অ্যান্টিবায়োটিকসের খুঁটিনাটি: সুপার-বাগ প্রতিরোধের উপায়
এর আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম কিভাবে কিছু বিশেষ ব্যাকটেরিয়া বিটা-ল্যাকটামেস (β-lactamase) নামে এক শ্রেণীর উৎসেচক তৈরী করে আমাদের প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। এই ব্যাকটেরিয়াদের তাই অ্যান্টিবায়োটিকস প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া (Antibiotic-Resistant Bacteria) বা সুপার-বাগ (Super-Bug) বলা হয়। সুপার-বাগ-রা হাইড্রোলাইসিস বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকস-এর কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। ফলে প্রচলিত বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকস (পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকস) দিয়ে আর ওই সব ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ নিরাময় সম্ভব হয় না।
সম্প্রতি, আমেরিকার স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ দপ্তর (Centers for Disease Control and Prevention) থেকে প্রকাশিত তথ্য মারফত জানা গিয়েছে যে, স্ট্রেপটোকক্কাস (Streptococcus pneumoniae), মাইকোব্যাকটেরিয়াম (Mycobacterium tuberculosis),স্টাফাইলোকক্কাস (Staphylococcus aureus), এন্টারোকক্কাস (Enterococcus), ক্লসট্রিডিয়াম (Clostridium botulinum), লিস্টেরিয়া (Listeria monocytogenes) ইত্যাদি একদল মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া এখন সুপার-বাগ এর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
এখন প্রশ্ন হল এই সব সুপার-বাগদের থেকে মুক্তির উপায় কি?
বিটা-ল্যাকটামেস-এর সন্ধান পাবার পর থেকেই বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করে দিয়েছিলেন কিভাবে এই অ্যান্টিবায়োটিকস ধ্বংসকারী উৎসেচকটিকে রুখে দেওয়া যায় তার উপায় বের করতে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্ট্রেপটোমাইসেস ক্লাভুলিজেরাস (Streptomyces clavuligerus) নামে এক ব্যাকটেরিয়ার থেকেই মিললো সুপার-বাগ সমস্যার সমাধান সূত্র।
এই Gram-positive (Gram রঞ্জক পদার্থে সহজেই রঞ্জিত হয়) ব্যাকটেরিয়া তাদের বিপাক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে এমন কিছু রাসায়নিক যৌগ তৈরী করে যেগুলির সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকসের গঠনগত মিল রয়েছে। স্ট্রেপটোমাইসেস ক্লাভুলিজেরাস থেকে বিজ্ঞানীরা এই রকম প্রায় ২০ টি যৌগের সন্ধান পেয়েছেন, ক্লাভুলানিক অ্যাসিড (Clavulanic acid) তাদের মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞানীদের নানাবিধ গবেষণার ফলে দেখা গেল এই ক্লাভুলানিক অ্যাসিড-এর উপস্থিতিতে বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকটি আর কাজ করে না। তাই বিটা-ল্যাকটাম বা পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মিশিয়ে দিলে সুপার-বাগদের মেরে ফেলা সম্ভব।
অনেক সময় ডাক্তারবাবুদের দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিকসে কাজ না হলে তাঁরা আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম বা second generation অ্যান্টিবায়োটিকস দিয়ে থাকেন। কখনো একটু খেয়াল করে দেখো প্রথমে হয়ত তিনি আমাদের Amoxicillin দিয়েছিলেন। ধরা যাক এতে ভালো কাজ হলো না, পরের বার প্রেস্ক্রিপশন-এ তিনি co-amoxiclav বা Augmentin দিয়ে থাকেন। Co-amoxiclav বা Augmentin হলো এই দ্বিতীয় প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিকস, যাতে বিটা-ল্যাকটাম বা পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মেশানো থাকে। আর তাতেই মোক্ষম কাজ হয় সুপার-বাগদের বিরুদ্ধে।
কি করে কাজ করে এই ক্লাভুলানিক অ্যাসিড?
ক্লাভুলানিক অ্যাসিড দেখতে অনেকটা পেনিসিলিনের মতই। তবে, এতে বিটা-ল্যাকটাম রিং থাকলেও পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিনের সঙ্গে সরাসরি বিক্রিয়া করে না। তাই ক্লাভুলানিক অ্যাসিড অ্যান্টিবায়োটিকস নয়।
মজার ব্যাপার হলো, ব্যাকটেরিয়ার বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকটি কিন্তু এই গঠনগত মিল থাকার জন্যে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিডের পার্থক্য করতে পারে না (মনে পড়ে মলিকিউলার মিমিক্রি?)। আর তাই যখন পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকসের সঙ্গে ক্লাভুলানিক অ্যাসিড মিশিয়ে দেওয়া হয় তখন ব্যাকটেরিয়ার বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচক, বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকস ও ক্লাভুলানিক অ্যাসিড দুইটি যৌগের সঙ্গেই রাসায়নিক বিক্রিয়া করে। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে ক্লাভুলানিক অ্যাসিডের সঙ্গে বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকের বিক্রিয়া করার প্রবণতা অনেক বেশি। এর কারণ ক্লাভুলানিক অ্যাসিড ও বিটা-ল্যাকটামেস সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রাসায়নিক ভাবে খুবই স্থিতিশীল একটি যৌগ তৈরী করে। ফলে বিটা-ল্যাকটামেস উৎসেচকটি সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
যখন কোনো রাসায়নিক অণু কোনো উৎসেচকের সঙ্গে বিক্রিয়া করে উৎসেচকটির কার্যকারিতা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দেয় তখন সেই সব রাসায়নিক অণুকে “সুইসাইড ইনহিবিটর” (suicide inhibitor) বলা হয় আর এইরকম রাসায়নিক বিক্রিয়াকে “সুইসাইড ইনএকটিভেশন” (suicide inactivation) বলা হয়। ক্লাভুলানিক অ্যাসিডের উপস্থিতিতে তাই বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকস আবার আগের মতই কার্যকরী হয়ে ওঠে।
একটা প্রশ্ন মনে আসতেই পারে, স্ট্রেপটোমাইসেস ক্লাভুলিজেরাস তো একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিকস এর গঠনের সঙ্গে মিল আছে এমন সব রাসায়নিক যৌগ ( যেমন ক্লাভুলানিক অ্যাসিড) ওদের কোষে কি করে পাওয়া সম্ভব?
ব্যাকটেরিয়ারা এই পৃথিবীতে এসেছে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে। ইউক্যারিওটদের আবির্ভাব হয়েছে তার অনেক অনেক পরে। তাই বিবর্তনের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, বেঁচে থাকার জন্যে ব্যাকটেরিয়াদের নিজেদের মধ্যেই লড়াই শুরু হয়েছিল সবার প্রথমে। আর এই কারণেই অনেক ব্যাকটেরিয়া এমন কিছু রাসায়নিক যৌগ তৈরী করে যেগুলো অন্যান্য ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে। পরবর্তী কালে ছত্রাক, প্রোটোজোয়া ও অন্যান্য ইউক্যারিওটদের আবির্ভাব হয়েছে এবং এদের মধ্যেও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী নানারকম রাসায়নিক যৌগের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এইরকমই এক ছত্রাক পেনিসিলিয়াম (Penicillium) থেকে স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেক্জান্ডার ফ্লেমিং (Alexander Fleming) ১৯২৯ সালে প্রথম পেনিসিলিন আন্টিবায়োটিকের সন্ধান পেয়েছিলেন।
সত্যি কথা বলতে কি, বিজ্ঞানীরা এখন উপলব্ধি করছেন ব্যাকটেরিয়াদের মোকাবিলা করার জন্যে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ও প্রোটোজোয়াদের থেকে নানাবিধ ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী রাসায়নিক যৌগ গুলিকে খুঁজে বার করা। সম্প্রতি বিজ্ঞানের নেচার পত্রিকায়১ এই বিষয়ে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে যেখানে মাটির সাথে মিশে থাকা বিভিন্ন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য এককোষী বা বহুকোষীদের দেহ থেকে বিজ্ঞানীরা এমন সব রাসায়নিক যৌগ খুঁজে পেয়েছেন (যেমন: Teixobactin) যাদের ব্যবহার করে অদূর ভবিষ্যতে আমরা হয়ত ব্যাকটেরিয়াদের বিরুদ্ধে আরো কঠিন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব।
এখনও পর্যন্ত আমরা প্রধানত বিটা-ল্যাকটাম শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিকস ও তাদের কার্যকারিতা নিয়েই আলোচনা করেছি। বলে রাখা ভালো এই শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিকসগুলি কিন্তু Gram-positive ব্যাকটেরিয়াদের বিরুদ্ধেই সফল ভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। কারণ Gram-negative ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীরের বাইরে বাহ্যিক কোষ-পর্দার একটি আস্তরণ থাকে। বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকসের পক্ষে এই আস্তরণ ভেদ করে পেনিসিলিন বাইন্ডিং প্রোটিনদের (PBPs) সঙ্গে বিক্রিয়া করার সম্ভবনা খুব-ই কম। এছাড়া, Gram-positive ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীরের আস্তরণ অনেক দৃঢ় এবং পুরু তাই কোষের সুরক্ষার জন্যে এর ভূমিকা অপরিসীম। Gram-negative ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীর সে তুলনায় অনেক শিথিল এবং তাদের সুরক্ষার জন্যে কোষ-প্রাচীরের বাইরে এই বাহ্যিক কোষ-পর্দা থাকে। তাই বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকসগুলি Gram-positive ব্যাকটেরিয়ার জন্য অনেক বেশি কার্যকরী। তাহলে অ্যাসিনেটোব্যাকটর (Acinetobacter), সিউডোমোনাস (Pseudomonas aeruginosa), ক্লেবসিয়েলা (Klebsiella pneumoniae), নিসেরিয়া (Neisseria gonorrhoeae) এই সব মারাত্মক Gram-negative ব্যাকটেরিয়াদের থেকে রক্ষা পাবার উপায় কি? ওদের বিরুদ্ধে আমরা কি কি অ্যান্টিবায়োটিকস ব্যবহার করি? Gram-negative ব্যাকটেরিয়া-ও কি সুপার-বাগ হয়?
এই বিষয়ে আরো জানার জন্যে পরের পর্বে নজর রাখো।
লেখার উৎস:
[১] https://www.nature.com/nature/journal/v517/n7535/full/nature14098.html
very good information .thanx doctor