আলো দিয়ে ঠান্ডা
আলো যেহেতু একটা তরঙ্গ, তাই তার কম্পাঙ্ক নির্ভর করে যে দেখছে তার গতিবেগের উপরে। ঠিক ধরেছেন, এ হল ডপলারের প্রভাব, যেমন শব্দের ক্ষেত্রে হয়। সেই সাথে যোগ করুন আর দুটি তথ্য – পরমাণু খুব নির্দিষ্ট কিছু কম্পাঙ্কের আলোই শোষণ করে, আর আলোর ভরবেগ আছে। এই নিয়মগুলোকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করলেই আলো ফেলে গ্যাসীয় পদার্থকে ঠান্ডা করে দেওয়া যায়!
ভাবছেন, এ সব কী বলছি আবার? “চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা- হল চশমা”? তাহলে ধৈর্য ধরে বসুন – প্রথমে পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকটি বিষয় একটু গল্পচ্ছলে বুঝে নিই।
ডপলারের প্রভাব
রেললাইনের ধারে দাঁড়িয়ে হর্ণ দিতে দিতে রেলগাড়ির চলে যাওয়া আমরা প্রায় সকলেই দেখেছি। অপু-দুর্গার সেই দৃশ্য তো অমর হয়ে আছে। ধরা যাক অপু আর দুর্গা কাশবনের মধ্যে রেললাইন থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, আর রেলগাড়িটা হর্ণ দিতে দিতে সোজা লাইন দিয়ে এগিয়ে আসছে। এখন প্রশ্ন করা যাক, ওই হর্ণের সুর (বিজ্ঞানের ভাষায় শব্দতরঙ্গের কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সি) গাড়ির চালক যেমনটি শুনবে, অপু-দুর্গা কি ঠিক তেমনটিই শুনবে? উত্তরটা হল, না! অপু-দুর্গা যদি হর্ণের কম্পাঙ্ক শোনে আর চালক যদি শোনে তাহলে,
(রেলগাড়ি এগিয়ে আসছে, অপু-দুর্গা বেশি তীক্ষ্ণ সুর শুনছে।)
রেলগাড়ি যত কাছাকাছি আসতে থাকবে অপু-দুর্গার শোনা হর্ণের কম্পাঙ্ক ততই কমতে থাকবে, যদিও তা চালকের শোনা সুরের থেকে তখনও বেশী। ঠিক যখন ওদের সামনে রেলগাড়ির চালকের কামরা এসে হাজির তখন তিনজনেই একই কম্পাঙ্কের সুর শুনবে। এরপর রেলগাড়িটি যখন হুস করে তাদের সামনে দিয়ে চলে যাবে তখন ঐ দুই ভাই-বোন যে হর্ণের সুর শুনবে তা চালকের শোনা সুরের থেকে ক্রমশ নীচুর বা খাদের দিকে হতে থাকবে।
(রেলগাড়ি দূরের দিকে চলে যাচ্ছে, চালক বেশি তীক্ষ্ণ সুর শুনছে।)
কোন তরঙ্গের কম্পাঙ্গ নির্ভর করে তরঙ্গের উৎস ও পর্যবেক্ষকের আপেক্ষিক গতির উপরে – এই ঘটনাকে ডপলারের প্রভাব বলে। সব তরঙ্গের ক্ষেত্রেই এই ঘটনা দেখা যায়। শব্দের যেমন, আলোক তরঙ্গেরও তেমন। ডপলারের প্রভাব সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা এই ওয়েবসাইটের ‘ক্লাসরুম’ বিভাগে করা হবে পরে।
কোন পরমাণুর উপর আলোক রশ্মি ফেলা হলে পরমাণুটি তার কম্পাঙ্ক কী দেখবে তা নির্ভর করবে পরমাণুর বেগের উপর। (আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্ক তার রঙ ঠিক করে দেয়, সব কম্পাঙ্কের আলো যদিও আমরা দেখতে পাই না।) এই ঘটনাটিকেই কাজে লাগিয়ে কোন গ্যাসীয় পদার্থের উপর আলো ফেলে তাকে ঠান্ডা করে ফেলা যায়! ঠিক কীভাবে তা বুঝতে হলে পরমাণুর উপর আলো ফেললে কী হয় তা একটু বুঝতে হবে।
পরমাণুর উপর আলোর প্রভাব
আসুন এবার পরমাণুর অন্দরমহলের গল্প শুনে নিই। সহজ করে বললে, পরমাণুর কেন্দ্রে একখানা পুচকে কিন্তু খুব ভারী নিউক্লিয়াস, আর তার বাইরে বনবন করে নানান সাইজের কক্ষপথে ঘুরছে কতকগুলি ইলেকট্রন। কক্ষপথের আকার যত বড় ইলেকট্রনের শক্তিও তত বেশী।
পরমাণুর উপরে আলো ফেললে এই ইলেক্ট্রনগুলো আলো থেকে শক্তি শোষণ করে ‘জাম্প’ মেরে উপরের কক্ষপথে চলে যেতে পারে! আলো জিনিসটা ঠিক কী, তা নিয়ে আলোচনা অন্য কোন লেখায় করা যাবে। আপাতত আমাদের আলোচনার জন্য এটুকু ধরলেই যথেষ্ট যে আলোক তরঙ্গ অনেক আলোক কণিকা বা ফোটন দিয়ে তৈরী। যেমন পুকুরের জলের তরঙ্গে অনেক জলের অণু থাকে, তারা জলতরঙ্গের সাথেই কাঁপতে থাকে, তেমনি আলোর মধ্যে ফোটন, তারাও আলোক তরঙ্গের সাথে কাঁপে। যে আলোর কম্পাঙ্ক যত বেশী (যেমন নীল আলোর কম্পাঙ্ক লালের থেকে বেশী), তার ফোটনের শক্তিও তত বেশী।
এবার ধরুন ‘ফ্যাৎ ফ্যাৎ সাঁই সাঁই’ করে একঝাঁক ফোটন গিয়ে আছড়ে পড়ল এক পরমাণুর উপর। পরমাণুরা কিন্তু খুব হিসেবি – তারা যে সে ফোটন ‘খায়’ না। যে ফোটনের শক্তি শোষণ করে ইলেকট্রন উপরের কোন নির্দিষ্ট কক্ষপথে চলে যেতে পারে, সেই কম্পাঙ্কের ফোটনই পরমাণুদের পছন্দ। এই বিশেষ কম্পাঙ্কগুলোকে রেসোন্যান্স কম্পাঙ্ক (Resonance frequency) বলে। ফোটনের ভাগাভাগি হয় না, খেতে গেলে একখানা আস্তই খেতে হবে, তাই আলোক তরঙ্গের কম্পাঙ্ক যদি এক কোটি ভাগের একভাগও পালটে যায় তাহলেই পরমাণুর সেই ফোটনে অরুচি জন্মায় – কারণ ঐ ফোটনের মধ্যে ইলেকট্রনের অন্য কক্ষপথে যাওয়ার জন্য ঠিক যে শক্তি দরকার তা নেই ! সেই কারণে কোন পরমাণুকে উত্তেজিত করতে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলোর উৎস, যেমন লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়।
আরেকটি মজার তথ্য হল আলোর ভর না থাকলেও ভরবেগ আছে! অর্থাৎ যখন কোন পরমাণু একটা আলোক কণিকা শোষণ করে, তখন সেই আলোক কণিকা তাকে শক্তির সাথে সাথে ভরবেগজনিত একটা ধাক্কাও দেয়। মেসির শট্ ধরতে গিয়ে গোলকিপার যেমন ধাক্কা খায়! পাঠক যদি ঘাবড়ে গিয়ে থাকেন আলোর ভরবেগের কথা শুনে, তাহলে শুধু এটুকুই বলি এখানে যে ছোটবেলায় যে ‘ভরবেগ সমান ভর গুণিতক বেগ’-এর সূত্র শিখেছিলাম, তা সবার ক্ষেত্রে খাটে না, যেমন ভরহীন আলোর ক্ষেত্রে!
তাহলে আমরা তিনটি নীতি শিখলাম :
1. আলোর কম্পাঙ্ক নির্ভর করে দর্শকের গতিবেগের উপর।
2. পরমাণুর মধ্যে ইলেক্ট্রনগুলো কিছু নির্দিষ্ট শক্তির বা কম্পাঙ্কের আলোক কণিকা বা ফোটন শোষণ করতে পারে।
3. ফোটনের যেহেতু ভরবেগ আছে তাই পরমাণু ফোটন শোষণ করতে গিয়ে ধাক্কা খায়।
এবার ধরা যাক, একটি পরমাণুর উপর লেজার রশ্মি ফেলা হচ্ছে একদিক থেকে। লেজার রশ্মিটির কম্পাঙ্ক হল রেসোন্যান্স কম্পাঙ্কের থেকে একটু কম। তাহলে যে পরমাণু স্থির আছে সে প্রায় কোন আলো শোষণ করবে না। যে পরমাণুগুলো ঐ আলোক রশ্মির সাথে একই দিকে ছুটছে তাদের কাছে ডপলারের প্রভাবের ফলে ঐ আলোর কম্পাঙ্ক আরো কমে যাবে, অর্থাৎ রেসোন্যান্স থেকে আরো দূরে সরে যাবে – তাই তাদের পক্ষে ঐ আলোক কণিকাদের শোষণ করার সম্ভাবনা আরও কম। কিন্তু যে পরমাণুগুলো আলোকরশ্মির বিপরীতে অর্থাৎ উৎসের দিকে ছুটছে তারা ডপলারের প্রভাবের ফলে আলোর কম্পাঙ্ক একটু বেশী দেখবে, অর্থাৎ তাদের মনে হবে যে আলোর কম্পাঙ্ক বেড়ে রেসোন্যান্স কম্পাঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে! তারা বলবে- চমৎকার, ধরা যাক দু-একটা ফোটন এবার! আর যেই একটা ফোটন খাবে, অমনি সেই মেসির শটের মত ধাক্কা – সেই ধাক্কায় তাদের বেগ যাবে একটু কমে। খানিক বাদে ওই পরমাণুর ইলেকট্রন আবার নেমে আসবে নিচের কক্ষপথে, আবার একটা ফোটন খাবে, আবার ধাক্কা, আবার বেগ কমবে একটু। এমনি করে তার বেগ আর সেই সাথে গতিশক্তি কমতেই থাকবে। আগেই বলেছি গড় গতিশক্তি কমা মানে তাপমাত্রা কমা, অর্থাৎ যে পরমাণুগুলো লেজারের দিকে ছুটছিল তারা ঠান্ডা হতে থাকবে। অনেকটা নিচের ছবির মত।
এবার একই ভাবে উল্টো দিক থেকে রেসোন্যান্সের থেকে কম কম্পাঙ্কের আলো ফেললে যে পরমাণুগুলো উল্টোদিকে ছুটছিল তারাও ঠান্ডা হয়ে যাবে! তাহলে মোট ছ’টা লেজার রশ্মি ব্যবহার করে উত্তর-দক্ষিণ-পুব-পশ্চিম-উপর-নিচ সব দিকে ছোটা পরমাণুর দল ঠান্ডা হয়ে যাবে।
এই ঘটনাটাকে বলা হয় লেজার কুলিং (Laser Cooling) বা লেজার শীতলিকরণ। 1978 সালে মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড ও সহকর্মীরা ম্যাগনেসিয়াম আয়নকে এবং হান্স ডেমেল্ট ও সহকর্মীরা বেরিয়াম আয়নকে লেজার কুলিং করে দেখান। এই পদ্ধতিতে গ্যাসের তাপমাত্রা কমিয়ে কয়েকশ’ মাইক্রোকেলভিন পর্যন্ত আনা যায় (এক মাইক্রোকেলভিন = 0.000 001 কেলভিন)। পরবর্তী কালে মার্কিন বিজ্ঞানী উইলিয়াম ফিলিপ্স ও স্টিভেন চু এবং ফরাসী বিজ্ঞানী কোহেন তানৌজ্জি ও তাদের সহকর্মীরা এই পদ্ধতিকেও আরো এগিয়ে নিয়ে যান – তাপমাত্রা কমিয়ে কয়েক মাইক্রোকেলভিন অব্দি নিয়ে চলে যান, এবং সঠিক ব্যাখ্যা করেন। উপরে নাম করলাম যে সব বিজ্ঞানীর তারা সবাই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন নানা সময়ে।
আজ এখানে থামব, কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয় – লেজার কুলিং-এর পরেও পদার্থকে আরো অনেক ঠান্ডা করা যায়। করতে করতে তাপমাত্রা এমন কমে যেতে পারে যে ঐ গ্যাস সম্পূর্ণ এক নতুন অবস্থায় চলে যেতে পারে, যেখানে পরমাণুগুলোর কে কোথায় আছে আলাদা করে চেনা যায় না, সবাই সব জায়গায় একসাথে থাকতে পারে, তাও কেউ কাউকে ধাক্কা মারে না! এই অদ্ভুত অবস্থার সাথে এক বাঙালী বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে আছে – সত্যেন্দ্রনাথ বসুর। আইনস্টাইনের সাথে বরেণ্য বাঙালী বিজ্ঞানীর নামে পদার্থের এই অবস্থার নাম বোস-আইনস্টাইন কন্ডেনশেসন।
প্রচ্ছদের ছবি : লেজার কুলিং-এর অন্যতম পথিকৃত বিজ্ঞানী ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড ও হান্স ডেমেল্ট। (ছবি : wikipedia/NIST and nobelprize.org)