প্যাসাডেনা, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে অবস্থিত পাহাড় ঘেরা সুন্দর সুসজ্জিত একটা ছোট্ট শহর। শহর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ কিছু নামকরা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। যেমন নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরি, কাভলি ন্যানোসায়েন্স ইনস্টিটিউট ইত্যাদি। আর রয়েছে বিশ্বের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা সংক্ষেপে ক্যালটেক। এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই পোস্ট ডক্টরাল গবেষক দেবনাথ ঘোষালের সঙ্গে প্যাসাডেনা শহরে আড্ডায় বসেছিল “বিজ্ঞান” এর পক্ষ থেকে ডঃ রাজীবুল ইসলাম। সেই আড্ডাতেই উঠে এল ব্যাকটেরিয়া ও অ্যান্টিবায়োটিক্স উপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, গবেষনার দিক। সেই আড্ডার উপর ভিত্তি করে লেখাটি সাজিয়েছেন দেবব্রত মাজী।
আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি ব্যাকটেরিয়া। পৃথিবীতে এই এককোষী, আণুবীক্ষণিক অণুজীবের আবির্ভাব ঘটেছিলো মানুষ সৃষ্টিরও প্রায় কয়েকশো কোটি বছর আগে। কোথায় থাকে এরা?? হিমশীতল পর্বতের চূড়া থেকে শুরু করে সমুদ্রের গভীরতম বিন্দু ; সর্বত্রই চলে এদের অবাধ বিচরণ। এমনকি আমার আপনার শরীরের ভেতরেও রয়েছে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া। সেই সংখ্যাটাও নেহাতই মন্দ নয় কিন্তু। ঠিক যতগুলো দেহকোষ রয়েছে আমাদের দেহে, তার থেকেও বেশি ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেহ জুড়ে। না না ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ব্যাকটেরিয়া মানেই যে অপকারী তা কিন্তু নয়। বরং এরা আমাদের শরীরে থেকে উপকারই করে। এরা একদিকে যেমন আমাদের দেহে খাদ্য হজমে সাহায্য করে, আবার অনাক্রম্যতা বা immunity গড়ে তুলে রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থাও করে। এছাড়াও এরা আমাদের শরীরে থেকে আমাদের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের শরীরে কিছু অপকারী ব্যাকটেরিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটে। তারাই জ্বর থেকে শুরু করে প্লেগ, যক্ষা, কলেরা বা গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সারের মতো ভয়ঙ্কর সব রোগ ঘটায়। আমাদের লড়াইটা তাদের বিরুদ্ধেই । তাদের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক্স তৈরির লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ল্যাবরেটরিতে অসংখ্য বিজ্ঞানী নিরলস গবেষণা করে চলেছেন। আজকের আড্ডাতে আমরা সেই গবেষণার গল্পই শুনবো।
যাইহোক আড্ডার প্রসঙ্গে আসা যাক। ‘বিজ্ঞান’ টিম-এর ডঃ রাজীবুল ইসলাম প্রশ্ন করলেন গবেষক ডঃ দেবনাথ ঘোষালের উদ্দেশ্যে।
রাজীবুলঃ আমরা যখন ডাক্তারের কাছে যাই, তখন প্রায়শই দেখা যায়, ডাক্তারবাবুরা আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক্স খেতে বলেন। তো এই অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলো ঠিক কী করে?
দেবনাথঃ আসলে বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক্স হয়। সব অ্যান্টিবায়োটিক্স একইরকম ভাবে কাজ করে না। তবে সবথেকে বেশি যে ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক্স আমরা ব্যবহার করি তা হলো পেনিসিলিন গোত্রের বিটা ল্যাক্টাম অ্যান্টিবায়োটিক্স। এর মূল কাজ হচ্ছে, ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিরক্ষাবলয় তথা কোষ প্রাচীর গঠনে বাধা দিয়ে তা নষ্ট করে দেওয়া। ফলে তখন ব্যাকটেরিয়া কোষটি অভিস্রবনজনিত চাপ সহ্য করতে না পেরে মারা যায়।
তবে গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের ক্ষেত্রে কোষ প্রাচীরের বাইরেও কোষ পর্দার একটা আস্তরণ থাকায়, ওদের কোষ প্রাচীরকে আক্রমণ করা বেশ কঠিন। আর যদি বা অ্যান্টিবায়োটিক্স ওদের কোষ প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছেও যায়, সেক্ষেত্রে তাকে ওরা এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন কমপ্লেক্সের মাধ্যমে নিজেদের কোষ থেকে বের করে দেয় (ইফ্ল্যাক্স পাম্প)। তাই গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের জন্য রাইবোজম ইনহিবিটরস, ফোলেট সিন্থেসিস ইনহিবিটরস, ট্রান্সক্রিপশন ইনহিবিটরস এই সব বিকল্প অ্যান্টিবায়োটিক্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে [৪]। এই অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলো ব্যাকটেরিয়া কোষের রাইবোজম থেকে প্রয়োজনীয় সব প্রোটিন উৎপাদনে বাধা দিয়ে ব্যাকটেরিয়া কোষের মৃত্যু ঘটায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই রাইবোজম-এর গঠন ও ইনহিবিটরস নিয়ে অসামান্য গবেষণার জন্যই 2009 সালে ভারতীয় বংশদ্ভূত বিজ্ঞানী ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণণ এবং আরও দুজন বিজ্ঞানী থমাস স্টেইজ ও এডা ইওনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বাহ! তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। এই সমস্ত অ্যান্টিবায়োটিক্স দিয়েই তো তাহলে সব ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলা যাবে। শরীর হবে রোগমুক্ত।
কিন্তু মুশকিলটা অন্য জায়গায়। ধরো আমি ব্যাকটেরিয়াদের রাইবোজমটাকে আক্রমণ করে ব্যাকটেরিয়াগুলোকে নষ্ট করে দিতে চাইছি। কিন্তু রাইবোজম তো শুধু ব্যাকটেরিয়াদের নেই। মানুষের দেহকোষেও রয়েছে রাইবোজম। সেক্ষেত্রে মানব দেহকোষেরও অল্পবিস্তর ক্ষতির সম্ভাবনা থেকেই যায়। আবার ব্যাকটেরিয়া নিজেরাও দিনের পর দিন আমাদের তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধেও দ্রুত প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। তাই আমাদের প্রতিনিয়ত আরও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক্স বানিয়ে যেতে হবে, সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন মানুষের দেহের বিশেষ কোনো ক্ষতি না করে বসে। সুতরাং আমাদের এমন কিছুর ওপর আক্রমণ হানতে হবে, যা মূলতঃ ব্যাকটেরিয়াদের দেহকোষেই আছে। তাই মূলত টার্গেট করা হয়, ব্যাকটেরিয়াদের কোষ প্রাচীরকেই। কেননা আমাদের দেহকোষে কিন্তু কোষ প্রাচীর নেই। তবে এক্ষেত্রেও একটা সমস্যা রয়েছে। আমাদের দেহে উপস্থিত সমস্ত ব্যাকটেরিয়া তো আর অপকারী নয়। অসংখ্য উপকারী ব্যাকটেরিয়াও রয়েছে আমাদের শরীরে। কোষ প্রাচীরের উপর আক্রমণ করলে তারাও যে মারা যাবে! তবে একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখতে পাবে, আজকাল কিন্তু ডাক্তারবাবুরা অ্যান্টিবায়োটিক্স খাওয়ার পরে দই, প্রোবায়োটিক এইসব খেতে বলেন। এতে কী হয়, অন্তত কয়েকটা শ্রেণীর উপকারী ব্যাকটেরিয়া পুনরায় আমাদের শরীরে সংখ্যায় বৃদ্ধি পায়!। যদিও সেই সংখ্যাটা খুবই সামান্য।
তাহলে তোমার মতে এই সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে করা যেতে পারে?
সবথেকে ভালো হয় যদি শুধুমাত্র অপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর জন্য পৃথক পৃথক ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক্স বানানো যায়। তবে তার জন্য পৃথকভাবে ওদের গঠন এবং রোগ বিস্তারের পদ্ধতিটা জানা খুব জরুরি। এ প্রসঙ্গে এইসব ব্যাকটেরিয়াতে উপস্থিত বিভিন্ন মলিকুলার মেশিনের কথাটা উল্লেখ করতেই হয়। অনেক বছরের বিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন অপকারী ব্যাকটেরিয়া-র দল আমাদের শরীরের কোষগুলোকে আক্রমণ করার জন্য বেশ কয়েক রকমের ইনজেকশন মেশিন (বা সিক্রেশন সিস্টেম) তৈরি করে ফেলেছে। এইগুলোর মাধ্যমেই তারা আমাদের শরীরে নানারকমের ক্ষতিকারক টক্সিন ছড়িয়ে রোগব্যাধির জন্ম দেয়। শুধু তাই না, যদি কোনো ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক্স-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলে, তাহলে এইসব মেশিনের মাধ্যমে তারা অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া-র মধ্যেও তা সঞ্চালন করতে পারে। ফলে একসময় যে সব অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলো খুব কার্যকরী ছিল তাদের কার্যক্ষমতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে আর ব্যাকটেরিয়াগুলো মহানন্দে রোগ বিস্তার করতে শুরু করে।
তাই নাকি? ব্যাপারটা তো খুব রোমহর্ষক ঠেকছে।
হুম। সত্যিই তাই। অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধের ঘটনা প্রথম সামনে এসেছিলো সত্তরের দশক নাগাদ। দেখা গেল পাপুয়া নিউগিনির একটি গ্রামে এক রোগীর স্ট্রেপ্টোকক্কাস নামের এক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ সারাতে গিয়ে প্রচলিত পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক্স আর কোনো কাজই করছে না। নব্বইয়ের দশকে এই প্রতিরোধের ঘটনা আরও অনেকগুলো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ক্ষেত্রে দেখা যেতে লাগলো। বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। কারণ খুঁজতে গিয়ে একদল বিজ্ঞানী দেখলেন, ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো আসলে এতোদিনে পেনিসিলিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক্সদের রুখতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে যার নাম বিটা ল্যাক্টামেজ উৎসেচক। এই উৎসেচক হাইড্রোলিসিস বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক্সদের প্রধান গঠনগত একক বিটা ল্যাক্টাম রিং-টাকেই ভেঙে দেয়। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলো পঙ্গু হয়ে যায়। আর কাজ করতে পারে না। আর যেসব ব্যাকটেরিয়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক্স-এর বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, তাদের বলা হয় “সুপার বাগ”।
আর এই পরিস্থিতে মলিকুলার মেশিন বা সিক্রেশন সিস্টেম-গুলোর ভূমিকা আরো ভয়ঙ্কর। ব্যাকটেরিয়া-রা এদের ব্যবহার করে একে অপরের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের অ্যান্টিবায়োটিক্স প্রতিরোধ ক্ষমতাগুলোকে অন্য ব্যাকটেরিয়াদের দেহে সঞ্চালন করে দেয় । ফলে সুপার বাগ-এর সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং সেই অ্যান্টিবায়োটিক্স-এর ব্যবহারযোগ্যতা ক্রমশই কমতে থাকে। এতোজনের বিরুদ্ধে ঐ প্রতিরোধ আর কতক্ষণই বা টিকে থাকতে পারে??
তাহলে উপায়??
উপায় হচ্ছে, এই সমস্ত সুপার বাগ-দের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা। এই লড়াইয়ের অন্যতম একটা স্ট্র্যাটেজি হলো – ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্গত মলিকুলার মেশিন বা সিক্রেশন সিস্টেম -গুলোর গঠন ও কার্যপ্রণালী জেনে নিয়ে ওদের বিরুদ্ধে ড্রাগ নির্মাণ করা। তো এই মলিকুলার মেশিন বিশ্লেষণের আরেকটা মস্ত সুবিধা হচ্ছে এই মলিকুলার মেশিনের গঠন কিংবা কার্যপ্রণালী কিন্তু ব্যাকটেরিয়া ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। ফলে সহজেই ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াগুলোকে চিহ্নিত করাও যাবে আবার তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষেধকও প্রস্তুত করা যাবে।
তো এখন এই মলিকুলার মেশিনের গঠন ও কার্যর্প্রণালী কীভাবে বোঝা সম্ভব?
এই কাজটা দুটো উপায়ে করা যেতে পারে। প্রথমত, ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্গত মলিকুলার মেশিন বা সিক্রিশন সিস্টেমের উপাদানগুলোকে আলাদাভাবে কোষের বাইরে পরীক্ষানিরীক্ষা করে তাদের গঠন ও কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করা। কিন্তু সেক্ষেত্রে আবার তারা মিলেমিশে ঠিক কীভাবে কাজ করে সেটা জানা যায়না। তাই সবথেকে ভালো হয়, যদি তুমি ব্যাকটেরিয়া কোষ থেকে ঐ মেশিনটাকেই পুরোপুরি বের করে নিয়ে এসে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি বা ইলেকট্রন ক্রায়ো মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে তার সামগ্রিক গঠন বিশ্লেষণ করতে পারো। তবে কাজটা বেশ দুরূহ।
এছাড়াও আরেকটা উপায় রয়েছে যা ইলেকট্রন – ক্রায়োটোমোগ্রাফী নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে ‘ভিট্রিফিকেশন’ পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্গত সমস্ত উপাদানকে গতিহীন করে দিয়ে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে কোষের মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়ার সিক্রিশন সিস্টেমের সামগ্রিক গঠন বিশ্লেষণ করা হয়। এই পদ্ধতিটাকে ইনসিটু স্ট্রাকচারাল বায়োলজি বলে। আমার গবেষণায় আমি মূলত এই কাজটাই করার চেষ্টা করছি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, কোষীয় উপাদানকে ‘গতিহীন’ করে দেওয়ার ধারণাটা কিন্তু বেশ মজার। আমরা যদি ‘ভিট্রিফিকেশন’ পদ্ধতিতে কোনও ভাবে একজন মানুষের কোষীয় উপাদানগুলোকে খুব দ্রুত এভাবে “গতিহীন” করে দিই, তারপর দীর্ঘদিন পরে এমনকি কয়েক হাজার বছর পরেও যদি ঐ “গতিহীন” অবস্থাটা তুলে নিই, তাহলে দেখতে পাবো, মানুষটা আবার ঠিক আগের অবস্থায় জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে, দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারছে। তবে হ্যাঁ, এটা তখনই সম্ভব যখন আমরা আমাদের সমস্ত কোষের মধ্যেকার জলের অণুকে ভিট্রিফিকেশন করতে পারবো অর্থাৎ জলের অণুগুলো নিশ্চল হয়ে যাবে কিন্তু বরফের মতো ত্রিমাত্রিক সজ্জায় সজ্জিত হবে না।
বাহ, এ তো কল্পবিজ্ঞান দেখছি। তো এই মলিকুলার মেশিনের গঠন ও কার্যকলাপ নিয়ে ঠিক কী ধরনের গবেষণা হচ্ছে বা এ ব্যাপারে এখনও কতদূর অগ্রগতি ঘটেছে?
আসলে হয় কী, ব্যাকটেরিয়াগুলো বিভিন্ন সিক্রেশন সিস্টেমের মাধ্যমেই ভয়ঙ্কর সব রোগ ঘটায়। ইতিমধ্যে প্রায় নয় রকমের সিক্রেশন সিস্টেম আবিস্কার হয়েছে। সেই সিক্রেশন সিস্টেমগুলোকে কী করে রুখে দেওয়া যায় তার ওপর ভিত্তি করেই মূলতঃ কাজগুলো হচ্ছে। বিশেষ করে টাইপ II ও টাইপ III সিক্রিশন পদ্ধতি নিয়ে এখন অসংখ্য বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। এমনকি দুটো সিক্রিশন সিস্টেমের বিরুদ্ধে ড্রাগ তৈরির কাজও অনেকদূর এগিয়েছে। এছাড়াও কোনো কোনো গবেষণাগারে একইসাথে দুটো মলিকুলার মেশিন-কে টার্গেট করে একটা বানানোর চেষ্টাও করা হচ্ছে।
তাহলে এতক্ষণ বিভিন্ন টক্সিন সঞ্চালনার পদ্ধতির ভিত্তিতে বানানোর গবেষণা সম্পর্কে জানলাম। এগুলো ছাড়াও কি আর কোনো ভাবে দুষ্টু ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলার আয়োজন চলছে?
নিশ্চয়। অনেকেই চেষ্টা করছেন ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো যে পদ্ধতিতে বিভাজিত হয়ে বংশবিস্তার করে, কোনো ব্লকার তৈরি করে সেটাকেই বন্ধ করে দিতে। বা ওদের কোষ পর্দাকেই বিপর্যস্ত করার চিন্তা ভাবনা করছেন কোনো কোনো বিজ্ঞানী। আরও একটা নতুন পদ্ধতি হচ্ছে-কিছু কিছু ভাইরাস যেগুলো কেবল ব্যাকটেরিয়া মারে, এই সব ব্যাক্টেরিওফেজ ভাইরাস ব্যবহার করে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে ধংস করার পদ্ধতি নিয়েও অনেক কাজ হচ্ছে|।
তবে একটা ভালো খবর বলি — ব্যাকটেরিয়াগুলোও কিন্তু নিজেদের মধ্যে প্রচন্ড মারামারি করে । আমাদের শরীরে এমন অনেক ভালো ব্যাকটেরিয়া আছে, যারা বাইরে থেকে আসা ঐ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াদের একদম সহ্য করতে পারে না। দেখতে পেলেই মেরে ফেলে।
বাহ, অনেককিছুই জানলাম। তোমার গবেষণার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। যেকোনো একটা রিসার্চ ফিল্ড-এ সাধারণত যে ধরণের সরঞ্জাম বা উপাদান ব্যবহৃত হয়, তার জন্য তো একটা পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। তো তুমি এখন যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে চলেছ তার জন্য কেমিস্ট্রি নাকি বায়োলজি; কোন বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ?
দেখো এটা নির্ভর করে ল্যাবরেটরিতে এসে তুমি আসলে কী ধরণের কাজ করতে চাইছো তার ওপর। তুমি যদি ব্যাকটেরিয়া কোষের অন্তর্গত মলিকুলার মেশিনের গঠন ও কার্যপ্রণালী নিয়ে কাজ করতে চাও তাহলে তোমার স্ট্রাকচারাল বায়োলজির জ্ঞান থাকলে সুবিধা হবে, আবার যদি তুমি ওই মেশিনের গঠন ও কার্যকারিতা জেনে নেওয়ার পর ওকে ধ্বংস করার জন্য কোনো ড্রাগ বানাতে চাও, তাহলে তোমার কেমিস্ট্রি নিয়ে গভীর জ্ঞান থাকলে সুবিধা হবে। এখন দেখো, এই দুটো আলাদা বিষয় নিয়ে একজনের পক্ষে কাজ করা তো বেশ কঠিন, তাই না? সেক্ষেত্রে দুজনে মিলে বা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করলে বেশ সুবিধা হয়।
এতো অভাবনীয় সমস্ত গবেষণার পরিধি তৈরি হচ্ছে ক্ষতিকারক অণুজীবদের মেরে দূরারোগ্য সব রোগ সারিয়ে তোলার! কোনো ছাত্রছাত্রী যদি ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে চায়, সে কোন পথে এগোবে বা কী নিয়ে পড়াশুনা করলে সুবিধা হবে ?
অনেকভাবেই এধরণের ফিল্ডে আসা যায়। তাহলে আমার নিজের উদাহরণটাই দিই। আসলে আমার খুব ইচ্ছে ছিল বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু তখন পশ্চিমবঙ্গে স্নাতক স্তরে বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়টাই ছিল না। তাই তখন আমি স্নাতক স্তরে কেমিস্ট্রি নিয়েই ভর্তি হলাম। তারপর স্নাতকোত্তর স্তরে TIFR গেলাম। ওখানে গিয়ে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়াশুনো করলাম। এবং সবশেষে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে পিএইচডি করলাম স্ট্রাকচারাল বায়োলজি আর মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে। তাই এরকম কোনো মানে নেই যে মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে গবেষণা করতে হলে মাইক্রোবায়োলজি নিয়েই পড়তে হবে। আমার মনে হয় ইন্টারেস্ট থাকাটাই সবথেকে বেশি জরুরি। সেই ইন্টারেস্ট থেকেই বোধহয় পড়াশুনার শুরুটা আমি কেমিস্ট্রি নিয়ে করলেও ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-তে আজ আমি এসে পৌঁছেছি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেকার মলিকুলার মেশিন নিয়ে পোষ্ট ডক্টরেট করতে।
একটা কথা জানতে চাইবো। ফিজিসিস্টরা এধরনের কাজে আসেন?
হা হা.. আমার বস কিন্তু একজন ফিজিসিস্ট-ই। আমার পিএইচডি সুপারভাইজার যিনি ছিলেন উনি কেমিস্ট্রি-র মানুষ। আসলে এধরনের গবেষণাতে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথেম্যটিকস, বায়োলজি ওতপ্রোতভাবে একে অপরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। এই গবেষণাতে ব্যবহৃত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র ক্রায়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের ব্যবহার ও তথ্য সংগ্রহ, রিয়াল স্পেস ও ফুরিয়ার স্পেসের মধ্যে আনাগোনা ইত্যাদি করার জন্য যেমন ফিজিক্সের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, আবার ঐ তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করতে ম্যাথেম্যটিকসের জ্ঞান থাকাও সমান জরুরি।
আসলে আমার মনে হয়েছে উচ্চশিক্ষা, গবেষণার ক্ষেত্রগুলোতে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে কোনো দ্বন্দ নেই। বরং ওরা মিলেমিশে ,পারস্পরিক সহযোগিতায় একটাই লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে – কীভাবে একটা সুন্দর, আরামদায়ক, স্বাস্থ্যময় ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়। সেখানেই বিজ্ঞানের সার্থকতা, সেখানেই বিজ্ঞানের জয়জয়কার।
পুনশ্চঃ প্রায় 360 কোটি বছর ধরে হাজার হাজার বাধা প্রতিকূলতা কাটিয়ে এই পৃথিবীতে যে ব্যাকটেরিয়ারা টিকে থাকতে পারে, তাদের নিকেষ করা সত্যিই ভীষণ দুরূহ একটা কাজ। আমরা যেমন বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটার পর একটা অ্যান্টিবায়োটিক্স বানিয়ে চলেছি, ওরাও তেমনি ওদের চরিত্র, গঠন পরিবর্তন করে সেই অ্যান্টিবায়োটিক্স-দের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তুলে ক্রমশ আরও মহা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। জানিনা এ লড়াইয়ের শেষ কোথায়।
তবে ভরসা থাকুক বিবর্তনবাদের ওপর, বিশ্বাস থাকুক যোগ্যতমের উদবর্তনের ওপর। কারণ, “অস্তিস্তের জন্য সংগ্রামের” লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত কিন্তু সেই বেঁচে থাকে…. যে লড়াই করতে জানে, যে বুদ্ধিমান, যে প্রকৃত বেঁচে থাকার যোগ্য।
(ড: রাজীবুল ইসলাম ও ড: দেবনাথ ঘোষাল-এর আড্ডার ভিত্তিতে লেখাটি সাজিয়েছেন দেবব্রত মাজী। )
(প্রচ্ছদের ছবির সূত্র, কৃতজ্ঞতা: Lightspring/Shutterstock.com)
উৎসাহী পাঠকদের জন্য
[১] ব্যাকটেরিয়া-র ভিতরের সজ্জা নিয়ে বিশদে জানতে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত ড: দেবনাথ ঘোষাল-এর এই ধারাবাহিক লেখাটি পড়ুন।
[২] ব্যাকটেরিয়া-র ভিতর জিনগত তথ্যের আদানপ্রদান কিভাবে হয়, সেই নিয়ে জানতে এই লেখাটি পড়ুন।
[৩] ভিট্রিফিকেশন:- এটি জলের এক ভিন্ন ধরনের “বরফ শীতল ( কিন্তু বরফ নয়) ” অবস্থা যেখানে জলের অণুগুলো মাইনাস 196 ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় শীতল হয় , কিন্তু বরফের মতো ত্রিমাত্রিক সজ্জায় সজ্জিত হয় না ।
[৪] বিকল্প অ্যান্টিবায়োটিক্স নিয়ে জানতে এই লেখাটি পড়ুন।
khub sundor totthosomriddho lekha.