প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ অবাক দৃষ্টিতে রাতের আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখেছে। চাঁদহীন অন্ধকার রাত্রে, শহরের আলোক-দূষণ থেকে দূরে কোথাও, চারধার খোলা কোন জায়গায় সন্ধ্যা থেকে মেঘমুক্ত আকাশের দিকে তাকালেই লক্ষ্য করবেন অগণিত, নানারকম ঔজ্জ্ব্যলের তারার মেলা। কোথাও তাদের দেখা মেলে বেশি, কোথাও কম, কোনটা খুব ঝকমক করছে, কোনটাকে দেখতে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে। বছরের পর বছর বিভিন্ন দিনে ঠিক সময়ে এদের বারবার দেখা যায়, এটা সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ পর্যবেক্ষণ করেছে। তার ভিত্তিতে তাদের ঘিরে তৈরি হয়েছে কাল্পনিক সব চরিত্র। তারাদের কাল্পনিক রেখায় সংযুক্ত করে, সেই সব চরিত্রানুযায়ী মানুষ, পশু, যন্ত্র ইত্যাদির বিভিন্ন অবয়ব দেওয়া হয়েছে। এদের বলা হয় নক্ষত্র-মণ্ডল, যেমন কালপুরুষ, বৃশ্চিক, বীণা ইত্যাদি। ডিসেম্বর মাসে সন্ধ্যা ৭টায় পুব আকাশে কালপুরুষ মণ্ডলকে উদয় হতে দেখা যায় কিংবা জুলাই মাসের ভোর ৫টায় আবার তাকে পুব আকাশেই উঠতে দেখা যায়। এই ঘড়ির কোন নড়চড় নেই। পৃথিবীর বার্ষিক গতি ও আহ্নিক গতির বড়সড় হেরফের না হলে এর কোন গড়বড় হবেনা।
(বর্ষার শেষে ভোরে লেখকের তোলা কালপুরুষ, বড় কুকুর ও শশক তারামণ্ডলের ছবি। পরের ছবিতে দাগ দিয়ে কল্পনাকে রূপায়িত করা হয়েছে। তৈরী হয়েছে Orion, Canis Major ও Lepus নক্ষত্রমণ্ডল।)
ছবিটা দেখলেই বোঝা যাবে কিভাবে সভ্যতার ক্রমঃবিকাশ আকাশকে কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। মনে মনে কত না ছবি মানুষ এঁকেছে এই তারাদের ঘিরে। কেননা এর মধ্যে দিয়ে সে শিখেছে দিন গুনতে, দিক ঠিক করতে আর ধর্মের ভীতির মধ্যে নিজেকে আষ্টে-পৃষ্টে বাঁধতে। প্রকৃতির ঘড়ির উপর তার নির্ভরশীলতা যত বেড়েছিল, ততই সে আকাশ সম্পর্কে আরও বেশি জানতে আগ্রহী হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞান হয়ে উঠল প্রাচীনতম বিজ্ঞান। সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা খালি চোখে দেখা যায় এমন তারার সংখ্যা মাত্র সাড়ে ছয় হাজারের কাছাকাছি। সেগুলোকে প্রথম তালিকাভুক্ত করেন হিপ্পার্কাস্, যদিও তাদের অবস্থান সম্পর্কে কোন ধারণা সে সময় ছিলনা। দূরবীনের ব্যবহার শুরু না হওয়া পর্যন্ত এইটুকুই জানতাম যে আমাদের থেকে তারারা অনেক দূরে আছে।
আকাশের বুক চিরে উত্তর থেকে দক্ষিণে নক্ষত্রদের মধ্যে দিয়ে একটা আবছা আলোর পটির অস্তিত্ত্ব খেয়াল করলেই দেখা যায়। বর্ষার সময় বৃষ্টিধৌত চাঁদহীন মেঘমুক্ত সন্ধ্যার আকাশে, বৃশ্চিক ও ধনু নক্ষত্রমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে ভাসমান পেঁজা তুলো বা আবছা সাদা মেঘের মত, খালি চোখে পরিষ্কার দেখা যায়। উত্তরে সেটি ঈগল, হংস পেরিয়ে ক্যাসিওপিয়া, পারসিয়ুস ঘুরে কালপুরুষের পাশ দিয়ে আবার দক্ষিণ মুখী হয়। তখন তার চেহারা অনেক আবছা। নানান জায়গায় বিভিন্ন পরিসর, ঔজ্জ্বল্য নিয়ে রাতের আকাশকে এই ছায়াপথ আকর্ষণীয় করে তোলে।
(লেখকের তোলা ছায়াপথের ছবি, উজ্জ্বল নক্ষত্রটি শ্রবণা। কালো এলাকাগুলো গ্যাস ও ধুলো, সাদাটা তারায় ভরা।)
প্রাচীনকালে ভারতীয়রা মনে করত এটি স্বর্গের সিঁড়ি। স্কাণ্ডিনেভিয়ান উপজাতিদেরও একই অভিমত ছিল। চীনারা ভেবেছিল এই নদীটা শ্রবণা ও অভিজিৎ এর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাদের আলাদা করে দিয়েছে। মিশরীয়রা মনে করত ওটি বোধহয় স্বর্গের নীল নদ। গ্রীকদের কাছে এটি ছিল দেবী হেরার বুকের দুধের প্রবাহ, তার থেকেই হয়তো ইংরাজী নাম “মিল্কি ওয়ে” এসেছে। ভারতীয় পুরাণে একে বলা হয়েছে “আকাশ গঙ্গা”। এই গঙ্গাই স্বর্গ, অন্তরীক্ষ ও পৃথিবীর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
গ্যালিলিও প্রথম দূরবীনের সাহায্যে লক্ষ্য করলেন আকাশ গঙ্গা আসলে অসংখ্য নক্ষত্রের সমাহার। তারপর বিভিন্ন অনুসন্ধানে আমরা জেনেছি যে প্রায় ১০ হাজার কোটি নক্ষত্র, অসংখ্য গ্যাস-পুঞ্জ আর বিশাল বিশাল আকারের অগুনতি ধূলোর মেঘ চাকতির আকারে আবর্তন করে চলেছে। এইভাবে সৃষ্ট নক্ষত্রের সমাহারকে “Galaxy” বা “তারা-জগৎ” বা “নক্ষত্র-জগৎ” বলে। আমাদের এই নক্ষত্র-জগৎকে “ছায়াপথ নক্ষত্র-জগৎ” বা “Milky Way galaxy” বলে। আমাদের মাথার উপরে চাকতিটির কেন্দ্র ও ধারের দিকে তারাদের অবস্থান অনেক বেশি বলে, সেদিকে তারাগুলোকে আলাদা করে দেখা যায় না। তাই সেটা অস্পষ্ট সাদা মেঘের মত দেখায়। সেই দৃশ্য থেকেই যত গল্পকথার উৎপত্তি।
আমাদের এই ছায়াপথ তারা-জগতের ১০ হাজার কোটি তারাদের সবাইকে তো আর দেখতে পাই না। গ্যাস ও ধুলোর আড়ালে কত যে লুকিয়ে আছে। চাকতির ব্যাস প্রায় ১ লক্ষ আলোক-বর্ষ। অর্থাৎ সেকেণ্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার বেগে ধাবমান আলো এই তারা-জগৎকে এপার ওপার করতে ১ লক্ষ বছর নেবে। আমাদের প্রাণদাতা সূর্য এই নক্ষত্র-জগতের কেন্দ্র থেকে ২৬ হাজার আলোক-বর্ষ দূরে। তার সৌরজগতকে নিয়ে সেকেণ্ডে ২৪০ কিলোমিটার বেগে সেই কেন্দ্রকে আবর্তন করে চলেছে। একটি পাক সম্পুর্ণ করতে সময় লাগবে সাড়ে ২২ কোটি বছর।
আমাদের গ্যালাক্সির চেহারা শিউলি ফুলের ছড়িয়ে থাকা পাপড়ির মতন। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, এই নক্ষত্রজগতের কেন্দ্রে আছে একটি বিশাল “কৃষ্ণগহ্বর(Black hole)” যার ভর প্রায় ৩০ লাখ সূর্যের ভরের সমান, ব্যাস মাত্র ২২ কোটি কিলোমিটার। শনির কক্ষপথের চেয়ে ছোট স্থানে এতটা ভরের অস্তিত্ত্ব কৃষ্ণগহ্বরকেই সমর্থন করে। এই কেন্দ্রের খুব কাছে একটি তীব্র রেডিয়ো-তরঙ্গের উৎস আছে যার নাম “সাজিটারিয়াস এ (Sagittarius A)”।
কেন্দ্রের চার ধারে তারায় ঠাসা ঘন অঞ্চল্টিকে বলা হয় “স্ফীত অঞ্চল (Bulge)”। স্ফীত অঞ্চল থেকে পাপড়ির মত বেরিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটি বাহু যেগুলি আবার কেন্দ্রকে কুণ্ডলিত চেহারায় ঘিরে ধরে আবর্তন করছে। এই অঞ্চলকে বলা হয় “চাকতি (Disk)”। এই চাকতির মধ্যে বেশ কয়েকটি কুণ্ডলিত বাহু (Arm) আছে। কেন্দ্রের দিকে বাহুটি হচ্ছে “ধনু বাহু”, তার পরের কুণ্ডলীটি “কালপুরুষ বাহু” আর এর পরেরটি “পার্সিয়ূস বাহু”। আমাদের সূর্য কালপুরুষ বাহুর একটি প্রশাখায় আছে। এছাড়া “নরমা বাহু” ও “স্কুটাম-সেন্টরাস বাহু” উল্লেখযোগ্য কুণ্ডলিত শাখা।
ছায়াপথের চাকতির তল থেকে ওপরে ও নিচে কিছু বর্তুলাকার (গোলাকার বা বলায়াকার) নক্ষত্রগুচ্ছ দেখতে পাওয়া যায়। যাদের নিয়ে গঠিত ওই অঞ্চলগুলিকে ছায়াপথের “বর্ণ-বলয়(Halo)” বলা হয়। ওই অঞ্চলে প্রায় ২০০টি বিশালাকৃতি বর্তুলাকার নক্ষত্রগুচ্ছ আছে যাদের এক একটিতে গড়ে লক্ষাধিক সূর্যের মত ভরযুক্ত তারা আছে।
(লেখকের তোলা ছায়াপথের কেন্দ্র অঞ্চলের ছবি)
ছায়াপথ নক্ষত্র-জগতে দুই ধরণের তারা দেখতে পাওয়া যায় যাদের ভিত্তিতে ছায়াপথের অঞ্চলগুলিকে বিভাজিত করা হয়েছে। এক, বয়সে নবীন “প্রথম শ্রেণীর নক্ষত্র (Population I)”। নীল রঙের উজ্জ্বল এই তারাগুলোর মধ্যে ভারী মৌলগুলিকে পাওয়া যায়। এগুলির দেখা মেলে কুণ্ডলিত বাহুগুলোয়। দুই, “দ্বিতীয় শ্রেণীর নক্ষত্র (Population II)”। এরা বয়সে প্রবীণ এবং এদের মধ্যে ধাতব ভারী মৌলগুলি দেখা যায়না। লাল রঙয়ের এই তারাগুলোকে দেখা যায় বর্ণ-মণ্ডলের বর্তুলাকার নক্ষত্রগুচ্ছগুলিতে।
এই বর্তুলাকার নক্ষত্রগুচ্ছগুলি ছায়াপথ নক্ষত্র-জগতের কেন্দ্রকে অতি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে আবর্তন করছে। দৃশ্যমান নক্ষত্রগুলির আবর্তন বেগ মেপে দেখা গেছে যে এদের দূরত্বের সাথে বেগের সম্পর্ক সৌরজগতের মত নয়। অর্থাৎ শুধুমাত্র কেন্দ্রের বিশাল ভরের মহাকর্ষ বলের জন্য সেগুলি আবর্তিত হলে যে বেগ তাদের হত এখানে তা হচ্ছেনা। দূরবর্তী বস্তুগুলোর বেগ তার চেয়ে বেশী। সেজন্য ধারণা হল আমাদের তারা-জগতে প্রচুর “অদৃশ্য বস্তু (Dark matter)” আছে, যাদের আকর্ষণে বস্তুগুলোর আবর্তন বেগ বেড়ে যাচ্ছে। আর সেই অদৃশ্য বস্তু পরিমাণ অনেক বেশী। নক্ষত্র-জগতগুলোয় শতকরা ৯০ ভাগ অদৃশ্য বস্তু ও বাকী ১০ ভাগ দৃশ্য বস্তু।
এই মহাবিশ্বে লক্ষ লক্ষ লক্ষ ….. কোটি তারা-জগত আছে। আদের মধ্যে আবার ছোট বড় দলাদলি আছে। আমাদের ছায়াপথের নিকটবর্তী “বৃহৎ মাজেলানিক মেঘ (Large Magelanic Cloud)”, “ছোট মাজেলানিক মেঘ(Small Magelanic Cloud)”, (এই দুটি নক্ষত্র-জগতকে দক্ষিণ গোলার্ধে খালি চোখে রাতের আকাশে দেখা যায়), “ধনুরাশির বামন উপবৃত্তাকার তারা-জগত (Sagittarius Dwarf Eliptical Galaxy)”, “বড় কুকুর মণ্ডলের বামন তারা-জগত (Canis Major Dwarf Galaxy)”, “অতি ঘন বামন তারা-জগত (Ultra Compact Dwarf Galaxy)” ইত্যাদি নক্ষত্র-জগতদের নিয়ে একটা পাড়া তৈরি করেছে।
এই পাড়া আবার “অ্যাণ্ড্রোমিডা তারা-জগত (M31 নামে সুপরিচিত,Andromeda Galaxy)” ও “ট্র্যাঙ্গুলাম তারা-জগত (M 33 নামে পরিচিত,Triangulam Galaxy)” মিলে “আঞ্চলিক গোষ্ঠী (Local Group)” তৈরি করেছে। এই গোষ্ঠীর অনান্য সদস্যরা হল NGC 6822, NGC 205, NGC 147, IC 1613 ইত্যাদি।
শরৎকালে সন্ধ্যাবেলায় বা গরমকালে ভোরবেলায় চাঁদহীন আকাশে অন্তত একবার ছায়াপথের মুখোমুখি হওয়া প্রত্যেকের দরকার। আকাশের সৌন্দর্য্য আর নিজেদের ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র অস্তিত্ব সম্পর্কে তবেই ওয়াকিবহাল হওয়া যায়।
কিছু তথ্য উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত। লেখকের তোলা ছবি ছাড়া বাকি ছবির সূত্র: