রাজীবুল: আমরা যখন ইস্কুলে পড়ি, সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে আলোচনা ক্লাস এইট বা নাইনে হয়। পরে কলেজে গিয়েও এই নিয়ে পড়তে পারি। তুই নিজে এই ভারতীয় সিস্টেমে পড়াশোনা করেছিস। এইটা বল, ইস্কুলে আমরা যা শিখি, সেটা কি আধুনিক সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার জন্য উপযুক্ত দৃষ্টিকোণ তৈরি করতে পারে? তোকে যদি বলা হয়, তুই কীভাবে পড়াবি এখন, ধর তোর পুরোনো কলেজে গিয়ে, তুই কী পাল্টাবি?
দেবলীনা: প্রথমত, ধর, আমরা পড়েছি Ashcroft/Mermin বা ওই জাতীয় বই (Editor’s note: এখানে Ashcroft এবং Mermin-এর লেখা Solid State Physics বইটার কথা বলা হচ্ছে)। তাতে তোর সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে ধারণাটা খুব ভালো তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু একটা ল্যাপটপ বানানোর কথাই যদি ধরিস, পুরোটাই একটা পরীক্ষামূলক (experimental) ল্যাবে কাজ করা। অতএব যে ছাত্রছাত্রীরা এই কাজে নামবে, তাদের হাতেনাতে পরীক্ষা করার একটা মনোবৃত্তি থাকা খুব দরকার।
প্রথম যেটা দরকার, সেটা হলো — একটা মিনি ফ্যাব-এ (fabrication lab) প্রত্যেকটা যন্ত্রের সাথে তাকে সড়গড় হতে হবে।
এরকম কোথায় রয়েছে? ধর, আমি যদি ভারতের কথাই ধরি।
ভারতে IISc-তে যখন আমি ছিলাম, ওখানে ফ্যাব ছিল ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট-এ। IISc-তে CENSE নামে যে গবেষণাকেন্দ্র-টা রয়েছে, সেটার কথা বলছি। ঐরকম একটা ফ্যাবে কাজ করলে কিছুটা অন্তত ধারণা তৈরি হয়।
পরবর্তীকালে আমি হার্ভার্ডে কাজ করেছি, হার্ভার্ডের যে ফ্যাব্রিকেশন-এর (fabrication) জায়গা রয়েছে, সেইখানে। এইসব জায়গাতে যন্ত্রপাতির স্কেলটা খুব ছোট, কিন্তু তবুও সেগুলো নিয়ে হাতেনাতে কাজ করে কিছুটা শেখা যায়।
আমাদের দেশে যদি সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি-কে বড় করে তৈরি করতে হয়, একটা জিনিস আমরা আগেই বললাম, সরকারের তরফ থেকে বিনিয়োগ লাগবে। কিন্তু শুধু বিনিয়োগ হলেই কি যথেষ্ট? ধরা যাক, সরকার বললো, এতো লক্ষ কোটি টাকা দিয়ে দিলাম। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে সাফল্য পেতে গেলে একটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী-বাহিনী লাগবে। আমরা যখন স্কুল বা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলে পড়াশোনা করি, আমরা সেইভাবে প্রশিক্ষণ পাই না। তোর কী মনে হয়, কীভাবে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে? এই যে বিনিয়োগের কথা বলছি, এর কিছুটা কি স্কুল কলেজে যাওয়া উচিত? এই জায়গা থেকে প্রশ্নটা করছি।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দেশের মধ্যে কর্মশক্তি গড়ে তোলা নিয়ে কতটা দূরদর্শিতা রয়েছে, তুই সেই ব্যাপারে প্রশ্ন করছিস। নেতৃত্ব-স্থানীয় ব্যক্তিদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বলছিস।
এর উত্তরে বলতে পারি, আমাদের অনেক কলেজ আছে, যেমন আইআইটি-গুলো আছে। কিন্তু আমি যদ্দুর জানি, এই বিশেষ ব্যাপারে তাদের পরিকাঠামোটা খুব একটা ভালো নয়। এই পরিকাঠামোটাকে যদি আমরা একটা ভালো জায়গাতে আনতে পারি, যাতে অন্তত তাদের একটা ভালো ফ্যাব থাকে, তখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেল থেকে তাদের সেই ফ্যাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। অন্তত যদি সেখানে ইন্টার্নশিপটুকুও (internship) করানো যায়, তাহলে আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে এই ধরনের কাজের জন্য একটা উপযুক্ত মনোবৃত্তি তৈরি হবে।
আমরা কিন্তু এখানে অন্তত দশ হাজার ছাত্রকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলছি। হঠাৎই আজকে যদি আমি দেশে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি শুরু করতে চাই, অন্তত দশ হাজার ছাত্রকে তো তৈরি করতে হবে। অতএব আমি বড় স্কেলে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলছি।
অর্থাৎ সেটা একটা দুটো কলেজে করলে হবে না। এই প্রশিক্ষণ দেওয়াটা ব্যাপকভাবে করতে হবে।
আমাদের দেশে এটাই সমস্যা। আমরা এই ধরনের ল্যাব বলতে IISc আর TIFR-এর কথাই বলি। কিন্তু আমাদের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা ধর, যেমন যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সি, সেখানে কি আমরা এই ধরনের প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে পারি?
আরেকটা উপায় হতে পারে যে গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা অন্যান্য জায়গার ছাত্রছাত্রীদের IISc বা TIFR-এর মত জায়গাতে আনলাম, সেখানে প্রশিক্ষণ দিলাম।
এই পুরো ecosystem-টা যদি তৈরি না হয়, তাহলে শুধু উপর থেকে বিনিয়োগ করে সাফল্য আসা মুশকিল। তুই সেটাই বলছিস তো?
হ্যাঁ, আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ল্যাব তৈরি সম্ভব না হয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের ইন্ডাস্ট্রি-তে পাঠাতে হবে। অন্তত মাস তিনেকের জন্য।
প্রশিক্ষণের জন্য, তাই তো?
হ্যাঁ।
অনেক বড় কোম্পানি — ইন্টেল-এর কথাই ধর — ভারতে যায়নি এই ভেবে যে লোকজন নিলে সবাইকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ধর, নতুন দশ হাজার লোককে নেওয়া হলো, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পুরো দায়িত্বটা কোম্পানির ঘাড়ে চলে আসবে। আমি নতুন মডেলও বানাবো, আবার নতুন ছাত্রদেরও প্রশিক্ষণ দেব, সেটা —
খুব চ্যালেঞ্জিং কোনো একটা বিশেষ কোম্পানির জন্য।
এই কারণেই কিছু কিছু দেশ ছাড়া অন্য দেশে ইন্টেল সেভাবে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। ইন্টেল-এর মধ্যে এটা বলা হয়েছিল। বর্তমান যে-ক’টা জায়গাতে আছে, তার বাইরে যেতে হলে ইন্টেল-কে অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হবে।
ধন্যবাদ, দেবলীনা! আমরা সেমিকন্ডাক্টর তৈরি নিয়ে একটা দারুণ আলোচনা করলাম। আমার মনে হয়, আমাদের আলোচনাটা অনেক ছাত্রছাত্রীর কাছে পৌঁছবে। আমরা আশা করবো, তাদের মধ্যে অনেকেই এই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে নামার জন্য যে প্রশিক্ষণ দরকার, সেই প্রশিক্ষণ নিতে তারা উৎসাহী হবে। তুই যেটা বললি, আমাদের দেশে সুযোগ কম থাকলেও, অনেক জায়গাতেই রয়েছে। এবং আশা করি আরো বিনিয়োগ হওয়ার ফলে অবস্থাটা আরো ভালো হবে।
অসংখ্য ধন্যবাদ! আমি খুব আশাবাদী, আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা সমস্ত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাবে।