“শুধু আমায় যেন হাসপাতালে পাঠিও না”, বলে শ্রেয়ম ধাক্কা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল। বেশ শক্তপোক্ত চেহারার ছাত্র সজল (নাম পরিবর্তিত) সজোরে ধাক্কা মারল, হাসপাতালে না গেলেও প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল শ্রেয়ম।
না, হাতে-কলমে বিজ্ঞানের কর্মশালায় মারামারি হয়নি। শ্রেয়ম শুধু একটা প্রশ্ন করেছিল: “এক লক্ষ ডাইন কত বড় বল (force), আমাকে ঠেলে দেখাও”।
হাতে-কলমে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের কয়েকটা সাধারণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ ধারণার ওপর আলোচনা করার জন্য আমাদের এই কর্মশালা হলদিয়ার চকদ্বীপা হাই স্কুলে। আমরা মানে শিক্ষক শ্রেয়ম জানা, অধ্যাপক প্রদীপ্ত পঞ্চাধ্যায়ী, আর আমি অর্থাৎ রাজীবুল ইসলাম। bigyan.org.in আর কন্টাই সায়েন্স অ্যাকাডেমি-র ‘ক্লাসরুম প্রোজেক্ট’-এ গত কয়েক বছর ধরে আমরা বেশ কিছু স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কাজ করছি। স্কুল পাঠক্রমে আছে এমন কিছু সহজ পরীক্ষা হাতে কলমে করার মাধ্যমে বিজ্ঞানকে বোঝা আমাদের এই প্রোজেক্টের অন্যতম উদ্দেশ্য।
ছোটোবেলা থেকে আমাদের বিজ্ঞান পড়াশোনা মূলত তাত্ত্বিক বা theoretical। উপরের ক্লাসে কিছু প্র্যাকটিক্যাল করতে হয়, কিন্তু সেখানেও প্রায়শই দেখা যায় উত্তর মেলানোর দিকেই (back-calculate ইত্যাদি ভয়ানক পদ্ধতিতে) আমরা বেশি নজর দিই। অথচ, বিজ্ঞানশিক্ষার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হল হাতে-কলমে কাজ করে প্রকৃতিকে বোঝা। ছোটোবেলা থেকে সে অভ্যেসটা আমাদের অধিকাংশেরই হয় না, তাই বড় হয়ে প্র্যাকটিক্যালে গোঁজামিল দিতে হয়।
একটা কাঠের ব্লককে চেয়ারের ওপর বসিয়ে কত জোরে টানলে সেটা চলতে আরম্ভ করবে – এই সহজ পরীক্ষা দিয়ে আমাদের আজকের কর্মশালার শুরু (ছবি ১)। তার আগে বলের এককের ধারণাটা পরিষ্কার করার জন্যই শ্রেয়ম এক লক্ষ ডাইনের প্রশ্নটা করেছিল। সমবেত ছাত্রছাত্রীরা মূলত সপ্তম থেকে নবম শ্রেণীর।
কোন একক কত বড়?
“এই যে তুমি আমাকে এত জোরে ঠেললে”, শ্রেয়ম সজলকে জিজ্ঞাসা করলো, “এক লক্ষ ডাইন (105 dyne) বল কি এর থেকেও বেশি, না তুমি একটু বেশি জোরেই ঠেলে ফেলেছো?”
“স্যার, আরও অনেক বেশি হবে। এক লক্ষ বলে কথা। আপনাকে হাসপাতালে পাঠাবো না বলেই একটু কম করে ঠেললাম” – ছাত্রটি উত্তর দিল! “আচ্ছা, যাও গিয়ে বোসো তোমার জায়গায়”, শ্রেয়ম নির্দেশ দিল আর ক্লাসের বাকি ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমরা কারা তোমাদের এই বন্ধুর সাথে সহমত এক লক্ষ ডাইন বলের ব্যাপারে?”
অনেকেই হাত তুললো।
এবার হাতে একটা একশো গ্রামের বাটখারা ক্লাসের সামনে তুলে ধরলো শ্রেয়ম । “বলতো, এই বাটখারার ওজন (weight) বা ভার কত? তোমরা ভর আর ওজনের পার্থক্য জানো?”
“হ্যাঁ, স্যার। এটাতো বইতে আছে। ভরকে অভিকর্ষজ ত্বরণ মানে নয়শো আশি সেন্টিমিটার প্রতি বর্গসেকেন্ড দিয়ে গুণ করলেই ওজন পাওয়া যাবে”, একজন বলে উঠলো।
“তাহলে একশো গ্রাম ভরের ওজন কত?”, শ্রেয়ম আবার জিজ্ঞেস করলো। অঙ্ক কষে কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক ছাত্রছাত্রী উত্তর করলো, “একশো গ্রাম গুণিতক নয়শো আশি সেন্টিমিটার প্রতি বর্গসেকেন্ড সমান আটানব্বই হাজার ডাইন”।
“মানে প্রায় এক লক্ষ ডাইন, তাই তো?”
একশো গ্রামের বাটখারাটা নিয়ে গিয়ে সজলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে শ্রেয়ম জিজ্ঞাসা করলো, “বলতো, তুমি আমায় এর ওজনের সমান বল দিয়ে ঠেলেছিলে না তার বেশি দিয়ে?”
মুখ কাঁচুমাচু করে সজল উত্তর দিল, ”স্যার, আমি আপনাকে অনেক বেশি বল দিয়ে ঠেলেছিলাম। এক লক্ষ ডাইন, মানে এই বাটখারাটার ওজন তো খুব অল্প বল।”
“ঠিক। আমরা যে এককগুলো বইতে পড়ি, সেগুলো আসলে কত বড়, এ সম্বন্ধে একটা বাস্তব ধারণা থাকা উচিত।”, শ্রেয়ম পরামর্শ দিল।
“এই ধরণের আরেকটা প্রশ্ন নিয়ে ভাবা যাক। এক লক্ষ মিলিমিটার বড় না এক কিলোমিটার?”, আমি ক্লাসের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলাম। তারপর বেশ কিছু আলোচনা হল, বিভিন্ন উত্তর উঠে এল। মোটের ওপর উত্তরগুলো তিন-ধরণের। কিছু ছাত্রছাত্রী এক লক্ষ মিলিমিটার বড় বলল। তাদের যুক্তি হল যে এক লক্ষ একটা বিশাল সংখ্যা। কিছু ছাত্রছাত্রী বলল এক কিলোমিটার বেশি বড়। তাদের যুক্তি হল যে কিলোমিটার অনেক বড় একক। মাত্র কয়েকজন বলে উঠলো, “দুটো সমান হবে। মান ও একক দুটোকেই গুরুত্ব দিতে হবে। ”
এক কিলোমিটার মানে এক হাজার মিটার। আবার, এক মিটার মানে এক হাজার মিলিমিটার। অর্থাৎ, এক কিলোমিটার হল ১০০০ x ১০০০ বা দশ লক্ষ মিলিমিটার। তাহলে, সঠিক উত্তর হল এক কিলোমিটার বেশি বড়, এক লক্ষ মিলিমিটারের তুলনায়।
আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞান পড়ে মূলত তথ্য মুখস্থ করে; প্রতিদিনের দেখা প্রকৃতি বা ঘটনাগুলোর সাথে বিজ্ঞানের কোনো তথ্যের যোগ বা ফারাক কতটা তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাই, না হয় তথ্যের আত্তীকরণ (assimilation), না হয় অভিজ্ঞতার সাথে যোগস্থাপন। তাই, বিজ্ঞানটা বই-এর জিনিসই থেকে যায়, জীবনের অংশ হয় না। প্রাকৃতিক রাশিগুলোর সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন ঘটানোর মাধ্যমে বিজ্ঞানশিক্ষাকে খানিক বাস্তবমুখী করা সম্ভব হবে।
পরীক্ষা বারবার করলে একই উত্তর আসবে কি?
এবার আমরা কাঠের ব্লক টানার পরীক্ষাটা শুরু করলাম। ব্লকের সাথে একটা স্প্রিং তুলাযন্ত্র আটকানো রয়েছে, যা দিয়ে বল মাপা যাবে। তুলাযন্ত্রে একটা স্কেল টানা রয়েছে। শ্রেয়ম সেই যন্ত্রটা ছাত্রছাত্রীদের দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এই যন্ত্র দিয়ে কত সূক্ষ্মভাবে বল বা ফোর্স মাপা যাবে?”
ক্লাসের কয়েকজন ভালো করে দেখে উত্তর দিল, “এই স্কেলে প্রতি এক নিউটন বলের দূরত্ব মাঝখানে সমান দূরত্বে চারটে দাগ কেটে পাঁচ ভাগে ভাগ করা। অর্থাৎ, সবথেকে ছোটো ঘর হল দশমিক দুই নিউটন।”
“একদম ঠিক।”
এবার, কয়েকজন ছাত্রছাত্রী এসে পরীক্ষাটা শুরু করলো। প্রথমে চেয়ারের তলের সাথে সমান্তরাল ভাবে তুলাযন্ত্রটি ধরে টান দিলে ব্লকটা নড়বে না, কারণ চেয়ারের তলের সাথে ঘর্ষণ বল এই বলকে বাধা দেবে। আরো জোরে টানলে একসময় টানার বল (প্রান্তীয়) ঘর্ষণ বলের থেকে যেই বেশি হয়ে যাবে, অমনি ব্লকটা চলতে শুরু করবে। যে পরীক্ষাটা করছে তার কাজ হল যে মুহূর্তে ব্লকটা চলতে শুরু করলো, স্প্রিং তুলার সূচক কোন বল নির্দেশ করছে, সেটা দেখে বলা।
প্রথম পরীক্ষক (experimenter) দেখলো, ৩.৪ নিউটন বল দিলে ব্লকটা চলতে শুরু করলো। সে ঘোষণা করলো, ঐ বলের মান ৩.৪ নিউটন।
এবার পরের জন। সেও পরীক্ষাটা করে দেখলো ৩.৪ নিউটন।
পরের জন, সেও দেখলো ৩.৪ নিউটন।
পরের জন, সেই ৩.৪ নিউটন।
পরপর চারজন ঘর্ষণ বলের একই মান (৩.৪ নিউটন) পাওয়ায় আমরা তিনজন একটু থতমত হয়ে গেলাম। আমরা যখন নিজেরা এই পরীক্ষাটা করেছিলাম প্রস্তুতির সময়ে, তখন এটা লক্ষ্য করেছিলাম যে একেকবার পরীক্ষাটা করলে একটু আলাদা আলাদা উত্তর আসছে। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ, সকলে চেয়ারের তলের সাথে সমান্তরাল ভাবে স্প্রিং তুলা নাও ধরে টানতে পারে। আবার বিভিন্নজন স্প্রিং তুলাকে চেয়ারের তলের সাথে আলাদা আলাদা কোণে টানতেও পারে। আবার, ঠিক যে মুহূর্তে ব্লকটা চলতে আরম্ভ করছে সেই মুহূর্তে স্প্রিং তুলার সূচক কোন ঘরে আছে সেটা দেখায় ত্রুটি হতে পারে। দেখার ক্ষেত্রে লম্বনভ্রম বা parallax হতে পারে, অর্থাৎ, স্কেলের সাথে লম্বভাবে না দেখার ফলে ত্রুটি হতে পারে। পরপর চারজন পর্যবেক্ষক একই উত্তর দিচ্ছে, এটা অসম্ভব না, কিন্তু ওরা একে অপরকে প্রভাবিত করছে না তো – এই আশঙ্কা হল আমাদের!
পরেরজন পরীক্ষা শুরুর আগে প্রদীপ্তদা বলে উঠলেন, “সবার উত্তর যে একই হবে তার কিন্তু কোন মানে নেই। আগের জনের উত্তর শুনে প্রভাবিত না হয়ে নিজে মাপার চেষ্টা কর।”
এর পরে “৩.২ নিউটন!” উত্তর এল পরের জনের কাছ থেকে।
পরের জন দেখলো ৩.৮ নিউটন!
এই কর্মশালায় দুটো সেশান (session) ছিল। পরের সেশানে (মূলত এগারো-বারো ক্লাসের ছাত্রছাত্রী) এই একই পরীক্ষা করে প্রথম কয়েকজন ছাত্রছাত্রী উত্তর দিয়েছিল ৩.২ নিউটন, ৩.২ নিউটন, ৩.২ নিউটন, ৩.২ নিউটন। আবার, প্রদীপ্তদার একই মন্তব্যের পরে যারা পরীক্ষাটা করলো তাদের উত্তর পালটে গেল! পরের তিনটি মান পেলাম ৩.০ নিউটন, ৩.৪ নিউটন, ৩.৪ নিউটন!
আমরা আসলে যা দেখলাম তাকে বলা হয় observer bias বা পর্যবেক্ষকের পক্ষপাত। এক পর্যবেক্ষক তার পর্যবেক্ষণটা বলে পরের জনকে প্রভাবিত করছে। প্রথম সেশানে প্রথমজন ৩.৪ নিউটন বলায় হয়তো পরের জন ৩.৪ নিউটন দেখল। হতেই পারে যে তার ক্ষেত্রে কাঁটাটা ৩.২ আর ৩.৪-এর মাঝে ছিল। প্রথমজনের উত্তর না জানা থাকলে সে হয়তো সেটাকে ৩.২ নিউটন বলত!
পর্যবেক্ষকের পক্ষপাত
এই observer bias আরো নানাভাবে হতে পারে। কেউ যদি back calculate করে পরীক্ষাটা করার আগে – ধরা যাক, এই ক্ষেত্রে অঙ্ক কষে উত্তর পেল ৩.৪ নিউটন, তাহলেও তার পক্ষে এই পক্ষপাত আসা স্বাভাবিক। পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানে এই পক্ষপাত দূর করা অত্যন্ত জরুরি। বিজ্ঞানের জগতে কিছু বিখ্যাত উদাহরণ আছে এই পক্ষপাত এবং কীভাবে এটা দূর করা যায়, তার।
১৯৮৮ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী জাক বেনভেনিস্ত (Jacques Benveniste)-এর নেতৃত্বে এক গবেষণা হয় জলের ‘স্মৃতি’-র ওপর। ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় এক ধরণের দাবী করা হয় যে ওষুধ যত লঘু করা হবে তত তার কার্যকারিতা বাড়তে থাকবে। বেনভেনিস্ত-এর পরীক্ষায় একটি ‘ওষুধ’-এর ঘনত্ব কমাতে কমাতে এমন মাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল (আপেক্ষিক আণবিক ঘনত্ব ১০-৬০, অর্থাৎ এক মিলিলিটার ওষুধ মেশানো হবে একের পর ষাটটা শূন্য মিলিলিটার দ্রবণে!) যে পরীক্ষায় ব্যবহৃত দ্রবণে সেই পদার্থের একটিও অণু থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। অথচ, তারা পরীক্ষা করে দেখলো যে দ্রবণে সেই ওষুধের কার্যকরিতা তখনও বর্তমান! অর্থাৎ, দ্রবণে (জলে) যে সেই পদার্থ ছিল একসময়ে, তার স্মৃতি বা memory এখনো রয়েছে! এই পরীক্ষার ফলাফল বিখ্যাত Nature পত্রিকায় প্রকাশিত হল [১]। কিন্তু, পত্রিকার সম্পাদক পরীক্ষার সত্যতা যাচাই করতে একটা দল তৈরি করলেন যাদের সামনে বেনভেনিস্তের গবেষণাগারে পরীক্ষাটা আবার করা হবে। এই দলের মধ্যে ছিলেন জেমস র্যান্ডি যিনি একজন জাদুকর আবার আমেরিকায় বিজ্ঞানপ্রচারও করতেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন যে পরীক্ষাটা করা হবে Double blind পদ্ধতিতে। অনেক স্যাম্পেল তৈরি করা হল, তার মধ্যে কিছু তৈরি করা হয়েছে মূল গবেষণার পদ্ধতিতে, অর্থাৎ ‘ওষুধ’ দিয়ে সেটার ঘনত্ব ক্রমাগত কমিয়ে। আর বাকিগুলো তৈরি হল কোনও ওষুধ ছাড়াই। কিন্তু, কোন বোতলে ওষুধ-ওয়ালা স্যাম্পেল আছে আর কোনটায় নেই, সেটা পরীক্ষককে জানানো হবে না। প্রতিটা বোতলের ওপর একটা কোড বসিয়ে সেই বোতল কোন দলে পড়ে সেটা একটা কাগজে লিখে রাখা হল। সেই কাগজটা মুড়ে পরীক্ষাগারের ছাদে টেপ দিয়ে সেঁটে রাখা হল!
পরীক্ষক এবার প্রতিটা বোতল থেকে দ্রবণ দিয়ে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে পর্যবেক্ষণ লিখে রাখল সেই বোতলের কোডের সাথে। সব কটা বোতল পর্যবেক্ষণ করার পর ছাদ থেকে নামানো হল সেই কোডের তালিকা। এবার দেখা গেল ওষুধ-ওয়ালা আর ওষুধ-ছাড়া বোতলের কার্যকারিতার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই! বেনভেনিস্তের মূল গবেষণাপত্রে কোনো observer bias হয়েছিল তাই মনে করা হল। সম্ভবত, পরীক্ষকরা প্রভাবিত হয়েছিল উত্তর কী আসা উচিত তার ওপর নিজেদের বিশ্বাস থেকে।
পর্যবেক্ষকের পক্ষপাত দূর করার জন্য পরীক্ষায় এই Double Blinding পদ্ধতি এখন বহুল ব্যবহৃত। উদাহরণ স্বরূপ, কোভিডের নতুন একটা টিকা কার্যকরী কিনা বুঝতে controlled randomized trial করা হয়েছে। এখানে, বাজারে আসার আগে যেসব স্বেচ্ছাসেবী টিকা নিয়েছে এই trial-এর অংশ হিসাবে, তাদের অনেককে যে ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তাতে টিকা ছিল, আর অন্যদের ইনজেকশনে টিকা ছিলই না (একে ডাক্তারী ভাষায় placebo বলা হয়)। কাকে টিকা দেওয়া হয়েছে আর কাকে প্লাসিবো দেওয়া হয়েছে, সেই তালিকাটা ডাক্তারও জানে না আর স্বেচ্ছাসেবীও জানে না। সেই তালিকাটা লুকিয়ে রাখা হয় পুরো পরীক্ষাটার সময়ে। ইনজেকশন পেয়ে কতজন পরে কোভিড আক্রান্ত হল আর কতজন হল না সেই তথ্য জোগাড় করে তারপর পরীক্ষক জানতে পারেন আসলে কে টিকা পেয়েছিল আর কে প্লাসিবো পেয়েছিল। যদি দেখা যায়, যারা প্লাসিবো পেয়েছিল তারা গড়ের ওপর বেশি কোভিডে আক্রান্ত হল টিকা যারা পেয়েছিল তাদের তুলনায়, তবেই সেই টিকা কার্যকরী হিসাবে গণ্য হবে।
পদার্থবিজ্ঞানের পরীক্ষার ক্ষেত্রেও Blinding ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, খুব সূক্ষ্ম পরীক্ষায় যেমন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের খোঁজ বা ইলেকট্রনের গঠন কী (electric dipole moment মাপা) – এই সব পরীক্ষায় Data blinding করা হয় যাতে পর্যবেক্ষকের পক্ষপাত কাটানো যায়।
সামাজিক জগতেও এই পক্ষপাত হামেশাই দেখি আমরা। কোনো ঘটনার সত্যতা যাচাই না করে অন্যে বলছে বলেই বিশ্বাস করে সেটা অন্যদের সাথে শেয়ার করা এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে [৫]। তাই, ছোটোবেলা থেকে হাতে-কলমে পরীক্ষা করে পক্ষপাত দূর করার পদ্ধতির অভ্যেস করা সামাজিক কারণেও বিশেষ প্রয়োজন।
আমাদের ব্লক টানার পরীক্ষাটি আপনারা যদি করেন তাহলে কিছু সতর্কতা নিতে পারেন। এক পর্যবেক্ষক পরীক্ষা করে তার উত্তর পরের জনকে না বলে খাতায় চুপিসারে লিখে রাখতে পারে। সবার দেখা হয়ে গেলে তবেই উত্তরগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। পরীক্ষাটা যদি একজন পর্যবেক্ষকই বারবার করে, তাকেও এই বিষয়ে সতর্ক হতে হবে যাতে তার একটি পর্যবেক্ষণ অন্যটাকে প্রভাবিত না করে। এক্ষেত্রে ছবি বা ভিডিও তুলে সেটা পরে কোনো সফটওয়্যার দিয়ে বিশ্লেষণ করার কথা ভাবা যেতে পারে।
গড় বল কত?
“আমরা যে বিভিন্ন রকম উত্তর পেলাম একই পরীক্ষা করে, তাহলে কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি? যদি প্রশ্ন করা হয়, কত বল দিয়ে টানলে ব্লকটা চলতে শুরু করছে, কী উত্তর দেব?”, প্রদীপ্তদা জিজ্ঞেস করলেন ছাত্রছাত্রীদের।
বেশ কিছুটা আলোচনার পর উত্তরটা বেরিয়ে এল, “স্যার, এই মানগুলোর গড় নিলে কেমন হয়?”
“খুব ভালো, গড় নিয়ে বল তাহলে কী উত্তর”, প্রদীপ্তদা মুচকি হেসে বললেন।
হিসেব কষে একজন বলল, “ ৩.২, ৩.২, ৩.২, ৩.২, ৩.০, ৩.৪, ৩.৪ -এর গড় পাচ্ছি ৩.২২৮৫৭১৪৩ । তাহলে, বলা যেতে পারে যে কাঠের ব্লকটাকে গড়ে ৩.২২৮৫৭১৪৩ নিউটন বল দিয়ে টানলে ব্লকটা চলতে শুরু করবে।”
প্রদীপ্তদার মুচকি হাসির কারণ বোঝা গেল এবার। স্প্রিং তুলাটা ক্লাসের সামনে উঁচু করে তুলে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “এই যন্ত্র দিয়ে সবথেকে সূক্ষ্ম কতটা বল মাপা যায়?”
ছাত্রছাত্রীরা হেসে উঠলো। এই প্রশ্নটা কর্মশালার শুরুতেই করা হয়েছিল। অনেকে উত্তরও দিয়েছিল যে ০.২ নিউটন।
“তোমার যন্ত্রের যদি ০.২ নিউটনের থেকে সূক্ষ্মভাবে মাপার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে তুমি আমাকে এত সূক্ষ্ম বল লাগবে সেটা উত্তর দিচ্ছ কেন? ৩.২২৮৫৭১৪৩ – দশমিকের পর এতগুলো অঙ্ক মাপলে কী করে?”, প্রদীপ্তদার প্রশ্ন!
একজন ছাত্রী সাহস করে বলেই ফেললো, “তাহলে স্যার, শুধু ৩.২ নিউটনই উত্তর দেব। approximation করে নিয়ে।”
“সাবাশ! ক্যালকুলেটার দশমিকের পর অনেক অঙ্ক দিলেও কতগুলো উত্তরে রাখা উচিত সেটা ভেবে দেখতে হবে। এটা শুধু তোমরা না, M.Sc লেভেলের ছাত্রছাত্রীরাও ভুল করে!”, হেসে শেষ করল প্রদীপ্তদা!
তারপর আমি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য তাদের ঘর্ষণ বলের কিছু কাল্পনিক মান বলে দিলাম। ঐগুলোর বেশ কিছু গড় মানের ধারে কাছেই নেই বরং তফাৎ অনেকটাই, অর্থাৎ কোনোটা ৩.২ নিউটনের থেকে অনেক বড় বা কোনোটা অনেক ছোটো। অথচ মজা এখানে যে ওই কাল্পনিক মানগুলির গড় কিন্তু ঐ ৩.২ নিউটন। এবার আমার প্রশ্ন ছিল: “দুক্ষেত্রে গড়মান একই হলেও কোনো পরীক্ষকের কাছে কোন ডাটা সেট বেশি নির্ভরযোগ্য”? তবে প্রায় বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই আমার এই প্রশ্নের পেছনে যা জানার উদ্দেশ্য ছিল, তা ভালো করে বুঝেই প্রথম ডাটা সেটের পক্ষে মত দেয়।
সহজ পরীক্ষা থেকে তাত্ত্বিক আলোচনা
হাতে-কলমে করা খুব সহজ পরীক্ষা থেকে অনেক কনসেপ্ট নিয়ে আলোচনা করা যায়। যেমন, এই ব্লক টানার পরীক্ষা থেকেই উঠে আসবে ঘর্ষণ বিষয়ে অনেক প্রশ্ন। যেমন, আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা! পরীক্ষার একদম শুরুতে, অর্থাত, যখন আমরা ব্লক টানা শুরু করিনি, তখন ঘর্ষণ বল কত? এবার, আস্তে আস্তে বল বাড়িয়ে ১ নিউটন কিংবা ২ নিউটন কিংবা ৩ নিউটন বল দিচ্ছি, সেক্ষেত্রেই বা ঘর্ষণ বল কত হবে?”
একজন বললো, “সব ক্ষেত্রেই ঘর্ষণ বল হবে ৩.৪ নিউটন”। আর একজনের উত্তর ছিল, “কোনো ক্ষেত্রে ঘর্ষণ বলের মান সঠিক ভাবে বলা যাবে না।” আর তিনটি মেয়ে বললো, “শূন্য বলের ক্ষেত্রে শূন্য, ১ এর বেলায় ১, ২ এর বেলায় ২, ও ৩ এর বেলায় ৩”। প্রতিমিত বলের ধারণা ছাত্রছাত্রীদের মনে করিয়ে দিয়ে একেবারে শেষের মতের পক্ষে রায় দিলাম আমরা।
উপসংহার
হাতে-কলমে বিজ্ঞানের এই কর্মশালাটি করার পিছনে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল একই পরীক্ষা বারবার করলে যে বিভিন্ন উত্তর আসতে পারে, সেটা দেখানো [৪]। এখান থেকে পরীক্ষার একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারণা – error analysis তার একটা প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল আমাদের। বাস্তবে দেখা গেল observer bias থেকে আরম্ভ করে বইতে পড়া তথ্যের সাথে (যেমন এককের মান) বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব – এগুলো ছাত্রছাত্রীদের বেশিরভাগ অংশের মধ্যেই রয়েছে। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ফিজিক্স টিচার্স এর প্রতিষ্ঠাতা ড. ডি. পি খান্ডেনওয়াল সেই কবে ১৯৯৩ সালে [২] লিখে গেছিলেন: “There appears to be total agreement that the greatest weakness in science education in India lies at the level of experimental skills“. খুব ছোটোবেলা থেকেই হাতে কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। তবে তা সার্বিক ভাবে সব স্তরে এবং সারা দেশ জুড়ে। এই তাগিদ থেকেই এইসব বিদ্যালয়ভিত্তিক কর্মশালার পরিকল্পনার উদ্যোগ। মোটের ওপর ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা আমাদেরকে এধরনের কাজ করতে আরও উৎসাহিত করলো। পাঠকের মধ্যে থেকে এই ধরণের হাতে-কলমে বিজ্ঞানচর্চার অভিজ্ঞতা জানার জন্য আমরা প্রবলভাবে কৌতূহলী।
প্রচ্ছদের ছবি: সূর্যকান্ত শাসমল
তথ্যসূত্র ও অতিরিক্ত
১। E. Davenas et al., Human basophil degranulation triggered by very dilute antiserum against IgE, Nature 333, 816–818 (1988)
২। সম্পাদকীয়: “Focus on Experimental Skills”, IAPT Bulletin, মে মাসের ইস্যু, ১৯৯৩
৩। https://www.youtube.com/watch?v=hw_vyY8hIGA – বেনভেনিস্তের পরীক্ষার উপর একটা ডকুমেন্টারি
৪। একই পরীক্ষা বারবার কেন করতে হয়, সেই নিয়ে এই লেখাটি দেখতে পারেন: https://bigyan.org.in/2021/05/why-same-object-is-measured-multiple-times/ ।
৫। হোয়াটস্যাপ ফরওয়ার্ড পেলে কিভাবে সেটা নেওয়া যেতে পারে, সেই নিয়ে এই পডকাস্ট-টি শুনতে পারেন: https://bigyan.org.in/2022/04/podcast-whatsapp-fake-or-not/ ।