আমরা সেই কোন ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি যে একটি শক্তিশালী অ্যাসিডকে জলের মধ্যে মিশিয়ে দিলে অ্যাসিডটি তৎক্ষণাৎ একটি হাইড্রোজেন আয়ন (H+) জলকে দান করে আর তার ফলে একটি আয়ন যুগল (ion pair) তৈরী হয়। একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যাক। আমরা সবাই জানি সালফিউরিক অ্যাসিড (H2SO4) একটি শক্তিশালী অ্যাসিড। এটি জলের মধ্যে হাইড্রোজেন আয়ন দান করে নিজে বাইসালফেটে পরিণত হয় আর ওই হাইড্রোজেন আয়ন গ্রহণ করে জল হাইড্রোনিয়াম আয়নে (H3O+) রূপান্তরিত হয়। নিচে সমীকরণটি দেওয়া হলো
H2SO4 + H2O → HSO4– + H+ + H2O → HSO4– + H3O+ – – – – (১)
হাইড্রোজেন আয়নকে প্রোটন নামেও অভিহিত করা হয় কারণ হাইড্রোজেন আয়নে কোনো ইলেক্ট্রন থাকে না, একটিমাত্র প্রোটন থাকে নিউক্লিয়াসে। উপরের সমীকরণটা প্রোটন ট্রান্সফার বিক্রিয়ার একটি অতি সাধারণ পদ্ধতি।
আমাদের মাথার মধ্যে এই ধরণের বিক্রিয়ার এই একটি ছবিই খুব স্পষ্ট ভাবা গাঁথা হয়ে আছে। এটি ছেলেবেলায় আমার অপরিণত মাথায় এমন ভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে কোনো অণুতে একটি হাইড্রোজেন পরমাণু থাকলেই আমি চেষ্টা করতাম কিভাবে ওটিকে হাইড্রোজেন আয়ন হিসেবে বের করে দেওয়া যায়! উদাহরণস্বরূপ কস্টিক সোডা (NaOH) ওই ভুলের স্বীকার হত মাঝে মাঝেই (NaOH → NaO– + H+ !!), যদিও এর জন্য মাস্টারমশাইদের থেকে তিরস্কারও শুনতে হয়েছে বিস্তর!
যাইহোক, এখন জেনে গেছি NaOH ক্ষার, তাই হাইড্রোজেন আয়ন দান করে না। বরং একটি হাইড্রক্সিল আয়ন (OH–) ত্যাগ করে সহজেই। এই ভুল হয়ত আর করব না। কিন্তু শক্তিশালী অ্যাসিড এর বেলায় যে সমীকরণটি (সমীকরণ-১) আমরা জেনে এসেছি সেটিই বা কতটা সত্যি, তা ভাববারও বোধহয় সময় এসেছে। আমার বিশ্বাস, অনেকেই হয়ত আকাশ থেকে পড়বেন যদি বলা হয় এটি সর্বৈব মিথ্যে, কল্পনা প্রসূত এবং বাস্তবের সাথে কোনো মিল নেই ! প্রত্যেকের এরকম ধারণা হওয়াই খুব স্বাভাবিক, কারণ অন্য কোন চিত্র আর তো ভাবাই যায় না।
কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণা এক জায়গাতে কখনই আটকে থাকতে পারে না, আর স্বভাবতই এ ক্ষেত্রেও তা নেই। কিন্তু বিপদ হলো উপরের এই সমীকরণটি যদি মিথ্যে হয় তাহলে তো আমাদের ছোটবেলায় পড়া এই সম্পর্কিত অনেক কিছুই ওলোট পালট হয়ে যাবে। কিন্তু সবকিছু উল্টে গেলেও বাস্তবকে অস্বীকার করার স্পর্ধা না করাই ভালো, আর তাই নতুন কিছু যদি শেখা যায় তাহলে মন্দ কি! আর যদি তা সত্যি প্রমাণিত হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। আচ্ছা তাহলে এখন আমরা একটু উন্মুক্ত মনে শিখতে বসি, জেনে নিই কি ভুল ওই সমীকরণটিতে আর আসল সত্যিটাই বা কি।
প্রোটন ট্রান্সফার বিক্রিয়া ঘটবার সময় আসলে কি হয় তা জানার আগে কয়েকটি বিষয় বলে নেওয়া দরকার। এই বিক্রিয়ায় একটি অণু প্রোটন দান করে আর অন্য একটি অণু তা গ্রহণ করে। যে প্রোটন দান করে তাকে আমরা দাতা আর যে তা গ্রহণ করে তাকে আমরা গ্রহীতা বলে এখানে সম্বোধন করব। ১৯৫২ সালে, প্রফেসর মুলিকেন প্রথম একটি তত্ত্ব খাড়া করলেন। প্রোটন ট্রান্সফারের আগে দাতা আর গ্রহীতার মধ্যে একটি হাইড্রোজেন বন্ধনী গড়ে ওঠে। এবং ঠিক তখন থেকেই কিছু পরিমাণ নিঃসঙ্গ ইলেক্ট্রন যুগল (lone pair of electrons) গ্রহীতার সাথে যে বন্ধনীতে হাইড্রোজেন যুক্ত আছে তার এন্টি-বন্ডিং অরবিটালে চলে আসে। এই ইলেক্ট্রন ট্রান্সফার ঘটে দাতা এবং গ্রহীতার অরবিটাল গুলির ওভারল্যাপ এর জন্য।১ এরকম ইলেক্ট্রন আদান প্রদান অণুতে অণুতে প্রতি নিয়তই চলতে থাকে যতক্ষণ তারা হাইড্রোজেন বন্ধনী দিয়ে আবদ্ধ থাকে।
এখানে একটি বিষয় বলে নেওয়া দরকার। এন্টি-বন্ডিং বা বন্ডিং এই শব্দবন্ধ গুলি ব্যবহার করা হবে মাঝে মাঝে। এগুলি সহজ ভাবে বোঝার জন্য মলিকুলার অরবিটাল তত্ত্বের সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা প্রয়োজন। সীমিত পরিসরে বিশদে বলা এখানে সম্ভব নয়। শুধু এটুকু মাথায় রাখলেই আপাতত চলবে যে কোন সমযোজী বন্ধনী (covalent bond) তৈরী হতে গেলে দুটি পরমাণুর অরবিটাল এর মধ্যে ওভারল্যাপ এর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এর ফলে একটি কম শক্তিসম্পন্ন অরবিটাল, যার নাম বন্ডিং অরবিটাল, আর একটি তুলনামূলক বেশি শক্তিসম্পন্ন এন্টি-বন্ডিং অরবিটালের উৎপত্তি হয়। এখন আউফবাউ নীতি (Aufbau Principle) অনুযায়ী কম শক্তি সম্পন্ন অরবিটালে আগে ইলেক্ট্রন বসাতে হবে তারপর বেশি শক্তিসম্পন্ন অরবিটালে ইলেক্ট্রন বসবে। সুতরাং এক্ষেত্রে বন্ডিং অরবিটালে ইলেক্ট্রন আগে বসবে। যেহেতু পাউলির অপবর্জন নীতি (Pauli’s exculsion principle) বলে একটি অরবিটালে দুটির বেশি ইলেক্ট্রন বসতে পারবে না, উদ্বৃত্ত ইলেক্ট্রন এন্টি-বন্ডিং অরবিটালে যাবে। এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে এন্টি-বন্ডিং অরবিটালে ইলেক্ট্রন যত বেশি হবে সেই বন্ধনিটিও ততই দুর্বল হয়ে পড়বে।
ফিরে আসি আগের আলোচনায়। দুটি অণু যখন একটি হাইড্রোজেন বন্ধনী গঠন করে তখন থেকেই ইলেক্ট্রন আদানপ্রদান চলতে থাকে। যেমন, দুটি জলের অণু যখন কাছাকাছি আসে এবং তাদের মধ্যে একটি হাইড্রোজেন বন্ধনী তৈরী হয় তখন থেকেই ইলেক্ট্রন আদান প্রদানও শুরু হয়ে যায় আর তার ফলে হাইড্রোজেন বন্ধনীটিও আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু ঘটনার সঙ্গে তুলনা করলে এই ব্যাপারটা আরো ভালো বোঝা যাবে। দুটি মানুষ যখন কাছাকাছি আসে, দুজনের মধ্যে একটি বন্ধুত্ব তৈরী হয়, আর ঠিক তখন থেকেই চাওয়া-পাওয়ার, দেনা-পাওনার সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে, আর সেই দেওয়া-নেওয়া থেকেই সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে। একই রকম ভাবে অণু জগতেও এই ঘটনা ঘটে থাকে প্রোটন ট্রান্সফারের সময়।
ইলেক্ট্রন ট্রান্সফার যত হতে থাকে ততই দাতা এবং গ্রহীতা একই সাথে আধানিত হতে থাকে (charged)। যেহেতু দাতার ইলেক্ট্রনেগেটিভিটি হাইড্রোজেন এর থেকে বেশি হয়, তাই গ্রহীতার নিসঙ্গ ইলেক্ট্রন যুগলের একটি অংশ দাতার সাথে যে বন্ধনীতে হাইড্রোজেন পরমানু যুক্ত আছে তার এন্টি বন্ডিং অরবিটালে আসে এবং আসলে দাতার কাছেই থেকে যায়। এর ফলে ওই বন্ধনীটি আরো বেশি সমবর্তিত (polarized) হয়ে পড়ে কারণ সমবর্তনের নিয়মই হলো বন্ধনীর দুই প্রান্তে অবস্থিত দুটি পরমাণুর অসম ইলেক্ট্রন বন্টন। যতই বন্ধনটি সমবর্তিত হয় ততই দাতা আর গ্রহীতার মধ্যে আকর্ষণ বাড়তে থাকে আর তারা আরো কাছাকাছি আসে এবং এর ফলে ইলেক্ট্রন আদান-প্রদান আরো বেড়ে যায়। এই ঘটনা অবিরত চলতেই থাকে আর এর ফলে হাইড্রোজেন বন্ধনীটিও ধীরে ধীরে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যেহেতু ইলেক্ট্রন ট্রান্সফারটি হচ্ছে উপরিউক্ত বন্ধনীর এন্টি-বন্ডিং অরবিটালে তাই এর ফলে ওই বন্ধনীটিও ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে (আগেই বলা হয়েছে যে এন্টি-বন্ডিং অরবিটাল এ ইলেক্ট্রনের বেশি আসা মানেই বন্ধনীর দুর্বলতা)। এখন উদাহরণ দিয়ে উপরের পুরো ব্যাপারটা একটু সহজ করে নিই।
মনে করি A—H হলো একটি শক্তিশালী অ্যাসিড, আর সে B নামক খার কে প্রোটন ট্রান্সফার করবে। সুতরাং এখানে A হলো দাতা আর B হলো গ্রহীতা। এখন উপরিউক্ত ধাপগুলি নিচে এক এক করে উল্লেখ করা যাক:
১. A—H – – – – – B ; প্রথমে তারা কাছাকাছি এসেছে এবং হাইড্রোজেন বন্ধনীতে আবদ্ধ হয়েছে।
২. A—H (এন্টি-বন্ডিং অরবিটাল ) এর ইলেক্ট্রন গ্রহণ B -এর নিঃসঙ্গ ইলেক্ট্রন যুগল (lone pair) থেকে।
৩. B -এর পসিটিভ আর A -এর নেগেটিভ চার্জ এর প্রাপ্তি।
৪. A—H বন্ধনীর দুর্বলতা আর একই সাথে হাইড্রোজেন বন্ধনীর আরো শক্তিবৃদ্ধি।
উপরের এই ধাপগুলি বারংবার আবর্তিত হতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত A—H এতই দুর্বল হয়ে পড়ে যে সেটি ভেঙ্গে যায়, প্রোটন ট্রান্সফার হয় আর তার ফলে A– এবং BH+ আয়ন যুগল তৈরী হয়। এটিই হলো প্রোটন ট্রান্সফার বিক্রিয়ার সর্বশেষ জানা সঠিক পদ্ধতি। একেই বলা হয় “Mulliken Charge Transfer Picture in Proton Transfer Reaction”, যার বাংলা তর্জমা করলে দাড়ায় “প্রোটন ট্রান্সফার বিক্রিয়ার মুলিকেন আধান হস্তান্তর চিত্র”। এই নামটি প্রথম পাওয়া যায় প্রফেসর হাইন্স ও তার সহকর্মীর একটি গবেষণা পত্রে, যেখানে প্রথম দেখানো হয় উপরিউক্ত চিত্রটি হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড তার প্রোটন ট্রান্সফারের সময় সঠিক ভাবে মেনে চলে।২ পরে আরও অনেকের কাজেও একই বিষয় উঠে এসেছে বারবার ।
এই পর্যন্ত এসে একটু থামা দরকার। কারও হয়ত একটি প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে যে এতক্ষণ যা বলা হলো তা কিভাবে প্রমাণ করে যে সমীকরণ-১ আসলে ঠিক নয়। এবার আসব সেই প্রসঙ্গে।
প্রোটন ট্রান্সফারের অনেক আগে থেকেই গ্রহীতা পসিটিভ চার্জ এবং দাতা সমপরিমাণ নেগেটিভ চার্জ লাভ করে এবং এই চার্জের পরিমাণ সর্বোচ্চ মানে পৌঁছায় প্রোটন ট্রান্সফারের ঠিক প্রাক্-মুহূর্তে। যেহেতু A—H বন্ধনীর এন্টি-বন্ডিং অরবিটালে ইলেক্ট্রন ট্রান্সফার হয়ে থাকে তাই A এবং H -এর সমপরিমাণ ইলেক্ট্রন লাভ করার কথা। কিন্তু সাধারণ ভাবে A বেশি ইলেকট্রোনেগেটিভ H -এর তুলনায়, তাই ইলেক্ট্রন ট্রান্সফার এর সাথে সাথে A—H বন্ধনীর সমবর্তনের এর জন্য লব্ধ ইলেক্ট্রনের শতাংশই A -এর কাছে থেকে যায়। আর তার ফলেই H পরমাণু সামান্য পরিমাণ ইলেক্ট্রনও পায় না আর সেই কারণে নিজের কাছে থাকা কিছু পরিমাণ ইলেক্ট্রন নিয়েই A -এর সঙ্গ ত্যাগ করে আর B -এর সাথে মিলে যায়।
এই “কিছু পরিমাণ ইলেক্ট্রন” মানে আসলে তা কত ? H যদি শূন্য ইলেক্ট্রন নিয়ে B -এর সাথে যুক্ত হত তাহলে তাকে প্রকৃতপক্ষে প্রোটন ট্রান্সফার বা হাইড্রোজেন আয়ন ট্রান্সফার বলা যেত। অন্য দিকে ১ টি ইলেক্ট্রন নিয়ে ট্রান্সফার হলে তাকে বলা হত হাইড্রোজেন পরমানু ট্রান্সফার বা H ট্রান্সফার। কিন্তু কোয়ান্টাম কেমিকাল ক্যালকুলেশন করে দেখানো হয়েছে যে এই পরিমাণ হলো ০ আর ১ এর মাঝামাঝি অর্থাৎ প্রায় ০.৫।২ অনেকেই হয়ত শুনে অবাক হচ্ছেন যে এ কেমন কথা! ইলেক্ট্রন আবার ভগ্নাংশ হয় নাকি! কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী ইলেক্ট্রন খুব ছোট বস্তু হওয়ার জন্য তাকে ক্লাসিকাল পদার্থ বলা যায় না। তাই সেই অর্থে সঠিক ভাবে এর অবস্থান এবং ভরবেগ নির্ণয় করা অসম্ভব। ঘনত্ব দিয়ে বোঝা যায় কিছুটা। যেহেতু ঘনত্বর ধারণা এখানে আনতে হয় তাই ভগ্নাংশ হিসবে ভাবতে অসুবিধা কোথায়। সুতরাং যেটা দাড়াচ্ছে যে প্রোটন ট্রান্সফার বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে H -এর ট্রান্সফার আয়ন বা পরমাণু হিসেবে নয়, বরং বলা ভালো তার মাঝামাঝি কোনো অবস্থায়। শুনতে খুব কাল্পনিক শোনালেও এটিই বাস্তব আর বাস্তবকে অস্বীকার না করাই বোধহয় যুক্তিযুক্ত।
এসব জানার পর কি মনে হয়না যে প্রকৃতিকে যতটা সহজ ভাবা হয় তা ঠিক ততটাই কঠিন এবং মজার! এসব মজার ঘটনা প্রতিমুহূর্তেই ঘটে চলেছে, আর তার কতটুকুই বা আমরা জানি বা বুঝি!
সূত্র :
১. রবার্ট মুলিকেন, জার্নাল অব কেমিকাল ফিজিক্স, ১৯৫২, ৫৬, ৮০১–২২।
২. কোজি এন্ডো, জেমস হাইন্স, জার্নাল অব ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি A, ১৯৯৯, ১০৩, ১০৩৯৮-৪০৮।