পাখিরাই সাধারণত কীট-পতঙ্গের প্রধান শত্রু। পাখি এবং অন্যান্য শত্রুদের আক্রমণ এড়াবার জন্যে কীট-পতঙ্গ জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত উন্নত শ্রেণীর প্রাণী অপেক্ষা বহুল পরিমাণে অনুকরণপ্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু পাখি সাধারণত ফড়িং বা প্রজাপতিকে আক্রমণ করে না। বাদলা পোকা আকাশে ওড়া মাত্রই যেমন বিভিন্ন জাতীয় পাখি সেগুলিকে ধরে খাবার জন্যে আকাশ ছেয়ে ফেলে, ফড়িং ও প্রজাপতির বেলায় তার বিপরীত ঘটনাই পরিলক্ষিত হয়। ফড়িং ও প্রজাপতিরা পাখিদের আশে-পাশে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায়। ফড়িংদের পরস্পরের মধ্যে অবশ্য শত্রুতা যথেষ্ট; সুযোগ পেলে সবল দুর্বলকে আক্রমণ করে খেয়ে ফেলে। কিন্তু প্রজাপতিদের মধ্যে সেরূপ কোনও শত্রুতা নেই। কোনও কোনও জাতের প্রজাপতির মধ্যে অদ্ভুত অনুকরণপ্রিয়তা দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য প্রজাপতির স্বাভাবিক শত্রু যে একেবারেই নেই, তা নয়। টিকটিকি, গিরগিটি, কোনও কোনও জাতের মাকড়সা ও পিঁপড়ে সুযোগ পেলে এগুলিকে ধরে খেয়ে ফেলে। এতদ্ব্যতীত এদের অপরুপ সৌন্দর্য ও বর্ণবৈচিত্র্যে আকৃষ্ট হয়ে মানুষেরাও এদের যথেষ্ট শত্রুতা করে থাকে। বোধ হয় এই স্বাভাবিক শত্রুদের কবল থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত কোন কোন জাতের প্রজাপতি ডানা মুড়ে গাছের পাতার অনুকরণ করে থাকে। কেউ কেউ বা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে শত্রুকে পশ্চাদ্ধাবন থেকে নিবৃত্ত করে। আমাদের দেশীয় মথ জাতীয় এক প্রকার শ্বেত বর্ণের প্রজাপতি ঠিক পাখির বিষ্ঠার অনুকরণ করে থাকে। এই প্রজাপতিদের আকৃতি-প্রকৃতি অতি অদ্ভুত – দেখতে ঠিক পাতলা টিসু কাগজের মত। ডানার পৃষ্ঠদেশের দুই প্রান্তে দুটি কালো ফোঁটা আছে। মনে হয় যেন দুটি চোখ। এরা ডানা মেলে পাতার গায়ের সঙ্গে এমনভাবে লেগে থাকে যে, সুনির্দিষ্ট আকৃতি সত্ত্বেও বিশেষ মনোযোগ দিয়ে না দেখলে, পাতার উপর চুণের দাগের মতো মনে হয়। ক্রমবিবর্তনের ফলেই হয়তো প্রজাপতির এই প্রকার অদ্ভুত আকৃতি-প্রকৃতি অভিব্যক্ত হয়েছে। হয়তো বললাম এজন্যে যে পর্যবেক্ষণের ফলে দেখেছি – কোন কোন জাতের মাকড়সারা পিঁপড়ের হুবহু অনুকরণ করেও শত্রুর কবল থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না। আশেপাশে বিভিন্ন জাতের মাকড়সা থাকা সত্ত্বেও কোনও কোনও কুমুরেপোকা, বেছে বেছে ঠিক একই রকমের বহুসংখ্যক পিঁপড়ে-মাকড়সা শিকার করে তাদের গর্তের মধ্যে রেখে দেয়। এ থেকেই সন্দেহ জন্মে, প্রজাপতির অনুকরণ-প্রিয়তাও সম্পূর্ণরূপে আত্মরক্ষামূলক কিনা।
পৃথিবীর অধিকাংশ প্রাণীর মধ্যেই নির্বিঘ্নে বিশ্রাম-সুখ উপভোগ করবার জন্যে এবং সেই সময়ে আত্মরক্ষার নিমিত্ত বিবিধ প্রকারে সুরক্ষিত বাসস্থান নির্মাণ করে তাতে আত্মগোপন করবার একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি দেখা যায়। যে সকল প্রাণী বাসস্থান নির্মাণ করে না, তারাও নির্বিঘ্নে বিশ্রাম উপভোগ করবার জন্যে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে থাকে। আমাদের আশেপাশে অহরহ যে সকল প্রজাপতি দেখতে পাই, তারা কেউ বাসা বাঁধে না; কিন্তু নিরুপদ্রবে অবসর কাল কাটাবার জান্যে আত্মগোপনোপোযোগি বিশ্রামস্থল বেছে নেয়। এর ফলে অপেক্ষাকৃত অনাবৃত স্থানে থেকে এরা মানুষ বা অন্যান্য শত্রুর দৃষ্টি এড়াতে সক্ষম হয়। এস্থলে আমাদের দেশের কয়েক প্রকার সাধারণ প্রজাপতির বিশ্রামকালীন আত্মগোপন কৌশলের বিষয়ে আলোচনা করছি।
আমাদের দেশে সচরাচর এক প্রকার সাদা প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায়। এদের ডানা প্রসারিত করলে একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত পাশাপাশিভাবে দুই ইঞ্চিরও কিছু বেশী লম্বা হয়। ডানার উপরিভাগ দুধের মতো সাদা; কিন্তু উভয় ডানার সংযোগস্থল থেকে কতকটা অংশ ঈষৎ হলদে। ডানার নিম্নভাগ নীলাভ ফিকে সবুজ। লড়বার সময় সাদা দিকটাই স্পষ্টগোচর হয়। উড়তে উড়তে কখনও অল্প সময়ের জন্য বিশ্রামের প্রয়োজন হলে এরা সাধারাণত যমজপত্রসমন্বিত গাছের পাতার উপর আধাআধি ডানা মেলে বসে।পাতার রঙের সঙ্গে এদের গায়ের রং ও আকৃতি এমনভাবে মিলে যায় যে, অতি নিকটে থেকেও তাদের গাছের পাতা বলে ভুল হয়। কিন্তু ভয় পেলে অথবা রাত্রিবাস করবার সময় উড়ে গিয়ে গাছের উঁচু ডালের পাতার উপর ডানা মুড়ে বসে। তখন পাতার রঙের সঙ্গে এমনভাবে মিলে থাকে যে, খুঁজে বের করা যায় না।
ডানার একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পাশাপাশিভাবে প্রায় তিন ইঞ্চি সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা ফিকে হলদে রঙের এক প্রকার প্রজাপতিকে সর্বদাই ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। এদের ডানার উপর ও নিচে বড় বড় কতকগুলি কালো ফোঁটা আছে। ডানার এই বর্ণবৈচিত্র্যে বহুদূর থেকে এদের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বিশ্রাম করার সময় এরা পত্রবিরল লতার ঝোপের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। ডানা গুটিয়ে এই জাতীয় লতার মধ্যে অবস্থান কালে লতার আঁকাবাঁকা ডাঁটাগুলির সঙ্গে মিলে গিয়ে প্রজাপতির গায়ের রেখাগুলি এমন একটা দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করে যে, তার মধ্যে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা থাকা সত্ত্বেও প্রজাপতি লুকিয়ে আছে বলে বুঝতে পারা যায় না।
এদেশে বনে-জঙ্গলে ‘লৌ-ফোঁট’ বা রক্ত-তিলক নামে ঘোর কালো রঙের একপ্রকার বড় বড় প্রজাপতি দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রজাপতির নিম্ন ডানার প্রান্তভাগে অর্ধচন্দ্রাকার কতকগুলি রক্ত বর্ণের ফোঁটা সারবন্দিভাবে অঙ্কিত থাকে, নিম্নভাগের ডানার মধ্যস্থলে পাশাপাশিভাবে কয়েকটি সাদা দাগ আছে। দিনের বেলায় ক্ষণিক বিশ্রাম করবার সময় এবং রাত্রিকালে এই প্রজাপতিরা অন্ধকার ঝোপের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং ঝোপের মধ্যে গাঢ় সবুজ রঙের পাতার উপর রাতটা বসে কাটায়। সাধারণত প্রজাপতির ডানার নিম্নভাগের রং ফিকে এবং নিস্প্রভ হয়ে থাকে এবং বসবার সময় ডানা ভাজঁ করে রাখে; কাজেই সহসা কারও দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু এই রক্ত তিলক প্রজাপতির ডানার নিচের দিক উপরের দিক অপেক্ষা উজ্বলতর। যে কারণেই হোক, এরা ডানা ভাজঁ করে বসেনা; মথদের মতো এরা ডানা মেলে বিশ্রাম করে। কাজেই পৃষ্ঠদেশের অনুজ্জ্বল অংশই বাইরের দিকে থাকে। অন্ধকার স্থানে গাঢ় রঙের পাতার উপর বিশ্রাম করবার ফলে এরা অনায়াসে শত্রুর চোখে ধুলি নিক্ষেপ করতে পারে।
আর এক প্রকার কালো রঙের প্রজাপতির ক্ষুদ্রতর ডানা দুটির প্রান্তভাগে সারবন্দিভাবে কতকগুলি সাদা ফোঁটা থাকে। এই প্রজাপতির পৃষ্ঠদেশের রং নিম্নভাগের রং অপেক্ষা অনেক হালকা ও অনুজ্জ্বল। গাছের যে সব পাতা শুকিয়ে কালো হয়ে ঝুলে থাকে, এই প্রজাপতিরা সেই সব পাতার গায়ে বসে অতি সহজেই আত্মগোপন করে থাকে।
এক ইঞ্চি দেড় ইঞ্চি লম্বা হলদে রঙের এক প্রকার প্রজাপতিকে দলে দলে উড়ে বেড়াতে দেখা যায়। এরা বিশ্রাম সময়ে এক প্রকার ফিকে হলদে রঙের পাতাওয়ালা ছোট ছোট গাছের ডালে ডানা মুড়ে বসে থাকে। হঠাৎ এগুলোকে দেখে সেই গাছের পাতা বলেই মনে হয়।
দেড় ইঞ্চি দুই ইঞ্চি লম্বা মথ জাতীয় একপ্রকার প্রজাপতিকে গাছের পাতার উপর বসে থাকতে দেখা যায়। অধিকাংশ সময়েই এরা বসে কাটায় এবং মাঝে মাঝে ধীরে ধীরে ডানা নেড়ে থাকে। প্রায়ই এগুলোকে আমগাছের উপর দেখতে পাওয়া যায়। এদের গুটির রং আম পাতার মতো গাঢ় সবুজ এবং শরীর ত্রিকোণাকার, গুটিগুলি আমপাতার গায়েই ঝুলে থাকে। পাতা ও গুটির রং এক হবার ফলে কদাচিৎ নজরে পড়ে থাকে। এই প্রজাপতির পৃষ্ঠদেশের রং ধূসর কিন্তু তলদেশ হালকা ধূসর বা গোলাপী রঙের। এই প্রজাপতিরা যখন পাতার উপর বসে বিশ্রাম করে, তখন পৃষ্ঠদেশই নজরে পড়ে এবং পাতার রঙের সঙ্গে গায়ের রঙের বিশেষ কোনও পার্থক্য বুঝতে পারা যায় না। ঝোপের মধ্যে অন্ধকারে পাতার উপর বসে থাকলে এরা মোটেই নজরে পড়ে না।
আপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ডানাওয়ালা মথ জাতীয় পতঙ্গদের গায়ের রং সাধারাণত অনেক ক্ষেত্রেই ধূসর বা অনুজ্জ্বল বাদামী হয়ে থাকে। এরা ছোট ছোট গাছের শুকনো পাতার উপর নিশ্চলভাবে বসে থাকে। তখনো পাতার রং ও মথের রং এমনভাবে মিলে থাকে যে সহজে এগুলিকে চিনতে পারা যায় না; মনে হয় যেন শুকনো পাতারই একটা ছিন্ন অংশ আটকে রয়েছে। সময়ে সময়ে এই জাতীয় বিভিন্ন শ্রেণীর পতঙ্গের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে রং মিলিয়ে নির্বিঘ্নে অবস্থান করবার কৌশল দেখে বিস্মিত হতে হয়।
কার্তিক ১৩৪৩
প্রচ্ছদের ছবি: PixaBay
(গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতে পারার জন্য আমরা তাঁর পুত্রবধূ শুভা ভট্টাচার্য, দৌহিত্রী মালা চক্রবর্ত্তী, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতির সম্পাদক দীপক কুমার দাঁ এবং আকাশবাণী কলকাতার মানস প্রতিম দাস-র কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মূল গ্রন্থ থেকে লেখাটি টাইপ করেছেন ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবক, অনিন্দিতা সরকার।