আধুনিক প্রযুক্তিতে সেমিকন্ডাক্টরের ভূমিকাটা বুঝতে গেলে আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে কম্পিউটার, মোবাইল, স্পিকার এরা ঠিক কাজ করে কীভাবে।
কম্পিউটার বা মোবাইল কোনো সিগন্যাল নিয়ে কাজ করার সময় এমন একটি গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে যাতে মাত্র দুটো সংখ্যা আছে, 1 এবং 0। এই গাণিতিক পদ্ধতিকে বলা হয় বাইনারি লজিক (binary logic)।
এক-শূন্যের গণিত
কম্পিউটার আদতে একটি গণনা করার যন্ত্র। কম্পিউটারে আমরা যখন কোনো গান চালাচ্ছি অথবা কোনো ছবির ফাইল খুলছি আসলে আমরা কম্পিউটারকে কিছু নির্দেশ (instruction) দিচ্ছি। কম্পিউটারের কাছে এগুলো 1 অথবা 0 হিসাবে আসে। এর পর কম্পিউটার ওই নির্দেশগুলো মানে 1 অথবা 0 গুলোর উপর গাণিতিক অপারেশন চালায় আর সব শেষে আমাদের আউটপুট দেয়।
কম্পিউটার এই গণনা করে অনেকগুলো ছোট ছোট ধাপে, আর প্রতিটি ধাপে চলে একেকটি ‘লজিক্যাল অপারেশন’ (logical operation)। কিরকম হয় সেই ‘লজিক্যাল অপারেশন’, একটা উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
এই দুটো বাক্য দেখো:
- “ক্লাবে তারাই ঢুকতে পারবে যাদের মাথায় সাদা টুপি এবং পায়ে কালো বুট জুতো থাকবে”।
- ”ক্লাবে তারাই ঢুকতে পারবে যাদের মাথায় সাদা টুপি অথবা পায়ে কালো বুট জুতো থাকবে”।
প্রথম বাক্যটির শর্ত অনুযায়ী কেবল সাদা টুপি থাকলেই ক্লাবে ঢোকা যাবে না। তার জন্য কালো জুতোও দরকার।
কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যটির শর্ত অনুযায়ী শুধু সাদা টুপি বা কালো বুট থাকলেই ক্লাবে ঢোকা যাবে। অন্যটা লাগবে না।
প্রথম বাক্যটিতে দুটি ছোট ছোট শর্তকে AND লজিক অপারেটর (logic operator) দিয়ে জোড়া হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যটিকে ওই দুটি শর্তকেই OR লজিক অপারেটর দিয়ে জোড়া হয়েছে।
অঙ্কের ভাষায় প্রকাশ করলে AND অপারেটর এইরকমভাবে কাজ করে। দুটো ইনপুট 1 হলে তবেই আউটপুট 1 হয়।
Input 1 | Input 2 | Output |
---|---|---|
0 | 0 | 0 |
0 | 1 | 0 |
1 | 0 | 0 |
1 | 1 | 1 |
অন্যদিকে, OR অপারেটর-এর ক্ষেত্রে যেকোনো একটা ইনপুট 1 হলেই আউটপুট 1 হয়ে যাবে।
Input 1 | Input 2 | Output |
---|---|---|
0 | 0 | 0 |
0 | 1 | 1 |
1 | 0 | 1 |
1 | 1 | 1 |
তৃতীয় আরেকটি লজিক অপারেটর হলো NOT। এর কাজ হলো হ্যাঁ-বোধক বাক্যকে না-বোধক বাক্যে এবং না-বোধক বাক্যকে হ্যাঁ-বোধক বাক্যে রূপান্তরিত করা। অর্থাৎ, আউটপুট সর্বদা ইনপুট-এর বিপরীত।
Input | Output |
---|---|
0 | 1 |
1 | 0 |
সুইচ দিয়ে এক-শূন্য
বাস্তবে বাইনারি লজিকের 1 এবং 0-কে নামানো হয় ইলেকট্রনিক সুইচের মাধ্যমে। সুইচ বন্ধ, অর্থাৎ যখন বিদ্যুৎ চলাচল করছে, সেটা 1-এর প্রতিনিধিত্ব করে। আর সুইচ খোলা, অর্থাৎ যখন বিদ্যুৎ চলাচল করছে না, সেটা 0-র প্রতিনিধি।
আমরা সাধারণত যে সুইচ দেখে অভ্যস্ত সেটা হলো মেকানিক্যাল সুইচ। অর্থাৎ, বহিরাগত বল প্রয়োগে সুইচটিকে বন্ধ করতে বা খুলতে হয়। কিন্তু কম্পিউটারের ভিতরে যে সুইচ-এর কথা বলা হচ্ছে তা হলো ইলেকট্রনিক সুইচ। এই ধরণের সুইচে বর্তনীতে (circuit) কোথাও একটা ভোল্টেজ প্রয়োগ করেই সুইচটিকে অন অথবা অফ করা যায়।
ইলেকট্রনিক সুইচে যাওয়ার আগে প্রথমে মেকানিক্যাল সুইচের বর্তনী দিয়ে বানানো যাক লজিকগুলোকে।
উপরের বর্তনীতে A সুইচটি বন্ধ করলে বর্তনীটি শর্ট হয়ে যাবে (short circuit), অর্থাৎ পুরো তড়িৎ বন্ধ সুইচটির মধ্যে দিয়ে যাবে। ফলে, বাল্বটি জ্বলে উঠবে না। অপরদিকে, সুইচ খোলা থাকলে আলো জ্বলবে। যদি সুইচটিকে ইনপুট হিসেবে ভাবি আর বাল্বটিকে আউটপুট হিসাবে, তাহলে এই বর্তনীটি NOT লজিক এর মতো কাজ করছে। এখানে সুইচ বন্ধ আর খোলা থাকা অবস্থাকে যথাক্রমে 1 আর 0 ধরা হচ্ছে আর বাল্ব-এর জ্বলা আর নেভা অবস্থাকে যথাক্রমে 1 আর 0 ধরা হচ্ছে।
অনুরূপে উপরের বর্তনীটি লক্ষ্য করো। বাল্বটি তখনই জ্বলবে যখন যখন দুটো সুইচ একই সাথে বন্ধ হবে। অর্থাৎ এই বর্তনীটি AND লজিকের বাস্তব রূপায়ণ।
শেষে এই বর্তনীটি দেখো। বাল্বটি কেবলমাত্র তখনই নেভা থাকবে যখন দুটো সুইচ একই সাথে খোলা থাকবে অর্থাৎ ইনপুট দুটো একই সাথে 0 হবে। অর্থাৎ এই বর্তনীটি OR লজিকের বাস্তব রূপায়ণ।
ইলেক্ট্রনিক সুইচ
কিন্তু কম্পিউটার-এর ভিতর তো আমরা মেকানিক্যাল সুইচ ব্যবহার করতে পারি না। সুইচ টেপাটিপির কোনো ব্যাপার সেখানে নেই। এইখানেই সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে তৈরী ইলেকট্রনিক সুইচের প্রয়োজন পড়ে।
আগের পর্বে আমরা শিখেছি যে সেমিকন্ডাক্টরদের পরিবহন ক্ষমতা আমরা অনেকটাই ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। এই সেমিকন্ডাক্টর দিয়েই এমন কিছু ডিভাইস (device) তৈরী করা যায় যারা বিশেষ অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবহন করে (তখন এরা অন সুইচ বা লজিক 1 এর অবস্থায় থাকে), আবার বিশেষ অবস্থায় মোটেও বিদ্যুৎ পরিবহন করেনা (তখন এরা অফ সুইচ অথবা লজিক 0 এর অবস্থায় থাকে)। এর মধ্যে এক ধরণের ডিভাইস হয় যারা কেবল একদিকেই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে, অন্যদিকে পারে না। এদেরকে বলে ডায়োড (diode)।
এবার দেখা যাক ডায়োড দিয়ে কীভাবে আগের অংশের AND এবং OR লজিকগুলো বানানো যায়।
এক্ষেত্রে দুটি বিষয় মাথায় রেখে চলতে হবে —
- লজিক 1 বলতে অপেক্ষাকৃত বেশি ভোল্টেজ-কে বোঝানো হবে, যা নীচের উদাহরণে 5 V। লজিক 0 বলতে অপেক্ষাকৃত কম ভোল্টেজ-কে বোঝানো হবে, যা এক্ষেত্রে 0 V (অথবা ground connection)।
- ডায়োড এখানে ঠিক সুইচের মতো কাজ করে। ডায়োডের এনোড (anode) প্রান্তের অর্থাৎ তীরচিহ্নটির পিছনের ভোল্টেজ যদি উল্টোদিকের ক্যাথোড (cathode) প্রান্তের ভোল্টেজের থেকে বেশি হয় তবেই ডায়োডরূপী সুইচটা বন্ধ হয়। নচেৎ সুইচটা খোলা থাকে।
নীচের বর্তনীটিতে ডায়োড-সুইচ দিয়ে OR লজিক বানানো হয়েছে। লক্ষ্য করো, আউটপুট কেবলমাত্র তখনই 0 হবে যখন ইনপুট দুটোই একসাথে 0। এটিই OR লজিক-কে সনাক্ত করার উপায়। বর্তনীতে ডায়োড কখন খোলা সুইচ এর মতো আচরণ করছে আর কখন বন্ধ সুইচ এর মতো আচরণ করছে, তা ছবিতেই দেখানো হয়েছে।
এইবার নিচের নতুন বর্তনীটি লক্ষ্য করো। এটি AND লজিক-কে প্রকাশ করছে কারণ আউটপুট কেবলমাত্র তখনই 1 হচ্ছে যখন দুটো ইনপুট দুটো একসাথে 1 হচ্ছে। এটিই AND লজিক-কে চেনার উপায়। নিচের সারিতে প্রথম চিত্রে দেখো আউটপুট-টি ground-এর সাথে সরাসরি যুক্ত তাই এক্ষেত্রে আউটপুট ভোল্টেজ 0 হবে। ওই সারিতেই শেষের চিত্রে দেখো আউটপুট কোনো রাস্তা দিয়েই ground এর সাথে যুক্ত না। বরঞ্চ যেহেতু বর্তনীতে কোনো তড়িৎ প্রবাহ হচ্ছে না তাই আউটপুট প্রান্তটিকে 5 V ব্যাটারীর সাথে যুক্ত বলে ভাবতে হবে। অর্থাৎ আউটপুট ভোল্টেজ 5 V বা আউটপুটের লজিক্যাল অবস্থা 1।
এইখানে ছোট্ট করে বলে রাখি AND, OR, এবং NOT ছাড়াও আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ লজিক্যাল অপারেটর হলো NAND এবং NOR।
NAND = NOT + AND
NOR = NOT + OR
অর্থাৎ AND, OR, এবং NOT লজিক এর সমন্বয়ে NAND আর NOR লজিক তৈরী করা যায়।
এই ধরণের লজিক্যাল অপারেটর জুড়ে জুড়েই তৈরী হয় লজিক সার্কিট। প্রত্যেকের কম্পিউটার অথবা মোবাইলে আছে এমন অসংখ্য লজিক সার্কিট যেগুলো দিয়ে সমস্ত গণনার কাজ করা হয়।
আমরা এখানে দেখলাম ডায়োড দিয়েই এই সব লজিক বানানো যায়। তবে আধুনিক ইলেকট্রনিক বর্তনীতে এই সব লজিকগুলো ট্রান্সিস্টর (transistor) নামক একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস দিয়ে বানানো হয়। ট্রানজিস্টর ডায়োডের থেকে দ্রুত কাজ করতে পারে, অর্থাৎ ট্রানজিস্টর দিয়ে তৈরী ইলেকট্রনিক সুইচ ইনপুটের পরিবর্তনের সাথে আরো দ্রুত বন্ধ হয় বা খোলে। ট্রানজিস্টরের গঠনগত জটিলতা এড়ানোর জন্য এখানে আমি আলোচনা ডায়োড-এই সীমাবদ্ধ রাখলাম।
স্পিকার এর হুংকার
স্পিকার এর মধ্যে থাকে বিবর্ধক বা অ্যামপ্লিফায়ার (amplifier) সার্কিট যার কাজ হলো আগত সিগনালকে বিবর্ধিত করা। যে স্পিকারে যত শক্তিশালী অ্যামপ্লিফায়ার সার্কিট লাগানো থাকবে তার থেকে তত জোরে আওয়াজ বেরোনো সম্ভব। ট্রানজিস্টর দিয়ে এই অ্যামপ্লিফায়ার সার্কিট বানানো যায়।
আমরা আগে দেখেছি একটি n-type আর একটি p-type সেমিকন্ডাক্টর পদার্থ জুড়ে ডায়োড তৈরী হয়। সেই কারণে ডায়োডের দুটো টার্মিনাল থাকে।
কিন্তু ট্রানজিস্টর পরপর তিনটি n-type আর p-type পদার্থ জুড়ে তৈরী হয় n-p-n অথবা p-n-p সজ্জায়। সুতরাং ট্রানজিস্টরে থাকে তিনটে টার্মিনাল। এদের নাম দেওয়া হয় ইনপুট, আউটপুট, আর কন্ট্রোল (অন্য নামে এমিটার, বেস, কালেক্টর, আর বেস)।
যখন একটি ট্রানজিস্টর অ্যামপ্লিফায়ার হিসাবে কাজ করে, এর ইনপুট টার্মিনাল দিয়ে স্পিকার এর ইনপুট সিগন্যালটি পাঠানো হয়। কন্ট্রোল টার্মিনাল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ট্রানজিস্টরটি কতটা বিবিৰ্ধিত করবে ইনপুট সিগন্যালকে, আর আউটপুট টার্মিনাল দিয়ে যে বিবর্ধিত গান আমরা উপভোগ করি তা বেরিয়ে আসে।
আরো আরো ছোট
যখন অনেকগুলি ডায়োড ও ট্রানজিস্টর একসাথে মিলে একটি কোনো বিশেষ সার্কিট হিসাবে কাজ করে তখন তাকে আমরা Integrated Circuit বা IC চিপ বলি।
এমন ভাবে একত্রিত করার সুবিধা হলো এরা অনেক কম জায়গার ক্ষেত্রফলে অনেক বেশি কর্মদক্ষতার বর্তনী হিসাবে কাজ করে। IC আসার ফলে কম্পিউটারের আয়তন ও চালন শক্তির পরিমান দুটোই কমানো গেছে।
আগেই বলেছি প্রত্যেকের কম্পিউটার আর মোবাইল এ আছে অসংখ্য লজিক সার্কিট। IC প্রযুক্তির মাধ্যমেই এতোগুলো সার্কিটকে ছোট জায়গায় আনা সম্ভব হয়েছে।
IC চিপ বর্তমান ইলেকট্রনিক্সের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। আমরা প্রতিদিনের জীবনে যে সর্বগুণসম্মত মোবাইল আর ল্যাপটপ ব্যবহার করছি তাকে এতো ছোটো আকারে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র IC চিপ এর দৌলতে।
শেষের কথা
শুধু সেমিকন্ডাক্টর-এর ব্যবহার নয়, নতুন ধরণের সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের অনুসন্ধান করাটাও সক্রিয় গবেষণার বিষয়। সিলিকন, জার্মেনিয়াম, গ্যালিয়াম ছাড়াও বর্তমানে কম্পাউন্ড সেমিকন্ডাক্টর (compound-semiconductor) নিয়ে বিজ্ঞানীদের উৎসাহ প্রবল। কম্পাউন্ড সেমিকন্ডাক্টর দুটি ভিন্ন মৌলিক পদার্থের সমন্বয়ে তৈরী হয়, যেমন Ga-As বা Si-N। এছাড়াও বিভিন্ন উপায়ে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যান্ডগ্যাপ এনার্জির পরিবর্তন করেও বিজ্ঞানীরা রকমারি প্রকারের সেমিকন্ডাক্টর পদার্থ বানিয়েছেন।
আধুনিক প্রযুক্তি সত্যিই সেমিকন্ডাক্টর ছাড়া অচল। প্রযুক্তিবিদদের কাছে সেমিকন্ডাক্টর পদার্থ একটি পরশ পাথর কারণ এটিই বর্তমান প্রযুক্তির চালিকাশক্তি।