এর আগে যা জেনেছি
আগের দুটি পর্বে (পর্ব ৬-৭) আমরা জেনেছি কিভাবে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকসের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এই সব অ্যান্টিবায়োটিকস-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াদের সুপার-বাগ (Super-Bug) বলা হয়ে থাকে।
পর্ব-৬: সুপার-বাগরা বিটা-ল্যাকটামেস নামের উৎসেচক তৈরী করে। এই বিটা-ল্যাকটামেস হাইড্রোলাইসিস বিক্রিয়ার মাধ্যমে বহুল প্রচলিত পেনিসিলিন গোত্রের বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক্সদের (যথা Amoxicillin, Cephamycins, Carbapenems, Flucloxacillin ইত্যাদি) কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। ফলে পেনিসিলিন গোত্রের (বা বিটা-ল্যাকটাম) অ্যান্টিবায়োটিক্স দিয়ে আর ওই সব ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত রোগ নিরাময় সম্ভব হয় না।
পর্ব-৭: আমরা আরো জেনেছি কিভাবে এই সব সুপার-বাগদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে বিজ্ঞানীরা অন্য এক ব্যাকটেরিয়া থেকেই ক্লাভুলানিক অ্যাসিড নামে এক রাসায়নিক যৌগের সন্ধান করেছেন। এই ক্লাভুলানিক অ্যাসিড অ্যান্টিবায়োটিক্স-প্রতিরোধী বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকটিকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আর এই ভাবেই সুপার-বাগদের বিরুদ্ধেও সফল ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিটা-ল্যাকটাম ছাড়াও কিছু অন্য শ্রেনীর রাসায়নিক যৌগ-ও সফলভাবে অ্যান্টিবায়োটিক্স হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলি ব্যাকটেরিয়াদের কোষ-প্রাচীরের গঠন প্রক্রিয়াতে বাধা দিয়ে ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে। এইসব অ্যান্টিবায়োটিক্সে কোনো বিটা-ল্যাকটাম রিং থাকে না, তাই বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচক এই সব অ্যান্টিবায়োটিক্সদের (vancomycin, teixobactin ইত্যাদি) নিষ্ক্রিয় করতে পারে না| সুপার-বাগদের প্রতিরোধে এরাও বেশ কার্যকরী।
তবে গল্পের শেষ এখানেই নয়! আগের দুই পর্বে আমরা প্রধানত বিটা-ল্যাকটাম শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিক্স ও তাদের কার্যকারিতা নিয়েই আলোচনা করেছি। বলে রাখা ভালো, এই শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলি কিন্তু মূলত গ্রাম-পজিটিভ (Gram-positive) ব্যাকটেরিয়াদের বিরুদ্ধেই সফল ভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে (গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়াদের সম্পর্কে জানতে লেখার তৃতীয় পর্বটি আরেকবার পড়ে নিতে পারো)।
গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার কোষরস পরিবেষ্টন করে থাকে অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দা (inner membrane)। তার পরেই খুব সুদৃঢ় ও পুরু মিউরিন বা পেপ্টাইডোগ্লাইকানের তৈরী কোষ-প্রাচীর (cell wall)-এর আস্তরণ থাকে। কোষ-প্রাচীরের এই আস্তরণ গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়াদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা বলয় যা ব্যাকটেরিয়াদের পরিবেশের অভিস্রবণ-জনিত চাপ (turgor pressure) থেকে রক্ষা করে। বিটা-ল্যাকটাম বা পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলি এই প্রতিরক্ষাবলয় নষ্ট করে দিলে গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া কোষের মৃত্যু হয়। কোষ-প্রাচীর যেহেতু গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার একদম বাইরের প্রতিরক্ষা বলয় তাই অ্যান্টিবায়োটিক্স খুব সহজেই তার সঙ্গে বিক্রিয়া করতে পারে।
গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া – কোষ প্রাচীরের বাইরে যাদের আরেকটি পর্দা আছে
গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের জন্যে কিন্তু ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়! গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের কোষরস পরিবেষ্টন করে থাকে অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দা (inner membrane)। অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দার চারপাশে থাকে কোষ-প্রাচীরের (cell wall) সুগঠিত বলয় আর সব শেষে এই কোষ-প্রাচীরকে রক্ষা করার জন্যে ফসফো-লিপিড দিয়ে তৈরী বাহ্যিক কোষ-পর্দার (outer membrane) আরো একটি আস্তরণ।
এই ত্রিস্তর প্রতিরক্ষায় সজ্জিত গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলা তাই বেশ কঠিন প্রধানত দুইটি কারণে:
এক, বাহ্যিক কোষ-পর্দার আস্তরণ ভেদ করে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক্সের পক্ষে পেনিসিলিন বাইন্ডিং প্রোটিনের (PBPs) সঙ্গে বিক্রিয়া করার সম্ভবনা কম (PBP কি, তা আরো বিশদে জানতে লেখার পর্ব-৬ টা দেখে নিতে পারো)। এই কারণে বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলি গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীর সহজে নষ্ট করতে পারে না!
আর যদিও বা কোষপ্রাচীরের অল্প-বিস্তর ক্ষতি করে, তাহলেও ওদের ত্রিস্তরী প্রতিরক্ষা বলয়ের জন্যে ওরা পরিবেশের অভিস্রবণ-জনিত চাপ (turgor pressure) সামলে নেয়। তাই পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলি গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধে সবসময় কার্যকরী হয় না।
দুই, গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার বাহ্যিক কোষ-পর্দায় বেশ কিছু প্রোটিন থাকে যাদের এফ্লাক্স পাম্প (efflux pump) বলে। যখনই ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক্স বা ব্যাকটেরিয়ার জন্যে ক্ষতিকারক কোনো রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতি টের পায়, এই পাম্পগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ব্যাকটেরিয়া কোষের জন্যে ক্ষতিকারক সেইসব রাসায়নিক যৌগগুলিকে কোষের থেকে বার করে দেয়।
মোটের উপর তাই গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ প্রতিহত করা অনেক কঠিন।
গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ও সুপার-বাগদের নিয়ে লেখা সুপরিচিত বই “Rising Plague”-এ ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া (লস এঞ্জেলেস)-এর প্রখ্যাত ডাক্তার ব্র্যাড স্পেলবার্গ (Brad Spellberg) তাই বলেছিলেন: “গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়াদের জন্যে আমরা ভালো ওষুধ খুঁজছি আর গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের জন্যে আমরা যে কোনো ওষুধ খুঁজছি (“For Gram-positives we need better drugs; for Gram-negatives we need any drug.”)।
এখন প্রশ্ন হলো, অ্যাসিনেটোব্যাকটর (Acinetobacter), সিউডোমোনাস (Pseudomonas aeruginosa), ক্লেবসিয়েলা (Klebsiella pneumoniae), নিসেরিয়া (Neisseria gonorrhoeae), ই. কোলাই (E. coli), এই সব গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের সংক্রমণ থেকে বাঁচবার উপায় কি?
বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা এই সমস্যার-ও সমাধানসূত্র দিয়েছে!
ব্যাকটেরিয়ার জীবন-প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার নানা ফিকির
গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিরোধ করতে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু অ্যান্টিবায়োটিক্সের সন্ধান দিয়েছেন যেগুলির নিশানা ব্যাকটেরিয়া কোষের কোষ-প্রাচীর নয়, বরং এমন কিছু অপরিহার্য কোষীয় প্রক্রিয়া যেগুলো ছাড়া ব্যাকটেরিয়া কোষের বেঁচে থাকা অসম্ভব! এইসব অ্যান্টিবায়োটিক্স অবশ্য গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া ও সুপার-বাগদের প্রতিরোধেও সফল ভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এই অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলিকে প্রধানত পাঁচটি শ্রেনীতে ভাগ করা যায়।
এক, রাইবোজোম ইনহিবিটরস (Ribosome or Protein synthesis inhibitors): পেনিসিলিন গোত্রের (বা বিটা-ল্যাকটাম) অ্যান্টিবায়োটিক্সের পরে সব থেকে বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক্স হলো “রাইবোজোম ইনহিবিটরস” শ্রেনীর অ্যান্টিবায়োটিক্স। সব কোষেই অসংখ্য রাইবোজোম থাকে আর রাইবোজোমের মাধ্যমেই কোষের প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রোটিন তৈরী হয়, তাই রাইবোজোমকে কোষের প্রোটিন তৈরির কারখানা বলা হয়!
রাইবোজোম-এর কার্যকারিতা থমকে গেলে কোষের সমস্ত প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই কোষটির মৃত্যু হয়! রাইবোজোম ইনহিবিটর শ্রেনীর অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলি ব্যাকটেরিয়া কোষের রাইবোজোম থেকে প্রোটিন উৎপাদনে বাধা দেয় এবং এর ফলে ব্যাকটেরিয়া কোষের মৃত্যু হয়!
আমাদের অর্থাৎ ইউক্যারিওটদের রাইবোজোমের গঠন ব্যাকটেরিয়াদের থেকে বেশ আলাদা, তাই রাইবোজোম ইনহিবিটরস আমাদের কোষের রাইবোজোমের বিশেষ ক্ষতি করে না।
প্রসঙ্গত, রাইবোজোমের গঠন ও রাইবোজোম ইনহিবিটরস নিয়ে অসামান্য গবেষণার (১) জন্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ভেঙ্কটরমণ রামকৃষ্ণণ (Venkatraman Ramakrishnan), এবং আদা য়োনা (Ada E. Yonath) ও টমাস স্টায়জ-কে (Thomas A. Steitz) ২০০৯ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে।
এই শ্রেনীর প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু উদাহরণ হল: Gentamicin, Garamycin, Kanamycin, Streptomycin, Spectinomycin, Neomycin, Clindamycin, Linezolid Doxycycline ইত্যাদি।
দুই, জায়রেজ ইনহিবিটরস (gyrase inhibitors): ব্যাকটেরিয়া কোষে সাধারণত একটি মাত্র বৃত্তাকার ক্রোমোজোম থাকে। জেনে রাখা ভালো, ব্যাকটেরিয়া ক্রোমোজোমের সঙ্গে আমাদের ক্রোমোজোমের গঠন ও সজ্জায় বিস্তর পার্থক্য আছে, সে বিষয়ে পরে একদিন আলোচনা করব!
ব্যাকটেরিয়ার কোষের বিভাজনের সময় ক্রোমোজোমের (বা ডিএনএ-র) প্রতিলিপিকরণ, বিশেষ কারণে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তার পুনর্সমন্নয়, প্রোটিন তৈরির প্রথম ধাপ অর্থাৎ ডিএনএ থেকে আরএনএ তে তথ্যের সঞ্চারণ এই সব প্রক্রিয়ায় জায়রেজ (বা টোপো আইসোমারেজ-II) নামের একটি উৎসেচকের ভূমিকা অপরিসীম (২)।
জায়রেজ ইনহিবিটরস শ্রেনীর অ্যান্টিবায়োটিক্স গুলি, এই জায়রেজ বা টোপো আইসোমারেজ-II উৎসেচকের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। এর ফলে কোষের অপরিহার্য্য প্রক্রিয়াগুলি বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যাকটেরিয়া কোষটির মৃত্যু হয়।
এই শ্রেনীর প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক্স গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো উদাহরণ হল: Ciprofloxacin, Moxifloxacin, Nalidixic acid, Norfloxacin, Ofloxacin ইত্যাদি।
তিন, ফোলেট সিন্থেসিস ইনহিবিটরস (folate synthesis inhibitors): ফোলেট বা ভিটামিন B9 সমস্ত কোষের জন্যে এক অপরিহার্য্য উপাদান। ডিএনএ ও আরএনএ-র গঠনগত এককগুলি তৈরির জন্যে ফোলেটের উপস্থিতি আবশ্যক। ফোলেট সিন্থেসিস ইনহিবিটরস-রা সাধারণত ব্যাকটেরিয়া কোষের এই ফোলেট বা ভিটামিন B তৈরির প্রক্রিয়ায় বাধ সাধে! আর তাই, এই সব অ্যান্টিবায়োটিক্সের উপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়ার কোষ বিভাজন ও প্রোটিন তৈরীর প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়ে যায় (৩)।
এই শ্রেনীর প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক্স গুলির মধ্যে অন্যতম হল: Sulfacetamide, Mafenide, Sulfadimethoxine, Sulfisoxazole ইত্যাদি।
চার, ট্রান্সক্রিপশন ইনহিবিটরস (transcription inhibitors): এই শ্রেনীর অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলি ব্যাকটেরিয়া-র ডিএনএ থেকে আরএনএ-তে তথ্যের সঞ্চারণ প্রক্রিয়ায় বাধা দেয় আর তাই ব্যাকটেরিয়ার প্রোটিন সংশ্লেষ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়!
যে কোনো কোষে সাধারণত প্রথমে ডিএনএ থেকে আরএনএ তৈরী হয়, আর কোষের মধ্যে উপস্থিত রাইবোজোম এই আরএনএ থেকেই প্রোটিন তৈরী করে। ডিএনএ থেকে আরএনএ-তে তথ্য সঞ্চারণের প্রধান কাজটি করে আরএনএ পলিমারেজ (RNA polymerase) নামে একটি উৎসেচক। ট্রান্সক্রিপশন ইনহিবিটরসরা আরএনএ পলিমারেজের সঙ্গে বিক্রিয়া করে এই গুরুত্বপূর্ণ উৎসেচকটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, ফলে ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রোটিন সংশ্লেষ বিঘ্নিত হয় এবং ব্যাকটেরিয়া কোষটি নষ্ট হয়ে যায়। Rifampicin হলো এই শ্রেনীর প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক্সের উদাহরণ (৪)।
পাঁচ, আউটার মেমব্রেন পারমিয়াবিলিটি চেঞ্জ-ফ্যাক্টর (outer membrane permeability change-factor): এই শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলি আমাদের শেষ অস্ত্র! যখন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক্সেই আর কাজ হয় না তখন সাধারণত এই অ্যান্টিবায়োটিক্স গুলি ব্যবহার হয়ে থাকে।
নাম থেকেই বুঝতে পারছো, এই সব অ্যান্টিবায়োটিক্স ব্যাকটেরিয়া কোষের বাহ্যিক ও অন্তর্বর্তী কোষ-পর্দার গঠন ও বিন্যাস বিপর্যস্ত করে দেয় (৫)! এর ফলে একদিকে যেমন কোষের আয়ন-এর সাম্যতা নষ্ট হয়ে যায়, তেমন অন্য দিকে Gram-negative ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীর উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, তাই ব্যাকটেরিয়া কোষটি নষ্ট হয়ে যায়।
তবে মুস্কিল হলো এই শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিক্সের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া খুবই বেশি। অনেক সময় এরা কিডনি ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ডাক্তারবাবুরা তাই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ-এর একদম শেষ পর্যায়ে এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন! এই গোষ্ঠীর প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক্সগুলির মধ্যে অন্যতম হলো: Polymyxin B, Colistin ইত্যাদি।
উপরের আলোচনা থেকে বুঝতেই পারছো বিজ্ঞানীরা কত রকম ভাবে এই সব মারাত্মক ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, উপরের সব শ্রেনীর অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধেই কোনো না কোনো ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে! প্রচলিত বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধে কোন কোন ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, ঠিক কত বছর সময়ের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তার একটা সংক্ষিপ্ত সময়-সারণী নীচে দেওয়া হলো (৬)।
এখন প্রায়শই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নতুন নতুন গ্রাম-পজিটিভ ও গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে যারা কোনো না কোনো অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। মুস্কিল হলো, এই প্রতিরোধ গড়ে তোলার ধরণ প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা। তাই কোনো একটা সমাধানসূত্র বার করে ওদের জব্দ করা যাচ্ছে না।
কোনো ব্যাকটেরিয়া একটি অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে অনেক সময় তাদের দুই বা ততোধিক অ্যান্টিবায়োটিক্সের সংমিশ্রন (antibiotics cocktail) ব্যবহার করে মোকাবিলা করা হয়!
আশঙ্কার ব্যাপার হলো কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া একাধিক শ্রেনীর অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সক্ষম! এইসব ব্যাকটেরিয়াদের মাল্টিপল-ড্রাগ-রেসিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া (Multiple-drug-resistance) বা MDR বলা হয়! গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া অ্যাসিনেটোব্যাকটর (Acinetobacter), ক্লেবসিয়েলা (Klebsiella pneumoniae), গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া স্ট্যাফাইলোকক্কাস (staphylococcus), স্টেপটোকক্কাস(streptococcus), ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়াদের মধ্যে এখন MDR-এর প্রবণতা বেড়েই চলেছে।
সম্প্রতি এমন উদাহরণও দেখা গিয়েছে যখন প্রচলিত কোনো অ্যান্টিবায়োটিক্স দিয়েই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঠেকানো যায়নি। এমনকি Polymyxin দিয়েও না (৭)। ব্যাকটেরিয়ারা যেরকম দ্রুত গতিতে অ্যান্টিবায়োটিক্সের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে আমরাও যদি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন শ্রেনীর অ্যান্টিবায়োটিক্সের সন্ধান খুঁজে না বার করতে পারি, তাহলে একটা সময় যেমন প্লেগ বা কলেরাতে গ্রাম উজাড় হয়ে যেত, সুপার-বাগদের দৌরাত্ম্যয় সেই দিন আবার ফিরে আসতেই পারে। তাই নতুন যুগের এই MDR ব্যাকটেরিয়াদের প্রতিরোধ করতে আমাদের নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক্সের সন্ধান চালিয়ে যেতেই হবে।
লেখার উৎস:
[১] নোবেল ওয়েবসাইটে ভেঙ্কটরামান রামাকৃষ্ণন-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।
[২] জায়রেজ সম্পর্কে উইকিপিডিয়া আর্টিকেল।
[৩] Utility of the Biosynthetic Folate Pathway for Targets in Antimicrobial Discovery, Christina R. Bourne (Antibiotics)।
[৪] Identification of inhibitors of bacterial RNA polymerase, Xiao Yang et al (Bacterial and Archaeal Transcription)।
[৫] Polymyxin B versus colistin: an update, Yiying Cai et al (Expert Review of Anti-infective Therapy)।
[৬] এই উৎস থেকে পাওয়া ছবির ওপর নির্ভর করে লেখকের নিজস্ব সৃষ্টি।
[৭] দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার এই খবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কেসের কথা জানা গেল যেখানে এক মহিলাকে এমন এক ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে যাকে শেষ-অবলম্বন অ্যান্টিবায়োটিক্সও কিছু করতে পারেনা।