মহাকাশ অভিযানে একটা নতুন অধ্যায় জুড়ল গত বছর। পৃথিবী, বুধ, শুক্র, শনি, চাঁদ, গ্রহাণু — সব সেরে একটা ধূমকেতুর উপর কৃত্রিম উপগ্রহ বসালাম আমরা। ধূমকেতু 67P/Churyumov-Gerasimenko সেই উপগ্রহকে বগলদাবা করে এখন সূর্যের দিকে চলেছে। সাথে সাথে পটাপট ছবি আসছে গবেষণাগারে। আশা করা যাচ্ছে, ২০১৫-র ডিসেম্বরে যখন মিশন শেষ হবে, তার মধ্যে ধূমকেতু ঘিরে অনেক রহস্যের কিনারা করা যাবে। বিশেষত, পৃথিবীর আজকের ভূগোলের পিছনে কোনো ধূমকেতুর ভূমিকা আছে কিনা, সেই প্রশ্নের একটা হিল্লে হতে পারে।
ধূমকেতু বললেই মাথায় আসে আকাশে লেজুড়ওয়ালা একটা আলোর গোলা, লেজুড়টা ধোঁয়াটে। তীরবেগে আকাশ চিরে না জানি কোথায় চলেছে। অদ্ভূত তাদের কক্ষপথ। ক্ষণিকের জন্য তারা সূর্যের কাছে এসে পড়ে, তবে বেশিরভাগ সময়টাই তাদের কাটে সৌরজগতের দূর দূরন্তে। এখন মোটামুটি নিশ্চিতভাবে জানা গেছে যে ওই ধোঁয়াটে লেজুড়টা আসলে জলীয় বাষ্প। হ্যাঁ, বরফ গলে জল, জল থেকে বাষ্প, সেই বাষ্প।
বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন যে পৃথিবীর জলের উৎস হয়ত কোনো বহিরাগত ধূমকেতু। সৃষ্টির আদিম কালে, যখন পৃথিবী ছিল একটা জ্বলন্ত গোলা, জল তৈরী হলেও তা কবেই উবে যাওয়ার কথা। এখনকার থৈ থৈ জলের একটা ব্যাখ্যা খুঁজতে বিজ্ঞানীরা তাই ধূমকেতুর দিকে তাকান। তবে এটা একটা থিওরি মাত্র। থিওরি প্রমাণ করতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। ধূমকেতু দেখাই যায় কালেভদ্রে, তার উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা কিসের? কিন্তু, এবার সেটা সম্ভব। ধূমকেতু 67P/Churyumov-Gerasimenko-র চারিদিকে এখন একটা চলমান ল্যাবরেটরি পাক খাচ্ছে। সে যেখানে যাবে, ল্যাবরেটরিটাও তার গলার মাদুলি হয়ে সাথে সাথে যাবে।
স্রেফ প্রযুক্তির দিক থেকে এই অভিযানের সাফল্য একটা সাংঘাতিক কীর্তি। কেন, সেটা বুঝতে হলে ২০১৪-র ক্লাইম্যাক্সটুকু দেখলেই চলবে না। ২০০৪-এর মার্চ মাসে যখন Rosetta মহাকাশযানটিকে ছাড়া হয়েছিল, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সীর বিজ্ঞানীরা ধূমকেতুর কক্ষপথ যেটা জানতেন, সেটা ১০০ কি.মি. এদিক ওদিক হতে পারে। ১০ বছর পর, এখন Rosetta ধূমকেতুর চারিদিকে গ্যাঁট হয়ে ঘুরছে। তার কক্ষপথের গড় ব্যাসার্ধই ১০০ কি.মি.-এর কম। সবচেয়ে কাছে যখন আসছে ধূমকেতুর, দূরত্মটা ২৯ কি.মি. মত। এই মাঝের ১০ বছরে অনেক ঝক্কি গেছে। মহাকাশে থাকাকালীন যানটির গতিপথ পরিবর্তন করতে হয়েছে। যত ধূমকেতুর কক্ষপথ সম্বন্ধে আরও সুনির্দিষ্টভাবে জানা গেছে, তত মহাকাশযানটির গতি বাড়ানোর প্রয়োজন হয়েছে।
একটা জনমানবহীন মহাকাশযানের গতি দুম করে বাড়ানো কমানো মুখের কথা নয়। রকেট ব্যবহার করাই যায়। মহাকাশযান থেকে রকেট ছাড়বে আর মোটরবাইকের কিক-স্টার্টের মত তাতে গতি বেড়ে যাবে। তবে তাতে জ্বালানি যা লাগে সেই জ্বালানি ঘাড়ে করে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ছাড়াও একটা সমস্যা। খরচসাপেক্ষ-ও বটে। সেটা এড়াতে, সেই সোভিয়েত স্বর্ণযুগ থেকেই, মহাকাশযান পরিচালনায় একটা নতুন পন্থা অবলম্বন করা হয় মাঝেমাঝে। একে বলে gravity assist বা মাধ্যাকর্ষণের মদতদান। চট করে বললে, একটা মহাকাশযান যদি অধিবৃত্ত আকারের কক্ষে একটা গ্রহের মাধ্যাকর্ষণের কবলে ঢোকে, আধপাক মত খেয়ে সেটা যখন বেরোবে, তার গতির মধ্যে গ্রহের গতির প্রায় দ্বিগুণ জুড়ে যাবে। শক্তি বা ভরবেগের সংরক্ষণ ভাঙ্গেনা এতে, কারণ গ্রহের ভরবেগ কিছু কমে যায়। শুধু দৈত্যের মত ভর বলে গতি এতটাই সামান্য কমে যে কেউ টের পায়না। এই পদ্ধতিতে বিনা জ্বালানি খরচে মহাকাশযানের গতি বাড়ানো যায়।
এই gravity assist সবসময় ব্যবহার করা যায় না, কারণ মহাকাশযানের জন্য যেমনটি চাই, সেরকম অবস্থায় কোনো গ্রহ থাকবে, এমন কেউ কথা দেয়নি। তবে Rosetta-র জন্য এই পদ্ধতিটি বারকয়েক ব্যবহার হয়েছিল। কখনো পৃথিবী, কখনো মঙ্গলগ্রহের মাধ্যাকর্ষণ ব্যবহার করে গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছিল। মঙ্গলগ্রহের সময় Rosetta পড়ে গেছিল গ্রহের ছায়ায়। সোলার প্যানেল বেকার হয়ে গেছিল, তাই ব্যাটারীতে চলছিল মহাকাশযানটি। একবার কক্ষপথে ছেড়ে দেওয়ার পর ব্যাটারী বাঁচাতে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ মাঝখানে বিছিন্ন করা হয়েছিল। ভেবে দেখুন, বিজ্ঞানীদের বুক ধুকপুক অবস্থা!
যাক, সব ভালো যার শেষ ভালো। দশ বছর মহাকাশে চক্কর কেটে Rosetta তার গন্তব্যে পৌঁছেছে। পুরো যে প্ল্যানমাফিক গেছে, সেটাও বলা ঠিক না। Rosetta মিশনের আরও দুঃসাহসী প্ল্যান ছিল। 67P/Churyumov-Gerasimenko -র উপর একটা ল্যান্ডার নামানোরও কথা ছিল। Philae নাম তার। উদ্দেশ্য ছিল: শুধু ছবি নয়, ধূমকেতুর উপর ড্রিল দিয়ে ফুটো করে তার নিচে কি আছে, সেই খোঁজ নেওয়া। যেহেতু ধূমকেতুর উপর অনর্গল গ্যাস নির্গত হচ্ছে, তাই ল্যান্ডারকে অক্ষত নামানোটাও একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ছ’ সপ্তাহের খোঁজের পর একটা ল্যান্ডিং সাইট বাছা হয়েছিল, যেটা তুলনায় সুরক্ষিত। ১২ নভেম্বর Philae তার মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধূমকেতুর উপর নামা শুরু করলো। নামলো-ও সেই দিন-ই, কিন্তু গোল বাধলো নামার পরেই। ধূমকেতুর পিঠের উপর যাতে ল্যান্ডারটা আঁকড়ে বসতে পারে, তাই হারপুন, স্ক্রু সবের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু কি কঠোর জমির উপর নামতে হবে, সেটা বোধহয় আন্দাজ করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।
ল্যান্ডারটা জমির উপর আছাড় খেয়ে শুন্যে উঠলো। এতোটাই যে আরেকটু উঠলে ধূমকেতুর মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে বেরিয়ে আসতো। দ্বিতীয়বার নামার পর ডিগবাজি খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এমন এক খাঁজে এসে থামল, যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছয় না। তার ব্যাটারী-ও রিচার্জ করা গেল না, যোগাযোগ-ও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বিজ্ঞানীদের তবু আশা মরেনি। ধূমকেতু সূর্যের দিকে এগোচ্ছে। আশা করা হচ্ছে এমন এক সময় আসবে যখন সেই খাঁজটাও আলোকিত হয়ে উঠবে। ব্যাস, তড়াক করে জেগে উঠবে Philae। তবে আপাতত সেই যজ্ঞের ইতি।
তবে ওটা হলে বাড়তি পাওনা হত। মিশনটাকে মোটামুটি সফলই বলা চলে। ইতিমধ্যেই এই সাফল্যের কিছু সুফলও আসতে শুরু হয়েছে। মহাকাশযানের মধ্যে থাকা একটা mass spectrometer-এর সাহায্যে ধূমকেতু থেকে নির্গত বাষ্পে হাইড্রোজেন (H) আর তার ভারী জমজ ডিউটেরিয়াম (D), এই দুইয়ের অনুপাত খুব সুক্ষ্মভাবে মাপা গেছে। সেটা পৃথিবীতে মাপা D/H অনুপাতের থেকে তিন গুণেরও বেশি। এখনো অব্দি যে সব ধূমকেতুর D/H অনুপাত মাপা হয়েছিল, তার উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা একটা সুন্দর গল্প সাজিয়েছিলেন। সেই গল্পটা ঘেঁটে গেছে এই নতুন তথ্য আসার ফলে। নতুন করে ভাবতে বসেছেন বিজ্ঞানীরা।
গল্পটা কি? তার আগে একটা ছোট্ট ভূমিকা। মহাকাশে আপাতত দুটো জায়গা আলাদা করা গেছে, যেখান থেকে ধূমকেতুর আমদানি হয়। সূর্য থেকে শুরু করে বাইরের দিকে বেরোলে প্রথম জায়গাটা আসবে নেপচুনের ঠিক পরে। যেহেতু বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণ এদের কক্ষপথ নির্ণয় করে, এখান থেকে আসা ধূমকেতুগুলোকে বলে Jupiter family comets ( JFC ) । আর দ্বিতীয় ঘাঁটিটা সৌরজগতের একেবারে সীমানায়। একটা ঘন মেঘের মত জাপটে আছে সৌরজগতটাকে। এখান থেকে আসা ধূমকেতুগুলোকে বলে Oort cloud comets ( OCC ) । হ্যালির ধূমকেতুর কথা আমরা শুনেছি, সেটার Oort মেঘমুলুক থেকে জন্ম।
বিজ্ঞানীরা প্রথম প্রথম বলতেন, সৌরজগতে D/H অনুপাত সূর্য থেকে যত দূরে যাওয়া হবে, তত বাড়বে। কিছু মডেল দেওয়া হয়েছিল তার। প্রথম প্রথম যে সব তথ্যগুলি পাওয়া গেছিল, সেগুলো কিছু OCC-র D/H অনুপাত মেপে। তাতে এই গল্পটা খাটছিল বেশ ভালো । সদ্য কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে JFC-গুলোকে নিয়ে। তাদের D/H অনুপাত দেখা গেছে পৃথিবীর কাছাকাছি প্রায়। এর ফলে দুটো জিনিস হলো। এক, মডেল পালটাতে হলো, কারণ পৃথিবী থেকে নেপচুনের দূরত্ম বেশ খানিকটা। কাছাকাছি D/H অনুপাত হওয়া সম্ভব নয় পুরনো মডেল অনুযায়ী। দুই, পৃথিবীর জলের পিছনে কিছু JFC-র হাত আছে, এমন মনে করা হলো।
এইসব কিছুর মধ্যে এলো Rosetta-র মাপা D/H অনুপাত। ধূমকেতু 67P/Churyumov-Gerasimenko JFC পরিবারের সদস্য আর এই মাপটা আগের JFCগুলোর সাথে একেবারেই মেলে না। বিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন, সোজাসাপটা মডেল দিয়ে সব ধূমকেতুকে বোঝা যাবে না। আর পৃথিবীর জলের পিছনে ধূমকেতুর বদলে বা সাথে সাথে গ্রহাণু বা asteroid -এরও অবদান থাকতে পারে এমন মনে করা হচ্ছে।
তবে এইতো খেলা শুরু। ধূমকেতু যত সূর্যের দিকে যাবে, তার উপর জমে থাকা বরফ আরো ব্যাপক হারে উবে যেতে থাকবে, এবং আরও সুক্ষ্মভাবে মাপা যাবে সেই বরফের গঠন। আরো কত চমক বাকি আছে কে জানে। সৃষ্টির আদিম কালের সাক্ষী ধূমকেতু বা গ্রহাণুগুলি। খোদ একটা ধূমকেতুর উপরই উপগ্রহ বসিয়ে সেই সাক্ষীকে জেরা করার এক অভূতপূর্ব সুযোগ পাওয়া গেছে।
ছবি: ইউরোপীয় সাইন্স এজেন্সীর ব্লগ