‘রাগিণী বলি তাকেই যা আপনার ভিতরকার সমুদয় সা-রে-গা-মা-গুলোকে সংগীত করে তোলে, তার পর থেকে তাদের আর গোলমাল করবার সাধ্য থাকে না। কিন্তু, সংগীতের ভিতরে এক-একটি সুর অন্য-সকল সুরকে ছাড়িয়ে বিশেষ হয়ে ওঠে—কোনোটাতে মধ্যম, কোনোটাতে কোমলগান্ধার, কোনোটাতে পঞ্চম।’
আগের পর্বে পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি যে, কোনো একটি স্বর (ধরা যাক C) এবং তার দ্বিগুণ কম্পাঙ্কের স্বরের (তাকে বলা যাক C’) মধ্যবর্তী অঞ্চলটিকে একটি অক্টেভ বলা হয়। C এবং C’ স্বর দুটিকে আমাদের কানে প্রায় একইরকম শোনায় বলে সঙ্গীতের বিচারে এদের আলাদা স্বর ধরা হয় না। এই C আর C’ এর মাঝে আরও ছটি “শুদ্ধ” স্বর থাকে, যাদের চিহ্নিত করা হয় D, E, F, G, A এবং B দিয়ে। সুতরাং C থেকে শুরু করে B পর্যন্ত এক অক্টেভে মোট সাতটা শুদ্ধ স্বর হয়। তবে এক অক্টেভের ব্যবধানকে 12 টি ভাগে ভাগ করে সৃষ্ট বারো স্বরবিশিষ্ট ক্রোম্যাটিক স্কেল সঙ্গীত রচনার মূল কাঠামো হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
সঙ্গীত রচনা বা পরিবেশন করার সময় এই ১২ টি স্বর থেকে বিশেষ কয়েকটি স্বর কে বেছে নিয়ে কেবল সেইগুলি রচনাটিতে ব্যবহার করা হয়। ভাষার যেমন বর্ণমালা থাকে এও ঠিক সেরকম একধরণের সাঙ্গীতিক বর্ণমালা। সঙ্গীতে ব্যবহৃত স্বরসমূহের একটি সুবিন্যস্ত ক্রমকে স্কেল বা স্বরগ্রাম বলা হয়। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে নানারকম স্কেল গঠনের গাণিতিক ভিত্তি নিয়ে আমরা আগের পর্বে আলোচনা করেছি।
এই পর্বে আমরা ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন স্কেল বা স্বরগ্রাম নিয়ে আলোচনা করবো। শুরুতে বলে রাখা ভালো যে ভারতীয় সঙ্গীতে দুটি পৃথক পদ্ধতি প্রচলিত আছে—উত্তর-ভারতীয় হিন্দুস্তানী সঙ্গীত ও দক্ষিণ-ভারতীয় কর্নাটকী সঙ্গীত। দুই পদ্ধতির স্বরের নাম ও স্বরের অবস্থান এক নয়। আজকের আলোচনায় আমরা হিন্দুস্তানী সঙ্গীত পদ্ধতির স্বরতালিকাই অনুসরণ করবো।
ভারতীয় সঙ্গীতের পরিভাষা
ভারতীয় সঙ্গীতেও এক অক্টেভে শুদ্ধ স্বরের সংখ্যা সাত, এই সংখ্যাটার ভিত্তিতে অক্টেভের নাম দেওয়া হয়েছে সপ্তক। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মতোই ভারতীয় সঙ্গীতেও শুদ্ধ এবং কড়ি ও কোমল মিলিয়ে এক সপ্তকে স্বরসংখ্যা বারো, কিন্তু এই বারোটি স্বর বাইশটি “শ্রুতি”-র ওপর অবস্থিত। এই শ্রুতি হলো ভারতীয় সঙ্গীতের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা আমাদের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের আলোচনায় আসেনি। তাই শুরুতে শ্রুতি কী, সেটা জেনে নেওয়া যাক।
অসংখ্য নাদ বা শব্দ থেকে যে নাদগুলি পরস্পরের পার্থক্যসহ বিশেষভাবে শোনা যায়, সঙ্গীতশাস্ত্রে তাদের নাম শ্রুতি। অতএব স্বরের সূক্ষ্মতর বিভাগের নাম শ্রুতি। আধুনিক মত অনুসারে এক শ্রুতি থেকে আর এক শ্রুতির ব্যবধান সমান নয়।
প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতে বাইশটি শ্রুতির ওপর সাতটি শুদ্ধ স্বরকে স্থাপিত করে সেই সাত স্বরের ক্রমিক সমষ্টিকে বলা হতো গ্রাম। অর্থাৎ ভারতীয় সঙ্গীতের ভিত্তি তৈরী করেছে সাতটি মূলস্বর। সাতটি মূলস্বরের সমন্বয়ে গঠিত এই স্বরগ্রামকে বলা হয় সপ্তক। স্বরগুলি হলো সা (ষড়জ), রে (ঋষভ), গা (গান্ধার), মা (মধ্যম), পা (পঞ্চম), ধা (ধৈবত), নি (নিষাদ)। এই সাতটি স্বরের সঙ্গে পরবর্তী সা স্বরটিকে অন্তর্ভুক্ত করে গঠিত হয় একটি অষ্টক। ভারতীয় শুদ্ধ সপ্তক পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মেজর স্কেলের সমতুল।
একটি নির্দিষ্ট স্বরগ্রামের ক্ষেত্রে সপ্তকের প্রথম ও পঞ্চম স্বর—সা এবং পা-এর কম্পাঙ্ক স্থির। তাই এদের বলা হয় অটল স্বর। অন্য পাঁচটি স্বর—রে, গা, মা, ধা, নি—এদের প্রত্যেকের দুটি করে পৃথক রূপ আছে। এক্ষেত্রে পাঁচটি শুদ্ধ স্বর ছাড়াও রয়েছে পাঁচটি কড়ি বা কোমল স্বর। এই স্বরগুলি হলো ঋ, জ্ঞ, হ্ম, দ, ণ—এর মধ্যে ঋ, জ্ঞ, দ, ণ যথাক্রমে শুদ্ধ রে, গা, ধা, নি-র কোমল স্বর বা কম কম্পাঙ্কের স্বর এবং হ্ম হলো শুদ্ধ মা-এর কড়ি বা তীব্র স্বর অর্থাৎ উচ্চ কম্পাঙ্কের স্বর। বস্তুত, একটি সপ্তকের মধ্যে সাতটি শুদ্ধ এবং কড়ি ও কোমল মিলিয়ে পাঁচটি অর্থাৎ মোট বারোটি স্বর আছে।
ভারতীয় সঙ্গীতে মূলত তিনটি প্রধান সপ্তক ব্যবহৃত হয়। মধ্য সপ্তক হলো এমন একটি স্বরগ্রাম যা গায়কের কণ্ঠের বা বাদকের যন্ত্রের সর্বাধিক স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। অন্যান্য স্কেল অর্থাৎ ভিন্ন মাত্রার স্বরগ্রামগুলি মধ্য সপ্তকের সাপেক্ষে নির্দিষ্ট করা হয়। সুতরাং, মধ্য সপ্তক থেকেই সমস্ত গণনার শুরু। কম্পাঙ্কের বিচারে মধ্য সপ্তকের নিম্নের অষ্টককে বলা হয় মন্দ্র সপ্তক এবং উচ্চ অষ্টককে বলা হয় তার সপ্তক। অর্থাৎ মন্দ্র সপ্তক হলো মধ্য সপ্তকের তুলনায় খাদের স্বরসমষ্টি আর তার সপ্তক হলো মধ্য সপ্তকের তুলনায় চড়ার স্বরসমষ্টি। ভারতীয় সঙ্গীতে মন্দ্র এবং তার সপ্তকের স্বরগুলি বোঝাতে যথাক্রমে হসন্ত (্) এবং রেফ (′) চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।
১ নং ছকে ইকোয়াল টেম্পার্ড স্কেল অনুযায়ী ভারতীয় স্বরসপ্তকের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যেখানে প্রদত্ত কম্পাঙ্কগুলি একটি তিন অক্টেভসম্পন্ন হারমোনিয়ামের রীডগুলির কম্পনে উৎপন্ন স্বরসমূহের কম্পাঙ্ক। ছকের ৩ নং স্তম্ভে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের একটি স্বর বা নোটের নাম এবং তার পাশে সংশ্লিষ্ট অক্টেভ সংখ্যা দেওয়া আছে। এটি স্বরলিপি বা নোটেশন লেখার একটি বিশেষ পদ্ধতি যাকে বলা হয় বিজ্ঞানসম্মত পিচ নোটেশন। অক্টেভসংখ্যা ‘শূন্য’ মানুষের শব্দ উপলব্ধির সর্বনিম্ন সীমা নির্দেশ করে। ছকের ৪ নং স্তম্ভে প্রদত্ত কম্পাঙ্কগুলির প্রতিটির মান আগেরটির ঠিক গুণ।
সপ্তক | ভারতীয় সঙ্গীতের স্বর | পাশ্চাত্য সঙ্গীতের স্বর | কম্পাঙ্ক (হার্ৎস) | বাদ্যযন্ত্রের চাবির রঙ |
---|---|---|---|---|
মন্দ্র | সা্ | 130.81 | সাদা | |
ঋ্ | 138.59 | কালো | ||
রে্ | 146.83 | সাদা | ||
জ্ঞ্ | 155.56 | কালো | ||
গা্ | 164.81 | সাদা | ||
মা্ | 174.61 | সাদা | ||
হ্ম্ | 185.00 | কালো | ||
পা্ | 196.00 | সাদা | ||
দ্ | 207.65 | কালো | ||
ধা্ | 220.00 | সাদা | ||
ণ্ | 233.08 | কালো | ||
নি্ | 246.94 | সাদা | ||
মধ্য | সা | 261.63 | সাদা | |
ঋ | 277.18 | কালো | ||
রে | 293.67 | সাদা | ||
জ্ঞ | 311.13 | কালো | ||
গা | 329.63 | সাদা | ||
মা | 349.23 | সাদা | ||
হ্ম | 369.99 | কালো | ||
পা | 392.00 | সাদা | ||
দ | 415.30 | কালো | ||
ধা | 440.00 | সাদা | ||
ণ | 466.16 | কালো | ||
নি | 493.88 | সাদা | ||
তার | র্সা | 523.25 | সাদা | |
র্ঋ | 554.37 | কালো | ||
র্রে | 587.33 | সাদা | ||
র্জ্ঞ | 622.25 | কালো | ||
র্গা | 659.26 | সাদা | ||
র্মা | 698.46 | সাদা | ||
র্হ্ম | 739.99 | কালো | ||
র্পা | 783.99 | সাদা | ||
র্দ | 830.61 | কালো | ||
র্ধা | 880.00 | সাদা | ||
র্ণ | 932.33 | কালো | ||
র্নি | 987.77 | সাদা |
বাদী স্বর এবং স্বর-সম্বাদ
ভারতীয় রাগসঙ্গীত পরিবেশনে একজন গায়ক বা বাদকের কল্পনাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং একটি একটি করে স্বর গাওয়া বা বাজানো হয়। এক্ষেত্রে দুটি স্বরের শুভ-সম্বাদ (consonance) রসসৃষ্টির মূল উপাদান। এই consonance এর ধারণা যে শুধুমাত্র দুটি স্বরের যুগপৎ ধ্বনির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এমন নয়, মানুষের স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিতে থাকা একটি স্বরের রেশ তার পরবর্তী স্বরের সঙ্গে মনস্তাত্বিক উপায়ে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে এবং সাঙ্গীতিক consonance এর ধারণা এই ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাগসঙ্গীতে ষড়জ-পঞ্চম এবং ষড়জ-মধ্যম এই দুই প্রকার স্বর-সম্বাদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সেই হিসাবে সা-পা, রে-ধা, গা-নি, মা-র্সা—এই স্বরযুগল হলো ষড়জ-পঞ্চম ভাবযুক্ত স্বর। ষড়জ-মধ্যম ভাবযুক্ত স্বরযুগল হলো সা-মা, রে-পা, গা-ধা, মা-নি, পা-র্সা।
রাগসঙ্গীতে ব্যবহৃত স্বরসমূহের মধ্যে যে স্বরটি সর্বাধিক প্রাধান্য লাভ করে অর্থাৎ রাগে যে স্বরের প্রয়োগ সর্বাপেক্ষা বেশি হয় তাকে বাদী বা প্রধান স্বর বলে। এই স্বর বিভিন্ন রাগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন। যেমন কাফী রাগের বাদী স্বর হলো পা, ভৈরবী রাগের বাদী স্বর মা ইত্যাদি। কোনো রাগে যে স্বরগুলি ব্যবহার করা হয় তাদের কম্পাঙ্ক নির্ধারিত হয় এই বাদী স্বরের সাপেক্ষে consonance বিবেচনা করে। তাই বিভিন্ন রাগে ব্যবহৃত একই নাম দ্বারা সূচিত স্বরের কম্পাঙ্ক ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্ন হয়। তবে অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট স্কেলের ক্ষেত্রে সা এবং পা এই দুটি অটল স্বরের কম্পাঙ্ক সবসময় এক।
বিভিন্ন রাগের ভিন্ন ভিন্ন বাদী স্বরের সাপেক্ষে কোনো একটি স্বরের consonance-এর সূক্ষ্ম তারতম্যের কারণে ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরগুলির স্থানের হিসাব ইকোয়াল টেম্পার্ড স্কেল অনুযায়ী হয় না। আর এখানেই বাইশটি শ্রুতির গুরুত্ব। একটি বিশেষ রাগের অন্তর্গত স্বরগুলির সঠিক অবস্থান এই বাইশটি শ্রুতির ওপরেই নির্ণয় করা হয়।
স্বরের নাম | ভারতীয় শ্রুতির নিরিখে বিবেচ্য স্বরের কম্পাঙ্কের অনুপাত (প্রাথমিক স্বরের সাপেক্ষে) |
---|---|
সা | 1 |
অতিকোমল রে | 256/243=1.053 |
কোমল রে | 16/15=1.067 |
শুদ্ধ রে | 10/9=1.111 |
তীব্র রে | 9/8=1.125 |
অতিকোমল গা | 32/27=1.185 |
কোমল গা | 6/5=1.200 |
শুদ্ধ গা | 5/4=1.250 |
তীব্র গা | 81/64=1.266 |
শুদ্ধ মা | 4/3=1.333 |
একশ্রুতি মা | 27/20=1.350 |
তীব্র মা | 45/32=1.406 |
তীব্রতর মা | 729/512=1.424 |
পা | 3/2=1.500 |
অতিকোমল ধা | 128/81=1.580 |
কোমল ধা | 8/5=1.600 |
শুদ্ধ ধা | 5/3=1.667 |
তীব্র ধা | 27/16=1.688 |
অতিকোমল নি | 16/9=1.778 |
কোমল নি | 9/5=1.800 |
শুদ্ধ নি | 15/8=1.875 |
তীব্র নি | 243/128=1.898 |
২ নং ছকে বাইশটি শ্রুতির ওপর অবস্থিত ভারতীয় স্বরসমূহের কম্পাঙ্কের অনুপাতগুলি (প্রাথমিক স্বরের সাপেক্ষে) দেওয়া হয়েছে। আগে যে শুদ্ধ স্বর এবং তার কড়ি বা কোমল যেকোনো একটি রূপের কথা বলা হচ্ছিলো, সেই স্বরগুলির আরও সূক্ষ্ম শ্রেণীবিভাগ এখানে দেখা যাচ্ছে। যেকোনো একটি স্বর, ধরা যাক কোমল রে, দুটি রাগে ব্যবহৃত হলে একটি ক্ষেত্রে হতে পারে অতিকোমল রে (সা এর সাপেক্ষে যার কম্পাঙ্কের অনুপাত ) , অন্যক্ষেত্রে কোমল রে (সা এর সাপেক্ষে যার কম্পাঙ্কের অনুপাত )। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ভারতীয় সঙ্গীতে স্বর নির্ণয়ের এই শিক্ষা মূলত গুরুমুখী যা মৌখিক প্রথা অনুযায়ী গৃহীত, সংরক্ষিত এবং এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে প্রেরিত হয়।
অবশ্য তার মানে এই নয় যে কোনো রাগে একসাথে বাইশটি আলাদা আলাদা কম্পাঙ্কের শ্রুতি ব্যবহার করা হয়। কোনো একটি সঙ্গীতের জন্য ব্যবহৃত স্বরের সংখ্যা সবসময় বারোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে বিভিন্ন রাগে একই নাম দ্বারা সূচিত স্বরের কম্পাঙ্কের এই সূক্ষ্ম তারতম্যের কারণে হারমোনিয়াম বা পিয়ানোর মতো স্থির কম্পাঙ্কের বাদ্যযন্ত্রে মার্গসঙ্গীতের প্রয়োজনমাফিক কম্পাঙ্কের স্বর সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। যদিও পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলিতে আমরা ইকোয়াল টেম্পার্ড স্কেলের সুবিধার কথা মাথায় রেখে এই স্কেলের নিরিখেই ভারতীয় সঙ্গীতের আলোচনা করবো।
স্কেল পরিবর্তন
ভারতীয় সঙ্গীত মধ্য সপ্তকের অবস্থান বা স্বরগুলির কম্পাঙ্ক নিরপেক্ষ। অবশ্য স্বরগুলির কম্পাঙ্কের পরমমান অনির্দিষ্ট হলেও তাদের অনুপাতগুলি কিন্তু স্থির। এক্ষেত্রে গায়ক বা বাদক তাঁর কণ্ঠের বা যন্ত্রের স্বাচ্ছন্দ্য অনুযায়ী মধ্য সপ্তকের প্রাথমিক স্বর সা-এর অবস্থান নির্দিষ্ট করেন।
সঙ্গীতের মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে সপ্তকের প্রাথমিক স্বরটির কম্পাঙ্ক বা অবস্থান পরিবর্তনকেই স্কেল পরিবর্তন বলা হয়। ৩ নং ছকে সপ্তকের মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে প্রাথমিক স্বরের অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টি দেখানো হয়েছে। প্রাথমিক স্বরটির এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে স্থানান্তরের দরুন অষ্টকের সবকটি স্বরেরই সমপরিমাণ স্থানান্তর ঘটে। ধরা যাক, কোনো ব্যক্তি ক, স্কেলে গান করেন অর্থাৎ তাঁর মধ্য সপ্তকের প্রাথমিক স্বরের কম্পাঙ্ক বর্ণ দ্বারা চিহ্নিত স্বরের কম্পাঙ্কের সমান। যদি আরেক ব্যক্তি খ, স্কেলে গান করেন, তাহলে আমরা বলতে পারি যে, খ ব্যক্তির কণ্ঠের স্বাভাবিক কম্পাঙ্ক ক ব্যক্তির তুলনায় গুণ বা মোটামুটি গুণ উঁচু।
বর্তমানে হারমোনিয়ামের স্কেল-পরিবর্তন ক্রিয়াবিধির দরুন আমরা চাবির পরিবর্তন ছাড়াই এক স্কেল থেকে অন্য স্কেলে যেতে পারি। এক্ষেত্রে বাদক মধ্য সপ্তকের কম্পাঙ্কের যেকোনো পরিবর্তনের জন্য বাদ্যযন্ত্রের উপর অঙ্গুলি সঞ্চালনের অভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেন। অর্থাৎ, বাদ্যযন্ত্রের স্কেল পরিবর্তন ক্রিয়াবিধি চাবির পরিবর্তন ছাড়াই কম্পাঙ্ক পরিবর্তনকে সুনিশ্চিত করে।
পাশ্চাত্য সঙ্গীতের স্বর | কম্পাঙ্ক (হার্ৎস) | স্কেল ও ভারতীয় স্বর | |||
---|---|---|---|---|---|
-মেজর | -মেজর | -মেজর | -মেজর | ||
130.81 | সা্ | ||||
138.59 | ঋ্ | ||||
146.83 | রে্ | ||||
155.56 | জ্ঞ্ | ||||
164.81 | গা্ | ||||
174.61 | মা্ | সা | |||
185.00 | হ্ম্ | ঋ | |||
196.00 | পা্ | রে | |||
207.65 | দ্ | জ্ঞ | |||
220.00 | ধা্ | গা | সা | ||
233.08 | ণ্ | মা | ঋ | সা | |
246.94 | নি্ | হ্ম | রে | ঋ | |
261.63 | সা | পা | জ্ঞ | রে | |
277.18 | ঋ | দ | গ | জ্ঞ | |
293.67 | রে | ধা | মা | গা | |
311.13 | জ্ঞ | ণ | হ্ম | মা | |
329.63 | গা | নি | পা | হ্ম | |
349.23 | মা | র্সা | দ | পা | |
369.99 | হ্ম | ধা | দ | ||
392.00 | পা | ণ | ধা | ||
415.30 | দ | নি | ণ | ||
440.00 | ধা | র্সা | নি | ||
466.16 | ণ | র্সা | |||
493.88 | নি |
ঠাট পরিচয়
ঠাট হলো পাশ্চাত্য সঙ্গীতের স্কেলের সমতুল্য। ঠাট কথাটির অর্থ কাঠামো। যেকোনো ঠাট সপ্তস্বরের সমন্বয়ে গঠিত এবং প্রসারিত সপ্তকের অন্তর্গত বারোটি স্বর থেকে বিভিন্ন ঠাটের সৃষ্টি হয়েছে। ঠাট থেকেই বিভিন্ন রাগ উৎপন্ন হয়। বর্তমানে যেমন কোন রাগে কী স্বর ব্যবহৃত হয়, তা বোঝাবার জন্য ঠাটের উল্লেখ করা হয়, আগে তেমন উল্লেখ করা হতো মূর্ছনার নাম। বর্তমান কালে মূর্ছনা পরিভাষাটি আর ব্যবহার করা হয় না। তার বদলে ঠাট কথাটিই প্রচলিত হয়ে গেছে। আধুনিক ঠাট পদ্ধতির সৃষ্টিকার হলেন পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে নামক একজন সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি সপ্তস্বরের সেইসব বিন্যাসগুলিকে ঠাট বলে অভিহিত করেছিলেন যেখানে স্বরগুলি কম্পাঙ্কের ক্রমোচ্চ বিন্যাসে সাজানো থাকে এবং কোনো স্বরের শুদ্ধ ও কড়ি বা কোমল রূপ একইসাথে উপস্থিত থাকে না। এখন সপ্তকের সাতটি স্বরের মধ্যে পাঁচটি স্বরের প্রত্যেকটির দুটি করে পৃথক রূপ আছে। তাহলে সপ্তস্বর সমন্বিত ঠাটের সম্ভাব্য মোট সংখ্যা হলো । এর মধ্যে 10 টি ঠাট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং উত্তর ভারতীয় বা হিন্দুস্তানী সঙ্গীতে সর্বাধিক প্রচলিত।
ধ্রুপদী সঙ্গীতে স্কেল পরিবর্তন একটি প্রগাঢ় এবং জটিল প্রক্রিয়াকে বোঝায়। সঙ্গীতে প্রত্যেক ঠাটের একটি নিজস্ব স্বরসমষ্টি আছে যা সেই ঠাটের অন্তর্গত রাগগুলিকে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। ইকোয়াল টেম্পার্ড স্কেলে একটি অষ্টকের সাতটি শুদ্ধ স্বর সমদূরবর্তী (লগারিদমিক স্কেলে) নয়। কেবল শুদ্ধ স্বরগুলিকে বিবেচনা করে যদি অষ্টকের স্থান পরিবর্তন ঘটানো হয়, তাহলে তা আগের অনুচ্ছেদে বর্ণিত সরল স্কেল পরিবর্তন অপেক্ষা ভিন্ন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায়। ৪ নং ছকে এই শুদ্ধ স্বরগুলির স্থান পরিবর্তনের বিষয়টি দেখানো হয়েছে।
প্রথমে, বিলাবল ঠাটটির অষ্টক বিবেচনা করা যাক। যেহেতু ভারতীয় সপ্তক পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মেজর স্কেলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, শুদ্ধ স্বরগুলির মধ্যেকার ব্যবধানের বিন্যাস হয় TTSTTTS, যেখানে T এবং S যথাক্রমে এবং গুণকদুটির প্রতীক। বিলাবল ঠাটের স্বরসমষ্টি সাতটি শুদ্ধ স্বর নিয়ে গঠিত অর্থাৎ স্বরগুলির মধ্যেকার ব্যবধানের বিন্যাস হলো TTSTTTS।
এখন, সপ্তকের শুদ্ধ স্বরগুলিকে যদি বিলাবল ঠাটের শুদ্ধ স্বরগুলির সাপেক্ষে একটি করে অবস্থান পিছিয়ে বসানো হয়, তাহলে যা পাওয়া যাবে তা ৪ নং ছকের তৃতীয় স্তম্ভে দেখানো হয়েছে। এক্ষেত্রে স্বরগুলির মধ্যে ব্যবধানের বিন্যাস TSTTTST। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের স্কেলের সংজ্ঞা অনুযায়ী, এই বিন্যাস মেজর স্কেল সূচিত করে না। যেহেতু ভারতীয় সঙ্গীতের ভিত্তি অর্থাৎ স্বরসপ্তক মেজর স্কেলের অনুসরণে নির্মিত, তাই, তৃতীয় স্তম্ভে প্রদত্ত স্থানান্তরিত স্বরগুলির প্রাথমিক স্বর সা থেকে শুরু করে প্রসারিত স্বরসপ্তক কল্পনা করলে যে বিন্যাস পাওয়া যাবে তা দেখানো হয়েছে ৪ নং ছকের চতুর্থ স্তম্ভে। তৃতীয় এবং চতুর্থ স্তম্ভের স্বরবিন্যাস থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, এক্ষেত্রে স্বরসমষ্টি দুটি কোমল স্বর দিয়ে গঠিত—জ্ঞ এবং ণ। এই নতুন স্বরসমূহ—সা, রে, জ্ঞ, মা, পা, ধা, ণ—একটি নতুন ঠাট সূচিত করে যার নাম কাফী।
এইভাবে শুদ্ধ স্বরগুলির স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন ঠাট সৃষ্টি হয়। ৪ নং ছকের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ স্তম্ভ থেকে দেখা যাচ্ছে, ভৈরবী ঠাটের স্বরসমূহ হলো সা, ঋ, জ্ঞ, মা, পা, দ, ণ।
পরবর্তী সপ্তম এবং অষ্টম স্তম্ভ অনুযায়ী, কল্যাণ ঠাটের স্বরগুলি হলো সা, রে, গা, হ্ম, পা, ধা, নি।
খাম্বাজ ঠাট সূচিত করে যে স্বরসমূহ, তা হলো সা, রে, গা, মা, পা, ধা, ণ।
পরিশেষে, একাদশ ও দ্বাদশ স্তম্ভে দেখানো হয়েছে আশাবরী ঠাটের স্বরগুলিকে। এই রাগে ব্যবহৃত স্বরগুলি হলো সা, রে, জ্ঞ, মা, পা, দ, ণ।
বিলাবল | কাফী | ভৈরবী | কল্যাণ | খাম্বাজ | আশাবরী | — | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
স্বর | প্রসারিত সপ্তক | স্বর | স্থানান্তরিত সপ্তক | স্বর | স্থানান্তরিত সপ্তক | স্বর | স্থানান্তরিত সপ্তক | স্বর | স্থানান্তরিত সপ্তক | স্বর | স্থানান্তরিত সপ্তক | স্বর | স্থানান্তরিত সপ্তক |
সা | সা | ||||||||||||
– | ঋ | ||||||||||||
রে | রে | সা | সা | ||||||||||
– | জ্ঞ | – | ঋ | ||||||||||
গা | গা | রে | রে | সা | সা | ||||||||
মা | মা | গা | জ্ঞ | রে | ঋ | সা | সা | ||||||
– | হ্ম | – | গা | – | রে | – | ঋ | ||||||
পা | পা | মা | মা | গা | জ্ঞ | রে | রে | সা | সা | ||||
– | দ | – | হ্ম | – | গা | – | জ্ঞ | – | ঋ | ||||
ধা | ধা | পা | পা | মা | মা | গা | গা | রে | রে | সা | সা | ||
– | ণ | – | দ | – | হ্ম | – | মা | – | জ্ঞ | – | ঋ | ||
নি | নি | ধা | ধা | পা | পা | মা | হ্ম | গা | গা | রে | রে | সা | সা |
র্সা | র্সা | নি | ণ | ধা | দ | পা | পা | মা | মা | গা | জ্ঞ | রে | ঋ |
– | র্ঋ | – | নি | – | ধা | – | দ | – | হ্ম | – | গা | – | রে |
র্রে | র্রে | র্সা | র্সা | নি | ণ | ধা | ধা | পা | পা | মা | মা | গা | জ্ঞ |
– | র্জ্ঞ | – | – | নি | – | ণ | – | দ | – | হ্ম | – | গা | |
র্গা | র্গা | র্রে | র্সা | র্সা | নি | নি | ধা | ধা | পা | পা | মা | মা | |
র্মা | র্মা | র্গা | র্রে | র্সা | র্সা | নি | ণ | ধা | দ | পা | হ্ম | ||
– | র্হ্ম | – | – | – | – | নি | – | ধা | – | পা | |||
র্পা | র্পা | র্মা | র্গা | র্রে | র্সা | র্সা | নি | ণ | ধা | দ | |||
– | র্দ | – | – | – | – | নি | – | ধা | |||||
র্ধা | র্ধা | র্পা | র্মা | র্গা | র্রে | র্সা | র্সা | নি | ণ | ||||
– | র্ণ | – | – | – | – | – | নি | ||||||
র্নি | র্নি | র্ধা | র্পা | র্মা | র্গা | র্রে | র্সা | র্সা |
এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, উপরোক্ত শুদ্ধ স্বর স্থানান্তরের সবকটি ধাপেই পা স্বরটি শুদ্ধ স্বর হিসাবেই অবস্থান করছে। ব্যতিক্রম কেবল ৪ নং ছকের সর্বশেষ স্তম্ভদুটিতে দেখানো স্বরবিন্যাস। কিন্তু আমরা জানি যে, ভারতীয় সঙ্গীতে সা এবং পা—এই দুটি স্বরের কোনো কড়ি বা কোমল রূপ নেই। অর্থাৎ সা এবং পা হলো অটল স্বর। এখন ৪ নং ছকের ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ স্তম্ভদুটি লক্ষ্য করলেই দেখা যায় যে, এক্ষেত্রে শুদ্ধ স্বর পা, কড়ি স্বর হ্ম-তে স্থানান্তরিত হয়েছে। যেহেতু, এই স্বরবিন্যাসে পা স্বরের অবিকৃত রূপটি লঙ্ঘিত হচ্ছে, তাই এটিকে কোনো স্বীকার্য ঠাট বলা যায় না। সুতরাং, যে পরিবর্তনে অটল স্বর পা, শুদ্ধস্বর হিসাবে স্থানান্তরিত না হয়, সেই পরিবর্তনটি গ্রাহ্য নয়।
এইরূপ স্কেল পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা কেবল ছয়টি ঠাটের সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করতে পারি।
হারমোনিয়াম: একটি জনপ্রিয় সাঙ্গীতিক বাদ্যযন্ত্র
আমাদের দেশে কণ্ঠসঙ্গীত শিক্ষার্থীদের উপযোগী যতগুলি সহযোগী যন্ত্র আছে, ব্যবহারের দিক থেকে সবচেয়ে সহজ হলো হারমোনিয়াম। নতুন শিক্ষার্থীরা অতি সহজেই এর সাহায্যে গান শেখা আরম্ভ করতে পারে। হারমোনিয়ামে বাঁধা চাবিগুলির ওপর এক হাতের আঙুলের মৃদু চাপ দিয়ে, অন্য হাতে বেলোটিকে টানলেই স্বর বেজে ওঠে। এই বাদ্যযন্ত্রে রীড বা ধাতুনির্মিত পাতের সাহায্যে স্বর উৎপাদন করা হয়। বেলোটি একটি বায়ুপূর্ণ প্রকোষ্ঠ থেকে বাতাস পাঠিয়ে নির্দিষ্ট চাবির সঙ্গে সংযুক্ত ধাতুপাতকে কম্পিত করে। হারমোনিয়ামের যেকোনো রীড বাজালে আমরা যে শব্দ শুনি, তা কেবল একটিমাত্র কম্পাঙ্কবিশিষ্ট সুর নয়, বরং তা মূলসুর এবং অনেকগুলি সমমেলের সমন্বয়ে গঠিত। এক্ষেত্রে মূলসুরটির কম্পনের বিস্তার সর্বোচ্চ এবং উচ্চ কম্পাঙ্কের সমমেলগুলির বিস্তার ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো স্বরের কম্পাঙ্ক বলতে মূলসুরটির কম্পাঙ্ককেই বোঝানো হয়। হারমোনিয়ামের স্বরের সঙ্গে অন্যান্য যন্ত্রের স্বর মিলিয়ে নেওয়া হয়। হারমোনিয়ামে একটা স্বরকে যতক্ষণ ইচ্ছে একটানা বাজানো যায়। বাদক তার কণ্ঠের শক্তি অনুযায়ী হারমোনিয়ামের যেকোনো চাবি থেকে সা শুরু করতে পারেন।
হারমোনিয়াম যন্ত্রটি প্রথমে ডায়াটনিক স্কেল অনুসারে তৈরী করা হয়েছিল। কিন্তু, একটা মারাত্মক অসুবিধা দেখা গেলো এতে। যে চাবিটিকে সা স্বরের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলো, সেই চাবিটির পরিবর্তে যদি অন্য কোনো চাবিকে সা বলে ধরা হয়, তাহলে অন্য স্বরগুলো সব বেসুরো হয়ে যাবে। এখন যেমন হারমোনিয়ামের যেকোনো চাবিকেই নিজের সুবিধা মতো সা বলে ধরে নেওয়া যায়, ডায়াটনিক স্কেলে বাঁধা হারমোনিয়ামে সে সুবিধা ছিলো না। তার কারণ, এই স্কেলে সা থেকে রে এবং রে থেকে গা স্বরের মধ্যবর্তী ব্যবধান পৃথক—স্বরানুপাতদুটি যথাক্রমে এবং । কাজেই রে স্বরটিকে যদি সা ধরে নেওয়া হয়, তাহলে গা হয়ে যাবে রে। আর সে অবস্থায়, সা ও রে স্বরদুটির জন্য স্বরানুপাতটি হয়ে যাবে এর পরিবর্তে । অতএব, রে বেসুরো লাগবে। সুতরাং, ডায়াটনিক স্কেলের অসুবিধা হলো, যে চাবিটিকে সা-এর জন্য নির্দিষ্ট করা আছে, সেই স্বরে যদি গায়কের গলা না মেলে, তবে ওই নির্দিষ্ট চাবিটির পরিবর্তে অন্য কোনো চাবিকে সা বলে গ্রহণ করা যায় না।
শেষ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান বেরোলো একটা। অষ্টকের অন্তর্গত সমস্ত স্বরগুলির ব্যবধানই রাখা হলো সমান। এই যে সমান স্বরান্তর যুক্ত স্কেল, একেই ইংরাজীতে বলা হয় ইকোয়াল টেম্পার্ড স্কেল (Equal Tempered Scale), ভারতীয় ভাষায় সমবিভাগীয় স্কেল। এই স্কেলে একটি অষ্টক বারোটি পরস্পর সমদূরবর্তী (লগারিদমিক স্কেলে) স্বরের সমন্বয়ে গঠিত অর্থাৎ পরপর দুটি স্বরের কম্পাঙ্কের অনুপাত সমান। এরপর থেকে হারমোনিয়াম, পিয়ানো ইত্যাদি যন্ত্র এই নিয়মে তৈরী হতে লাগলো। যেকোনো রীড বাদ্যযন্ত্রে সমবিভাগীয় স্কেলে একটি অষ্টকের বারোটি স্বরের সঙ্গে ভারতীয় সপ্তকের স্বরগুলিকে সংযুক্ত করা হয়। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে এই বারোটি স্বরকে চিহ্নিত করা হয়েছে যথাক্রমে C, C♯, D, D♯, E, F, F♯, G, G♯, A, A♯ এবং B দ্বারা। এক্ষেত্রে, প্রতিটি স্বরের কম্পাঙ্ক তার ঠিক পূর্ববর্তী স্বরের কম্পাঙ্কের গুণ অর্থাৎ সা, ঋ, রে, জ্ঞ, গা, মা, হ্ম, পা, দ, ধা, ণ, নি— এই বারোটি স্বরের পরে যে চড়ার সা আসবে তার কম্পাঙ্ক হবে আগের সা-এর ঠিক দুইগুণ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এক্ষেত্রে অষ্টকের শুদ্ধ স্বরগুলি কিন্তু সমদূরবর্তী নয়। শুদ্ধ এবং কড়ি ও কোমল যুগপৎ বিবেচনা করলে বারোটি সমদূরবর্তী স্বর পাওয়া যায়। সপ্তকের শুদ্ধ স্বরগুলির মধ্যে ব্যবধানের বিন্যাস হলো TTSTTTS, যেখানে T এবং S যথাক্রমে এবং গুণকদুটির প্রতীক। এতে সুবিধা হলো এই যে, এবার যেকোনো চাবিকেই ইচ্ছেমতো সা হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। সব সময়েই সব স্বর অভিন্ন ব্যবধানেই থাকবে।
তিন অক্টেভসম্পন্ন হারমোনিয়ামের মাঝের সপ্তক, অর্থাৎ ২ নম্বর সপ্তকের ধা বা A চাবির কম্পাঙ্ক বাঁধা হয় 440 হার্ৎসে। কম্পাঙ্কের এই মাপকাঠি স্থির করা হয়েছিল ঐকবাদনের ক্ষেত্রে সুসমন্বয়সাধন বা orchestration এর প্রয়োজনে। সারা পৃথিবী জুড়ে যাতে একই মাপদণ্ডে গান-বাজনা হতে পারে তার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা International Organization for Standardization (ISO) এই মাপকাঠি নির্ধারণ করে।
তবে হারমোনিয়াম বা পিয়ানোর মতো স্থির কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্র সামান্য হলেও বিসম্বাদের দোষে দুষ্ট। আধুনিক সিন্থেসাইজার এর মতো ইলেকট্রনিক যন্ত্রে কিন্তু প্রয়োজন মতো যেকোনো কম্পাঙ্কের শব্দ সৃষ্টি করা যায়। বর্তমানকালে বাদকরা বিভিন্ন স্বরের এই পরিবর্তনশীল কম্পাঙ্ককে কাজে লাগিয়ে সঙ্গীত সৃষ্টি করেন।
উপসংহার
এই দুই পর্বে আমরা পাশ্চাত্য ও ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরগ্রাম নিয়ে আলোচনা করলাম। আধুনিক পাশ্চাত্য সঙ্গীতে অর্কেস্ট্রেশনকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেক বাদ্যযন্ত্রকে একসঙ্গে সুরে বাঁধতে এবং প্রয়োজনমতো টোনিক পরিবর্তন করতে ইকোয়াল টেম্পার্ড স্কেলের জুড়ি মেলা ভার, তাই পাশ্চাত্য সঙ্গীতে এই স্কেল আজ অত্যন্ত জনপ্রিয়। যদিও এই স্কেল সামান্য হলেও বিসম্বাদের দোষে দুষ্ট।
অপরপক্ষে ভারতীয় রাগসঙ্গীতে স্বর-সম্বাদ একদম নিখুঁত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সেই থেকেই সপ্তককে বারোটি স্বরের থেকেও সূক্ষ্ম বিভাজনে বিভক্ত করা হয়। এই সূক্ষ্মতম বিভাজনের নাম দেওয়া হয়েছে শ্রুতি এবং বিভিন্ন রাগে একই নাম দ্বারা সূচিত স্বরকেও সামান্য আলাদা আলাদা কম্পাঙ্কের শ্রুতিতে বসানো হয়। অতএব ভারতীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত বারোটি স্বর আসলে বাইশটি শ্রুতির ওপর অবস্থিত। তবে ইকোয়াল টেম্পার্ড স্কেলে বাঁধা হারমোনিয়াম গায়কের কণ্ঠের সমস্ত কারুকার্য অনুসরণ করতে না পারলেও, সুবিধার কারণে আধুনিক যুগে নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে এর ব্যবহার বহুল প্রচলিত।
পরিশেষে বলা যেতে পারে, সঙ্গীতের বিজ্ঞান সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চর্চা শব্দবিজ্ঞান তথা তরঙ্গগতিবিদ্যা শিক্ষায় আমাদের অংশগ্রহণকে আরো আনন্দদায়ক করে তুলতে সক্ষম হবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
অধ্যাপক পলাশ বরন পাল পাণ্ডুলিপিটি খুঁটিয়ে পড়ে অনেক ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে দিয়েছেন। নিরন্তর উৎসাহ জুগিয়েছেন অধ্যাপক নিখিল চক্রবর্তী এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সদস্যরা। এছাড়াও বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর পরামর্শ ও সহায়তা লেখাটার মানোন্নয়নে বিশেষভাবে সহায়ক হয়েছে। এই লেখায় ব্যবহৃত ঠাট সংক্রান্ত ভিডিও ফাইলগুলি দিয়েছেন অধ্যাপক সোনালী রায়। এঁদের সবার কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।
তথ্যসূত্র
১. The Notion of Twenty-Two Shrutis, Dinesh S Thakur, Resonance (2015).
২. The Sounds of Music: Science of Musical Scales III: Indian Classical Music, Sushan Konar, Resonance (2019).
৩. হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতি, পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে, চতুর্থ খণ্ড (মূল মারাঠি থেকে বঙ্গানূদিত)।
৪. সঙ্গীতভাবনার কয়েকটি দিক, অসিত দে, আলোচনা চক্র ৩৫ বর্ষ ১ ম সংখ্যা, সংকলন ৫০, জানুয়ারী ২০২১।
৫. https://www.youtube.com/watch?v=CrI7SjVBL3I