তন্নিষ্ঠা সামন্ত
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, গান্ধীনগর
অরবিন্দ সামন্ত
প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
আপনি কি জানেন, জাপান আর জার্মানিতে পৃথিবীর বয়স্ক মানুষের (৬০ বছরের উর্ধ্বে যাদের বয়স) একটা বড় অংশ বাস করেন? আরও জানেন কি, ভারত পৃথিবীর যাবতীয় তরুণদের একটা বড় অংশের বাসস্থান? যেখানে জাপানের জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ প্রৌঢ়, সেখানে ভারতে সংখ্যাটা হলো মাত্র ৮ শতাংশ (সেনসাস, ২০১১)। জাপানে বা জার্মানিতে মধ্যবর্তী বয়স ৪৬, ভারতে সেটা ২৭। অর্থাৎ, ভারতের অর্ধেক জনসংখ্যা ২৭ বছরের কম বয়সী।
তা নাহয় হলো, কিন্তু তাতে কি আসে যায়? জনসংখ্যায় বয়সের বিন্যাস নিয়ে এই মাথাব্যথা কেন? অনেক কারণের একটা হলো, এটা ঠিক করে আমাদের পরিবারের গঠন কেমন হবে। আমরা অনেকে ঠাকুমা-ঠাকুরদাদার সঙ্গে সপরিবারে বসবাস করি, অনেকে শুধু বাবা-মার সাথে থাকি, অনেকে আবার থাকি একা একাই। এই সম্ভাবনাগুলোর কোনটা দেশের বেশিরভাগ লোকের জন্য প্রযোজ্য হবে, সেটা শুধু সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যবস্থ্যা থেকেই আসে না। এতে দেশের বয়স কাঠামো বা এজ স্ট্রাকচার-এরও একটা অবদান আছে।
মজার ব্যাপার হলো, অতীতের ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক ঘটনা, যেমন যুদ্ধ, মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন কিংবা আর্থিক মন্দা, এর যে কোনো একটা দেশের ভবিষ্যত বয়স-কাঠামো নির্ধারণ করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ জাপানের কথা ধরা যাক। জাপানের বয়স কাঠামো নিয়ে পড়াশুনো করলে দেখতে পাবেন, নব্বইয়ের দশকে ৭০-৮০ বয়সসীমার মানুষজন খুবই কম। এর কারণ হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুল লোকসংখ্যা হানি হয়েছে। আরো চোখে পড়বে যে ৬৫-৬৭ বছর বয়সসীমার লোকজনও বেশ কম। তার কারণ কি? এর জন্য পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৩৮-৩৯ সালে। এবং দেখা যাবে সেটা চীন-জাপানের যুদ্ধের সময়।
আরো খুঁটিয়ে দেখা যায়। যেমন, ১৯৯৫ সালের গণনায় জাপানে ২৯ বছর বয়েসী মানুষের সংখ্যাও খুবই কম। এখানে কি হলো? ২৯ বছর বয়েসীদের সঙ্গে ১৯৬৬ সালের “ইয়ার অফ দ্য ফায়ারহর্স” (Year of the FireHorse) মিলে গেছে। এই “ইয়ার অফ দ্য ফায়ারহর্স” ষাট বছর অন্তর একবার আসে। জাপানিদের সাংস্কৃতিক বিশ্বাস হলো, এই বছরটা নবজাতক শিশুদের জীবনে অশুভ ভাগ্য নিয়ে আসে। তাই এবছরে কেউ সন্তান জন্ম দিতে চায় না। এইভাবে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর অর্থনীতি একটা দেশের জনসংখ্যার বিন্যাসকে প্রভাবিত করে।
জনসংখ্যার চরিত্র খুব ভালোভাবে বোঝা যায় একটা দেশের জনসংখ্যা পিরামিড (population pyramid) দেখলে। জনসংখ্যায় বয়স আর নারী-পুরুষের বিন্যাস, দুইয়ের একটা সুন্দর চিত্র এই পিরামিড থেকে বেরিয়ে আসে। পিরামিডের অক্ষরেখার একদিকে থাকে পুরুষের সংখ্যা, আর একদিকে নারীর। পিরামিডের এক একটা স্তর এক একটা বয়স গ্রুপের নারী-পুরুষের অনুপাত/শতাংশ বোঝায় (শতাংশ মানে সম্পূর্ণ জনসংখ্যার কত শতাংশ)। সবথেকে নিচের স্তরের দৈর্ঘ্য যদি ০-৪ এই বয়স গ্রুপটার সংখ্যা দেয়, তাহলে তার উপরের স্তরটা দেবে ৫-৯ বছর, তার উপরেরটা ১০-১৪ বছর, এইভাবে।
সাধারণত, দেশের পপুলেশন পিরামিডের ভিতটা যদি খুব চওড়া হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেখানে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে। যেমন, নিচের রেখাচিত্র দেখে আপনি স্পেনের ক্রমশ হ্রাসমান বা স্থিতিশীল জনসংখ্যার সাথে নাইজেরিয়ার দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনা করতে পারেন।
পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে যুবা বা তরুণদের আধিক্য লক্ষ্য করা যায় জনসংখ্যা বিন্যাসে। আগেই বলেছি, ভারতবর্ষ এমনই একটা দেশ। দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণে যুব সম্প্রদায়ের এই আধিক্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যায়। ধরুন, আপনি এমন একটা দেশে, এমন একটা বছরে জন্মালেন, যে দেশে সেবছর প্রচুর শিশুর জন্ম হয়েছে। তার মানে, কি শিক্ষায়, কি চাকরির ক্ষেত্রে, কি বিয়ের বাজারে, আপনাকে ওই বছর জন্মানো যাবতীয় ছেলেমেয়েদের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। তার মানে জন্ম-বছরের ভাগীদার যদি বড় সংখ্যায় থাকে, তাহলে প্রতিযোগিতা কি প্রতিদ্বন্দিতা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। এখনো অব্দি গবেষণাতেও সেরকমই দেখা গেছে।
শুধু তাই নয়, কোনো দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই যদি যুবক-যুবতী হয়, তাহলে সে দেশে বিপ্লব ও প্রতিবাদের সম্ভাবনাও বেশি হবে। বিশেষ করে, সে দেশের সরকার যদি দায়হীন ও নিরুত্তাপ হয়। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব (১৯৬৬-৭৬), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর সিভিল রাইটস আন্দোলন (১৯৫৪-১৯৬৪), “আরব বসন্ত” (Arab Spring, ২০১১-২০১৪) এবং আরও সাম্প্রতিককালে ভারতে (২০১১) দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন যুবপ্রধান দেশেরই উদাহরণ। সুতরাং তরুণদের সংখ্যাধিক্য যদিও আর্থিক দিক থেকে লাভজনক, দেশের সরকার তার ফলে অনেক বেশি জবাবদিহির সম্মুখীন হতে পারে।
জনসংখ্যা গবেষকদের অনেক কাজের একটা হলো এটা: একটা বিশেষ সময়ে দেশে বৃদ্ধের অংশ কত হবে, কি সংখ্যক শিশুর জন্ম-সম্ভাবনা প্রবল, কতগুলো মানুষ শ্রম-সরবরাহের যোগ্য বয়েসে (১৮-৫৯ বছর বয়স) পৌছবে, এসবের পূর্বানুমান করার চেষ্টা করেন। কিন্তু, এসব জেনে কি হবে? এক, এইসব তথ্য আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, কত তাড়াতাড়ি একটা দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে সমর্থ হবে। দুই, দেশের বাজেট ঠিক করতে এই গবেষণা খুবই জরুরি। শিশুশিক্ষার খাতে কতটা আর্থিক সম্পদ বরাদ্দ করা হবে বা কতটা বয়স্কদের পেনশনের খাতে যাবে, তা এইসব তথ্য থেকেই আসে। এমনকি, অদূর ভবিষ্যতে বয়স্কদের যত্ন-আত্তী করার জন্য যথেষ্ট পরিমানে তরুণ প্রজন্ম থাকবে কিনা, সেই ভাবনার রসদও এই গবেষণা থেকে আসে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পিছনে জনসংখ্যার বয়স কাঠামোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিভাবে, তা বুঝতে ভারতের উদাহরণ নেওয়া যাক। লোকগণনার হিসেব থেকে জানা যায়, এদেশে জনসংখ্যা ১৯৫০ সালে ৩৭২ মিলিয়ন থেকে ২০১১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১.২ বিলিয়নে। যদিও আমরা বছর বছর এক কোটি করে লোক সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছি, বিশেষজ্ঞদের মতে এর একটা সুবিধে রয়েছে। যাকে “জনতাত্ত্বিক মুনাফা” বা “demographic dividend” আখ্যা দেওয়া হয়। এটা একটা বিরল জনতাত্ত্বিক সুযোগ। এরকম বিশ-তিরিশ বছর চলতে পারে, যখন একটা দেশের কর্মক্ষম যুবসম্প্রদায় দেশের অবসরপ্রাপ্ত মানুষ এবং শিশুদের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায়। যদি সঠিক মাত্রায় শিক্ষা ও অর্থনীতিতে সামাজিক বিনিয়োগ বা “সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট” করা যায়, তাহলে দেশটা দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে। থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশ জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা প্রসারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এই সুযোগটারই সদ্ব্যবহার করেছে। এবং তার ফলে দ্রুত অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ভারতবর্ষ বর্তমানে এমনই একটা জনতাত্ত্বিক মুহূর্তের শিখরে পৌঁছেছে যখন কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৫৯ বছর বয়স) খুব শিগগিরই ৬৪ শতাংশ ছূয়ে ফেলবে। ভারতবর্ষ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারবে কিনা, সেই নিয়ে খবরের কাগজে প্রচুর লেখালিখি চলছে। এর জন্য দরকার আরো স্কুল-কলেজ গড়ে তোলা এবং তরুণদের জন্য আরো অনেক বেশি ট্রেনিং ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা। ভারত কি পারবে তা করে উঠতে? সময়ই তা বলে দেবে।
প্রচ্ছদের ছবি: ভারতের পপুলেশন পিরামিড (জনসংখ্যা মিলিয়নে)– ২০১০ এবং ২০৫০ (সম্ভাব্য)।
সূত্র: ইউনাইটেড নেশনস, ডিপার্টমেন্ট অফ ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স