(নিচের লেখাটি ড: সৌমেন মান্না-র সাথে একটি লেকচার থেকে অনুপ্রাণিত। সম্পূর্ণ লেকচারটি এখানে দেখতে পাবেন।)
মোটা হওয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু শারীরিক স্থূলতার সাথে শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা দুটোই জড়িত (মানসিক সমস্যা বিশেষ করে কৈশোর থেকে মধ্যবয়স অব্দি), এর বোঝা মা-বাবা, চিকিৎসক, সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর উপর, আজকাল ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে চটজলদি রোগা হবার উপায় বাতলানো হাজারো বিশেষজ্ঞ এবং কোম্পানি। প্রতিনিয়ত বিভিন্নরকম ডায়েট এবং ডায়েটিং প্রণালী উদ্ভাবন করছেন তাঁরা, তার অনেকগুলোই বহুলাংশেই বিজ্ঞানসম্মত নয়।
সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয় খাওয়াদাওয়ার বহরের উপরেই শরীরের ওজন নির্ভর করে। কিন্তু সম্পর্কটি মোটেই সরলরৈখিক নয়। কেউ কেউ হঠাৎ খাওয়াদাওয়া কমিয়ে অস্বাস্থ্যকরভাবে রোগা হয়ে পড়ছেন, আবার অনেকে বহু ডায়েটিং করেও কিছুতেই রোগা হতে পারছেন না। তার মানে শুধু খাওয়ার উপর ওজন নির্ভর করে না। তাহলে কি এর পিছনে জিন-ঘটিত কিছু দায়ী?
বিজ্ঞানীরা যখন এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিলেন, তারা লক্ষ্য করেন যে একই বাবা মায়ের যমজ সন্তানদের মধ্যেও শারীরিক স্থূলতার বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। অর্থাৎ খাদ্যাভ্যাস এবং জিন এর বাইরে কিছুর উল্লেখযোগ্য প্রভাব স্থূলতার সাথে জড়িত। তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন যে স্থূলতার পিছনে আমাদের অন্ত্রে সহবাসী কিছু অণুজীবের (ব্যাকটেরিয়া-র) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ভূমিকাটা ঠিক কী রকম, সেই খোঁজে নেমেছেন অনেক গবেষক। অধ্যাপক জেফ্রি গর্ডন তাদের মধ্যে অন্যতম। তার ল্যাব থেকে এই বিষয়ে বেশ কিছু কাজ হয়েছে। শুরুর দিকের একটা কাজ নিয়ে আজকের গল্প। এই কাজটা ২০১৩ সালে Science পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল [১]।
সমস্যাটা
মানুষের রোগা বা মোটা হওয়ার পিছনে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার তফাৎ কতটা দায়ী, সেটাই ছিল প্রশ্ন।
এর উত্তর দিতে খুব গোদাভাবে বললে দুটো জিনিস করতে হবে। প্রথমত, অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতিগুলোকে নির্ণয় করতে হবে। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার স্যাম্পল পেতে হলে, পাকস্থলী অন্ত্রের পরিপাকের পর সেখান থেকে যে মালপত্র (fecal matter) বেরোয়, সেগুলোর মধ্যে ব্যাকটেরিয়া খুঁজতে হয়।
দ্বিতীয়ত, সেই ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতিগুলো কী রকম হলে মুটিয়ে যায় মানুষ, সেইটা বুঝতে হবে। কোন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া কত বেশী আছে, শুধু সেটা দেখলেই চলবে না। মোটা মানুষের মুটিয়ে যাওয়ার পিছনে ব্যাকটেরিয়া প্রজাতির কমবেশী হওয়ার অবদান কতটা আর খাদ্যের অবদান কতটা, সেইটা বুঝতে হবে।
সেটা বুঝবো কি করে? গবেষকরা এক উপায় বার করলেন।
গবেষণা
গবেষণার শুরু এক ধরণের জীবাণুমুক্ত ইঁদুর থেকে (germ-free mice)। এগুলোকে বিশেষভাবে বড় করা হয় গবেষণাগারে যাতে এদের অন্ত্রে বলার মত কোনো জীবাণু থাকে না।
এই ধরণের ইঁদুর খুব কাজের। মানুষের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া এই ধরণের জীবাণুমুক্ত ইঁদুরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করানো যায়। যেহেতু এরা শুরুতে জীবাণুমুক্ত থাকে, মানুষের মধ্যের ব্যাকটেরিয়া এদের ভিতর ঢোকালে এদের দেহের ব্যাকটেরিয়া কলোনিগুলো সেই মানুষের ব্যাকটেরিয়া কলোনির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
গবেষণাতে সেটাই করা হলো। কিছু জীবাণুমুক্ত ইঁদুরের মধ্যে রোগা মানুষের ব্যাকটেরিয়া আর কিছুর মধ্যে মোটা মানুষের ব্যাকটেরিয়া চালান করা হলো [২]।
এরপর দু ধরণের ইঁদুরকে একই খাবার খেতে দেওয়া হলো দিনের পর দিন।
কী বেরোলো
দেখা গেল একই আহার সত্ত্বেও মোটা মানুষের প্রতিনিধি ইঁদুর দিনকে দিন মুটিয়ে গেল।
আর রোগা মানুষের প্রতিনিধি ইঁদুর একই থাকলো।
অর্থাৎ, খাদ্য এক রেখে শুধু অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া পাল্টে জীবাণুমুক্ত ইঁদুরকে মুটিয়ে দেওয়া গেল।
এর পরের গবেষণাটা আরো মজার। ব্যাকটেরিয়া অনুপ্রবেশের পর দু’ধরণের ইঁদুরকে একসাথে একই খাঁচায় রাখা হলো। এক দলের মধ্যে রয়েছে মোটা মানুষের ব্যাকটেরিয়া, আরেক দলের মধ্যে রোগা মানুষের।
ইঁদুরের একে অপরের বিষ্ঠা খেতে আপত্তি নেই (প্রাণিজগতে এই ঘটনাকে বলে coprophagy)। দেখা গেল, একই খাঁচায় রাখার বেশ কিছুদিন পর দু’ধরণের ইঁদুরই রোগা রয়ে গেল। আগের পরীক্ষার মত এক জাতীয় ইঁদুর মোটা হয়ে গেল না।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয়টা হলো: বিষ্ঠা খেয়ে ব্যাকটেরিয়া কলোনির আদানপ্রদানের পর ব্যাপারটা রোগার হওয়ার দিকে এগোলো, মোটা হওয়ার দিকে নয়।
বিজ্ঞানীরা এর থেকে আন্দাজ করলেন যে রোগা মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে যেই ইঁদুর, তাদের দেহে ব্যাকটেরিয়া প্রজাতির বৈচিত্র বেশি। মোটা ইঁদুরের ব্যাকটেরিয়া কলোনিতে সেই বৈচিত্র্যের খানিক অভাব রয়েছে। একে অপরের বিষ্ঠা খাওয়ার পর সেই বৈচিত্র্যের অভাব পূরণ হওয়াতে দু’ধরণের ইঁদুরই রোগা থাকার দিকে এগোতে লাগলো। (অন্যান্য গবেষণাতেও মোটা মানুষের অন্ত্রে এই ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্যের অভাব দেখা গেছিল।)
এর মানে কি মানুষের মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যার একটা ব্যাকটেরিয়া-ভিত্তিক সমাধান রয়েছে? অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া কলোনির কি একটা কাঙ্ক্ষিত অবস্থা রয়েছে, যেটার ব্যতিক্রম হলেই মুটিয়ে যাওয়া?
জেফ্রি গর্ডনের ল্যাবে এই নিয়ে আরো অনেক গবেষণা হয়েছে। এই নিয়ে আরো মজার গল্প থাকবে পরের বার।
(চলবে)
প্রচ্ছদ ছবি: DALL-E-2
তথ্যসূত্র এবং অন্যান্য টুকিটাকি
[১] Gut Microbiota from Twins Discordant for Obesity Modulate Metabolism in Mice, Science, VOL. 341, NO. 6150
[২] পরীক্ষায় যে রোগা-মোটা জুড়িদের ব্যবহার করা হয়েছিল, তারা সব যমজ। যমজের সাথে কাজ করার সুবিধে এটাই যে জিনগত গঠন এক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই যমজের একজন রোগা, একজন মোটা হলে, সরাসরি খ্যাদ্যাভ্যাস বা ব্যাকটেরিয়ার উপর ফোকাস করা যায়। শুরুর জিনগত গঠনটাই আলাদা, এইটা ভাবতে হয়না।