অবহেলিত বিজ্ঞানীর শ্রেণীতে ফেলা যায় না তাঁকে। আবার তাঁর কথা যে খুব চর্চিত তাও নয়। যে বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর মামা সেটার প্রকৃত বিকাশ হয়েছিল তাঁরই হাতে। তাঁর গবেষণা যে পথে অগ্রসর হয়েছিল সে পথেই এসেছে নোবেল পুরস্কার তবে প্রাপক কোনো বারই তিনি নন। আবার, ভারতবর্ষে সংগঠিত আকারে বিজ্ঞান ইতিহাস রচনার কাজ শুরু হয়েছিল এই মানুষটিরই হাতে। তিনি দেবেন্দ্রমোহন বসু। মামা জগদীশচন্দ্রের নামের পাশেই তাঁর নামটা জ্বলজ্বল করা উচিত ছিল ভারতের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাসে। কিন্তু তা যে হয় নি সেটাও তো এক ইতিহাস!
বসু এবং বসু
দেবেন্দ্রমোহনের জন্ম ১৮৮৫ সালে। বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর থেকে ন’ বছরের বড় তিনি। ঘটনাচক্রে দু’জনের পদবী এক হয়ে যাওয়ায় বহুদিন অবধি দু’জনকে গুলিয়ে ফেলত পশ্চিমের বিজ্ঞানীমহল। সেভাবে দেখতে গেলে তিন বসু – জগদীশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ এবং দেবেন্দ্রমোহন, এই তিনজনের কে যে কী কাজ করেছেন তা অনেক পশ্চিমী বিজ্ঞানীর রচনাতেই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।
সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেবেন্দ্রমোহনের যে খুব বেশি যোগাযোগ ছিল তা নয়। একটা চাকরির প্রশ্নে তাঁদের নাম কাছাকাছি আসে একসঙ্গে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু নবগঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রীডার হিসাবে যোগ দেন ১৯২১ সালে। ১৯২৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দু’ বছরের ছুটি দেয়, ইউরোপে গিয়ে গবেষণা এবং পঠনপাঠনের জন্য। এই সময়েই তিনি আইনস্টাইন থেকে শুরু করে মাদাম ক্যুরির সঙ্গে দেখা করেন এবং সরাসরি তাঁদের চিন্তাভাবনা জানার সুযোগ পান। ১৯২৬ সালে ঢাকায় ফেরেন সত্যেন্দ্রনাথ। বন্ধুরা তাঁকে অনুরোধ করেন প্রফেসর পদে আবেদন করার জন্য। সত্যেন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের কাছে সুপারিশের জন্য লিখে পাঠান। একটু অবাক হন আইনস্টাইন। তাঁর মনে হয়েছিল যে এমন একটা পদ সত্যেন্দ্রনাথের এমনিতেই পাওয়া উচিত। তাও তিনি সুপারিশ পাঠান। কিন্তু এতেও কাজ হয় নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর পদের জন্য দেবেন্দ্রমোহন বসুর নাম মনোনীত করে। কিন্তু পদ গ্রহণে রাজি হন নি দেবেন্দ্রমোহন। ফলে সত্যেন্দ্রনাথকেই প্রথম বিকল্প হিসাবে বেছে নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা। ১৯২৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও হেড হিসাবে নিযুক্ত হন।
বার্লিন থেকে দেবেন্দ্রমোহন ফেরার পর তাঁর সঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য সাক্ষাৎকার ঘটে সত্যেন্দ্রনাথের। এ প্রসঙ্গে একটু বলে রাখি, ১৯১৪ সালে দেবেন্দ্রমোহন সদ্য স্থাপিত ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্সে (বিজ্ঞান কলেজ) পদার্থবিজ্ঞানের রাসবিহারী ঘোষ অধ্যাপক পদে যোগ দেন। এর পর পরই তিনি ঘোষ ট্র্যাভেল ফেলোশিপ পান বিদেশে দু’ বছর উচ্চশিক্ষার জন্য। তিনি বার্লিনের হুমবোল্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নেন (যার নাম আগে ছিল ফ্রেডেরিক-উইলহেল্ম-ইউনিভারসিট্যাট বার্লিন)। ১৯১৪ সালের গ্রীষ্মকালীন সেমেস্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্টার্ড হন তিনি।
কিন্তু দু’ বছরে কাজ শেষ করে ফিরে আসতে পারলেন না। এর মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ফলে তাঁকে থেকে যেতে হল। বিজ্ঞানী এরিক রেগনারের ল্যাবরেটরিতে কাজের ভিত্তিতে ১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জমা পড়ল তাঁর থীসিস । পরীক্ষা নিলেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে ছিলেন হাইনরিখ রুবেন্স এবং ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। দেবেন্দ্রমোহনের কাজের অন্যতম দিক ছিল বিজ্ঞানী উইলসনের তৈরি ক্লাউড চেম্বারের উন্নতি করা। এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি বিশেষ কয়েকটি কণার অস্তিত্ব নির্ণয় করেন। সে কাজে নিঃসন্দেহে প্রথম দেবেন্দ্রমোহন।
পি-এইচ-ডি নিয়ে মার্চ মাসে দেশে ফিরে পুনরায় রাসবিহারী ঘোষ অধ্যাপক পদে বিজ্ঞান কলেজে যোগ দিলেন তিনি। সত্যেন্দ্রনাথ আর মেঘনাদ তখন পড়াচ্ছেন সেখানে। বিশ্বযুদ্ধের কারণে পদার্থবিজ্ঞানের তৎকালীন গবেষণার প্রায় কোনো তথ্যই পাচ্ছিলেন না এই দু’জন। বুভুক্ষু দুই তরুণ বিজ্ঞানী এলেন ইউরোপ ফেরত দেবেন্দ্রমোহনের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি সত্যেন্দ্রনাথকে প্ল্যাঙ্কের লেখা দুটো বই দিলেন পড়তে। এর একটার নাম Thermodynamik আর দ্বিতীয়টার নাম Warmestrahlung। প্রথম বইটি বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে সত্যেন্দ্রনাথকে। সামান্য কয়েকটি মূলনীতিকে ভিত্তি করে কীভাবে প্ল্যাঙ্ক তাপগতিবিদ্যার গোটাটা গড়ে তুলেছেন তা দেখে মোহিত হয়ে যান তিনি। তবে দেবেন্দ্রমোহনের স্মৃতিচারণ পড়ে মনে হয়, যেভাবে প্ল্যাঙ্ক নিজের বিকিরণ সংক্রান্ত বিখ্যাত সূত্রটি গড়ে তোলেন তাতে সম্ভতঃ সন্তুষ্ট হন নি সত্যেন্দ্রনাথ। সেখানে মূলতঃ সনাতনী তড়িৎচুম্বকত্ব এবং তাপগতিবিদ্যার সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। যুক্ত হয়েছিল মাত্র একটি কোয়ান্টাম ধারণা। মেঘনাদের মধ্যে অবশ্য এই খুঁতখুঁতে ভাব লক্ষ্য করেন নি দেবেন্দ্রমোহন। আকন্ঠ আগ্রহ নিয়ে মেঘনাদ কেবল জানতে চাইছেন পাশ্চাত্যে কোয়ান্টামবিদ্যা এবং তাপগতিবিদ্যার অগ্রগতি সম্পর্কে। এটাই ছিল দু’জনের মনোভাবের মধ্যে পার্থক্য।
দুই বসুর মধ্যে আর একটা যোগাযোগ বেশ মজার। সত্যেন্দ্রনাথের সত্তর বছরের জন্মদিনে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। কথাপ্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করলেন ১৯২৭ সালের একটি কনফারেন্সের কথা। প্রায় আচমকাই শান্ত, মৃদুভাষী সত্যেন্দ্রনাথ বলে উঠলেন যে আসলে তাঁরই যাওয়ার কথা ছিল এই সম্মেলনে কিন্তু নিমন্ত্রণের ভুলে দেবেন্দ্রমোহন পৌঁছন সেখানে। চমকিত দর্শকমন্ডলী। কি হল হঠাৎ! এই অদ্ভূত ব্যপারটা বুঝতে কয়েকটা ঘটনা জানা প্রয়োজন।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্ল্যাঙ্কের সূত্র গঠন করেন ভিন্নভাবে – স্ট্যাটিসটিক্যাল-মেক্যানিক্যাল পথ ধরে। এটাই গবেষণাপত্র হিসাবে পাঠানো হয় আইনস্টাইনকে ১৯২৪ সালের জুন মাসে। আইনস্টাইনের অনুবাদ এবং তাঁর সুপারিশ সহ গবেষণাপত্রটি জিৎশ্রিফ্ট ফার কিজিক জার্নালে গৃহীত হয় জুলাই মাসের দু’ তারিখে। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া একটা মন্তব্যে আইনস্টাইন জানান যে সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতি আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে যা তিনি পরে অঙ্ক কষে দেখাবেন। সেই অনুযায়ী বিশে সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় তিনি ‘কোয়ান্টাম থিয়োরি অফ মোনো অ্যাটমিক আইডিয়াল গ্যাস’ প্রকাশ করেন। এখানেই রহস্যময়ভাবে তিনি সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্রের উল্লেখ করতে গিয়ে একটা মারাত্মক ভুল করেন। লেখকের নামের জায়গায় তিনি লেখেন Hrn (Mr) D Bose।
যাহোক, দু’জনের গবেষণাপত্র এক নতুন পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠা করল যার নাম হল বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন। এর বছর তিন পরে আলেসান্দ্রো ভোল্টার মৃত্যুশতবার্ষিকীতে ইতালির কোমোতে আয়োজিত হল এক বিশেষ সম্মেলন। ১৯২৭ সালের ১১ থেকে ২০শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সেই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হলেন চোদ্দটি দেশের ষাট জন প্রতিনিধি। আয়োজকরা ভারত থেকে আমন্ত্রণ জানাতে চেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ এবং মেঘনাদকে। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথের নাম ছাপার সময় তাঁরা আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রে ব্যবহৃত Hrn (Mr) D Bose দ্বারা চালিত হন। ফলে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছয় দেবেন্দ্রমোহনের কাছে। তিনিই ইতালি যান মেঘনাদের সঙ্গে। প্রাপ্য সুযোগ পেলেন না সত্যেন্দ্রনাথ। তাঁর পরবর্তী বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আসে ২৭ বছর পরে, ১৯৫৪ সালে।
মামার কাছে মানুষ
এখনকার বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে আদি বাড়ি ছিল দেবেন্দ্রমোহনদের। ঠাকুরদা পদ্মলোচন বসু ছিলেন সেরেস্তাদার। তিন ছেলে পদ্মলোচনের – হরমোহন, আনন্দমোহন এবং মোহিনীমোহন। প্রথম জনের কথা তেমনভাবে জানা না গেলেও পরের দু’জন বাংলায় সুপরিচিত। অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করেন আনন্দমোহন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় র্যাংলার (Wrangler) তিনি। ভাই মোহিনীমোহন ছিলেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। আমেরিকায় পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। তিনি এবং তাঁর দাদা আনন্দমোহন বিয়ে করেন খ্যাতনামা প্রশাসক ভগবান চন্দ্র বসুর দুই কন্যাকে। মোহিনীমোহনের সঙ্গে বিয়ে হয় সুবর্ণপ্রভার। তাঁদের দুই সন্তানের নাম দেবেন্দ্রমোহন এবং সুধাংশুমোহন। দু’জন ছোট থাকতেই মারা যান মোহিনীমোহন। সুবর্ণপ্রভা আর কী করেন, দুই ছেলেকে নিয়ে এসে উঠলেন ভাই জগদীশচন্দ্রের কাছে। ফলে মামা-ই হয়ে দাঁড়ালেন তাঁদের অভিভাবক।
ছোটোবেলায় মামার বাড়িতে বহু দিকপাল মানুষের সংস্পর্শে আসেন তিনি। প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সিস্টার নিবেদিতা, চারুচন্দ্র দত্ত, লোকেন পালিত প্রমুখের নিয়মিত যাতায়াত ছিল জগদীশচন্দ্রের বাড়িতে। এছাড়াও ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় এম এ পাশ করার পর তাঁরই পরামর্শে মামার অধীনে গবেষণা শুরু করেন দেবেন্দ্রমোহন। এর মধ্যে সুযোগ এল বিলেত যাত্রার। কেমব্রিজের ক্রাইস্টস কলেজে ভর্তি হলেন ১৯০৭এ। যেহেতু তিনি একজন advanced student তাই ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরিতে গবেষণার অধিকার পেলেন। তাঁর গাইডের নাম জে জে থমসন।
এখানেই দেখা পেলেন ভিড় থেকে সরে থাকা একজন আত্মনিমগ্ন বিজ্ঞানীর – সি টি আর উইলসন। আপন মনে নিজের ক্লাউড চেম্বার নিয়ে কাজ করতেন তিনি। কণাপদার্থবিদ্যার অগ্রগতিতে এই ক্লাউড চেম্বারের গুরুত্ব যে কতখানি তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। এই উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরস্কার পান উইলসন। উইলসনের সান্নিধ্য তাঁকে এই বিষয়ে একজন শক্তিশালী গবেষক হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।
এর পর একসময় লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ সায়েন্সে ভর্তি হলেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯১২ সালে সেখানকার বি এস সি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন দেবেন্দ্রমোহন। দেশে ফেরার কিছু সময় পরে তিনি যে বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপক পদে যোগ দেন সে তো আগেই বলেছি। বার্লিন থেকে ১৯১৯ সালে দেশে ফিরে আসার কথাও জেনেছি। এরই মধ্যে কলকাতার বিজ্ঞান গবেষণা চিত্রে একটা বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। ১৯১৭ সালের নভেম্বরে স্থাপিত হয়েছে বসু বিজ্ঞান মন্দির। জগদীশ্চন্দ্র তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে এবং অবশ্যই দেশবাসীর দান সম্বল করে গড়ে তুলেছেন দেশে বিজ্ঞান গবেষণার প্রথম প্রতিষ্ঠানটি। এর বেশ কয়েক দশক আগে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স তৈরি হলে সেখানে গবেষণা ছাড়াও বিজ্ঞান সম্পর্কিত অন্যান্য কাজও হত। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের একমাত্র কাজ ছিল বিজ্ঞানের গবেষণা।
দেবেন্দ্রমোহনের কী ভূমিকা ছিল এখানে? বিজ্ঞানের যে দু’ একজন ইতিহাসকার দেবেন্দ্রমোহন সম্পর্কে লিখেছেন তাঁদের মধ্যে কেউই এ ব্যাপারটা সম্পর্কে আলোকপাত করেন নি। বেতার যোগাযোগ বা ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের গবেষণা দিয়ে বিশ্বকে নাড়া দিলেও বেশিদিন এই ক্ষেত্রে থাকেন নি জগদীশচন্দ্র। উদ্দীপনায় জীব ও জড় যে একইভাবে সাড়া দেয় সেটা প্রমাণ করতে তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি। এর পর নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যান উদ্ভিদবিজ্ঞানের গবেষণায়। ফলে মামার সহযোগী বিজ্ঞানী হয়ে কাজ করার সুযোগ হয় নি দেবেন্দ্রমোহনের। কিন্তু বসু বিজ্ঞান মন্দির তো শুধু উদ্ভিদবিজ্ঞানের চর্চা করত না। এই প্রতিষ্ঠানের জার্নালে তো অন্যান্য বিজ্ঞান শাখায় গবেষণার কথাও ছাপা হত। অথচ ১৯৩৭ সালের আগে দেবেন্দ্রমোহনের একটিও গবেষণাপত্র এই জার্নালে প্রকাশিত হয় নি। কেন? এই বছরেই প্রয়াত হন তাঁর মামা। প্রশ্ন তোলা কি যায় না?
রবীন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রমোহন
জগদীশচন্দ্র প্রয়াত হওয়ার পর কে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দায়িত্ব নেবেন তা নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়। সেটা কি জগদীশচন্দ্রের উপযুক্ত অঙ্গীকারপত্র না থাকার কারণে? বলা কঠিন। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে দেবেন্দ্রমোহন এই দায়িত্ব নেন। অধিকর্তা হিসাবে যোগ দেওয়ার আগে তিনি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। ভুলে গেলে চলবে না যে মামা জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে সখ্য তার প্রসাদ দেবেন্দ্রমোহনও পেয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর নানা কাজে রবীন্দ্রনাথ নির্ভর করতেন তাঁর উপর। দীর্ঘ দিন বিশ্বভারতীর অর্থসচিবের দায়িত্ব পালন করেন দেবেন্দ্রমোহন। বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘দেশিকোত্তম’-এ ভূষিত করা হয় তাঁকে। স্বল্প পরিসরে এই দু’জন মনীষীর সম্পর্কের কথা বর্ণনা করা কঠিন, তবুও কয়েকটা প্রসঙ্গ না আনলেই নয়।
বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের গভীর জ্ঞান এবং আগ্রহের কথা জানি আমরা অনেকেই। দেবেন্দ্রমোহনের নিজের বয়ানেই জানা যায় যে জীবনের শেষ দিকে এই আগ্রহের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রোটন আর ইলেকট্রনে গঠিত পদার্থের স্বরূপের কথা তিনি জেনেছিলেন জেমস জীন্স আর আর্থার এডিংটনের মত বিজ্ঞানীদের লেখা গ্রন্থ পড়ে। ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ডে তিনি যে হিবার্ট লেকচার দেন তার প্রস্তুতিতে এই নবলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত আলাপচারিতাতেও এই জ্ঞানের প্রতিফলন ঘটে। যাই হোক, ১৯৩৮ সালে যখন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের রজত জয়ন্তী অধিবেশন হয় তখন জেমস জীন্স আর আর্থার এডিংটন কলকাতায় আসেন। রবীন্দ্রনাথ অধীর হয়ে ওঠেন তাঁদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। দেবেন্দ্রমোহন প্রমুখদের উদ্যোগে একটা ব্যবস্থা হয় লব্ধপ্রতিষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একটা দলকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে এডিংটন আর জীন্স রইলেন না সেই দলে। ব্যথিত হন রবীন্দ্রনাথ। পরে অবশ্য তাঁর সঙ্গে এডিংটনের পত্রালাপ হয়েছিল।
আর একবার জাপানে এক কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার পথে কলকাতায় এসে উপস্থিত হন সমারফেল্ড এবং হাইসেনবার্গ। সেটা ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস। দেবেন্দ্রমোহন ডায়েরিতে লিখেছেন যে হাইসেনবার্গ একদিন আচমকা এসে উপস্থিত হলেন বিজ্ঞান কলেজে। সেখানে তখন দেবেন্দ্রমোহনের সঙ্গে উপস্থিত আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী যাঁদের মধ্যে ছিলেন শিশির কুমার মিত্র। কোমো কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার সুবাদে হাইসেনবার্গকে চিনতেন দেবেন্দ্রমোহন। এই জার্মান বিজ্ঞানীর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন তিনি। দু’জনের কথাবার্তার সময় অবশ্য উপস্থিত ছিলেন না দেবেন্দ্রমোহন কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল যে এই সাক্ষাৎকারে মুগ্ধ হয়েছেন হাইসেনবার্গ। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য এই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে অন্যতর কিছু ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ নিয়মিতভাবে খোঁজ নিতেন দেবেন্দ্রমোহনের গবেষণা সম্পর্কে। তাঁর আগ্রহের কথা প্রকাশ্যে জানাতেও ভালোবাসতেন তিনি। ১৯৪০ সালের অগাস্টে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরা যখন তাঁকে সাম্মানিক এল এল ডি ডিগ্রী দিতে শান্তিনিকেতনে পৌঁছন তখন এক অভূতপূর্ব আলোচনাচক্র বসে আধুনিক ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে। সেই আলোচনাতে, উপস্থিত বিদেশি অতিথিদের সামনে, রবীন্দ্রনাথ হঠাৎই দেবেন্দ্রমোহনকে জিজ্ঞাসা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে চলা কসমিক রে সম্পর্কিত গবেষণা কেমন চলছে। অন্যরা হয়ত বিস্মিত হয়েছিলেন কিন্তু দেবেন্দ্রমোহন বিচলিত হন নি প্রশ্নে। সবার উপস্থিতিতেই তিনি জানান তাঁর গবেষণার অগ্রগতি সম্পর্কে।
মহাজাগতিক রশ্মির গবেষণা
১৯৩৮ সালেই ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে বিদেশি বিজ্ঞানীদের যোগদান শুরু হয়। অনেকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী, জার্মান পরমাণু বিজ্ঞানী ওয়াল্টার বাথ (Walter Bothe)। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল দেবেন্দ্রমোহনের। দু’জনেই আগ্রহী কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মিতে থাকা কণা কতটা পার্শ্ববর্তী মাধ্যমকে আয়নিত করতে পারে সে সম্পর্কে। এক্ষেত্রে ফোটোগ্রাফি প্লেট ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে মত দেন দু’ জনেই। চার্জড বা আধানযুক্ত কণার সঞ্চারপথ নির্ণয়ের জন্য যে উইলসন ক্লাউড চেম্বার ব্যবহৃত হয় তারই এক নিরবচ্ছিন্ন সংস্করণ হিসাবে ফোটোগ্রাফি প্লেটকে দেখতে চাইলেন দু’জন। বিজ্ঞান কংগ্রেসের ওই অধিবেশনেই এইচ জে টেলর পাঠ করলেন ফোটোগ্রাফি প্লেটের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষোণাপত্র। খুব যে নতুন তথ্য ছিল এই গবেষণাপত্রে তা নয়। তবু একটা চিত্র পাওয়া গেল। ১৯৩৯ সালে বিভা চৌধুরীকে সঙ্গী করে দেবন্দ্রমোহন মেতে গেলেন এই গবেষণায়। বিশ্বে মাত্র দুটো সংস্থা তখন তৈরি করছে গবেষণার উপযুক্ত ফোটো প্লেট। এর মধ্যে একটা ইংল্যান্ডের, নাম ইলফোর্ড ল্যাবরেটরিজ। এই সংস্থার তৈরি হাফটোন প্লেট তাঁরা উন্মুক্ত করলেন দার্জিলিং, সান্দাকফু এবং ফাড়ি জং-এ। এই সব জায়গার উচ্চতা ছিল সাত হাজার থেকে চোদ্দ হাজার ফিটের মধ্যে।
এত উঁচুতে কেন? কারণ আছে। উঁচুতে গেলে বাতাসের ঘনত্ব কমে যায়। এই ঘনত্বে মহাজাগতিক রশ্মিতে থাকা কণারা বাতাসের পরমাণুর সঙ্গে খুব বেশি বিক্রিয়া করার সুযোগ পায় না। ফলে সেকেন্ডারি বা গৌণ বিকিরণ কম তৈরি হয়। এতে শুধুমাত্র কাঙ্খিত কণার সঞ্চারপথ স্পষ্ট করে দেখা সম্ভব হয় প্লেটে।
দেবেন্দ্রমোহন ও বিভা তাঁদের প্লেট দেভলপ করার পর এমন কিছু বাঁকানো সঞ্চারপথ পেলেন যেগুলোর সঙ্গে আলফা কণা বা প্রোটন কণার পথের পার্থক্য আছে বলে মনে হল তাঁদের। দুই বিজ্ঞানী মনোনিবেশ করলেন সঞ্চারপথের গড় বিক্ষেপণ (mean scattering) এবং ডেভলপ করা দানার গড় দূরত্বের (mean spacing) উপর। প্লেট যেমন বাতাসের মধ্যে রাখা হয় তেমনি রাখা হয় জলের মধ্যেও। দুটো মাধ্যমে রেখেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাঁদের গবেষণাপত্র ‘নেচার’এ প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। সেখানেই ১৯৪২ সালে তাঁদের একটা চিঠিও প্রকাশিত হয়। দেবেন্দ্রমোহন এবং বিভার সিদ্ধান্ত ছিল যে প্লেটে তাঁরা যে কণার সঞ্চারপথ পেয়েছেন তার ভর ইলেকট্রনের ভরের দুশো ষোলো গুণ। নতুন এই কণার নাম তাঁরা দেন মেসোট্রন।
এই একই গবেষণা ইংল্যান্ডে বসে করছিলেন সিসিল পাওয়েল। দেবেন্দ্রমোহন এবং বিভার মত তিনি তাঁর দেশে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইংল্যান্ড তখন এমন কিছু গবেষণা করছে যা থেকে সামরিক শক্তি সংগ্রহের আশা করছিলেন দেশের নেতারা। চলছিল নিউক্লীয় গবেষণা। কণা পদার্থবিদ্যার গবেষণাও যুক্ত হয়ে যায় এর সঙ্গে। ফলে পাওয়েল অতিরিক্ত সুবিধে পেয়ে যান। সে দেশের সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো তাঁকে উচ্চ মানের ফোটোগ্রাফি প্লেট সরবরাহ করতে লাগল। অন্যদিকে পাওয়েল বেলুন ব্যবহার করে নিজের প্লেটকে তুলে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন পঁচানব্বই হাজার ফিট উচ্চতায়। বিশেষ ব্যবস্থা করে এমন বেলুন ইংল্যান্ডে তৈরি করাতে পেরেছিলেন পাওয়েল। এভাবে কাজ করে ১৯৪৭ সালে পাওয়েল পাই মেসন এবং মিউ মেসনের ভর জানালেন নির্দিষ্ট করে। ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক আধানযুক্ত পাই মেসনের ভর ইলেকট্রনের ভরের ২৭৪ গুণ পাওয়া গেল।
ধনাত্মক, ঋণাত্মক এবং আধানশূন্য – এই তিন রকম পাই মেসনের অস্তিত্ব রয়েছে। জাপানি বিজ্ঞানী হিদেকি ইওকাওয়া ১৯৩৫ সালে পাই মেসনের অস্তিত্বের কথা বলেন তাত্ত্বিক গণনার উপর ভিত্তি করে। সেটাই আবিষ্কৃত হল পাওয়েলের হাতে। একইভাবে মিউ মেসনের ভর পাওয়েল ঘোষণা করলেন – ইলেকট্রনের ভরের ২১২ গুণ। পেলেন নোবেল পুরস্কার, ১৯৫০ সালে। তার আগের বছরেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন ইওকাওয়া। এই সব আবিষ্কারের বিবরণ রয়েছে পাওয়েলের নোবেল লেকচারে।
দেবেন্দ্রমোহনের গবেষণার কী হল? উন্নত ফোটোগ্রাফি প্লেট এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্রের অভাবে তাঁর কাজ বাধার মুখে পড়তে লাগল ক্রমাগত। পাশাপাশি, ১৯৪৫ সালে বিভা চৌধুরী ইংল্যান্ডে ব্ল্যাকেটের ল্যাবরেটরিতে যোগ দেওয়ায় দেবেন্দ্রমোহনের গবেষণা মুখ থুবড়ে পড়ল। তবে তাঁদের গবেষণার প্রাথমিকতা কেউই কোনোদিন অস্বীকার করতে পারেন নি। পাওয়েল নিজে তাঁর বই ’দ্য স্টাডি অফ এলিমেন্টারি পার্টিক্লস বাই দ্য ফোটোগ্রাফিক মেথড’এ দেবেন্দ্রমোহন এবং বিভার কাজের গুরুত্ব স্বীকার করেন দ্বিধাহীনভাবে।
অন্যান্য গবেষণা
চৌম্বকত্ব নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেন দেবেন্দ্রমোহন। পরমাণুর গঠন সম্পর্কে নীল্স বোরের তত্ত্ব প্রকাশিত হওয়ার পর, মোটামুটি ১৯১৯ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে প্রচুর কাজ হয়। বেশ বুঝতে পারছিলেন বিজ্ঞানীরা যে পরমাণুর অতি ক্ষুদ্র পরিসরে সনাতনী অর্থাৎ ক্ল্যাসিকাল বলবিদ্যা কাজ করে না।
বোরের ইলেকট্রন বন্টনের ছবিটা ব্যবহার করে সাধারণ (ground state) এবং উত্তেজিত (excited state) অবস্থায় থাকা পরমাণু বা আয়নের স্পেকট্রোস্কোপিক বৈশিষ্ট্য বোঝা সম্ভব হচ্ছিল। ১৯২৫ সালে বিজ্ঞানী হুণ্ড(Hund) দেখান কীভাবে ইলেকট্রনে পূর্ণ নয় এমন অসম্পূর্ণ কক্ষবিশিষ্ট (incomplete shell) আয়নের চৌম্বক ভ্রামক (magnetic moment) তাত্ত্বিকভাবে নির্ণয় করা যায় বর্ণালী সম্পর্কিত সমীকরণ থেকে। যে সতেরোটা rare earth elements আছে পর্যায় সারণিতে(periodic table) সেগুলোর ক্ষেত্রে হুণ্ডের সূত্র খেটে গেলেও লোহা, কোবাল্ট বা নিকেলের ক্ষেত্রে খাটছিল না। দেবেন্দ্রমোহন বললেন, সূত্রের সঙ্গে বাস্তব পরীক্ষার মিল দেখা যাবে যদি ধরে নেওয়া যায় যে এইসব পরাচৌম্বক পদার্থের ক্ষেত্রে চৌম্বক ভ্রামকের জন্য দায়ী কেবল ইলেকট্রনের স্পিন ভ্রামক (spin moment)। এই ব্যাখ্যাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান স্টোনার ও ফ্যান ফ্লেক। ফলে সংশ্লিষ্ট সূত্র পরিচিত হয় বোস-স্টোনার সূত্র হিসাবে। এটা ছাড়াও বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দেবেন্দ্রমোহন একগুচ্ছ কাজ করেন বিশেষ করে লোহার যৌগ এবং অন্যান্য ট্র্যানজিশন মৌলের যৌগের চৌম্বক ধর্ম নিয়ে। সেগুলোর প্রত্যেকটাই মৌলিক গোত্রের।
তরলের মধ্যে শব্দোত্তর তরঙ্গের উৎপাদন এবং সেগুলোর গতিপথ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেন দেবেন্দ্রমোহন ও তাঁর সহযোগীরা। এই তরঙ্গ তরলের মধ্যে কত গতিতে চলে এবং কতটা শোষিত হয় তা নিরূপণ করেন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা। বার্লিনে বিজ্ঞানী পিটার ডিবাই-এর ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছিলেন এ কে দত্ত। তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগে এই গবেষণায়। তরঙ্গ উৎপাদনের জন্য যে যন্ত্র লাগে তা তৈরি করতে কেন্দ্র সরকারের বিজ্ঞান দপ্তর অর্থ দেয়। প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কশপে তৈরি হয় এটা, ব্যবহৃত হয় দেশীয় সামগ্রী। শুধুমাত্র উচ্চশক্তির একটি ট্রায়োড ভাল্ভ আমদানি করতে হয়েছিল।
১৯৩৮ থেকে ১৯৬৭ অবধি বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। মামা জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে যে সব গবেষণা করেন সেগুলোকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। জগদীশচন্দ্রের কাজকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এক জায়গায় এনে প্রকাশ করেন J. C. Bose’s Plant Physiological Investigations in the Light of Modern Biological Knowledge। পাশাপাশি, বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রত্যঙ্গে প্রতিক্রিয়ার শক্তি আসে কোথা থেকে তা চিহ্নিত করার জন্য গবেষণা করেন তিনি। স্পর্শকাতর উদ্ভিদ যেমন লজ্জাবতীতে উত্তেজনা সংবহনের ক্ষেত্রে কোন কোন রাসায়নিক যৌগ দায়ী সে ব্যাপারেও আগ্রহ ছিল তাঁর।
অধিকর্তা হিসাবে বহু বিভাগ যেমন তৈরি করেছিলেন তিনি তেমনি তাঁর উৎসাহে গতি পেয়েছিল অনেক গবেষণা। দেবেন্দ্রমোহনের সময়ে এই প্রতিষ্ঠানে অন্ততঃ তিন-চারটি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়। আবার, যে সময় দেশে জনসংখ্যার চাপ এতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে নি সেই সময়ে তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত ওষুধ উৎপাদনের উপর জোর দেন। ১৯৪২ সালে তাঁর আগ্রহে এই প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ। ১৯৫৬ সালে তৈরি হয় রেডিও কেমিস্ট্রি বিভাগ। তেজষ্ক্রিয় মৌল কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়ার গতিপথ বোঝার চেষ্টা করার কাজে মগ্ন থেকেছেন এই বিভাগের বিজ্ঞানীরা। দরাজ হাতে সাহায্য এসেছিল অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের কাছ থেকে।
ভারতে বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনা
সায়েন্স অ্যান্ড কালচার – মেঘনাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত এই জার্নালটির সঙ্গে দেবেন্দ্রমোহনের নিবিড় একটা সম্পর্ক ছিল। বহু বছর এই জার্নালের প্রধান সম্পাদক ছিলেন তিনি। তবে শুধু সম্পাদনাই নয়, নিজে বিভিন্ন সংখ্যার জন্য লিখেছেনও প্রচুর। বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা সম্পর্কে তথ্য পরিবেশন থেকে শুরু করে বরেণ্য বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন প্রকাশিত হয়েছে এর পাতায়। খুঁটিয়ে পড়লে ধরা পড়বে দেবেন্দ্রমোহনের প্রখর ইতিহাস চেতনা যা আজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিরল। প্রত্যেকটা বিষয়কে যেভাবে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দাঁড় করাতেন তিনি, যে ভঙ্গী অবলম্বন করতেন তা অনন্য। বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনার এই তাগিদ তাঁর মধ্যে কাজ করেছে সারা জীবন। এর প্রতিফলন আমরা দেখেছি অন্যত্র।
১৯৫০ সালে দিল্লীতে আয়োজিত এক সিম্পোজিয়ামে ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস লেখার প্রয়োজনীয়তা আলোচিত হয়। এই আলোচনাচক্রের যৌথ আয়োজক ছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘের শাখা প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো এবং ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সেস অফ ইন্ডিয়া। পরবর্তীকালে এটাই পরিচিত হয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি হিসাবে। কিন্তু এমন তো হামেশাই হয় যে একটা বড় সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে আলোচ্য বিষয় ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় এবং এক সময় সংশ্লিষ্ট সবাই তা ভুলে যায়। বিজ্ঞান ইতিহাসের ক্ষেত্রে তা যেন না হয় এটা চেয়েছিলেন দেবেন্দ্রমোহন। তাই বারে বারে বিষয়টা উত্থাপিত করেছেন বিভিন্ন ফোরামে। এদিকে ১৯৫৬ সালে সায়েন্স অ্যান্ড কালচারে এক সম্পাদকীয়তে তিনি বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনার প্রয়োজনীয় দিকগুলো তুলে ধরেন সুস্পষ্টভাবে। কিন্তু প্রশাসনের মারপ্যাঁচে হঠাৎই ইতিহাস রচনার প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়ল কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ। ইতিহাস রচনায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ বা যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠানকে সম্ভবত ঢোকানো হয়েছিল দেবেন্দ্রমোহনের মত অভিজ্ঞ মানুষদের ভূমিকা খর্ব করতে। বিক্ষুব্ধ দেবেন্দ্রমোহন তীব্র ভাষায় এই সিদ্ধান্তকে আক্রমণ করলেন ১৯৬৩ সালের এপ্রিল মাসে সায়েন্স অ্যান্ড কালচারের সম্পাদকীয়তে। শেষে অবশ্য শীর্ষ দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরানো যায় নি। ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি প্রথমে একটা ‘হিস্ট্রি অফ সায়েন্স বোর্ড’ এবং পরে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর হিস্ট্রি অফ সায়েন্স’ গঠন করে এগিয়ে নিয়ে যান কাজটা। দেবেন্দ্রমোহনের কাঙ্খিত বিজ্ঞানের ইতিহাস প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে।
বাকি কথা
এত সহজে তাঁর কথা শেষ হওয়ার নয়। দর্শন এবং সাহিত্যে দেবেন্দ্রমোহনের পান্ডিত্য এবং তার প্রকাশ আলোচনা হয় নি সেভাবে। তাঁর দর্শনের সেই বোধ বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। স্বাধীন ভারতে বহু সংগঠন প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন তিনি। সেটারও বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। তিনি ভূষিত হন বহু সম্মানে। কিন্তু প্রচারের আলো থেকে সবসময় নিজেকে দূরে রাখতেন দেবেন্দ্রমোহন। ১৯৬৭ সালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তার পদ থেকে অবসর নিয়েও থেকে যান এই প্রতিষ্ঠানের অর্থ উপদেষ্টার পদে। দার্জিলিং আর ফলতার বাসভবনে সময় কাটানো ছিল তাঁর প্রিয় শখ। ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ এই মানুষটি মারা যান ১৯৭৫ সালের ২রা জুন।
(প্রচ্ছদের ছবি: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বিজ্ঞানীমহল, দেবেন্দ্রমোহন বসু পিছনের সারিতে বাঁদিক থেকে তৃতীয়, সূত্র)
তথ্যসূত্রঃ
[১] Commemoration Volume 1885-1985, Dr D. M. Bose Birth Centenary Celebration, Bose Institute, Calcutta, 1985
[২] D M Bose, S N Sen, B V Subbarayappa, A Concise History of Science in India, Second Edition, Indian National Science Academy & Universities Press, 2009
[৩] Science and Culture জার্নালের বিভিন্ন সংখ্যার সম্পাদকীয়
[৪] Subrata Dasgupta, Jagadis Chandra Bose and the Indian Response to Western Science, Oxford University Press, 1999
[৫] Purabi Mukherjee, Debendra Mohan Bose (1885–1975) – an eminent physicist of India, Current Science, Vol. 109, No. 12, 25 December 2015
[৬] Santimay Chatterjee, Enakshi Chatterjee, Satyndra Nath Bose, Second Edition, Kolkata, 1976
[৭] Rajesh Kochhar, The Wrong Bose at Como, 31 May 1994, Economic Times
[৮] Personal mail from Joachim Oesterheld in Berlin, 2014
[৯] Digital documents retrieved from Viswa Bharati archives