খেলার মাঠে গোপাল আর দুর্গার তুমুল তর্ক লেগেছে! কেউই নিজের জমি ছাড়তে রাজি নয়। আস্তে আস্তে বাকি বন্ধুরাও দু’ভাগ হয়ে গেলো। এক দল গোপালের পক্ষে, আরেক দল দুর্গার। হাতের কাছে যত সাক্ষ্য-প্রমাণ মজুত আছে তার থেকে কে ঠিক বোঝা মুশকিল। দুজনের যে কোনো একজনের কথাই ঠিক হতে পারে।
এমন অবস্থায় গোপালের দলের পুঁটি অনেক মাথা চুলকে একগাদা যুক্তি দেখিয়ে বললো, “দেখ দুর্গা, তোর কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে তার থেকে প্রমাণ করা যায় যে তেঁতুল গাছের নিচে গরুর ল্যাজ তিনবার টানলে গরু চারপায়ে গাছে উঠে পড়বে (বা ওরমই অবিশ্বাস্য একটা কিছু)। গোপালের মত মেনে নিলে তার থেকে কিন্তু এরকম আজগুবি কিছু প্রমাণ করা যায় না। সুতরাং তোর কথা কিছুতেই ঠিক হতে পারে না, আমাদের গোপালই ঠিক বলছে!” এই শুনে বাকিরা অনেকেই পুঁটির যুক্তিবিচার গুলো অনেকক্ষণ ধরে খতিয়ে দেখলো। দিয়ে দু’দলই মেনে নিলো যে পুঁটি ঠিকই বলেছে, দুর্গার মত সত্যি হলে ওই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটার কথা। ব্যাস গোপালের দলের সবাই আহ্লাদে আটখানা! এমনকি দুর্গার দলের বেশিরভাগ বন্ধুও দলবদল করে ফেলল। সত্যিই তো, গল্পের বাইরে গরুকে আর কে কবে গাছে চড়তে শুনেছে, সে তেঁতুলই হোক আর নারকেল।
পুঁটির ভাই গুবলু এতক্ষণ দুর্গাকে সাপোর্ট করছিলো। সে এবার বলে উঠলো, “আচ্ছা পুঁটির পরীক্ষাটা একবার করেই দেখা যাক না। বলা যায় না হয়তো ঠিকমতো অবস্থায় পড়লে গল্পের বাইরেও গরু গাছে চড়তে পারে।” এই শুনে বাকি সবাই খুব খানিক হাসলেও নাছোড়বান্দা গুবলু সব জোগাড়যন্ত্র করে সাবধানে এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখলো। এবং দুদলের সবাই চক্ষু চড়কগাছ করে দেখলো যে গরুটা সত্যি সত্যি গাছে উঠছে!!! দেখে গোপাল পর্যন্ত বলে উঠলো, “আমি দুর্গার দলে!!!!”
পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ঠিক এইরকমই একটা ঘটনা ঘটেছিলো ফ্রান্সে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। সেই সত্যি গল্পের গোপালের নাম আইজাক নিউটন (Issac Newton)। আর দুর্গার নাম ক্রিস্টিয়ান হাঘেন্স (Christiaan Huygens)।
গোড়ার কথা: গোপাল আর দুর্গার ঝগড়া
নিউটন আর হাঘেন্স সপ্তদশ শতাব্দীর দুই জাঁদরেল বিজ্ঞানী। দুজনেই আলো যে ঠিক কি সেই প্রশ্ন নিয়ে অনেক মাথা ’চুলকেছিলেন আর পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু নিউটনের সিদ্ধান্ত ছিল আলো খুব ছোট্ট ছোট্ট কণার সমষ্টি। এই কণাগুলো ভরহীন এবং একই মাধ্যমে থাকলে কণাগুলো সরলরেখায় নির্দিষ্ট বেগে চলে। অন্যদিকে হাঘেন্স ভাবতেন আলো আসলে একধরণের তরঙ্গ যা উৎস থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শান্ত পুকুরের জলে ঢিল ছুড়লে যেমন চারিদিকে ঢেউ ছড়িয়ে যায় সেইরকম আর কি !
মজার ব্যাপারটা হলো, সেই আদ্যিকালে আলো নিয়ে প্রতিফলন, প্রতিসরণ, বিচ্ছুরণ এইসব যা যা ঘটনা জানা ছিল এই দুই মতের সাথেই কিছু কিছু অনুমান জুড়ে তাদের ব্যাখ্যা করা চলে। তাই নিউটন আর হাঘেন্স এর মধ্যে যে কে ঠিক তা বোঝার বিশেষ কোনো উপায় ছিল না। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীদের খেলার মাঠে দুটো পরস্পরবিরোধী দল তৈরী হলো আমাদের শুরুর গল্পের মতোই। গণিত ও বিজ্ঞানের আরও নানা শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য বিজ্ঞানীমহলে নিউটনের প্রতিপত্তি ছিল বেশি, তাই আলোকে কণা ভাবার দলটাই হলো বেশি ভারী।
এই অবস্থা টিকলো প্রায় আরও একশো বছর।
একশো বছর পর: পুঁটির (ওরফে পোয়াঁসোর) গণনা
১৮১৮ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী অগুস্ত-জাঁ ফ্রেনেল (Augustin-Jean Fresnel) হাঘেন্সের তরঙ্গ-মতবাদের একটা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ গাণিতিক তত্ত্ব খাড়া করলেন। এই তত্ত্ব থেকে অঙ্ক কষে কষে আলোর অনেক নতুন আচরণের ভবিষ্যদ্বাণী করা গেলো যেগুলো সত্যি হবে যদি আলো তরঙ্গ হয়। এই ফরাসী হোমরা-চোমরাদের মধ্যেই হাঘেন্সের তরঙ্গ-মতবাদের একজন কট্টর বিরোধী ছিলেন — তাঁর নাম সিমিওন পোয়াঁসো (Siméon Denis Poisson)। তিনি ফিকির খুঁজছিলেন এই তরঙ্গপ্রেমীদের অপদস্থ করার।
পোয়াঁসো ফ্রেনেলের এই গাণিতিক তত্ত্ব ব্যবহার করে একটা অদ্ভুত ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করলেন।
চাকতির আলো-ছায়া
আমরা সবাই দেখেছি একটা গোল অস্বচ্ছ চাকতির ওপর আলো ফেললে আর চাকতির পেছনে একটা সমান্তরাল পর্দা রাখলে পর্দায় ঠিক একটা গোলাকার অন্ধকার জায়গা বা ছায়া তৈরী হয়। ঠিক এই ছবিটার মতো (ছবি ১)।
নিউটনের কণা তত্ত্ব দিয়ে যে এই ঘটনার সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় সেটা ছবিটা দেখেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো। আলোর যে যে কণাগুলো গোলাকার চাকতিতে বাধা পাচ্ছে সেগুলো পর্দায় পৌঁছতে পারছে না। সুতরাং একটা গোলাকার অন্ধকার জায়গার সৃষ্টি হচ্ছে।
পোয়াঁসো তর্কের খাতিরে ধরে নিলেন যে আলো আসলে তরঙ্গ, কণা নয়। দিয়ে দেখতে চাইলেন এরকম গোলাকার বাধা পেলে ঠিক কিভাবে আচরণ করবে।
তরঙ্গ কিন্তু সবসময় সরলরেখায় চলে না, সে বাধার পাশ দিয়ে বেঁকে চলতে পারে। ঠিক যেমন পুকুরের জলের ঢেউ এর পথে একটা বড়োসড়ো পাথরের চাঁই থাকলে ঢেউটা পাথরের দু’ধার দিয়ে বেঁকে পাথরের অন্যদিকে পৌঁছে যেতে পারে (ছবি ২)।
আলো তরঙ্গ হলে তারও ঐভাবেই আচরণ করার কথা। সেক্ষেত্রে ওই গোলাকার ছায়াটা পুরোপুরি অন্ধকার হবে না, তার মধ্যে কিছু আলো ঢুকে পড়বে। পোয়াঁসো অঙ্ক কষে দেখালেন যে ছায়াটা মোটামুটি অন্ধকারই থাকার কথা, কিন্তু তার ঠিক কেন্দ্রে একটা উজ্বল আলোকবিন্দু তৈরী হবে!!! চাকতির ব্যাস, চাকতি থেকে আলোর পর্দার দূরত্ব, এইসব মাপজোখ ঠিক কত হলে এই আলোকবিন্দু আমাদের চোখে দেখতে পাওয়ার মতো হবে তারও একটা ধারণা সেই গণনা থেকে পাওয়া গেলো (ছবি ৩)।
এই অঙ্ক কষে পোয়াঁসো তো আহ্লাদে আটখানা। ঠিক আমাদের শুরুর আষাঢ়ে গল্পের পুঁটির মতো। তিনি বিজ্ঞানীমহলে ঘোষণা করে দিলেন যে একটা আজগুবি ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী-ই প্রমাণ করে যে আলো তরঙ্গ হতেই পারে না। এর থেকে জোরালো প্রমাণ আর কিছুই হতে পারে না।
গুবলুর অদ্ভুত পরীক্ষা
কিন্তু পোয়াঁসোর আহ্লাদে বাধ সাধলেন আমাদের গল্পের গুবলু, তাঁর নাম দোমিনিক আরাগো (Dominique François Jean Arago)। আরাগো মস্ত পরীক্ষামূলক (experimental) পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি বললেন ঘর একদম অন্ধকার করে চাকতি, আলোর উৎস, আর পর্দা ঠিকঠিক জায়গায় বসিয়ে দেখাই যাক না ছায়ার মধ্যিখানে উজ্জ্বল বিন্দু দেখা যায় কিনা।
পরীক্ষাটা সাবধানে করতেই সবাইকে বিষম অবাক করে দিয়ে গোল অন্ধকার ছায়ার মাঝে উজ্জ্বল বিন্দুটা দেখা গেলো !!! নিউটনের কণা-তত্ত্ব থেকে যা কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্যাস, দু’শো বছরের তর্কের অবসান ঘটলো। পোয়াঁসো পর্যন্ত মেনে নিলেন আলো আসলে তরঙ্গই।
মজার ব্যাপার হলো ওই উজ্জ্বল বিন্দুটাকে পদার্থবিজ্ঞানীরা পোয়াঁসো বিন্দু আর আরাগো বিন্দু দুটো নামকরণই করলেন। দুই নামেই এই বিন্দু আজও বিখ্যাত হয়ে আছে।
লেসার ও দূরবীন ব্যবহার করে আধুনিক পরীক্ষাগারে এই বিন্দু বেশ নাটকীয়ভাবে দেখা যায়। এইরকম একটা পরীক্ষা এই ভিডিওটায় দেখতে পাবে।
শেষমেষ
এইসব ঘটনার পর দুশো বছর কেটে গেছে। আরও অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর তাত্ত্বিক গণনার পর আমরা আজ জানি যে আলো কিছু পরিস্থিতিতে তরঙ্গ আর কিছু পরিস্থিতিতে কণা হিসেবে আচরণ করে। এই আলোক কণার নামও হয়তো তোমরা শুনেছ, একে আমরা ফোটন (photon) বলি। কিন্তু এই কণার সঙ্গে নিউটনের আদিম তত্ত্বের আলোক কণার কোনোই মিল নেই।
অন্যদিকে হাঘেন্স-ফ্রেনেলের তত্ত্ব কিন্তু আজও বহাল তবিয়তে আছে, আধুনিক কণা-তরঙ্গ তত্ত্বের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ নেই। আলোর ফোটন-ধর্ম যে যে পরিস্থিতিতে প্রকাশ পায় না, সেইসব পরিস্থিতিতে আলো সেই হাঘেন্স-ফ্রেনেলের তরঙ্গ-তত্ত্ব অনুসারেই আচরণ করে।
সুতরাং এই ফ্রেনেল-আরাগোর উজ্জ্বল বিন্দু আজও পদার্থবিজ্ঞানেই সংস্কৃতিতে এক কিংবদন্তি। কোনো বিজ্ঞানীর আনকোরা নতুন তত্ত্ব কেউ না মানলে তিনি আজও অনেক সময় বলেন: “আমার একজন পোয়াঁসো আর একজন আরাগো চাই!!”