কুমোরে-পোকার সন্তানরক্ষার কৌশল
ঘরের দেয়ালে, পতিত জমি বা বৃক্ষকাণ্ডের উপর বোলতার মতো ইতস্তত পরিভ্রমণকারী বিভিন্ন রঙের পোকা অনেকেরই নজরে পড়ে থাকবে। চলিত কথায় এগুলিকে কুমোরে-পোকা বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতীয় কুমোরে-পোকার সংখ্যা কম নয়। এ-দেশীয় উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ আভাযুক্ত সোনালী রঙের পোকাগুলির প্রতিই অধিকতর দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। অবশ্য কালো, হলদে, খয়েরী অথবা বিবিধ বর্ণে চিত্রিত পোকাও যথেষ্ট দেখা যায়। যে সব কুমোরে-পোকা সচরাচর আমাদের নজরে পড়ে, তাদের অনেকেই ঘরের দেয়াল বা আনাচে-কানাচে নরম মাটির সাহায্যে বাসা তৈরি করে ; কেউ কেউ আবার মাটিতে গর্ত খুঁড়ে ডিম পাড়ে। এই জন্যেই বোধ হয় এদের নাম হয়েছে কুমোরে-পোকা। কিন্তু কয়েক জাতীয় কুমোরে–পোকা গাছের গুঁড়িতে ছিদ্র করে বাসা নির্মাণ করে, কোনও কোনও কুমোরে-পোকা আবার ফাঁপা বাঁশ বা নলখাগড়ার মধ্যেও বাসা বাঁধে। কয়েক জাতীয় পোকা মোটেই বাসা তৈরি করে না । বসবাস করবার জন্যে এদের বাসা বাঁধবার প্রয়োজন হয় না ; ডিম ও বাচ্চাদের জন্যেই এদের বাসার প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ সন্তানদের জন্যেও যারা বাসা নির্মাণ করে না, তারা বাচ্চাদের আহারোপযোগী জীবন্ত প্রাণীর শরীরের অভ্যন্তরে অথবা বহির্দেশে ডিম পেড়ে যায়। অনেকে আবার কচি ফুল বা মুকুলের গায়ে হুল ফুটিয়ে ডিম পেড়ে রাখে। ডিম ফুটে বের হলেই যথেষ্ট সঞ্চিত খাদ্য উদরস্থ করে তারা দ্রুত গতিতে বেড়ে ওঠে এবং প্রাণীর দেহ ভেদ করে অথবা মুকুলে ছিদ্র করে বেরিয়ে আসে [১]।
বোলতা, ভীমরুল প্রভৃতি পতঙ্গের সঙ্গে অনেকাংশে দৈহিক সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হলেও কুমোরে-পোকার জীবনযাত্রা-প্রণালী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বোলতা, ভীমরুল, মৌমাছিরা সর্বদাই সমাজবদ্ধভাবে বাস করে ; কিন্তু কুমোরে-পোকা সর্বদাই একাকী বাস করতে অভ্যস্ত ; কখনও দলবদ্ধভাবে বাস করে না । বোলতা, মৌমাছি প্রভৃতি প্রাণীরা দিবাবসানে নিজ নিজ বাসায়ই প্রত্যাবর্তন করে বিশ্রাম করে ; কিন্তু বিশ্রাম করবার জন্যে কুমোরে-পোকার কোনও নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই। পাতার আড়ালে, গাছের ডালে বা ঘাসের ঝোপে আত্মগোপন করে এরা রাত কাটিয়ে দেয়। অনেকে আবার ঘাসের ডাঁটা কামড়ে ধরে শরীরটাকে পাশাপাশি প্রসারিত করে নিদ্রা যায়। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে বলে মৌমাছি, ভীমরুল প্রভৃতি স্ত্রী-পতঙ্গেরা ডিম পেড়েই খালাস, বাকি সব কাজের ভার শ্রমিকদের উপর।
বাচ্চাদের পরিণতি লাভ করবার বয়স পর্যন্ত কর্মী বা শ্রমিকেরাই তাদের তদারক করে থাকে । কিন্তু কুমোরে-পোকারা সামাজিক প্রাণী নয় বলে তাদের মধ্যে কর্মী বা শ্রমিক জাতীয় কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব নেই । কাজে কাজেই স্ত্রী কুমোরে-পোকাকে নিজে নিজেই সন্তানরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। এরা সন্তান রক্ষার ব্যবস্থা করে বটে, কিন্তু সেগুলিকে মৌমাছি বা বোলতার শিশুর মতো প্রতিপালন করে না ; বোলতা বা মৌমাছিরা যেমন বাচ্চাগুলিকে আহার্য দ্রব্য মুখে তুলে খাইয়ে দেয় এবং সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে, কুমোরে-পোকার বাচ্চাদের সে-সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। ডিম ফুটে বের হবার পর থেকেই আহারাদি কার্যে বাচ্চাগুলি স্বভাবতই অদ্ভুত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। অবস্থার চাপে পড়েই হয়তো অতি শৈশবকাল থেকেই তাদের সর্ববিষয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়েই গড়ে উঠতে হয়েছে।
বোলতারা শোঁয়াপোকা বা অন্যান্য কীট-পতঙ্গের পিছু পিছু তাদের আক্রমণ করে থাকে এবং তৎক্ষণাৎ শিকারের দেহ ছিন্নভিন্ন করে অধিকাংশই উদরসাৎ করে ফেলে । সময় সময় শিকারের অবশিষ্টাংশ বাসায় বয়ে নিয়ে যায়। ভীমরুলেরাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীট-পতঙ্গ শিকার করে এক পায়ের সাহায্যে গাছের ডালে ঝুলে তৎক্ষণাৎ তাদের উদরস্থ করে। কিন্তু কুমোরে-পোকা নানা জাতীয় পোকামাকড় শিকার করলেও ঐ শিকার উদরস্থ করে না । ফুলের মধু ও শর্করা জাতীয় শক্ত পদার্থই তাদের কুরে কুরে খেতে দেখেছি । অবশ্য বোলতা, ভীমরুল, মৌমাছিরা সকলেই শর্করা জাতীয় পদার্থ পরম উপাদেয় বোধে চেটে খায়। ডিম পাড়বার সময় হলেই কুমোরে-পোকা নানা জাতীয় পোকা মাকড় শিকার করবার জন্যে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে থাকে এবং শিকার পেলেই বাচ্চাদের জন্যে গর্তের মধ্যে সঞ্চয় করে রাখে।
আমাদের দেশের ঘরের আনাচে-কানাচে বা দেওয়ালের গায়ে লম্বাটে ধরনের এবড়ো-খেবড়ো এক-একটা শুকনো মাটির ডেলা লেগে থাকতে দেখা যায়। সেগুলি এক প্রকার কালো রঙের লিকলিকে কুমোরে-পোকার বাসা । এই পোকাগুলির গায়ের রং আগাগোড়া মিশ্ মিশে কালো। কেবল শরীরের মধ্যস্থলের বোঁটার মতো সরু অংশটি হলদে। ডিম পাড়বার সময় হলেই এরা বাসা তৈরি করবার জন্যে উপযুক্ত স্থান খুঁজতে বের হয়। দুই-চার দিন ঘুরে-ফিরে মনোমত কোনও স্থান দেখতে পেলেই তার আশেপাশে বারবার ঘুরে বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করে দেখে । তারপর খানিক দূর উড়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে এবং স্থানটাকে পুনঃপুন দেখে নেয়। দু-তিন বার এরূপভাবে এদিক-ওদিক উড়ে অবশেষে কাদামাটির সন্ধানে বের হয়। যতটা সম্ভব নিকটবর্তী স্থানে কাদামাটি সন্ধান করতে সময় সময় দু–একদিন চলে যায়। কাদামাটির সন্ধান পেলেই বাসা নির্মাণের জন্যে সেই স্থান থেকে নির্বাচিত স্থানে যাতায়াত করে রাস্তা চিনে নেয়। সাধারণত আশেপাশে চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ ব্যবধান থেকে মাটি সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু অত কাছাকাছি বাসা নির্মাণের উপযোগী মাটি না পেলে সময় সময় দেড়-দুশ গজ দূর থেকেও মাটি সংগ্রহ করে থাকে । কাছাকাছি কোনও স্থান থেকে মাটি সংগ্রহ করে বাসার একটা কুঠুরি নির্মাণ প্রায় শেষ করে এনেছে, এমন সময় সেই স্থানে কাদামাটি চাপা দিয়ে বা বাসাটি সরিয়ে ফেলে দেখেছি – সংস্কারবশেই হোক আর বুদ্ধি করেই হোক, কুমোরে-পোকাটা বাসার সন্ধান না পেয়ে কোনও একটা জলাশয়ের পাড়ে উড়ে গিয়ে সেখান থেকে ভিজা মাটি সংগ্রহ করে পূর্বের জায়গায় নতুন করে বাসা তৈরি শুরু করেছে। যত বারই এরূপ করেছি, ততবারই দেখেছি – পুকুর বা নালা, ডোবা যত দূরেই থাকুক না কেন, সেখান থেকেই ভিজা মাটি এনে বাসা তৈরি করেছে । এইসব অসুবিধার জন্যে অবশ্য বাসা নির্মাণে যথেষ্ট বিলম্ব ঘটে । একটি কুঠুরি তৈরি হয়ে গেলেই তার মধ্যে উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্য, অর্থাৎ পোকামাকড় ভর্তি করে তাতে একটি মাত্র ডিম পেড়ে মুখ বন্ধ করে তারই গা ঘেঁষে নতুন কুঠুরি নির্মাণ শুরু করে। কাজেই এ থেকে মনে হয় যে, কুমোরে-পোকা ইচ্ছামত ডিম পাড়বার সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ।
বাসা নির্মাণের জন্যে মাটি সংগ্রহ করবার সময় উড়ে গিয়ে ভিজা মাটির উপর বসে এবং লেজ নাচাতে নাচাতে এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে দেখে । উপযুক্ত মনে হলেই সেখান থেকে ভিজা মাটি তুলে নিয়ে চোয়ালের সাহায্যে খুব ছোট্ট এক ডেলা মাটি মটরদানার মতো গোল করে মুখে করে উড়ে যায় । মাটি কুরে তোলবার সময় অতি তীক্ষ্ন স্বরে একটানা গুন্গুন্ শব্দ করতে থাকে। মুখ দিয়ে চেপে চেপে মাটির ডেলাটিকে দেয়ালের গায়ে অর্ধ-চক্রকারে বসিয়ে দেয়। মাটির ডেলাটাকে লম্বা করে চেপে বসাবার সময়ও তীক্ষ্ন স্বরে একটানা গুন্গুন্ শব্দ করতে থাকে। কোন অদৃশ্য স্থানে বাসা বাঁধবার সময়ও এই গুন্গুন্ শব্দ শুনেই বুঝতে পারা যায়, কুমোরে-পোকা বাসা বাঁধছে । পুকুর ধারে কাদামাটির উপর মাছির মতো একপ্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকা ঘুরে ঘুরে আহার সংগ্রহ করে। এরূপ স্থলে মাটি তোলবার সময় ঐরূপ কোনও পোকা তার কাছে এসে পড়লে মাটি তোলা বন্ধ রেখে তাকে ছুটে গিয়ে তাড়া করে। যাহোক, বারবার এরূপ এক এক ডেলা মাটি এনে ভিতরের দিকে ফাঁকা রেখে ক্রমশ উপরের দিকে বাসা গেঁথে তুলতে থাকে । প্রায় সওয়া ইঞ্চি লম্বা হলেই গাঁথুনি ক্ষান্ত করে। এরূপ একটি কুঠুরি তৈরি করতে প্রায় দু-দিন সময় লেগে যায় । ইতিমধ্যে মাটি শুকিয়ে বাসা শক্ত হয়ে যায় । কুমোরে-পোকা তখন কুঠুরির ভিতরে প্রবেশ করে মুখ থেকে একপ্রকার লালা নিঃসৃত করে তার সাহায্যে কুঠুরির ভিতরের দেয়ালে প্রলেপ মাখিয়ে দেয় । প্রলেপ দেওয়া শেষ হলে শিকারের অন্বেষণে বের হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাকড়সার অভাব নেই ; তারা জাল বোনে না, ঘুরে ঘুরে শিকার ধরে । এই কুমোরে-পোকারা বেছে বেছে এরূপ ভ্রমণকারী মাকড়সা শিকার করে থাকে। কোনও রকমে মাকড়সা একবার চোখে পড়লেই হলো, ছুটে গিয়ে তার ঘাড় কামড়ে ধরে। কিন্তু কামড়ে ধরলেও একবারে মেরে ফেলে না । শরীরে হুল ফুটিয়ে এক রকম বিষ ঢেলে দেয় । একবার হুল ফুটিয়ে নিরস্ত হয় না । কোনও কোনও মাকড়সাকে পাঁচ-সাত বার পর্যন্ত হুল ফুটিয়ে থাকে। এর ফলে মাকড়সাটার মৃত্যু হয় না বটে, কিন্তু একেবারে অসাড়ভাবে পড়ে থাকে। তখন কুমোরে-পোকা অসাড় মাকড়সাকে মুখে করে নব-নির্মিত কুঠুরির মধ্যে উপস্থিত হয়। কুঠুরির নিম্নদেশে মাকড়সাটাকে চিৎ করে রেখে তার উদর দেশের এক পাশে লম্বাটে ধরনের একটি ডিম পাড়ে । ডিম পেড়েই আবার নতুন শিকারের সন্ধানে বের হয় । সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে দশ-পনেরোটা মাকড়সা সংগ্রহ করে সেই কুঠুরির মধ্যে জমা করে আবার দু-তিন ডেলা মাটি এনে কুঠুরির মুখ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। তারপর দু-একদিনের মধ্যেই পূর্বোক্ত কুঠুরির গায়েই আর একটি কুঠুরি নির্মাণ শুরু করে। সেই কুঠুরিটিও মাকড়সা পূর্ণ করে তাতে ডিম পেড়ে মুখ বন্ধ করবার পর তৃতীয় কুঠুরি নির্মাণ করতে আরম্ভ করে। এরূপে এক একটি বাসার মধ্যে চার-পাঁচটি কুঠুরি নির্মিত হয়। ডিম পাড়া সম্পূর্ণ হয়ে গেলে সে তার ইচ্ছামত যে কোনও স্থানে চলে যায়, বাসার আর কোনও খোঁজ-খবরই নেয় না। বাচ্চাদের জন্যে খাদ্য সঞ্চিত রেখেই সে খালাস।
দু-এক দিনের মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। বাচ্চা সরু লম্বাটে হাত-পা শূন্য পোকা মাত্র। ডিম থেকে বের হবার পর থেকেই বাচ্চাটি মাকড়সার দেহ খেতে আরম্ভ করে। একটি খাওয়া শেষ হলেই আর একটিকে খেতে আরম্ভ করে। দিন-রাত তার খাওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। খেতে খেতে প্রায় সাত-আট দিনের মধ্যেই সবগুলি মাকড়সাকে নিঃশেষ করে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গে শরীরও যথেষ্ট বেড়ে উঠতে থাকে ; কিন্তু আকৃতি বিশেষভাবে পরিবর্তিত হয় না । ডিম পাড়বার পাঁচ-ছয় দিন পরে কুমোরে-পোকার বাসা ভেঙে দেখেছি – বাচ্চাগুলি বেশ বড় হয়েছে, মাকড়সাগুলি তখন সম্পূর্ণ নিঃশেষিত হয়নি, কিন্তু এতদিন পরেও সবগুলি মাকড়সাই জীবিত ছিল, যদিও সম্পূর্ণরূপে অসাড়। একটু জোরে সুড়সুড়ি দিলেই হাত-পা নেড়ে সাড়া দিত। মেরে ফেললে নিশ্চয়ই এতদিনে পচে নষ্ট হয়ে যেত। বাচ্চাগুলি যাতে রোজ টাটকা খাদ্য পায় তার জন্যেই কুমোরে-পোকা শিকারগুলিকে অসাড় করে রাখবার কৌশল আয়ত্ত করে নিয়েছে।
এক-একটি কুঠুরির মাকড়সাগুলি সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষিত হলেই বাচ্চাগুলি কয়েক ঘণ্টা চুপ করে অবস্থান করে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শরীরের চতুর্দিকে এক প্রকার সূক্ষ্ম সুতার জাল বুনতে থাকে। প্রায় দুদিনের চেষ্টায় শরীরের চতুর্দিকে খোলসের মতো এক প্রকার আবরণ গড়ে ওঠে। বাচ্চাটি সেই আবরণের মধ্যে নিশ্চেষ্টভাবে অবস্থান করে । এই সময় বাচ্চা ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ পুত্তলীর রূপ ধারণ করে। কিছুদিন পরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিপুষ্ট হলে মাটির আবরণ ছিদ্র করে বের হয়ে যায়।
মাকড়সা-শিকারী কুমোরে-পোকাদের আরও একটি বিশেষত্ব এই যে বিভিন্ন জাতীয় পোকা বিভিন্ন জাতীয় অথবা এক গোষ্ঠীভূক্ত বিভিন্ন শ্রেণীর মাকড়সাই সংগ্রহ করে থাকে। প্রত্যেকের বাসার মধ্যে একই শ্রেণীর মাকড়সা দেখতে পাওয়া যায় । খুব ক্ষুদ্র কয়েক জাতীয় কুমোরে-পোকা কেবল পিঁপড়ে-মাকড়সাই বাচ্চাদের জন্যে সংগ্রহ করে রাখে। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন জাতীয় জালবোনা মাকড়সাকে জাল দিয়ে ধরে নিয়ে আসে। কুমোরে-পোকাকে জালবোনা মাকড়সা শিকার করতে যেরূপ কৌশল ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে দেখেছি, তা সত্য-সত্যই বিস্ময়কর। এক প্রকার কুঁজো মাকড়সা তাঁবুর মতো বাসা নির্মাণ করে এবং তারা এক সঙ্গে বহু তাঁবু খাটিয়ে দলে দলে বাস করে থাকে। তাঁবুর জালের বুনোনি সাধারণ মাকড়সার জালের মতো নয়। এটা ঠিক সূক্ষ্ম ছিদ্র বিশিষ্ট তারের জালের মতো। জালগুলি কাপড়ের মতো টানা-পোড়েনে বোনা নীচে এক থাক বা দু-থাক চাঁদোয়া বিস্তৃত । মধ্যস্থলে মাকড়সা মালার আকারে ডিম পেড়ে অতি সুরক্ষিত অবস্থায় চুপ করে বসে থাকে। বাস্তবিকই অন্যান্য জালবোনা মাকড়সারা যেরূপ অরক্ষিতভাবে জালে বাস করে, এদের অবস্থানক্ষেত্র মোটেই সেরূপ নয়। ছোট ছোট শত্রুর পক্ষে সেটা একরূপ দুর্ভেদ্য দুর্গবিশেষ । চতুর্দিকে বহু বাসা একত্র থাকায় এদের প্রবেশ পথ শত্রুর পক্ষে অগম্য হয়ে ওঠে । কিন্তু সূচের মতো সব প্রায় আধ ইঞ্চি লম্বা এক প্রকার নীল রঙের কুমোরে-পোকা অনেক ঘুরে ফিরে বিভিন্ন ফাঁক-ফন্দিতে সেই বাসার মধ্যে ঢুকে মাকড়সাকে আক্রমণ করে। ঘুরে-ফিরে বললাম এই জন্যে যে, জাল ছিঁড়ে সোজাসুজি মাকড়সাকে ধরবার চেষ্টা করলেই কুমোরে-পোকার বিপদ অবশ্যম্ভাবী , কারণ জালের আঠায় তাকে জড়িয়ে পড়তেই হবে। কাজেই তাকে ঘুরে-ফিরে প্রশস্ত ফাঁক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। মাকড়সা এই জাতীয় কুমোরে-পোকা অপেক্ষা আকারে বড় হলেও শত্রুর ভয়ে কম্পিত কলেবরে ছুটাছুটি করে এক বাসা থেকে আর এক বাসায় বা একই বাসার ভিতরে বা বাইরে আত্মগোপন করবার চেষ্টা করে, কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। কুমোরে-পোকা চিৎ হয়ে, কাৎ হয়ে, কখনও উড়ে গিয়ে কখনও বা ছুটাছুটি করে যেন মরিয়া হয়েই শিকার আক্রমণ করে। একটি মাকড়সার পিছনে কুমোরে-পোকা লাগতে দেখা মাত্রই একসঙ্গে সংলগ্ন সকল বাসার মাকড়সারা বাসস্থান পরিত্যাগ করে কোনও নিভৃত স্থানে এমনভাবে আত্মগোপন করে থাকে যে, শত চেষ্টা করেও তাদের খুঁজে বের করা যায় না।
আর এক জাতীয় মাঝারি আকৃতির কুমোরে-পোকা দেখা যায় । তারা ডিম পাড়বার জন্যে কখনও বাসা নির্মাণ করে না । তারা বড় বড় এক জাতীয় কাঁকড়া-মাকড়সার গায়ে ডিম পেড়ে যায় । এই মাকড়সারা পাতা মুড়ে বাসা নির্মাণ করে অধিকাংশ সময়ই তার মধ্যে অবস্থান করে। কুমোরে-পোকা ডিম পাড়বার সময় উপস্থিত হলেই সেগুলিকে বাসার মধ্যে থেকে খুঁজে বের করে । এই মাকড়সাদের বাসায় দুটি করে দরজা থাকে। কুমোরে-পোকাকে এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেখলেই মাকড়সা অন্য দরজা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ে প্রাণভয়ে ছুটতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই শত্রুর হাত থেকে নিস্তার পায় না । পিছু তাড়া করে কুমোরে-পোকা তাকে ধরে ফেলে এবং কোনরূপ আহত না করে তার পেটের একপাশে একটি ডিম পেড়ে যায় । ডিমটি তার গায়ে আঠার মতো লেগে থাকে । ডিম পাড়বার পরক্ষণেই এরূপ একটা মাকড়সাকে ধরে বড় কাচপাত্রে রেখে দিয়েছিলাম। প্রথম দিন অপরাহ্ণের দিকে ডিম পেড়েছিল । দ্বিতীয় দিন সকালবেলায় দেখলাম ডিমটা যেন অনেক বড় হয়ে উঠেছে, কিন্তু একই জায়গায় লেগে রয়েছে। প্রায় এগারোটার সময় দেখলাম বেশ পরিষ্কার বাচ্চার আকার ধারণ করেছে এবং মাকড়সার রস শুষে নেবার প্রক্রিয়াটাও স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হল। তার শরীরের বৃদ্ধি যেন ক্রমশই দ্রুততর হয়ে উঠছিল ।
মাকড়সাটা এতক্ষণ পর্যন্ত বেশ স্বাভাবিকভাবেই নড়াচড়া করছিল । কিন্তু প্রায় একটার সময় দেখলাম, বাচ্চাটা অনেক মোটা ও বড় হয়ে উঠেছে এবং মাকড়সার পেটটা যেন অনেকটা চুপসে গেছে । মাকড়সাটা তখন একস্থানে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল । বেশী নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। বেলা দুটার পর থেকেই বাচ্চাটা যেন ভীষণ মূর্তি ধারণ করে পেটটাকে কুরে খেয়ে ঠ্যাংগুলিকে একটি একটি করে নিঃশেষ করতে লাগলো । প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই এত বড় একটা মাকড়সাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেললো। খাওয়া শেষ হলে বাচ্চাটা প্রায় ঘণ্টা-দুই বিশ্রামের পর মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শরীরের চতুর্দিকে সুতা বুনতে লাগলো । আড়াই ঘণ্টার পর শরীরের চতুর্দিকে একটা পাতলা স্বছ আবরণ গঠিত হলো । তার পরদিন দেখি, আবরণ আরও কঠিন, অস্বছ ও কালচে বাদামী রং ধারণ করেছে। প্রায় একমাস পরে পূর্ণাঙ্গ কুমোরে-পোকা গুটি কেটে বাইরে বেরিয়ে এলো।
পরিত্যক্ত বেলে মাটির জমির উপর একটু নজর রাখলেই দেখতে পাওয়া যাবে, নানা জাতীয় উজ্জ্বল নীল, সোনালী বা হলদে রঙের বড় বড় কুমোরে-পোকা গর্ত খুঁড়তে ব্যস্ত রয়েছে । এদের অনেকেই এক ইঞ্চি থেকে প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে । মাটির নীচে তির্যকভাবে ৬/৭ ইঞ্চি গর্ত খুঁড়ে নিম্ন প্রান্ত অপেক্ষাকৃত চওড়া করে বাড়ির মতো তৈরি করে । এরাও ডিম পাড়বার সময় হলেই গর্ত খুঁড়তে আরম্ভ করে । গর্ত খোঁড়বার সময় প্রথমত পা দিয়ে মাটি দূরে ছড়িয়ে ফেলে । গর্ত যতই নীচে নামতে থাকে, শরীরের অধিকাংশ নীচে ঢুকে যাবার ফলে আর পা দিয়ে মাটি ছড়াতে পারে না । তখন সে মুখে করে মাটি তুলে এনে দূরে গিয়ে ফেলতে থাকে । এভাবে গর্ত নির্মাণ শেষ হলে সে শিকারের সন্ধানে বের হয় । নীল রঙের বড় বড় কুমোরে-পোকারা উই-চিংড়ি শিকার করে থাকে । কেউ কেউ পঙ্গপাল অথবা বড় বড় কয়ার ফড়িংও শিকার করে। উইচিংড়ি শিকার করবার জন্যে এরা তাদের গর্ত খুঁজে বেড়াতে থাকে। কয়েক জাতীয় বড় বড় উইচিংড়ি মাটির নীচে দু-মুখো গর্ত করে বাস করে । এরা কিছুতেই আলোতে আসতে চায় না । দিনের বেলা চুপ করে থাকে – সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই সকলে মিলে অতি তীক্ষ্ন স্বরে একটানা ঝিন্ঝিন্ শব্দ করতে থাকে । দিনের বেলায়ও সময় সময় একটা শব্দ করে থাকে। দিনের বেলায় একটু নিস্তব্ধ অবস্থা বুঝতে পারলেই লম্বা লম্বা শুঁড় দুটাকে গর্তের মুখে একটুখানি বের করে ধীরে ধীরে আন্দোলন করতে থাকে । কুমোরে-পোকারা ঘুরতে ঘুরতে এই শুঁড়ের আন্দোলন দেখেই তাদের গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে । কিন্তু গর্তের মধ্যে তাদের ধরা খুবই শক্ত ব্যাপার। কুমোরে-পোকা গর্তে ঢোকবামাত্রই উইচিংড়ি অপর মুখ দিয়ে লাফিয়ে বাইরে পালিয়ে যায় । এরা এক এক লাফে প্রায় দু-তিন হাত জায়গা অতিক্রম করতে পারে । কিন্তু এত দ্রুতগতিতে লাফিয়েও তারা কুমোরে-পোকার হাত থেকে নিষ্কৃতি পায় না । কুমোরে-পোকা তৎপরতার সঙ্গে উড়তে উড়তে তাকে অনুসরণ করে সুযোগ পেলেই ঘাড়ে কামড়ে ধরে হুল ফোটাবার চেষ্টা করে । কিন্তু সহজে উইচিংড়িকে এঁটে উঠতে পারে না । অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তির পর উইচিংড়ি কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়লে তার শরীরের নিম্নাংশে ও ঘাড়ের কাছে কয়েকবার হুল ফুটিয়ে দিলেই সে একেবারে অসাড় হয়ে পড়ে । তখন কুমোরে-পোকা শিকারটাকে সেখানে রেখে বোধ হয় রাস্তা ঠিক করে নেয় । তারপর অসাড় উইচিংড়িটাকে চিৎ করে গলার কাছে কামড়ে ধরে উড়ে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু অত ভারী শিকারসহ একটানা উড়ে যেতে পাড়ে না । খানিক দূর উড়ে আবার মাটিতে অবতরণ করে এবং একইভাবে ধরে পোকাটাকে মাটি বা ঘাসের উপর দিয়ে নিয়ে যেতে থাকে । আবার খানিক দূর উড়ে যায়। এরূপভাবে শিকারকে গর্তের কাছে এনে মাটিতে ফেলে রেখে একটু এদিক-ওদিক দেখে গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়ে । অল্পক্ষণ পরেই বের হয়ে এসে শিকারটাকে পূর্ববৎ কামড়ে ধরে গর্তের মধ্যে নিয়ে যায় । যদি এভাবে গর্তের মধ্যে ঢুকতে না পারে, তবে শিকারের শুঁড় ধরে গর্তে টেনে নামায় । শিকারটাকে গর্তের প্রশস্ত স্থানে রেখে তার পেটের দিকে একটা ডিম পেড়ে প্রায় দশ-বারো মিনিট পরেই বাইরে চলে আসে। বাইরে এসে চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করবার পর পায়ের সাহায্যে আলগা মাটিগুলিকে গর্তের ভিতর ফেলে মুখ বন্ধ করে চলে যায় । শিকার আকারে ছোট হলে সময় সময় দুটি উইচিংড়িও একই গর্তে রেখে দিতে দেখা যায় । উইচিংড়ির দেহ সম্পূর্ণরূপে খেয়ে ফেলবার পর বাচ্চা গুটি বাঁধে এবং প্রায় মাসাধিক কাল পরে পূর্ণাঙ্গ কুমোরে-পোকা মাটি সরিয়ে বের হয়ে আসে ।
যারা মাটিতে গর্ত করে ডিম পাড়ে তাদের মধ্যে কোনও কোনও জাতীয় কুমোরে-পোকা কেবল মাকড়সাই শিকার করে আনে। বড় মাকড়সা শিকার করে তার সব কয়টি ঠ্যাং কেটে ফেলে দেয়, শুধু দেহটা বাসায় নিয়ে আসে। মাকড়সা অপেক্ষাকৃত ছোট হলে তাদের ঠ্যাং কেটে ফেলে না, বাসার কাছে এসে শিকার বেহাত হবার ভয়েই বোধ হয় অনেক সময় ছোট ছোট গাছপালার ডালের মধ্যে রেখে দেয় এবং গর্তের ভিতর তদারক করে এসে শিকার ভিতরে নিয়ে যায় । এরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন গর্ত খুঁড়ে প্রত্যেক গর্তে একটি মাত্র ডিম পেড়ে রাখে ।
কোনও কোনও জাতীয় বড় বড় কুমোরে-পোকা মথ প্রজাপতির বড় বড় শূককীটই বেছে বেছে শিকার করে। এই শূককীটেরা পাতার রঙের সঙ্গে গায়ের রং মিলিয়ে আত্মগোপন করে থাকে। কিন্তু কুমোরে-পোকার চোখ এড়াবার উপায় নেই । তারা শূককীটকে ঘাড়ে কামড়ে দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় এবং অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তির পর শরীরের নানা স্থানে হুল ফুটিয়ে তাকে অসাড় করে ফেলে। তারপর গলায় কামড়ে ধরে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে যায় । শূককীটগুলি সময় সময় এত বড় হয় যে, গর্তের ভিতর প্রবেশ করাতে পারে না, কাজেই শিকার বাইরে রেখে গর্ত অধিকতর প্রশস্ত করে নেয় । তারপর তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে যায়। ডিম পাড়বার পর গর্তের মুখ বন্ধ করে এরা এক অদ্ভুত কাণ্ড করে । এক খণ্ড ভারী মাটির টুকরো সংগ্রহ করে তাকে গর্তের মুখে বারবার আছাড় মারতে থাকে । এতে নরম মাটি চেপে বসে গিয়ে গর্তের স্থানটি আশেপাশের জায়গার সঙ্গে বেমালুম মিশে যায়। শত্রুর চোখে ধূলি দেবার জন্যই এই ব্যবস্থা করে থাকে।
অনেক জাতের কুমোরে-পোকা গাছের গুঁড়িতে ছিদ্র করে বাসা নির্মাণ করে । তারা বাচ্চার আহারের জন্যে বিভিন্ন রকমের পোকা-মাকড়, কীট–পতঙ্গ ধরে এনে অসাড় করে রাখে। কতকটা ভীমরুলের মতো দেখতে এক প্রকার উজ্জ্বল নীল রঙের কুমোরে-পোকা এদেশে গাছের উপর প্রায়ই দেখা যায়। এরা ছোট বড় নানা জাতীয় আরসোলা ধরে বাসায় নিয়ে যায়। কুমোরে-পোকার আরসোলা শিকার যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা বাস্তবিকই অদ্ভুত। শিবপুরের বাগানে ও সুন্দরবনের এক স্থানে একই রকম ঘটনা দেখেছিলাম। প্রকাণ্ড একটা গাছের গুঁড়ির উপর একটা মাঝারি গোছের কুমোরে-পোকা একটা আরসোলাকে শূঁড়ে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল । আরসোলাটাও দিব্যি হেঁটে হেঁটে কুমোরে-পোকার সঙ্গে যাচ্ছিল। খানিক দূর গিয়েই কুমোরে-পোকাটা আরসোলাটাকে ছেড়ে দিয়ে গাছের উপরে বাসাটা দেখে আসলো । কিন্তু আরসোলাটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়েছিল । আবার এসে কুমোরে-পোকা তাকে শূঁড়ে ধরে টেনে খানিক দূর উপরে নিয়ে গিয়ে এক স্থানে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল। এই ফাঁকে একটা কাঠি দিয়ে আরসোলাটাকে অন্য স্থানে ঠেলে দিলাম ; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আরসোলাটা পুনরায় ঘুরে ফিরে এসে ঠিক পূর্বস্থানেই স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। যতবার আরসোলাটাকে সরিয়ে দিলাম, ততবারই সে ঠিক পূর্বস্থানে এসে উপস্থিত হলো। সুন্দরবনেও ঠিক একই রকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আরসোলাটা ভয়ে সম্মোহিত হয়ে অথবা কোনও অদ্ভুত বিষের ক্রিয়ায় এরূপ কাণ্ড করেছিল, তা আজও বুঝতে পারিনি।
আমাদের দেশে পুরানো দেয়ালের গায়ে অথবা কোনও পরিত্যক্ত স্থানে কালো রঙের একপ্রকার অদ্ভুত পোকা দেখা যায়। এরা দেখতে একটা সাধারণ কুমোরে-পোকার মতো। কিন্তু শরীরের পশ্চাদ্ভাগ এত ক্ষুদ্র যে নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না । শরীরের এই অসামঞ্জস্য ভয়ানক চোখে লাগে। এগুলি সাধারণত ধোবি-পোকা নামে পরিচিত। এই ধোবি–পোকা কোনও বাসা নির্মাণ করে না, ডিম পাড়বার সময় হলেই এরা গাছের ডালে কচি ডগার অভ্যন্তরে হুল ফুটিয়ে ডিম পেড়ে রাখে। ডিম ফুটে বাচ্চাগুলি গাছের কোমল অংশ খেয়ে বাড়তে থাকে । সঙ্গে সঙ্গে গাছের ডগার আহত অংশও অসম্ভব রূপে ফুলে ওঠে। বাচ্চাগুলি পরিণতি লাভ করে গাছের গায়ে ছিদ্র করে বেরিয়ে আসে। আমাদের দেশে এই জাতীয় বিভিন্ন শ্রেণীর পোকা দেখতে পাওয়া যায়।
এক-চতুর্থ ইঞ্চি বা আরও ক্ষুদ্রকায় বহু জাতের কুমোরে-পোকার আমাদের দেশে অভাব নেই। এদের অনেকেই বাসা নির্মাণ করে না । কোনও জীবন্ত প্রাণীর শরীরে ডিম পেড়ে যায়। আমাদের দেশে এক ইঞ্চির প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ পরিমিত এক জাতীয় কুমোরে-পোকা দেখতে পাওয়া যায়। এরা সাদা শোঁয়াবিশিষ্ট শোঁয়াপোকার শরীরে হুল ফুটিয়ে ডিম পেড়ে যায়। ডিম পাড়বার প্রায় আট-দশ দিন পরে শোঁয়াপোকাটা ক্রমশ নির্জীব হয়ে পড়তে থাকে। পূর্ব থেকেই তার আহারে অরুচি ধরতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বন-জঙ্গল থেকে বের হয়ে কোনও পরিষ্কার স্থানে এসে চুপ করে বসে থাকে। এক স্থানে চুপ করে বসবার কয়েক ঘণ্টার পরেই দেখা যায়, তার শরীরের ভিতর থেকে থেকে চামড়া ভেদ করে একের পর এক সুতার মতো সরু সরু প্রায় পঁচিশ-ত্রিশটা ছোট ছোট বাচ্চা বেরিয়ে আসছে। বাচ্চাগুলি বাইরে এসেই শোঁয়াগুলির মধ্যে থেকে শরীরটাকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে মোচড় দিতে দিতে সুতা বের করে এবং শরীরের চতুর্দিকে গুটি বাঁধতে থাকে। বিশ থেকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে সবগুলি বাচ্চাই গুটি প্রস্তুত করে ফেলে এবং এক-একটি চালের মতো সাদা গুটি শোঁয়াগুলির গায়ে লেগে থাকে । শোঁয়াপোকাটা তখন ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হয় । ছয়-সাতদিন থাকবার পর ছোট ছোট পূর্ণাঙ্গ পোকাগুলি গুটি কেটে উড়ে যায় ।
ফাল্গুন, ১৩৪৫
প্রবাসী
[১] অধ্যাপক রতনলাল ব্রহ্মচারীর মতে এগুলি Hunting wasp বা কুমোরে বোলতা। ( আমার দেখা পোকা-মাকড়, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, দে’জ পাবলিশিং)
[২] কুমোরে পোকা (potter wasp) নিয়ে ‘বিজ্ঞান’-এ প্রকাশিত আরেকটি লেখা: https://bigyan.org.in/2014/09/05/potter-wasp/
[৩] কুমোরে পোকার উপর নিকো টিনবার্গেন-এর কিছু মজার পরীক্ষা নিয়ে বলছেন এভোলিউশনারী বায়োলজিস্ট রিচার্ড ডকিন্স: https://www.youtube.com/watch?v=CFn4hCZ3g9w ।