দেবনাথ ঘোষাল, ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর … )
মানুষ আর ব্যাকটেরিয়ার লড়াই: সুপার-বাগ বনাম অ্যান্টিবায়োটিকস
অনেক দিন পরে ফিরে এলাম জীবাণুদের যত কথার ষষ্ঠ পর্ব নিয়ে। আগের পাঁচটি পর্বে আমরা জীবাণুদের বাসস্থান, তাদের নানা প্রকারভেদ, বৈচিত্র্যময় গঠন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আকারে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হলেও গঠনগত দিক দিয়ে তারা যে অনেক জটিল এবং তাদের কোষের বাহ্যিক প্রতিরক্ষা বলয় যে অনেক বেশী সুসংগঠিত সে বিষয়েও আমরা অনেক কিছু জেনেছি। উন্নত ইউক্যারিওটদের থেকে ব্যাকটেরিয়া কোষের বাহ্যিক আবরণের প্রধান পার্থক্যটি হল, ব্যাকটেরিয়া কোষের বাইরে কোষ-পর্দা ছাড়াও কোষ-প্রাচীরের দৃঢ় আচ্ছাদন থাকে। আর এই কোষ-প্রাচীরের উপস্থিতির জন্যই প্রতিকূল পরিবেশেও ব্যাকটেরিয়া অভিস্রবণ জনিত চাপ (Turgor pressure) থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারে। কোনো কারণে যদি ব্যাকটেরিয়া কোষের এই প্রতিরক্ষা বলয় নষ্ট হয়ে যায় তাহলে ব্যাকটেরিয়া কোষটি অভিস্রবণ জনিত চাপ সহ্য করতে না পেরে মারা যায়। আর এই কারণেই দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকস গুলির বেশীর ভাগের-ই নিশানা হল ব্যাকটেরিয়া কোষের কোষ-প্রাচীর। এই পর্বে আমরা অ্যান্টিবায়োটিকস কীভাবে কোষ-প্রাচীরের গঠন নষ্ট করে এবং কিছু ‘সুপার’ ব্যাকটেরিয়া তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সেই বিষয়ে আলোচনা করব।
আমাদের যখন শরীর খারাপ হয় তখন ডাক্তারের কাছে গেলে প্রায়শই তাঁরা আমাদের অ্যান্টিবায়োটিকস খেতে বলেন। ঠান্ডালাগা, কোথাও ছড়ে যাওয়ার মত সাধারণ সমস্যা বা প্লেগ, হুপিং কাশির মত মহামারী সবের-ই এক সমাধান – অ্যান্টিবায়োটিকস! তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করে এই অ্যান্টিবায়োটিকস-এ কী এমন ম্যাজিক থাকে যে ভয়ংকর সব ব্যাকটেরিয়া পালাবার পথ খুঁজে পায় না?
এই বিষয়ে জানার আগে চট করে আমরা একটু আগের পর্বের বিষয়টা ঝালিয়ে নেব। আগের পর্বে (পর্ব-৫) আমরা আলোচনা করেছিলাম যে NAG ও NAM এই দুই অদ্ভুত শর্করার সমন্বয়ে তৈরী হয় পেপ্টাইডোগ্লাইকান পলিমার। অসংখ্য পেপ্টাইডোগ্লাইকান পলিমার একসঙ্গে মিলে ব্যাকটেরিয়ার পেরিপ্লাসমে ত্রিমাত্রিক জালের ন্যায় কোষ-প্রাচীর তৈরী করে। NAG ও NAM এই দুই শর্করার অণুকে পরপর সাজিয়ে পলিমার তৈরী ও এই পলিমার গুলিকে জুড়ে ত্রিমাত্রিক সজ্জায় সাজানোর কাজ করে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একদল প্রোটিন বা উৎসেচক। এদের পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিন (Penicillin-binding proteins) বা PBPs বলা হয়।
তোমরা কি আন্দাজ করতে পারো কেন এদের পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিন বলা হয়? কারণটা খুব-ই সহজ! পেনিসিলিন বা পেনিসিলিন গোত্রের যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিকস আসলে এই শ্রেণীর উৎসেচক গুলির সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওদের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। তাই এই প্রোটিন বা উৎসেচক গুলিকে পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিন বলে। এই প্রক্রিয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়া কোষের কোষ-প্রাচীর তৈরী হয় না এবং কোষটিও নষ্ট হয়ে যায়।
PBP-র উপস্থিতি প্রায় সব ব্যাকটেরিয়াতেই দেখা যায় এবং ওদের ভূমিকা ব্যাকটেরিয়া কোষের বেঁচে থাকার জন্যে অপরিহার্য। তাই পেনিসিলিন গোত্রের বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকস গুলি (Amoxicillin, Cephamycins, Carbapenems, Flucloxacillin ইত্যাদি) ডাক্তারবাবুরা আমাদের ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত রোগ সরানোর জন্যে প্রায়শই দিয়ে থাকেন।
তোমরা ভাবছ, ব্যাস তাহলে তো ল্যাঠা চুকে গেল! ব্যাকটেরিয়াকে বেশ জব্দ করা গিয়েছে। ওই পুঁচকিগুলো কিনা এসেছিল আমাদের সঙ্গে লড়াই করতে! আসলে সবাই তেমনটাই ভেবেছিল। ১৯২৯ সালে স্কটিশ বিজ্ঞানী আলেক্জান্ডার ফ্লেমিং জার্নাল অফ এক্সপেরিমেন্টাল প্যাথলজি তে সর্বপ্রথম আন্টিবায়োটিকস-এর ধারণা প্রকাশ করেন। তার পর থেকে ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ সারানোর জন্যে পেনিসিলিনের বহুল ব্যবহার শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈন্যদের সংক্রমণ সারাতে পেনিসিলিন ব্যবহারের অনেক উল্লেখ আছে।
সমস্যা দেখা দিল ১৯৬৭ সালে। পাপুয়া নিউগিনির (তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ায়) এক গ্রামে এক রোগীর স্ট্রেপটোকক্কাস নামে এক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ (Streptococcus pneumoniae) সারাতে গিয়ে দেখা গেল পেনিসিলিন আর কাজ করছে না। এই সময় গুয়াতেমালাতেও সিগেলা (Shigella spp.) নামে আর এক ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেল। সাত বছর পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায় আমেরিকাতে – নিসেরিয়া (Neisseria gonorrhoeae) নামে অন্য আর প্রকার ব্যাকটেরিয়াতে। নব্বই-এর দশকে দেখা গেল বিভিন্ন দেশে অনেক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ-ই আর প্রচলিত পেনিসিলিন শ্রেণীর অ্যান্টিবায়োটিকস দিয়ে সারানো যাচ্ছে না। এই ব্যাকটেরিয়াদের তাই অ্যান্টিবায়োটিকস প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া (Antibiotic-Resistant Bacteria) বা সুপার-বাগ (Super-Bug) নাম দেওয়া হয়েছে!
তোমরা নিশ্চই ভাবছ, এই সব ব্যাকটেরিয়াদের তো PBPs আছে। আবার ওদের কোষ-প্রাচীরেরও একান্ত প্রয়োজন। তাহলে পেনিসিলিন কাজ করছে না কেন? আসলে আমরা যত সহজে ওদের জব্দ করব ভেবেছিলাম ব্যাপারটা অত সহজ না। ব্যাকটেরিয়া যেহেতু খুবই প্রতিকূল পরিবেশে পৃথিবীতে প্রায় ৩৬০ কোটি বছর ধরে টিকে আছে তাই ওদের অভিযোজন ক্ষমতা বড্ড বেশী। এক্ষেত্রে ওরা পেনিসিলিনের জন্য একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
কি সেই ব্যবস্থা?
সুপার-বাগগুলি এক বিশেষ ধরনের উৎসেচক তৈরী করে ফেলেছে, যার নাম বিটা-ল্যাকটামেস (β-lactamase)। এই উৎসেচক হাইড্রোলাইসিস বিক্রিয়ার মাধ্যমে পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকস-এর প্রধান গঠনগত একক বিটা-ল্যাকটাম রিং (β-lactam ring, উপরের ছবিতে লাল রঙের) ভেঙ্গে দেয়! বিটা-ল্যাকটাম রিং নষ্ট হয়ে যাওয়ায় PBP বা পেনিসিলিন-বাইন্ডিং-প্রোটিনদের সাথে পেনিসিলিন১ আর বিক্রিয়া করতে পারে না। ফলে অ্যান্টিবায়োটিকসের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায় এবং ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীরের স্বাভাবিক গঠন প্রক্রিয়ার কোনো ক্ষতি হয় না। ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ চলতেই থাকে!
এই সুপার-বাগদের থেকে রক্ষা পাবার উপায় কি? ওদের সাথে লড়াই করার জন্যে বিজ্ঞানীরা কি ব্যবস্থা নিলেন? সেসব জানার জন্যে পরের পর্বে নজর রাখো।
-চলবে
জীবাণুদের যত কথার পরের পর্বঃ সুপার-বাগদের মারণাস্ত্র সম্বন্ধে পড়তে ক্লিক করুন
দেবনাথ ঘোষাল বর্তমানে ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্টডক্টরাল ফেলো। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি। গবেষণার বিষয় ব্যাকটেরিয়ার আণুবীক্ষণিক গঠন ও সংক্রমণ প্রক্রিয়া।
[১] বিটা-ল্যাকটাম রিং থাকার জন্য পেনিসিলিন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকস গুলিকে বিটা-ল্যাকটাম অ্যান্টিবায়োটিকস-ও বলা হয়ে থাকে।