“নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে সত্য ও নিরপেক্ষতার কাছে পৌঁছে দেয় বিজ্ঞান; বিস্ময়ের সাথে শেখায় বাস্তবকে গ্রহণ করতে, স্বীকৃতি দিতে। একইসাথে, একজন প্রকৃত বিজ্ঞানীর মনে তার চারপাশের জগতের স্বাভাবিক গঠন এনে দিতে পারে এক গভীর সম্ভ্রম আর আনন্দের ছোঁয়া।”
–লিসা মাইটনার
লিসা মাইটনার, বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানমহলে সম্ভবতঃ সবচেয়ে অবহেলিত নাম। গোটা জীবনটাই তাঁর কেটেছে চরম লিঙ্গবৈষম্য, অবিচার ও বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে। প্রকৃতপক্ষে, নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার জগতে গভীর জ্ঞান আহরণের প্রবল আকাঙ্ক্ষাই তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। সমস্ত প্রতিকূলতাকে পিছনে ফেলে রেখে তিনি নিজের যোগ্য জায়গা করে নিয়েছিলেন পুরুষপ্রধান বিজ্ঞান জগতে। ১৯৩৮ সালে নিউক্লিয়ার ফিশন আবিষ্কার করে তিনি বিজ্ঞানজগতে অমরত্ব লাভ করেছিলেন। কাজের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ঠিকই, তবে জীবনসীমার একদম শেষে।
লিসা মাইটনারের জন্ম ১৮৭৮ সালের ৭-ই নভেম্বর, অস্ট্রিয়ার এক ইহুদী পরিবারে। পরবর্তীকালে এই ইহুদী হওয়ার জন্যই তিনি বাধ্য হয়েছিলেন হিটলারের একনায়কতন্ত্রে জর্জরিত জার্মানি ছেড়ে পালাতে। পদার্থবিদ্যা নিয়ে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয় ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবং পরবর্তীকালে (১৯০৫) পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট উপাধিও লাভ করেন ওই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি ছিলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট অর্জন করা দ্বিতীয় মহিলা বিজ্ঞানী।
এরপর লিসা সিদ্ধান্ত নিলেন বার্লিন যাওয়ার, স্বয়ং ম্যাক্স প্লাঙ্কের কাছ থেকে সম্মতি পেয়েছিলেন ক্লাসঘরে বসে তাঁর (প্লাঙ্কের) বক্তৃতা শোনার। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এ এক অভাবনীয় ঘটনা। কারণ তার আগে পর্যন্ত সমস্ত মহিলার আবেদনপত্র খারিজ করে দিয়েছিলেন ম্যাক্স প্লাঙ্ক। বার্লিনে লিসা অটো হানের সাথে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই অটো হান-ই হয়ে ওঠেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু। একদিকে লিসা গবেষণা করতেন তেজস্ক্রিয় পদার্থের পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আর অন্যদিকে সেই সব পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম নিয়ে মেতে থাকতেন অটো হান।
তিরিশ বছরেরও বেশি অটো এবং লিসা একজোট হয়ে কাজ করেছিলেন। দু’জনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিন্তু দু’জনের চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। লিসা অতিমাত্রায় লাজুক আর অটো ছিলেন অতি সপ্রতিভ। তাঁরা একসাথে কাজ করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের দুজনের জন্য পরিস্থিতিটা মোটেই এক ছিল না। সে এক প্রকট লিঙ্গ বৈষম্যের সময়। গোড়ার কয়েকটা বছর লিসা তো তাঁর পারিশ্রমিকই পেতেন না, পরে যাও বা পেতেন তা ছিল অটো হানের পারিশ্রমিকের তুলনায় নিতান্তই সামান্য। তবে তাঁদের যৌথ প্রয়াস বিজ্ঞানের জগতে এনে দেয় দারুন কিছু ফলাফল, যেমন – ১৯১৮-এ প্রোট্যাক্টিনিয়াম নামে নতুন মৌলের আবিষ্কার। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো ১৯৩৮ সালে নিউক্লিয়ার ফিশন-এর আবিষ্কার।
“লিসা হলেন আমাদের জার্মানীর মেরি ক্যুরি।”
–অ্যালবার্ট আইনস্টাইন
১৯৩৩ সাল নাগাদ বার্লিনে বসবাসকালে ইহুদী জন্মপরিচয়ের কারণে লিসাকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তখন তিনি বার্লিনের কায়সার উইলহেম ইনস্টিটিউট ফর কেমিস্ট্রী-র পরিচালিকা এবং একই সাথে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের পূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপিকা । সেই বছরেই, শিক্ষাজগতের সাথে জড়িত সমস্ত ইহুদীদের আইন মোতাবেক বাধ্য করা হয়েছিল তাদের পদ ছেড়ে দিতে।
স্বাভাবিকভাবেই লিসার গায়েও তার আঁচ লাগে। আইনস্টাইন, বর্নের (Max Born) মতো বিজ্ঞানীরা দেশত্যাগ করলেও লিসা দেশে থেকেই তাঁর গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেন। যদিও পরবর্তীকালে এই সিদ্ধান্তের জন্য তাঁকে অনুতপ্ত হতে হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে তিনি বলেন, “সেই মুহূর্তে দেশত্যাগ না করার সিদ্ধান্তটা শুধু বোকামিই ছিল না, ছিল একটা বড় ভুল”। অবশেষে ১৯৩৮ সালে নিজের ভয়ঙ্কর ক্ষতির শাসানি তাঁকে বাধ্য করে দেশ ছাড়তে। নিজের পরবর্তী বাসস্থান হিসেবে তিনি বেছে নেন স্টকহোমকে। কিছু ডাচ সহকর্মী বিজ্ঞানীদের সহায়তায়,শূন্য হাতে, ভয়ানক ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় লিসা জার্মানী ছেড়ে চলে যান। স্টকহোমে অত্যন্ত উদাসীন আপ্যায়নে তিনি ভীষণরকমের অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশতঃ এই সময় কর্মসূ্ত্রে বিজ্ঞানী নীলস বোরের সাথে তাঁর পরিচয় হয়, বোর-এর তখন কোপেনহাগেন থেকে সুইডেন নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
বিজ্ঞানের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাব, ১৯৩২ সালে নিউট্রন কণার অস্তিত্ব প্রমাণ করেন বিজ্ঞানী জেম্স চ্যাডউইক। ফলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ধারা যায় বদলে, যেমন – ১৯৩৪ সালে বিজ্ঞানী ফার্মি নিউট্রন কণার সংঘর্ষ ঘটিয়ে সক্ষম হন সমস্থানিক(isotope) তেজস্ক্রিয় পদার্থসমূহের উৎপাদনে। অকস্মাৎ এই নতুন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ধরণ চালু হয়ে যায় এবং কার্যতঃ সমস্ত পরীক্ষাগারেই তখন একই ধরনের পরীক্ষা চালানো হতে থাকে। ১৯৩৮ সালে নির্বাসিতা লিসা, বিজ্ঞানী বোরের উপস্থিতিতে কোপেনহাগেনে তাঁর বন্ধু অটো হানের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। লিসার পরামর্শ অনুযায়ী অটো ও তাঁর দল ইউরেনিয়াম পরমাণুর সাথে নিউট্রন কণার কৃত্রিম সংঘর্ষ ঘটিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন এবং শুরুতেই পেয়ে যান চমকপ্রদ ফলাফল। পরীক্ষার ফলে উৎপন্ন হয়েছিল বেরিয়াম ও ক্রিপটন, কিন্তু মোট ভর আশ্চর্যজনকভাবে কমে যায় এবং একইসাথে উৎপাদিত হয় বিপুল পরিমান শক্তি। কিন্ত তা কী ভাবে সম্ভব? এই হেঁয়ালির সমাধান খুঁজতে অটোর আবার প্রয়োজন পড়ল লিসার প্রখর বুদ্ধিমত্তা এবং পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান।
সেইসময়ে নিজের ভাগ্নে অটো ফ্রিশের সাথে কর্মরত লিসা তৎক্ষণাৎ এই ঘটনার পেছনের কারণ খোঁজা শুরু করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে যাওয়া ভর, রূপান্তরিত হয়েছে শক্তিতে – যা ছিল ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভবিষ্যৎবাণী! E=mc2 সমীকরণটি পরীক্ষার ফলাফলের সাথে সম্পূর্ণরূপে মিলে যায়। সেই ছিল সূত্রপাত, যা আজ “নিউক্লিয়ার ফিশন” নামে পরিচিত।
“নিউক্লিয়ার ফিশনের আবিষ্কারের আগে কেউই ভাবেনি নিউক্লিয়ার ফিশনের কথা।”
–লিসা মাইটনার
এই অবিশ্বাস্য অন্তর্দৃষ্টি সত্ত্বেও এবং সন্দেহাতীত ব্যাখ্যা দিয়েও বঞ্চিত হন লিসা। ১৯৪৪ সালে সহকর্মী অটো হানকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হলেও অনুচ্চারিত থেকে যায় লিসার নাম।
তাঁর নির্বাসন এবং বার্লিনে গবেষকদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে এই তত্ত্ব উদ্ভাবনে লিসার প্রধান ভূমিকার কথা বুঝতে পারেননি নোবেল পুরষ্কারদাতারা। নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে এই বড় ভুলকে চিহ্নিত করা হয় “নোবেল মিসটেক” হিসেবে। নোবেল পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হলেও অন্যান্য অনেক পুরষ্কার তিনি পেয়েছিলেন যাতে তাঁকে এই কাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে উঁচুমানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। যেমন – ১৯৬৬ সালে অটো, লিসা এবং স্ট্রাসম্যানকে (অটোর দলের আর একজন সদস্য) যৌথভাবে ‘ফার্মি পুরষ্কার’ দেওয়া হয়।
একভাবে বলা যায়, নিউক্লিয়ার ফিশনের এই আবিষ্কারই পরবর্তীকালে নিউক্লিয়ার (পারমাণবিক) আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির পথ খুলে দেয়। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, অটো হান আর তাঁর দলের করা কাজের পদ্ধতিতেই শৃঙ্খলা বিক্রিয়া (চেইন রিয়্যাকশন)-কে কাজে লাগিয়ে উৎপন্ন করা যেতে পারে বিপুল পরিমাণ শক্তি। জার্মানী যদি এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক বোমা বানাতে সক্ষম হয় তাহলে তাদের সেই অগ্রগতি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রকাশ পেতে পারে – ১৯৩৯ সালে লিও সিলার্ড দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এই ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে সতর্ক করার সিদ্ধান্ত নেন। যার ফলস্বরূপ ১৯৪২ সালে ম্যানহাটন প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রকল্পে যোগদানের প্রস্তাবে লিসার স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর ছিল: “বোমা নিয়ে আমার কোনো কিছু করার নেই! ”
“আমি যদি জানতাম যে জার্মানরা আদৌ একটি পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সফল হবে না, তবে আমি কিছুই করতাম না।”
–অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (১৯৪৭ সালে রুজভেল্টকে লেখা চিঠিতে)
এরপর বাকি জীবনটা লিসা কাটিয়েছেন যুদ্ধের বিপক্ষে সংগ্রাম আর বিজ্ঞান প্রচার করে। অবশেষে তিনি কেমব্রিজে গিয়ে অবসর নেন এবং সেখানেই ১৯৬৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সমাধিপ্রস্তরে তাঁর উদ্দেশ্যে ভাগ্নে অটো ফ্রিশের লেখা শব্দগুলি আজও পড়া যায়: “লিসা মাইটনার: এক পদার্থবিজ্ঞানী যিনি কখনো তাঁর মনুষ্যত্ব হারান নি।” ১৯৯৭ সালে তাঁকে সম্মান জানিয়ে তাঁর নামানুসারে মৌল ১০৯ এর নাম দেওয়া হয় মাইটনারিয়াম (Mt)।
লেখকের প্রতিক্রিয়া: আমি মনে করি, যে পরিমাণ প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে সারাজীবন লিসাকে যেতে হয়েছে, তাতে অধিকাংশ মানুষই লড়াই করা ছেড়ে দিতেন। তাঁর একমাত্র সম্বল ছিল পদার্থবিজ্ঞান আর সেই জগতে তিনি নিজের প্রয়োজনীয় সমস্ত আনন্দ খুঁজে নিতেন। এই সাধনার জায়গা থেকেই অটো হানের সাথে কাজ করার প্রথম কয়েক বছর তিনি পারিশ্রমিক না পাওয়া সত্ত্বেও কাজ করা থামাননি অথবা পরবর্তীকালে স্টকহোমে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব তাঁকে তাঁর কাজ থেকে বিরত করতে পারে নি। তিনি এই সমস্ত বাধা একে একে পেরিয়ে এসেছিলেন। বন্ধু অটো তাঁর সাথে খানিকটা হলেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, তা সত্ত্বেও জীবিতাবস্থায় তাঁরা বরাবর বন্ধু ছিলেন এবং তাঁদের এই জুটি ইতিহাসের পাতায় সফল জুটিগুলির মধ্যে অন্যতম, নিঃসন্দেহে । কিছু কিছু সূত্র থেকে গুজব রটে, সম্ভবতঃ তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু লিসা নিজে বারংবার বলেছেন, তাঁর সমস্ত ভালোবাসা ছিল তাঁর গবেষণার প্রতি আর সেই কারণেই তিনি সময় পাননি বিয়ে বা সংসার করার। লিসা সেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন যারা সেই অর্থে সুপরিচিত না হলেও,বর্তমান সমাজকে গড়ে তোলার পিছনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।
(লেখাটি প্রথম এখানে প্রকাশিত হয়েছিল। মূল ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছে শ্রীনন্দা ঘোষ।)
লেখার সূত্র:
[১] কেমিকাল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন-এর প্রবন্ধ
[২] ওয়াশিংটন পোস্ট-এ লিসা-র জীবনী
[৩] স্প্যানিশ ভাষায় অনলাইন এনসাইক্লোপিডিয়াতে লিসা-র জীবনী
[৭] E=mc2:Einstein’s Big Idea (অংশবিশেষ লিসাকে নিয়ে)