সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে সব কিছুই ফিকে হয়, ইতিহাস আধুনিক থেকে প্রাচীন হয়। ঐতিহ্য অবশ্য বিবর্ণ হয় না। সেই ঐতিহ্যেরই অঙ্গ জগদীশচন্দ্র বসু। ছোটবেলায় বলতে শিখেছিলাম, ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। পরবর্তীকালে দেখেছি এই কৃতিত্ব অন্যান্যদের ভাগে পড়তে পারে। যেমন ১৮১৩ সালে জন্মানো রাধানাথ শিকদার যিনি ছিলেন দুর্দান্ত একজন গণিতবিদ। ডিরোজিও-র একনিষ্ঠ ভক্ত এই ব্যক্তি চিহ্নিত করেছিলেন পিক ফিফটিন। সেটাই মাউন্ট এভারেস্ট, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ১৮৫৫ সালে জন্মানো প্রমথনাথ বসু-ও অনেক আগে ভূ- বিজ্ঞানী এবং জীবাশ্মবিদ হিসাবে নিজের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে ছোটবেলায় শেখা ওই বিবৃতিটা হয়ত পাল্টাতে হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানী হিসাবে জগদীশচন্দ্রের জায়গা ইতিহাসের বিচারে একটুও নড়বে না। ভাবনা এবং গবেষণার দিক থেকে নিজের সময়ের থেকে একশো বছর এগিয়ে ছিলেন তিনি।
বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন জগদীশচন্দ্র। খুব ছোট মাপের তরঙ্গ উত্পাদন করা তাঁর প্রথম কৃতিত্ব। একেই বলা হয় মিলিমিটার ওয়েভ বা ভাষান্তরে মাইক্রোওয়েভ। হাইনরিখ হার্ৎজ শুরু করেছিলেন তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের উত্পাদন কিন্তু এত ছোট তরঙ্গ উত্পাদন করতে পারেন নি তিনি। ফলে এই কাজটা যেমন উল্লেখযোগ্য তেমনি পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য ছোট দৈর্ঘ্যের তরঙ্গকে নির্দেশ করার জন্য গ্রাহক যন্ত্র উদ্ভাবন করা। এই গ্রাহক যন্ত্রের প্রাণভোমরা ছিল একটা বিশেষ ব্যবস্থা যার নাম কোহরার। সজ্জাটা খুব সাধারণ। ইংরেজি ইউ অক্ষরের মত দেখতে একটা নলে পারদ ও লোহার সমন্বয়ে এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন যা নিরবিচ্ছিন্নভাবে তড়িচুম্বকীয় তরঙ্গ গ্রহণ করতে পারে। তখনকার দিনে অন্যান্য কোহরার ব্যবস্থায় একটা অবসাদ আসত। একবার সঙ্কেত নেওয়ার পর নাড়া দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে সেগুলোকে কার্যকরী করতে হত। জগদীশচন্দ্রের কোহরার যন্ত্রে এই ত্রুটি ছিল না। এই কোহরারের নকশাই ইতালিয় প্রযুক্তিবিদ গুগলিয়েলমো মার্কনি চুরি করেন বলে অভিযোগ করা হয়। এ নিয়ে বিজ্ঞানী প্রবীর কুমার বন্দোপাধ্যায়ের লেখায় মার্কনির চুরির ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জগদীশচন্দ্র গ্যালেনা কৃস্ট্যালের সঙ্গে ধাতব তারের সংযোগ ঘটিয়ে আরও একটা নির্দেশক তৈরি করেন। ১৯০১ সালে আমেরিকায় তিনি এ সম্পর্কে এক পেটেন্ট আবেদন দাখিল করেন। ১৯০৪ সালে তাঁকে পেটেন্ট অধিকার দেওয়া হয় Detector for Electrical Disturbances-এর জন্য। পেটেন্ট ক্রমাঙ্ক ছিল ৭৫৫৮৪০, এটা বিশ্বের প্রথম সেমিকন্ডাক্টর যন্ত্র যা বেতার তরঙ্গ গ্রহণ করতে সক্ষম।
এই সব কাজ করতে গিয়ে জগদীশচন্দ্র যে সব যন্ত্র গড়ে তোলেন তার সূক্ষ্মতা আজও আমাদের বিস্মিত করে। কোহরারের কথা তো বলেইছি। মিলিমিটার তরঙ্গ তৈরি করতে গিয়ে জগদীশচন্দ্র যে স্ফূলিঙ্গ (স্পার্ক) সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা গড়ে তোলেন তা সেই সময়ের নিরিখে অনবদ্য। গ্যালেনা-নির্ভর যন্ত্রের ক্ষেত্রেও তিনি অসামান্য উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখান। হাই স্কুলের পাঠ্যক্রমে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করার কথা আমরা ভাবি না কেন ?
যন্ত্রবিদের এই সূক্ষ্মতার সাধনা আমরা দেখতে পাই তাঁর উদ্ভিদ সংক্রান্ত গবেষণাতেও। ক্রেস্কোগ্রাফ তাঁর অমূল্য অবদান। গাছের মধ্যে দিয়ে জলের আরোহণের কথা ধরা যাক। ডিক্সন আর জলি ১৮৯৪ সালে বলেছিলেন যে গাছের পাতা থেকে জলের বাষ্পায়নের ফলে একটা টান তৈরি হয়। সেই টান প্রযুক্ত হয় জলের স্তম্ভের উপর। কীভাবে তৈরি হয় এই স্তম্ভ ? জলের অণুদের নিজেদের মধ্যে আসঞ্জন বল এবং উদ্ভিদের জাইলেমের সঙ্গে জলের আন্তঃ-আকর্ষণের ফলে। সেটাই গৃহীত হয়েছিল বিজ্ঞানী মহলে। জগদীশচন্দ্র একমত হন নি। তিনি মানতে চান নি যে এভাবে জল ওঠে শেকড় থেকে পাতা পর্যন্ত। ওনার যুক্তি ছিল গাছের শরীরে তৈরি হওয়া হাওয়ার বুদবুদ কখনই এত বড় স্তম্ভ তৈরি হতে দেবে না। জগদীশচন্দ্রের নিজের তত্ত্ব ছিল অন্যরকম। তিনি বলেছিলেন, বহিঃত্বক বা এপিডার্মিসের নীচে থাকা কর্টেক্সের কোষের ছন্দোবদ্ধ সঙ্কোচন-প্রসারণে জল প্রবেশ করে জাইলেমের মধ্যে এবং উপরদিকে একটা চাপ তৈরি হয়। কীভাবে প্রমাণ হবে এটা ? তিনি ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্রের ইলেক্ট্রোড-কে কর্টেক্সের বিভিন্ন গভীরতায় প্রবেশ করিয়ে গ্যালভানোমিটারে কাঁটার বিক্ষেপ দেখেন। বেশি গভীরতায় বিক্ষেপ অত্যন্ত বেশি হয়। জগদীশচন্দ্র খুঁজে পান তাঁর কাঙ্খিত তড়িৎ সঙ্কেত। এই তাড়িতিক স্পন্দনকে জলের উত্থানের জন্য দায়ী বলে মানতে চায় নি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানী মহল। বেনেডিক্ট গত শতাব্দীর শেষে দেখান জগদীশচন্দ্রের দেখানো স্পন্দন জলের উত্থানের হারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেপার্ড সবটা মেনে নিয়েও ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বিজ্ঞানী ক্যানি-র এক গবেষণার দিকে আমাদের দৃষ্টি ঘুরিয়েছেন। ক্যানি জলীয় চাপ সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেটা যদি গৃহীত হয় তবে ডিক্সন আর জলির বহু পুরনো তত্ত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। শেপার্ডের আশা, তখন হয়ত জগদীশচন্দ্রের Ascent of Sap তত্ত্ব নতুনভাবে দেখা হবে।
তবে উদ্ভিদবিজ্ঞানে জগদীশচন্দ্রের মূল অবদান কোষের তাড়িতিক ক্রিয়াকে তুলে ধরা। বনচাঁড়াল আর লজ্জাবতী গাছ নিয়ে পীড়ন এবং তার প্রতিক্রিয়ার যে সব পরীক্ষা তিনি করেছিলেন তা উদ্ভিদ কোষে তাড়িতিক ক্রিয়ার প্রমাণ তুলে ধরে। কোনো পীড়নের সঙ্কেত অতি ক্ষুদ্র মানের তড়িৎপ্রবাহের সাহায্যে পৌঁছে যায় লজ্জাবতীর পাতার বোঁটা আর শাখার সংযোগস্থলে (পালভিনাস) আর পাতাকে বুজে যেতে সাহায্য করে। এই যে গ্রাহক পাতা আর চালক (মোটর) অঙ্গ পালভিনাসের মধ্যে তড়িৎসঙ্কেতের আদানপ্রদান এটাই জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার। যে উদ্ভিদবিজ্ঞান কেবল রাসায়নিক সঙ্কেত ‘অক্সিন’ নিয়ে মেতে ছিল তাকে নতুন দিশা দেন বাংলার জগদীশচন্দ্র।
নোবেলজয়ী নেভিল মট বলেছিলেন, নিজের সময়ের থেকে ষাট বছর এগিয়ে জগদীশচন্দ্র। সাহেব যে ভুল বলেন নি তা আজও প্রমাণিত হচ্ছে।
Graphics: Rounak Bhattacharjee
জগদীশচন্দ্র বসু’র লেখা ‘অব্যক্ত’ অনলাইনে সংরক্ষিত লেখা পড়তে পারবেন ইন্টারনেটে নীচের দেওয়া link-টিতে।