শিশুসুলভ খেয়ালের বশে কিছু দিন মাটির খুরি চাপা দিয়ে রাখবার পর একটা শোঁয়াপোকা ফড়িং হয়ে গেছে, সমবয়সীর এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা শুনে বিস্ময় বোধ করলেও ঘটনাটা সম্পুর্ণ বিশ্বাস করতে পারি নি। অলক্ষ্যে দৈবাৎ একটা ফড়িং ঢাকনার নিচে চাপা পড়া আশ্চর্য নয় এবং কোনও গতিকে হয়তো শোঁয়াপোকাটা বের হয়ে গিয়েছিল। কোনও ঘটনা বোধগম্য না হলে এরূপ সিদ্ধান্ত করা স্বাভাবিক। তথাপি প্রত্যক্ষদর্শীর দৃঢ় উক্তিও একেবারে উপেক্ষা করা চলে না। কিন্তু কেমন করে এরূপ একটা ঘটনা সম্ভব হতে পারে? কারণ ফরিঙের সঙ্গে শোঁয়াপোকার কোনও সাদৃশ্য বা সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। পরীক্ষার সাহায্যে সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করা ব্যতীত এ সম্বন্ধে কৌতূহল নিবৃত্তির অন্য কোনও উপায় ছিল না, অথচ শোঁয়াপোকা সম্বন্ধে একটা ভয়মিশ্রিত ঘৃণা এই সাধারণ পরীক্ষা সম্পাদন করবার পক্ষে যথেষ্ট অন্তরায় হয়ে উঠেছিল। একবার গাছে চড়তে গিয়ে হাতের নিচে কী যেন নরম নরম বোধ হল। চেয়ে দেখি – ভীষণ দৃশ্য। প্রায় দু-তিন ইঞ্চি লম্বা অসংখ্য শোঁয়াপোকা গায়ে গায়ে ঠেসাঠেসি করে গাছের গুঁড়ির খানিকটা অংশ ঘিরে রয়েছে। গায়ের রং ঠিক গাছের বাকলের রঙের মতো – চট করে কিছুই বোঝবার উপায় নেই। হাত লাগা মাত্রই সাপের মতো ফণা তুলে এক প্রকার অস্ফুট শব্দ করতে লাগলো। এই বিষাক্ত প্রাণীগুলি পূর্ববঙ্গে ‘ছেঙ্গা-বিছা’ নামে পরিচিত।
এদের শোঁয়াগুলি হাতে বিঁধে কয়েক দিন অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিলো। এই ঘটনা থেকেই শোঁয়াপোকা সম্বন্ধে একটা বিজাতীয় ঘৃণা ও ভয় যেন বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিলো। কাজেই সন্দেহ ভঞ্জনার্থ পরীক্ষা করাও হয়ে ওঠে নি। অবশেষে দৈবাৎ একদিন প্রায় আড়াই ইঞ্চি লম্বা কালো রঙের একটা শোঁয়াপোকা নজরে পড়লো। সেটাকে ছোট একটা বাটি চাপা দিয়ে রেখে দিলাম। দিন তিনেক পরে বাটি তুলে দেখি – যেমন শোঁয়াপোকা তেমনই রয়েছে। পাত্রটার একপাশে সে গুটিসুটি হয়ে বসেছিল। ফড়িং হবার কাহিনী সম্বন্ধে অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। আর পাঁচ-সাত দিন কাটবার পর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। প্রায় মাস খানেক পর হঠাৎ একদিন বাটিটা নজরে পড়ায় তুলে দেখি – অবাক কান্ড! শোঁয়াপোকার চিহ্নও নেই। ডানার উপর লাল ও হলদে রঙের ডোরাকাটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা ধূসর বর্ণের প্রজাপতির মতো একটা পতঙ্গ চুপ করে বসে আছে। ধরবার চেষ্টা করতেই উড়ে গেলো। বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম! এমন একটা বিদঘুটে শোঁয়াপোকা কেমন করে একটা পতঙ্গে রূপান্তরিত হলো কিছুই স্থির করতে পারলাম না, তবে এটুকু বুঝলাম যে, শোঁয়াপোকার এরূপ রুপান্তর পরিগ্রহণ অসম্ভব নয়। তবে শোঁয়াপোকা ফড়িং হয় না, প্রজাপতির মতো পতঙ্গের আকৃতি ধারণ করে।
এ ঘটনার অনেক দিন পরে মালদহ জেলার একটি গ্রামের ভিতর দিয়ে যাবার সময় একটা গাছের পাতার গায়ে আমড়ার আঁটির মতো একটা গুটি দেখতে পেয়ে সেটাকে একটা বোতলে ভরে রেখেছিলাম। সকালে উঠে দেখি, ডানায় বিচিত্র ডোরাকাটা প্রকাণ্ড একটা প্রজাপতি বোতলটার মধ্যে ঝটপট করছে। আমরা সাধারণত যেরূপ প্রজাপতি দেখতে পাই, এর চেহারা মোটেই সেরূপ নয়। ডানাগুলি অপেক্ষাকৃত মোটা ও ভারী। ডানার একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা। বোতলের অপ্রশস্ত স্থানের মধ্যে ডানা দুটি মুড়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। আকৃতি বড়ই হোক কী ছোটই হোক, তাতে বিস্মিত হবার তেমন কিছু নেই; কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, কেমন করে একটা শোঁয়াপোকা বা গুটি থেকে বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি বেরিয়ে আসে ?
কলকাতার সন্নিহিত কোনও এক পল্লী অঞ্চলে দুপুর বেলায় এক স্থানে বসে ছিপে মাছ ধরা দেখছি। প্রায় দু’শ গজ দূরে ঝোপের মধ্যে একটা উজ্জ্বল পদার্থের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। নিকটে গিয়ে দেখি, ছোট্ট একটা নীলকণ্ঠ ফুলের গাছের পাতার নিচের দিক থেকে একটা অদ্ভুত পদার্থ ঝুলে রয়েছে। জিনিসটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা, দেখতে কতকটা চীনাবাদামের মতো; কিন্তু বর্ণ উজ্জ্বল নীল। পড়ন্ত সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সেটা একটা বেলোয়ারি কাচের দুলের মতো ঝিকমিক করছিল। এর গঠন-পারিপাট্য ও রঙের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। জিনিসটা কি বুঝতে না পেরেও কেবল সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েই সেটাকে এনে একটা শিশিতে পুরে রাখলাম। দুই দিন একই ভাবে ছিল। তৃতীয় দিন ভোরে উঠে দেখলাম – সে অপূর্ব বস্তুটার খোলস পড়ে রয়েছে, কিন্তু তার সেই ঔজ্জ্বল্য নেই। পাশেই বিচিত্র বর্ণের একটা প্রজাপতি বাইরে আসবার জন্যে ছটফট করছে।
পর পর এই কয়টি ঘটনা থেকে প্রজাপতির জন্মের একটা মোটামুটি আভাস পেলাম বটে, কিন্তু জন্মের ধারাবাহিক ইতিহাস সম্বন্ধে কিছুই অনুমান করতে পারলাম না। এই ঘটনার কিছুদিন পরে শিবপুরের কোনও একটি বাড়ির রান্নাঘরের অন্ধকারাচ্ছান্ন দেয়ালের গায়ে প্রায় নয় ইঞ্চি লম্বা একটা অদ্ভুত প্রজাপতি দেখতে পেলাম। দুই দিকের ডানার উপর পেঁচার চোখের মতো গোলাকার উজ্জ্বল নীলবর্ণের দুটি ছাপ, হঠাৎ মনে হয় যেন অন্ধকারের মধ্যে একটা পেঁচা তার গোলাকার চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে। অনেক কৌশলে সেটাকে জীবিত অবস্থায় ধরতে পেরেছিলাম। একটা জালের খাঁচায় সেটাকে রেখে দিলাম। কী খায় জানি না; কাজেই খাবার কিছু দেওয়া সম্ভব হয় নি। দুই দিন পর্যন্ত প্রজাপতিটাকে জালের উপর একভাবে ডানা মেলে বসে থাকতেই দেখলাম। তৃতীয় দিনে দেখা গেল জালের গায়ে পাশাপাশি ভাবে অসংখ্য ডিম পেড়ে রেখেছে। ডিম পাড়বার দুই দিন পরে প্রজাপতিটা মরে গেল। ডিমগুলিকে সেভাবে রেখে দিলাম। প্রায় মাস দেড়েক পরে সেই ডিম ফুটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য শোঁয়াপোকা বেরিয়ে এলো। তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, শোঁয়াপোকারা প্রজাপতিরই বাচ্চা। এখন কী উপায়ে শোঁয়াপোকা প্রজাপতির রূপ ধারণ করে – সেটাই অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠলো। অনেক চেষ্টা করেও কিছুই নির্ণয় করতে পারা গেল না। অবশেষে বিভিন্ন জাতীয় শোঁয়াপোকা কাঁচের নলের ভিতর পুরে সঙ্গে নিয়েই চলাফেরা করতে লাগলাম। লক্ষ করলাম যে কাচের নলে রাখবার পর শোঁয়াপোকাটা প্রথমে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করে অকৃতকার্য হলে শরীরটাকে গুটিয়ে চুপ করে বসে থাকে। চুপ করে বসবার পর সাধারণত তিন ঘন্টা থেকে ছ’ঘন্টার মধ্যে যে-কোন এক সময়ে মাত্র পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে দেহের আকৃতি বেমালুম পরিবর্তন করে পুত্তলীর আকার ধারণ করে। কাজেই এই পাঁচ-সাত মিনিট সময় পর্যবেক্ষণ করতে পারলেই তাদের আকৃতি-পরিবর্তনের কৌশলটা দেখা যেতে পারে। কাচের নলে শোঁয়াপোকা পুরে যখন-তখন লক্ষ করে দেখতাম – হয় শোঁয়াপোকাই রয়ে গেছে, নয়তো কোন্ ফাঁকে যে দৃষ্টি এড়িয়ে পুত্তলী হয়ে বসে আছে, তা বুঝতে পারি নি। কোনও কোনও জাতের শোঁয়াপোকা রাতের শেষভাগেই সাধারণত পুত্তলির আকার ধারণ করে থাকে। অনেক চেষ্টার পর একদিন শেষ রাত্রিতে লক্ষ করলাম – নিশ্চল শোঁয়াপোকাটা যেন একটু একটু নড়ে উঠছে। ক্রমশ নড়াচড়া বৃদ্ধি পেতে লাগলো। প্রায় দু-তিন মিনিট পরে শোঁয়াপোকাটার ঘাড়ের কাছের খানিকটা অংশ চিড় খেয়ে ফেটে গেল। সেই ফাটা স্থানের ভিতর থেকে ঈষৎ লাল আভাযুক্ত একটা শাদা পিণ্ডাকার পদার্থ ক্রমশ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। আরও তিন-চার মিনিট অতিক্রান্ত হতেই নারিকেলী কুলের আঁঠির মতো সূচালো মুখবিশিষ্ট একটা অদ্ভুত প্রাণী মোচড় খেতে খেতে ঠেলে বেরিয়ে এলো। শোঁয়াপোকার সেই বিশ্রী ছালটা একপাশে পড়ে রইলো। খোলসটা পরিত্যাগ করবার পূর্বেই সে দেহের প্রান্তদেশ থেকে একটু সূতা বের করে তাতে আটকে ঝুলে থাকে।
দেখতে দেখতে সেই পুত্তলী পরিবর্তিত হয়ে একটি সুনির্দিষ্ট আকৃতি ধারণ করে এবং উপরের আবরণের উজ্জ্বল বর্ণে আত্মপ্রকাশ করে। পুত্তলীটি সম্পূর্ণ নিশ্চেষ্টভাবে দুলের মতো ঝুলে থাকে। দশ-বারো দিন পরে হঠাৎ পুত্তলীর পিঠের দিক চিড় খেয়ে ফেটে যায় এবং ধীরে ধীরে সেই খোলস থেকে দু’তিন মিনিট সময়ের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি বেরিয়ে আসে। বাইরে আসবার সময় প্রজাপতিটা তার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে আকারে অনেক ছোট থাকে। ডানাগুলিও থাকে খুবই ছোট ছোট, কিন্তু দেখতে দেখতে প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই তরতর করে ডানা বেড়ে ওঠে এবং শরীরের আকৃতি বদলে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ প্রজাপতি উড়ে বেড়াতে শুরু করে। আমরা অহরহ যে সকল বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি দেখতে পাই, তাদের জন্মবৃত্তান্ত মোটামুটি এইরূপ। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন জাতীয় অগণিত প্রজাপতির জন্মবৃত্তান্তের বৈচিত্র্যও কম নয়।
আমরা সাধারণত দিবাচর প্রজাপতিই দেখতে পাই। বিচিত্র বর্ণে চিত্রিত হালকা ডানাওয়ালা ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির দিবাচর প্রজাপতি সারাদিন ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় এবং সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসবার বহু পুর্বেই পত্রপল্লবের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে ডানা মুড়ে বিশ্রাম গ্রহণ করে। কিন্তু নিশাচর প্রজাপতিরা সারাদিন কোনও নির্জন অন্ধকার স্থানে ডানা প্রসারিত করে বিশ্রাম করে এবং গভীর অন্ধকারে আহারান্বেষণে বহির্গত হয়। এরা সাধারণত মথ নামে পরিচিত। মথ বা নিশাচর প্রজাপতি সর্বদাই ডানা প্রসারিত করে বসে, কিন্তু দিবাচর প্রজাপতি ডানা মুড়ে বসেই বিশ্রাম করে। অবশ্য সময়ে সময়ে তারা ডানা মেলে বসে রোদ পোহায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দিবাচর প্রজাপতির বাচ্চার গায়ে শোঁয়া থাকে না; কিন্তু লোমশ শোঁয়াপোকা থেকে সাধারণত মথ জাতীয় প্রজাপতিই আত্মপ্রকাশ করে। অবশ্য লেজওয়ালা, লোমশূন্য বিচিত্র বর্ণের বড় বড় শূককীট থেকেও নিশাচর প্রজাপতি উৎপন্ন হয়ে থাকে। দিবাচর প্রজাপতি পুত্তলী অবস্থায় কোনও কিছুতে ঝুলে বা আটকে থাকবার জন্যে মাত্র সামান্য সুতা বোনে এবং বিভিন্ন জাতীয় পুত্তলী বিভিন্ন বর্ণের উজ্জ্বল কাচ খন্ডের মতো আকার পরিগ্রহণ করে, কিন্তু নিশাচর প্রজাপতির বাচ্চা পুত্তলী অবস্থায় রূপান্তরিত হবার পূর্বে মুখ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ লালা নিঃসরণ করে সুতা বোনে এবং সেই সুতায় গুটি তৈরি করে তার অভ্যন্তরে পুত্তলী রূপ ধারণ করে নিশ্চলভাবে অবস্থান করে।
বিভিন্ন জাতীয় নিশাচর প্রজাপতির গুটি থেকেই আমরা রেশম পেয়ে থাকি। নিশাচর প্রজাপতির ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলেই তারা গাছের পাতা বা ছাল খেয়ে ক্রমশ বড় হতে হতে বার বার খোলস পরিত্যাগ করতে থাকে। বার বার খোলস বদল করে পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় উপনীত হলে দল বেঁধে কোনও স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং কিছুদিন পরে সুবিধামত স্থান নির্বাচন করে মুখ থেকে সুতা বের করে শরীরের চতুর্দিকে একটি ডিম্বাকার আবরণ গড়ে তোলে। আবরণটি বেশ পুরু হলে শরীরের লোমগুলি তুলে নিয়ে একটি আস্তরণ দিয়ে দেয়। তারপর চুপ করে অবস্থান করে। কিছু দিন পরে উপরের ছালটা ফেলে দিয়ে জলপাইয়ের বীজের মতো পুত্তলীর আকার ধারণ করে আবার কিছুদিন নিশ্চেষ্টভাবে পড়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে এক মাস বা দুই মাস আবার কোন কোন ক্ষেত্রে প্রায় বৎসরাবধি এরূপ নিশ্চলভাবে অবস্থান করবার পর প্রজাপতির রূপ ধারণ করে গুটি কেটে বেরিয়ে আসে। এদের মধ্যে কয়েক জাতীয় পতঙ্গ দেখা যায়, যাদের স্ত্রী-পতঙ্গের নামমাত্র ডানা থাকে। শরীরটা তাদের অসম্ভব মোটা – একটুও নড়তে চড়তে পারে না। বৎসরাধিক কাল গুটির অভ্যন্তরে কাটিয়ে বাইরে আসামাত্রই পুরুষ-পতঙ্গেরা উড়ে এসে তাদের সঙ্গে মিলিত হবার পর দুই-তিন দিনের মধ্যেই স্ত্রী-পতঙ্গগুলি অসংখ্য ডিম প্রসব করে মারা যায়। এই হল তাদের প্রজাপতি-জীবন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মথ সাধারণ প্রজাপতির মতোই জীবনযাত্রা নির্বাহ করে থাকে।
কয়েক জাতীয় প্রজাপতি দেখা যায়, যারা আকৃতি-প্রকৃতিতে মথের মতো, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সেগুলিকে দিবাচর প্রজাপতির পর্যায়ভুক্ত বলা যেতে পারে। এরা সর্বদাই অল্প অন্ধকার অথবা ছায়ার মধ্যেই অবস্থান করে। দক্ষিণ আমেরিকার পেঁচক-প্রজাপতিই বোধহয় এই জাতীয় প্রজাপতিদের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ আকৃতির হয়ে থাকে। দিবাচর প্রজাপতিদের মধ্যেও এদের চেয়ে বৃহত্তর প্রজাপতি বিরল। এদের নিচের ডানা দুটির নিম্নতলে পেঁচার চোখের মতো বড় বড় দুটি গোল দাগ থাকে। সন্ধ্যার সময় যখন এরা উড়তে থাকে, তখন তাদের বৃহৎ ডানা ও গোলাকার চোখ দুটির জন্যে একটা অদ্ভুত প্রাণী বলে মনে হয়। আমাদের দেশেও দুই-তিন ইঞ্চি পরিমাণ এই জাতীয় প্রজাপতির অভাব নেই। শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেনে বড় বড় গাছের শিকড়ের আড়ালে অন্ধকারের মধ্যে অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে, অসংখ্য ধূসর ও কালো রঙের অদ্ভুত আকৃতির প্রজাপতি বসে আছে।
দিবাচর প্রজাপতির মধ্যে সাধারণত আধ ইঞ্চি থেকে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের (প্রসারিত ডানার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত মাপ) প্রজাপতির সংখ্যাই বেশী। তাদের শোঁয়াপোকাগুলিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুদৃশ্য এবং মাঝারি আকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু নিশাচর প্রজাপতিদের মধ্যে ডানার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত এক ফুট লম্বা প্রজাপতিও অনেক দেখা যায় এবং চার-পাঁচ মিলিমিটার থেকে পাঁচ-ছয় ইঞ্চি ডানাবিশিষ্ট প্রজাপতির সংখ্যা অগণিত। এই ধরনের বড় বড় প্রজাপতির বাচ্চাগুলি প্রায়ই বিরাটাকৃতির হয়ে থাকে। নিশাচর প্রজাপতির মধ্যে ‘সেক্রোপিয়া’, ‘অ্যাটলাস’, ‘ইম্পিরিয়ালিস’ প্রভৃতি প্রজাপতির বিরাট আকার বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ‘লুনা-মথে’র সুদৃশ্য আকৃতি এবং ডানার স্নিগ্ধ রং বড়ই মনোরম। এতদ্ব্যতীত ‘জরুলা’, ‘পলিফেমাস’, ‘প্রমেথিয়া’, ‘ফিলোসামিয়া সিন্থিয়া’ প্রভৃতি মাঝারি আকৃতির সুদৃশ্য নিশাচর প্রজাপতিরা উৎকৃষ্ট রেশম উৎপাদন করে বলে সর্বত্র পরিচিত।
মাঘ, ১৩৪৬
(গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতে পারার জন্য আমরা তাঁর পুত্রবধূ শুভা ভট্টাচার্য, দৌহিত্রী মালা চক্রবর্ত্তী, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতির সম্পাদক দীপক কুমার দাঁ এবং আকাশবাণী কলকাতার মানস প্রতিম দাস-র কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।মূল গ্রন্থ থেকে লেখাটি টাইপ করেছেন ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবক, পার্থ আঢ্য।)