A historical and an epistemological perspective, Studies in History and Philosophy of Modern Physics (2017)৪। Alan D Fiala, David W Dunham, Sabatino Sofia, Variation of the solar diameter from solar eclipse observations, 1715-1991, Solar Physics, June 1994
Onar Bari sauri. Bengali te সাউরি