আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও যখন বৃহস্পতির চারপাশে তার উপগ্রহের পরিক্রমা পর্যবেক্ষণ করে ভূ-কেন্দ্রিক জগতের ধারণা নস্যাৎ করে দিয়ে আলোড়ন ফেলেছিলেন ঠিক তেমনই সম্প্রতি তাঁরই আবিষ্কৃত বৃহস্পতির এক উপগ্রহ Europa-কে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ১৯৯৫ সালে পাঠানো মহাকাশযান ‘Galileo’- র মারফৎ বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে কিছু অভাবনীয় ছবি। ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত Europa-র চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে তোলা ছবিগুলো থেকে এটা বেশ পরিস্কার যে উপগ্রহটির উপরিতল শুধু বরফাবৃতই নয় তার নিচের গোটাটাই জুড়ে রয়েছে বিশাল এক মহাসমুদ্র। ছবিগুলোকে গভীর ভাবে পরীক্ষা করার ফলে বিজ্ঞানীদের নজরে এসেছে মহাসমুদ্রের উপর ভাসমান বরফস্তরগুলির নড়া-চড়া। ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছে সেটা জানার আগে আমরা একটু বুঝে নিই ‘প্লেট টেক্টনিক্স’-এর তত্ত্ব।
পৃথিবীতেই ঘটা উদাহরণ দেখা যাক। পৃথিবীর সবচেয়ে যে উপরিতলে আমরা বসে আছি সেগুলি আসলে ভাসমান ভূস্তর আর এই ভাসমান ভূস্তরের নড়াচড়াকেই বলে plate tectonics। কখনও কখনও এইসব স্তরের নড়াচড়া এমনই প্রবল হয় যে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তলগুলোর ভূগোলই পাল্টে যায়। ভীষণ ধাক্কায় কোনো কোনো স্তর নীচের থেকে উপরে উঠে আসে কোনোটা বা তলিয়ে যায় ভূগর্ভে, পাল্টে যায় ভৌগলিক মানচিত্র ! এই প্রসঙ্গে জার্মান ভূ-পদার্থ বিজ্ঞানী Alfred Wegener-এর দেওয়া continental drift-এর ঘটনাটা বলাও বেশ প্রয়োজন।
আমাদের পৃথিবীর মহাদেশগুলো একসময় একই ভূ-খন্ডের অংশ ছিল, যেটাকে Alfred Wegener নাম দিয়েছিলেন super continent বা pangea। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন প্লেট টেক্টনিক্স , ভূমিকম্প ইত্যাদির ফলে সেই super continent ভেঙে যায় বিভিন্ন continent বা মহাদেশে। আমরা যদি কাগজে ছাপা পৃথিবীর ভৌগলিক মানচিত্রের উপরিতলের মহাদেশ এবং অন্যান্য ভূস্তরগুলির ধার বরাবর কাঁচি দিয়ে কেটে নিয়ে তারপর যদি খাঁজ মিলিয়ে জুড়তে থাকি তাহলেই বেশ বুঝতে পারবো Wegener-এর মতের যৌক্তিকতা। এসব কথা বলার কারণ Europa-র ভৌগলিক বরফস্তর পর্যবেক্ষণ করতেও ভূবিজ্ঞানী Simon Kattenhorn (University of Idaho, Moscow) এবং গ্রহবিদ Louise Prockter (Johns Hopkins Applied Physics Laboratory in Laurel, Maryland) একই পন্থা অবলম্বন করেছেন।
১৯৯৫ থেকে ২০০৩ অবধি NASA-র Galileo মহাকাশযানটির তোলা ছবিগুলো থেকে চিহ্নিত করেছেন Europa-র বিভিন্ন বরফস্তরকে আর সময়ের সাথে লক্ষ্য করেছেন স্তরগুলির চৌহদ্দির পরিবর্তন। বিজ্ঞানীরা এভাবেই ধরতে পেরেছেন বরফতলগুলির নড়াচড়া। হিমস্তরগুলি একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা লেগে কিছু তলিয়ে যাচ্ছে মহাসমুদ্রের নীচে আবার নীচে থাকা কোনো কোনো স্তর উপরে এসে নতুন করে জেগে উঠছে। কিন্তু এই ঘটনার সাথে জীবনের অস্তিত্বের সম্ভাবনা ঠিক কিভাবে সম্পর্কিত ? বিজ্ঞানীদের ধারণা ক্রমান্বয়ে এই স্তরগুলির ওঠা-নামা যত হবে ততই সেগুলোতে ছড়িয়ে পড়বে প্রাণের উপযোগী নানান যৌগ বা খনিজ লবণ আর সেই সাথে সম্ভাবনা বাড়বে জীবের উত্পত্তির !
সমস্যা কিন্তু অন্য জায়গায়। Europa-কে নিয়ে বিশাল আশা থাকা সত্ত্বেও মুশকিল একটাই যে গভীরভাবে গবেষণা করার জন্য Galileo-র পাঠানো ছবিগুলো ঠিক ততটা পরিস্কার নয় আর তাই NASA বিশদে জানতে ‘Europa Clipper’ নামে এক উদ্যোগ নিয়েছে , পাঠানো হবে এক অত্যাধুনিক মহাকাশযান। বাধা একটাই, ব্যাপারটা বেশ খরচ সাপেক্ষ, US$2-billion, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১২,২০০ কোটি টাকা ! ঠিক কি করবে NASA ? জানতে হলে আমাদের সময়ের আশ্রয় নিতেই হবে।
ছবি : NASA
লেখার উত্স :
১) https://www.nature.com/news/plate-tectonics-found-on-europa-1.15851
২) https://www.jpl.nasa.gov/news/news.php?release=2014-300