আমাদের আশেপাশে রকমারি পিঁপড়ে দেখতে পাই । এদের বাসস্থান অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে – প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাতে দুই, তিন বা ততোধিক বিভিন্ন আকৃতির পিঁপড়ে রয়েছে । একই জাতীয় পিঁপড়ের এই আকৃতি-বৈষম্য স্বভাবতই বিস্ময়ের উদ্রেক করে । খুঁটিনাটি বৈষম্য থাকলেও সন্তান, মাতা অথবা পিতার মতো আকৃতি পরিগ্রহ করে থাকে । জীবজগতের এটাই অতি পরিচিত ঘটনা । কদাচিৎ কখনও দু-এক ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায়, কিন্তু তার কারণও সুস্পষ্ট । পিঁপড়েদের ক্ষেত্রে কিন্তু মাতা অথবা পিতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আকৃতির সন্তান জন্মগ্রহণ করাটাই স্বাভাবিক নিয়ম । মাতা বা পিতার অনুরূপ সন্তান জন্মগ্রহণ করাটা কতকটা সাময়িক এবং অনেকটা আকস্মিক ব্যাপারের মতো । এক একটা পিঁপড়ের বাসায় সাধারণত চার-পাঁচ রকমের পিঁপড়ে থাকে – কয়েক শত পুরুষ, কয়েক শত রানী এবং কয়েক হাজার কর্মী বা শ্রমিক । আমরা সচরাচর শ্রমিক-পিঁপড়েই দেখে থাকি এবং এদের দেখেই জাতি নির্ণীত হয় । শ্রমিকদের মধ্যে কতকগুলি থাকে মাথা মোটা সৈন্য এবং বাকিগুলি ছোট, বড় ও মাঝারি – এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত । রানীর আকৃতি সাধারণ পিঁপড়েদের তুলনায় অসম্ভব বড় । পুরুষের আকৃতি মাঝারি গোছের । কিন্তু কর্মীরা সর্বাপেক্ষা ছোট এবং পিতা বা মাতার সঙ্গে কোনো আকৃতিগত সামঞ্জস্য দেখা যায় না । পুরুষ বা রানী পিঁপড়েদের প্রত্যেকেরই ডানা আছে ; কিন্তু কর্মীদের কারও ডানা নেই, অথচ বিস্ময়ের বিষয় এই যে, পুরুষ ও রানীর মধ্যে মিলন সংঘটিত হবার পর রানীর ডিম থেকে কেবল এই কর্মী শ্রেণীর পিঁপড়েরাই জন্মগ্রহণ করে থাকে । কি উপায়ে এরূপ অদ্ভূত ব্যাপার সংঘটিত হয়ে থাকে, প্রত্যেকেরই তা জানবার আগ্রহ হওয়া স্বাভাবিক । বিভিন্ন জাতীয় কয়েক প্রকার পিঁপড়ের মধ্যে এরূপ আকৃতিগত বৈষম্য দেখে এক সময় আমারও কৌতূহল অদম্য হয়ে উঠেছিল । ইতিপূর্বে বৈজ্ঞানিকেরা এ সম্বন্ধে অনেক প্রকার গবেষণা করেছেন বটে, কিন্তু কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি ।
কিছুকাল যাবৎ পিঁপড়েদের এই অদ্ভুত প্রজনন-রহস্য উদ্ঘাটনের নিমিত্ত পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হয়েছিলাম । পরীক্ষার ফলে এই রহস্য সম্বন্ধে যতটুকু জানতে পেয়েছি, তা মোটামুটিভাবে আলোচনা করবো । প্রথমত কাঠ-পিঁপড়ে নিয়ে কাজ আরম্ভ করেছিলাম । তার পর ক্রমাগত ডেঁয়ো-পিঁপড়ে, বিষ-পিঁপড়ে, সুড়সুড়ে-পিঁপড়ে নিয়ে পরীক্ষা করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারি নি । কারণ এই পিঁপড়েরা প্রত্যেকেই মাটির নিচে গর্ত খুঁড়ে বাস করে । বাচ্চা প্রভৃতি মাটির নিচে অন্ধকারেই প্রতিপালিত হয়, বাইরে থেকে দেখবার কোনও উপায় নেই । কৃত্রিম বাসা তৈরি করে তাতে হাজার হাজার পিঁপড়ে প্রতিপালন করে দেখেছি, তারা – রানী, বাচ্চা, ডিম প্রভৃতি অন্ধকারে কোনও কিছুর আড়ালে অতি সংগোপনে রক্ষা করে । কাজেই এদের স্বাভাবিক কার্যপ্রণালী প্রত্যক্ষ করা অতি দুরূহ ব্যাপার । অবশেষে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করবার নিমিত্ত লাল-পিঁপড়ে পুষতে আরম্ভ করি । লাল-পিঁপড়েরা গাছের ডালের পাতা পরস্পর জুড়ে গোলাকার বাসা নির্মাণ করে । পাতার ভিতর দিয়ে বাসার ভিতরের অবস্থা দেখা যায় না ; কাজেই কৃত্রিম বাসার সাহায্য নিতে হয়েছিল । অনেক কিছু ব্যর্থ চেষ্টার পর অবশেষে পাতলা সেলোফিন মুড়ে বাসা তৈরি করতে সক্ষম হলাম । পুরুষ, রানী, ডিম ও বাচ্চা সমেত হাজার হাজার পিঁপড়ে বাসায় ছেড়ে দিলাম । তারা সেলোফিন-আবৃত বাসায় উপস্থিত হয়ে ফাটা এবং ফুটা স্থানগুলি বন্ধ করে দিল এবং বিভিন্ন কুঠুরি নির্মাণ করে বেশ সহজভাবেই বসবাস করতে লাগলো । পাতলা সেলোফিনের পর্দার ভিতর দিয়ে পিঁপড়েগুলির কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করতে কোনই অসুবিধা হয় না । বিভিন্ন জাতীয় পিঁপড়েদের আকৃতি এবং প্রকৃতি বিভিন্ন হলেও তাদের সমাজ-ব্যবস্থা এবং প্রজনন ব্যাপারে মোটামুটি একটা সামঞ্জস্য দেখা যায় । কাজেই লাল-পিঁপড়ের সম্বন্ধে আলোচনা করলেই সাধারনভাবে পিঁপড়েদের সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার বিষয় অবগত হওয়া যাবে ।
মানুষ সামাজিক প্রাণী । অপেক্ষাকৃত উন্নত শ্রেণীর জীবের মধ্যে মানুষের মতো সমাজ-ব্যবস্থা না থাকলেও মৌমাছি পিঁপড়ে প্রভৃতি নিম্নস্তরের কীট-পতঙ্গের মধ্যে এরূপ সমাজ-ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে । তাদের সমাজের রীতিনীতি যাতে অক্ষুন্নভাবে নিরুপদ্রবে চলতে পারে, তার জন্যেও একটা স্বাভাবিক অবস্থা অবলম্বিত হয়েছে । মানুষেরা বুদ্ধিমান এবং কৌশলী হলেও পিঁপড়ে অথবা মৌমাছির মতো সুনিয়ন্ত্রিত একটা পাকাপোক্ত সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে নি । প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থায় মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি এবং ব্যক্তিগত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে । প্রত্যেকেই সুবিধামত সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকে । তার ফলেই দাসত্ব প্রথা, বাধ্যতামূলক বেগার খাটা এবং অন্যান্য দুর্নীতিমূলক প্রথার উদ্ভব ঘটেছিল । স্বার্থান্বেষী ও প্রভুত্ব-প্রয়াসী ব্যক্তিরা অস্ত্র-প্রয়োগে মানুষের প্রজনশক্তি নষ্ট করে নিজেদের সুখসুবিধা বিধানের নিমিত্ত কায়েমীভাবে এক ধরনের শ্রমিকশ্রেণী উৎপাদনে অগ্রসর হচ্ছিল । কিন্তু যে কারণেই হোক তাদের এই প্রচেষ্টা অধিক দূর প্রসার লাভে সক্ষম হয় নি । যা হোক, মানুষের প্রয়োজনে আজ পর্যন্তও গৃহপালিত পশুপক্ষীর উপর এ ব্যবস্থা অবাধে প্রযুক্ত হচ্ছে । উদ্দেশ্য যাই হোক, উপায়টা যে সম্পূর্ণ নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক, সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই । শ্রমসাধ্য যাবতীয় কার্যনির্বাহের জন্যে পিঁপড়েরা কিন্তু অতি সহজ উপায়ে এরূপ একপ্রকার শ্রমিকশ্রেণী উৎপাদন করবার উপায় আয়ত্ব করে নিয়েছে । মনুষ্য কর্তৃক অবলম্বিত উপায় অপেক্ষা তাদের উপায় যে সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠ, এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই । স্বার্থান্বেষী, পুঁজিবাদী, প্রভুত্বপ্রয়াসী মানুষেরা যদি পিঁপড়েদের অবলম্বিত কৌশলের মতো এমন কোনও সহজসাধ্য উপায় আবিষ্কারে সক্ষম হতো, তবে তার প্রভাবে পৃথিবীর অশিকাংশ মানুষই হয়তো বংশানুক্রমে কায়েমী শ্রমিকশ্রেণীতে পরিণত হতো । প্রভুর তুষ্টিবিধান ও স্বার্থ রক্ষা ছাড়া তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ বলে কোনও কিছুরই অস্তিত্ব থাকতো না । কৃত্রিম বাসার মধ্যে হাজার হাজার পিঁপড়ে প্রতিপালন করে বছরের পর বছর তাদের আচার-ব্যবহার যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা থেকে এই ধারণাই বদ্ধমূল হয় ।
আগেই বলেছি, এক-একটা পিঁপড়ের বাসায় কয়েক শত রানী, কয়েক শত পুরুষ এবং হাজার হাজার কর্মী বা শ্রমিক পিঁপড়ে দেখা যায় । রানী এবং পুরুষ পিঁপড়েরা কোনও কাজই করে না, কেবল অলসভাবে বাসার মধ্যে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায় মাত্র । শ্রমিকরা রানী ও পুরুষকে সর্বপ্রকার সেবা-যত্ন করে থাকে । শ্রমিকেরা খাবার সংগ্রহ করে পুরুষ ও রানীদের মুখের কাছে তুলে ধরে । আহারান্তে একাধিক শ্রমিক মাইল গাত্র মার্জনা করে দেয় এবং অবসরমত তাদের প্রসাধনে ব্যাপৃত হয় । ডিম পাড়বার সময় হলেই হাজার হাজার কর্মী-পিঁপড়ে তার আপাদমস্তক আড়াল করে অপেক্ষা করতে থাকে । সে সময় শ্রমিকেরা রানীর যেরূপ সেবাযত্ন করে থাকে, তা দেখলে বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতে হয় । একটির পর একটি করে ডিম বেরিয়ে আসতে আরম্ভ করলেই শ্রমিকেরা সেগুলিকে অতি যত্ন সহকারে মুখে তুলে নিয়ে একটা নির্দিষ্ট কুঠুরিতে সাজিয়ে রাখে । অন্য এক দল শ্রমিক তখন ডিমের তদারকে নিযুক্ত হয় । তারা ডিম ছেড়ে কোথাও নড়ে না । দু-এক দিনের মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় । এক-একটি কর্মী এক-একটি বাচ্চা প্রতিপালনের ভার গ্রহণ করে । এগুলিকে খাওয়ানো, পরিষ্কার করা, উন্মুক্ত স্থানে বেড়িয়ে আনা প্রভৃতি যাবতীয় কাজ শ্রমিকেরাই করে থাকে । পুরুষ বা রানীরা কোনও কাজেই বিন্দুমাত্র অংশগ্রহণ করে না । এরা বহু দূর দূরান্তর থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে বাসায় নিয়ে আসে এবং পুরুষ ও রানীকে শ্রেষ্ঠাংশ খাওয়াবার পর অবশিষ্ট অংশ সকলে মাইল ভাগাভাগী করে খায় । এদের সঞ্চয়ের অভ্যাস নেই । যা সংগৃহীত হয়, তাই খেতে শুরু করে দেয় । যদি খাদ্যের অনটন ঘটে তবে যৎসামান্য যা সংগৃহীত হয়, তা থেকে প্রথমে বাচ্চাগুলিকে খাওয়ায় এবং পরে পুরুষ ও রানীকে খাইয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তা নিজেরা ভাগাভাগী করে খায়, নচেৎ অনাহারে থেকেই প্রয়োজনীয় কাজকর্ম চালিয়ে যায় । অনাহার সহ্য করে মৃত্যু বরণ না করা পর্যন্ত এরা নিজের কর্তব্যকর্মে বিন্দুমাত্র শৈথিল্য প্রকাশ করে না ।
শত্রুর আক্রমণে ভীত হয়ে হয়তো বাচ্চা মুখে করে কোনো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে ছুটছে, সেই সময় দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ – এমন কী, অর্ধাংশ দ্বিখন্ডিত করে দিলেও বাচ্চাকে মুখ থেকে ফেলে দিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে না । শত্রু-কবলিত বাচ্চা, রানী অথবা পুরুষ পিঁপড়েকে উদ্ধার করবার জন্যে নিষ্ফল প্রচেষ্টায়ও কেউ জীবন দিতে কিছুমাত্র ইতস্তত করে না । দু-একটি ব্যতীত অধিকাংশ ঘটনা দেখে জীবনের প্রতি এদের সত্য-সত্যই কোনো মমত্ববোধ আছে কিনা সন্দেহ হয় । এদের কোনও চালকও নেই বা কার্য-বন্টনও কেউ করে দেয় না । যখন যার প্রয়োজন উপস্থিত হয়, সংস্কারবশেই যেন সে কার্যে আত্মনিয়োগ করে এবং সুশৃঙ্খলার সঙ্গে তা সম্পন্ন করে । এদের মধ্যে কঠিন বা সহজ বলে কোনও কাজের বিচার নেই । কঠিনই হোক, কী সহজই হোক প্রয়োজন উপস্থিত হওয়া মাত্র এরা নির্বিচারে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে । শত্রু প্রবলই হোক, কী দুর্বলই হোক, নাগালের মধ্যে আসামাত্রই সমস্ত শক্তি দিয়ে নির্বিচারে তাকে আক্রমণ করবে । একটা কাঠি বা এক টুকরো ইঁট কাছে আনামাত্রই তাকে প্রানপণে কামড়ে ধরবে এবং ভারী হলে তা টেনে তুলতে না পারলেও সেই নিরীহ ইঁটের টুকরোটা মুখে করে সারা দিন ঝুলে থাকবে- এমনই কর্তব্যপরায়ণ এবং বিশ্বস্ত এরা ।
বাসা বাঁধবার সময় কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে থাকতে হয় । লাল-পিঁপড়েরা একটির পর একটি পাতা জুড়ে গাছের ডালে গোলাকার বাসা নির্মাণ করে । শত শত কর্মী একযোগে কাছাকাছি অবস্থিত দুটি পাতা টেনে ধরে পরস্পর সংলগ্ন করে রাখে । আর এক দল কর্মী বাচ্চা মুখে করে সে স্থানে উপস্থিত হয় এবং বাচ্চার মুখনিঃসৃত সুতার সাহায্যে পরস্পর সংলগ্ন পাতা দুটিকে জুড়ে দেয় । এভাবে অনেক পাতা জুড়ে ক্রমশ একটি বড় বাসা গড়ে তোলে । অনেক সময় দেখেছি- হাজার হাজার পিঁপড়ের একত্রিত হয়ে এক সঙ্গে গাছের পাতা জুড়ে টেনে ধরে রয়েছে । সুতা বোনা শেষ হলে কর্মীরা একে একে সেই টানা ছেড়ে দিতে থাকে । কিন্তু পরীক্ষার উদ্দেশ্যে একবার সুতা-বোনা পিঁপড়েগুলিকে অগ্রসর হতে দেওয়া হলো না । কৌশলে তাদের গতিরোধ করা হলো । এদিকে কর্মীরা পাতা টেনে ধরেই আছে । এক দিন, দু’দিন করে ক্রমাগত কয়েক দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেল, তথাপি পাতার টানা ছাড়বার কোনই লক্ষণ দেখা গেল না । অনাহারজনিত দুর্বলতায় দু’একটা করে পিঁপড়ের কামর ছেড়ে নিচে পড়ে যেতে লাগলো । কিন্তু অন্য পিঁপড়ে এসে তৎক্ষনাৎ তাদের স্থান পূরণ করতে লাগতে লাগলো । কিন্তু সুতা বোনবার সুযোগ আর এলো না । এথেকেই পিঁপড়েদের স্বভাবের দৃঢ়তার এবং কর্তব্য-নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায় ।
জিতকে টুকরো টুকরো করে ফেলে । অনেক সময় দেখা যায়- বিজেতার পায়ে অথবা শুঁড়ে পরাজিতের মস্তক অথবা দেহের প্রথমার্থ ঝুলে রয়েছে । পরাজিত যে মরণ-কামড় দিয়েছিল, মৃত্যর পরেও তা ছাড়ে নি । তাছাড়া দেখা যায়, শরীরের কতকাংশ সমেত তা বিজেতার শরীরে আঁকড়ে রয়েছে । বিজেতাকে আমরণ এভাবে শত্রুর দেহাংশ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে । কর্মীদের এই যে কর্তব্যপরায়ণতা, দৃঢ়তা এবং পুরুষ ও রানীর প্রতি সেবাপরায়ণতা – এই সকল প্রবৃত্তির বিকাশ হলো কেমন করে ? অথচ এরা নিজের সুখদুঃখ সম্বন্ধে অনেকটা উদাসীন – এটাই বা সম্ভব হলো কিরূপে ? তাছাড়া আর একটা বিস্ময়ের বিষয়ে এই যে, এদের প্রজননক্ষমতা নেই কিন্তু কোনও কারণে বাসার শ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকলে অথবা রানীর অভাব ঘটলে এই শ্রমিক দলের মধ্যে থেকে দু-একটি, যৌনসম্পর্ক ব্যতীতই ডিম পাড়তে আরম্ভ করে এবং এই প্রকার ডিম থেকে কেবলমাত্র শ্রমিকই জন্মগ্রহণ করে । একটি কথা জানা দরকার যে পিঁপড়েদের শ্রমিকেরা সকলেই স্ত্রী-জাতীয়, কিন্তু অপরিপুষ্ট অর্থাৎ এদের প্রজননযন্ত্র মোটেই পরিপুষ্টি লাভ করে না । তথাপি প্রয়োজনবোধ যৌন-সংসর্গ ব্যতিরেকে ডিম পাড়তে পারে ।
কিন্তু কেমন করে রানীর ডিম থেকে নির্দিষ্ট আকৃতিবিশিষ্ট লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পিঁপড়ে জন্মগ্রহণ করে ? পর্যবেক্ষণের ফলে যতদূর জানা গেছে, তাতে দেখা যায় – সাধারণত ফাল্গুন মাসের প্রথম দিক থেকে বাসার মধ্যে রানী এবং পুরুষদের অপরিণত বাচ্চার আবির্ভাব ঘটে । এর পর আষাড়-শ্রাবণ মাস থেকে আবার পুরুষ এবং রানী পরিণত অবস্থায় উপনীত হবার পর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ডানায় ভর করে আকাশে উড়ে যায় । উড়তে উড়তে পুরুষ ও রানীর মিলন সংঘটিত হয় । পুরুষ পিঁপড়েরা আর বাসায় ফিরে আসে না । রানী যে কোনও একটা বাসায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করে । তার পরেই তার ডানা খসে যায় এবং কিছুকাল বাদেই ডিম পাড়তে আরম্ভ করে । এই ডিম থেকে যে সকল বাচ্চা হয় তারা সকলেই শ্রমিক শ্রেনীর । পরীক্ষার ফলে দেখা গেছে- রানীর সঙ্গে পুরুষ পিঁপড়ের মিলন ঘটতে না দিলেও রানী ডিম পেড়ে থাকে । কিন্তু সে সকল ডিম থেকে কেবল পুরুষ পিঁপড়েই জন্মগ্রহণ করে । কিন্তু কোনও অবস্থাতেই ডিম থেকে সরাসরি রানী জন্মগ্রহণ করে না । আবার এও দেখা গেছে, বাসা থেকে রানীদের সরিয়ে নিলে কিছু পরেই শ্রমিকদের মধ্যে থেকে দু-একটি বেশ কিছু সংখ্যক ডিম পাড়তে শুরু করে এবং সেই ডিম থেকে শ্রমিক পিঁপড়ে জন্মগ্রহণ করছে । সমস্যা এতে বড়ই জটিল বোধ হলো, কারণ জীবজগতের প্রজনন-প্রক্রিয়ার সাধারণ নিয়মের মধ্যে এদের আনা চলে না ।
বিবিধ পরীক্ষার পরে অবশেষে দেখা গেল যে, পিঁপড়েদের ডিম পর্যন্ত আদিম জৈব-বস্তুর বংশানুবর্তী একটা ধারাবাহিকতা আছে বটে, কিন্তু ডিম ফোটবার পর থেকেই একটা বিশেষ খাদ্যবস্তুর প্রভাবে বাচ্চার আকৃতি এবং প্রকৃতি পরিবর্তিত হতে থাকে । এই খাদ্যবস্তুর পরিমাণের উপর আকৃতি এবং প্রকৃতিগত পরিবর্তন নির্ভর করে । অবশ্য এরও একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে । ব্যাপারটা আরও একটু পরিষ্কার ভাবে বুঝিয়ে বলছি । বছরের অধিকাংশ সময়েই বাসার মধ্যে কেবল হাজার হাজার শ্রমিক-পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায় । শ্রমিকদের দু-একটার ডিম থেকে সেই সময়ে আরও কিছু কিছু শ্রমিক পিঁপড়ে জন্মগ্রহণ করে । পূর্বেই বলেছি, এই পিঁপড়েরা গাছের উপর বাসা বাঁধে এবং সাধারণত গাছের উপরেই ঘোরাফেরা করে থাকে এবং মৃত কীট-পতঙ্গ, পাখির পালক, মাছের কাঁটা প্রভৃতি সংগ্রহ করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে । শীত ঋতুর অবসানে ফাল্গুনের প্রারম্ভে গাছে গাছে নতুন পত্র-পল্লব এবং মুকুলের মধ্যে কয়েক প্রকারের অজস্র গাছ-উকুন আত্মপ্রকাশ করে থাকে । এই সব মুকুল ইং গাছ-উকুনের শরীর থেকে অতি অল্প পরিমাণে মধুর মতো এক প্রকার পদার্থ নিঃসৃত হয়ে থাকে । এই সময়ে পিঁপড়েদের মধু সংগ্রহ করবার মরসুম । তারা প্রায় সকল কাজ পরিত্যাগ করে এই মধুর লোভেই দিনরাত্রি পত্র-পল্লব এবং গাছ-উকুনের মধ্যে অবস্থান করে । এই মধুর মধ্যে ভিটামিন-বি-১ নামক এক প্রকার খাদ্যপ্রাণের অস্তিত্ব আছে । এই মধু খাবার পর শ্রমিক-পিঁপড়েরা বাসায় এসে তা উদ্গীরণ করে বাচ্চাগুলিকে খাওয়ায় । শ্রমিক-পিঁপড়ের অনেকেই পরপর বাচ্চাগুলিকে উদ্গীর্ণ মধু খাওয়াতে থাকে । এক-একটা বাসায় হাজার হাজার বাচ্চা থাকে এবং শ্রমিকদের সংখ্যাও অগণিত; কাজেই কোন কোন বাচ্চাকে কতবার খাওয়ানো হলো, তার কোনো হিসাব ঠিক রাখতে পারে না । এর ফলে কোনো কোনো বাচ্চা প্রচুর পরিমাণে এই খাদ্যপায় আবার অনেকে অতি সামান্য মাত্র পেয়ে থাকে । যারা এই খাদ্য বেশি পরিমাণে পায় তারা অতি দ্রুতগতিতে বর্ধিত হয়ে রানীর আকৃতি পরিগ্রহ করে । যারা মাঝামাঝি পরিমাণে মধু খেতে পায়, তারা পুরুষ-পিঁপড়েতে পরিণত হয় । যারা অতি সামান্য পায় অথবা মোটেই পায় না তারাই বড় এবং ছোট বিভিন্ন রকমের কর্মী বা শ্রমিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে । যৌনমিলন ব্যতিরেকে উৎপন্ন পুরুষ এবং মধুর প্রভাবে উৎপন্ন পুরুষ পিঁপড়ের মধ্যে হয়তো কোনও প্রকৃতিগত পার্থক্য বিদ্যমান থাকতে পারে, তবে তা এখনও পরীক্ষাসাপেক্ষ বলে নিশ্চিতরূপে কোনও কথা বলা যায় না । তবে একথা ঠিক যে পত্র-পল্লব এবং গাছ উকুনের দেহনিঃসৃত রসপরিবেশনের তারতম্যানুসারে প্রয়োজনমত রানী এবং কর্মী-পিঁপড়ে উৎপাদন করা যেতে পারে ।মোটের উপর খাদ্য পদার্থের মধ্যে ভিটামিন-বি এবং সেই জাতীয় অন্যান্য কোন পদার্থের অভাবের ফলেই শ্রমিক পিঁপড়ের উৎপত্তি ঘটে থাকে ।
________________
প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩৫১