কেবল বিদ্যুৎগতিতে সৈন্য পরিচালনাই নয়, শত্রু-ঘাঁটির যাবতীয় বিধিব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা উৎপাদন এবং তৎসহ অবিরাম শিলাবৃষ্টি ও বজ্রপাত সহকারে প্রবল বন্যাপ্রবাহের মতো যান্ত্রিক বাহিনীর যুগপৎ দুর্ধর্ষ আক্রমণই ব্লিৎসক্রিগের বিশেষত্ব। আকাশ থেকে বোমারু বিমানের নিরবিছিন্ন অগ্নিবর্ষণ, সঙ্গে সঙ্গে প্যারাসুটিস্ট সৈন্যদের নগরাভ্যন্তরে অবতরণ এবং পঞ্চমবাহিনীর সহায়তায় পেট্রোল সরবরাহের আস্তানা, বিমান ঘাঁটি, যানবাহন চলাচল ও সংবাদ আদান-প্রদানের কেন্দ্রসমূহ দখল করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেই সাধারণ নাগরিকেরা ভীতিবিহ্বল চিত্তে প্রাণরক্ষার নিমিত্ত ইতস্তত ছুটাছুটি করে স্বপক্ষীয় সৈন্য চলাচলের বিঘ্ন সৃষ্টি করে এবং অনেকে দলিত ও পিষ্ট হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাতে বাধ্য হয়। ছোটোখাটো পাহাড়-পর্বত বা উচ্চভূমিতে বাধা পেয়ে বন্যার জল যেমন বর্ধিত তেজে ভীমগর্জনে প্রবাহিত হতে থাকে, যান্ত্রিক বাহিনীও সেইরূপ জীবন-মরণ তুচ্ছ করে সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই হলো সমর-কৌশলের চমকপ্রদ অভিব্যক্তি। মানুষের পক্ষে এরূপ সমরনীতি বা ‘ব্লিৎসক্রিগ’ পরিচালনা সম্ভব হলেও মনুষ্যেতর প্রাণীদের মধ্যে কোথাও যে এইরূপ কৌশল অনুসরণ করা সম্ভব নয় এটা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু পিঁপড়েদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এমন কয়েকটি লড়াই প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ ঘটেছিল যাতে তাদের এক পক্ষের রণকৌশল – সৈন্য-পরিচালন, সৈন্য-সংস্থান এবং অসতর্ক মুহূর্তে বিদ্যুৎগতিতে আক্রমণ প্রভৃতি ব্যাপার, বহুলাংশেই ‘ব্লিৎসক্রিগে’র অনুরূপ বলে মনে হয়। এমন কী ব্যাপক ধ্বংস ও লুন্ঠনাদি ব্যাপারের ভীষণতায় হয়তো তা মনুষ্যপরিচালিত ‘ব্লিৎক্রিগকে’ও হার মানায়। এরূপ ‘ব্লিৎক্রিগে’র এক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলছি।
লড়াই বেধেছিল বিভিন্ন জাতীয় দুই দল পিঁপড়ের মধ্যে। একদল ক্ষুদে, অপর দল বৃহদাকৃতির নালসো পিঁপড়ে। বিভন্ন জাতীয় পিঁপড়ের জীবনযাত্রা প্রণালীর বিষয় যাঁরা সম্যক অবগত নন, তাঁদের বোঝবার সুবিধার জন্যে যুদ্ধমান পিঁপড়েদের মোটামুটি একটু পরিচয় দিচ্ছি। আমাদের দেশে প্রায় সর্বত্রই আম, জাম, পাকুড় প্রভৃতি গাছে লাল রঙের এক প্রকার দুর্ধর্ষ পিঁপড়ে দেখতে পাওয়া যায়। কতগুলি পাতা একত্রে জুড়ে এই পিঁপড়েরা গাছের ডালে বড় বড় গোলাকার বাসা নির্মাণ করে থাকে। এদের স্বভাব অতিশয় উগ্র ; কাকেও বাসার নিকটে পেলেই দলে দলে ছুটে এসে আক্রমণ করে। মরে গেলেও কামর ছাড়ে না। এদের পরিবারের মধ্যে শ্রমিক, পুরুষ ও রানী – এই তিন রকমের পিঁপড়ে দেখা যায়। পুরুষ ও রানী উভয়েরই ডানা আছে ; কিন্তু শ্রমিকদের ডানা থাকে না। পুরুষের শরীরের রং কালো, রানীদের রং সবুজ ; কিন্তু একমাত্র শ্রমিকদের শরীরের রং লাল। রানীরা লম্বায় প্রায় এক ইঞ্চির মতো বড় হয়। পুরুষের শরীরের দৈর্ঘ্য আধ ইঞ্চির কিছু বেশি। শ্রমিকরা সিকি ইঞ্চি থেকে আধ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। শ্রমিকেরা তাদের সংসারের যাবতীয় কাজ করে থাকে। যুদ্ধের সময় সৈনিকের কাজও এরাই করে। এক একটি বাসার মধ্যে প্রায় শতাধিক রানী কয়েক শত পুরুষ এবং চার-পাঁচ হাজার বা ততোধিক শ্রমিক বাস করে। তাছাড়া বাসার মধ্যে থাকে হাজার হাজার ডিম, বাচ্চা ও পুত্তলী। বাচ্চাগুলিই পিঁপড়েদের প্রধান সম্পত্তি। এগুলিকে রক্ষা করবার জন্যে শ্রমিকেরা প্রাণ বিসর্জনেও কিছুমাত্র ইতস্তত করে না। বাচ্চা না হলে এদের বাসা তৈরি করা সম্ভব হয় না। বাচ্চার সাহায্যে সুতা বুনে বাসা নির্মাণ করে। এদের যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ধারালো সাঁড়াশীর মতো একজোড়া শক্ত চোয়াল এবং একপ্রকার বিষাক্ত গ্যাস। যুদ্ধ বাধবার উপক্রম হলেই শরীরের পশ্চাদেশ উঁচু করে শত্রুর প্রতি অনবরত গ্যাস ছুড়তে থাকে। তারপর শুরু হয় কামড়াকামড়ি। এই পিঁপড়েগুলিকে সাধারণত লাল-পিঁপড়ে বলা হয়। বাংলাদেশে এরা নালসো পিঁপড়ে নাম পরিচিত।
আমাদের দেশে বহু জাতীয় ক্ষুদে পিঁপড়ে দেখা যায়। তাদের মধ্যে এক জাতীয় ক্ষুদে পিঁপড়ের শরীরের সম্মুখভাগ লালচে হলুদ বর্ণের, কিন্তু পশ্চাদভাগ কালো। এরা দেড় থেকে দুই মিলিমিটারের বেশি বড় হয় না। এগুলিকে প্রায়ই সুদীর্ঘ লাইন করে উঁচু জমি, ঘরের দেওয়াল বা বড় বড় গাছের উপর বিচরণ করতে দেখা যায়। এক-একটি ফাটল বা গর্তে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদে পিঁপড়ে বসবাস করে। নালসো-পিঁপড়ে অপেক্ষা এরা অনেক ধীরগতি সম্পন্ন। ক্ষুদে পিঁপড়েরা নালসো-পিঁপড়ে এবং তাদের ডিম ও বাচ্চাগুলিকে অতি উপাদেয় বোধে উদরসাৎ করে থাকে। ক্ষুদে পিঁপড়েদের দংশন অতি বিষাক্ত, বিশেষত নালসোদের পক্ষে এই বিষ অতি মারাত্মক বলেই মনে হয়। নালসোদের সম্পত্তি লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে ক্ষুদেরা তাদের সঙ্গে লড়াই বাধায় এবং শত্রুকে পর্যুদস্ত করবার জন্যে বিবিধ কৌশল অবলম্বন করে। নালসোদের সঙ্গে এদের যুদ্ধ প্রায়ই দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। সময় সময় উভয় পক্ষে একটা সামরিক সন্ধিও হতে দেখা যায়। নালসোরা প্রায়ই চুক্তিভঙ্গ করে না ; কিন্তু ক্ষুদেরা সুযোগ বুঝলেই যখন-তখন চুক্তিভঙ্গ করে নালসোদের আক্রমণ করে থাকে।
পিঁপড়েদের জন্মরহস্য বড়ই জটিলতাপূর্ণ। এই জন্মরহস্যের প্রকৃত তত্ত্ব নির্ধারণের জন্যে কিছুকাল থেকে নালসো-পিঁপড়ে নিয়ে পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হয়েছিলাম ! আণুবীক্ষণিক পরীক্ষার জন্যে বহুসংখ্যক পিঁপড়ের দেহ ব্যবচ্ছেদ করার প্রয়োজন হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কলকাতার আশেপাশে নালসো-পিঁপড়ের প্রাচুর্য লক্ষিত হলেও শহরের অভ্যন্তরে যথেষ্ট গাছপালার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কোথাও এদের সন্ধান পাওয়া যায় না। এই অসুবিধার জন্যে কিছুকাল পূর্বে শিবপুরের বাগান থেকে পিঁপড়ে সমেত বড় বড় বাসা থলেয় পুরে নিয়ে এসে পরীক্ষাগারের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছোট্ট একটা আমগাছে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল, পিঁপড়েরা নতুন বাসা বেধে গাছটাতে উপনিবেশ স্থাপন করবে। প্রথমত একটা থলের মুখ খুলে বাসাটাকে বের করে গাছের একটা নিচু ডালে আটকে দিয়েছিলাম। পাতলা সাদা কাগজের মতো পর্দার সাহায্যে পাতাগুলিকে পরস্পর জুড়ে নালসোরা বাসা নির্মাণ করে। দূরবর্তী স্থান থেকে থলেয় পুরে আনবার সময় জোড়া মুখের পর্দা ছিঁড়ে বাসাগুলি স্বভাবতই কিছু না কিছু জখম হয়েছিল। তাছাড়া বাসার পাতাগুলি শুকোতে শুরু হতেই বাসাটা ক্রমশ বাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। বাসাটা ভাঙবার লক্ষণ দেখেই সহজাত সংস্কারবশে পিঁপড়েরা নতুন পত্র-পল্লবের মধ্যে নতুন বাসা নির্মাণ করতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে বিপদ-আপদ সংঘটিত হলে সাধারণত এদের এরূপ কার্যপ্রণালীই অনুসরণ করতে দেখা যায়। এই ভরসাতেই পত্র-পল্লবের মধ্যে বাসাটাকে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম।
জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষের দিক। মাঝে মাঝে এক-আধ পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। পিঁপড়েগুলি পুরাতন বাসা থেকে ছোটাছুটি করে বেরিয়ে আসতে লাগলো। সকলেই ভয়ানক উত্তেজিত। তাদের অনেকগুলি বাসাটাকে ঘিরে পাহারা দিয়ে আর মাঝে মাঝে একে অন্যের মুখে মুখ ঠেকিয়ে কী যেন সংকেত করে, আবার ছুটে গিয়ে চতুর্দিক তদারক করে আসে। কতকগুলি আবার নিশ্চল পুত্তলিকার মতো শুঁড় উঁচিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে খাড়া পাহারায় নিযুক্ত। আমাকে সেখানে নড়াচড়া করতে দেখে আর একদল – প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি হবে – বাসার শেষ প্রান্তে এসে নিম্নভাগ ঘেঁষে সম্মুখের পা দুটি শূন্যে তুলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভীতি প্রদর্শন করছিল। কতকগুলি আবার শরীরের পশ্চাদ্ভাগ ঊর্ধ্বে তুলে আমার প্রতি বিষাক্ত গ্যাস ছড়াচ্ছিল, একটা অপ্রীতিকর গন্ধে তা বুঝতে পারলাম। কয়েক শত নালসো তড়িদগতিতে ছুটাছুটি করে গাছটার বিভিন্ন ডালে নতুন স্থানের অবস্থা তদারক করতে লেগে গেল। ভাবলাম শীঘ্রই হয়তো নতুন বাসার পত্তন শুরু হবে, কিন্তু কোথায় হবে তার কিছুই বোঝা গেল না। প্রায় তিনঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেল, তথাপি বাসা নির্মাণ করবার কোনই তোড়জোড় দেখা গেল না। বাসার নিচের দিকটা ছিঁড়ে যাবার ফলে কতকগুলি ডিম ও বাচ্চা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সেগুলির লোভে ইতিমধ্যে কতকগুলি ক্ষুদে পিঁপড়ে আনাগোনা শুরু করেছে। আমার নজর ছিল তখন নালসোদের দিকে। ক্ষুদে পিঁপড়ে তো সর্বত্রই আছে, এখানেও ছিল, ডিমের লোভে এসেছে – এই ভেবেই ব্যাপারটা উপেক্ষা করে গেলাম।
বেলা তখন ৫টা হবে। হালকা এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছের ডালে ডালে যে নালসোগুলি ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েছিল, বৃষ্টির দরুণ তাদের আনাগোনা কমে গেছে। তাদের অনেকেই বাসায় ফিরে এসেছে। খাড়া পাহারা ও টহলদাররাও অনেকেই বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। ইতিমধ্যে একটা জিনিস লক্ষ করে বিস্মিত হলাম। ঘন্টা দুই পূর্বে যে ক্ষুদে পিঁপড়েরা মাটির উপর বিচরণ করছিল, তারা এখন একটা সরু লাইন করে প্রায় ছয়-সাত হাত তফাত থেকে গাছের গুড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এর ফলে যে একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সে বিষয়ে তখন কিছুমাত্র সংশয় জাগে নি। যাহোক, নিরাশ হয়ে সেদিনের মতো পর্যবেক্ষণ বন্ধ করতে হলো।
তার পরের দিন সকাল সাড়ে আটটার সময় অবস্থার কিছু পরিবর্তন লক্ষিত হলো। নালসোগুলিকে গাছের উপর ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম না। এতদ্ব্যতীত যে ডালটায় তাদের বাসা ঝুলছিল, সেই ডালটার আগাগোড়া কতকগুলি টহলদার নালসো মোতায়েন হয়েছে। বাসাটার উপরেও কয়েকটা খাড়া পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে। গাছটার বিপরীত দিকে যেতেই শিকড়ের প্রায় কাছাকাছি গুড়িটার গায়ে ৫০/৬০ টা লাল পিঁপড়েকে শুঁড় উঁচিয়ে নিচের দিকে মুখ করে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তার কিছু উপর থেকেই ডালটা পর্যন্ত দশ-বারোটা নালসো বার্তাবাহকের মতো একবার উপরে একবার নিচে ছুটাছুটি করছে। এক-একটি বার্তাবাহক নিচ থেকে বাসার দিকে ছুটে যাবার পথে ডালের উপরে টহলদার ও খাড়া পাহারাদারদের প্রত্যেকের মুখের সঙ্গে মুখ ঠেকিয়ে কী যেন বলে যাচ্ছিল। যাই বলুক, সেটা যে কোনও উত্তেজনাপূর্ণ সংবাদ, তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। কারণ বার্তাবাহকের মুখ ঠেকাঠেকি হবার পরক্ষণেই প্রত্যেকটি পাহারাদার যেন জোড় পায়ে লাফাতে লাগলো। এক দিন এক রাত কেটে গেছে – উত্তেজনা একটু মন্দীভূত হবারই কথা। তবে এরা আজ আবার বাসা থেকে এত দূরে এসে ঘাঁটি নিয়েছে কেন ?
চারদিক ঘুরে ফিরে দেখতেই নজরে পড়লো ক্ষুদে পিঁপড়েরা গাছের গোড়াটার চারদিকে আলগা মাটি তুলেছে। আগের যে সরু লাইনটি দেখেছিলাম, সেটি আজ অনেক চওড়া হয়েছে এবং ক্ষুদেরা উৎসাহভরে দলে দলে আনাগোনা করছে। লাইনটি শেষ হয়েছে গাছের গোড়ার কাছে মাটির নিচে। আলগা মাটির উপর এখানে-সেখানে কতকগুলি নালসোর মৃতদেহ পড়েছিল। আলগা মাটির নিচ থেকে অলক্ষিতে ক্ষুদেরা সেই মৃতদেহগুলি টেনে নিয়ে আসছিল। বুঝতে বাকি রইলো না যে, ইতিপূর্বে উভয় দলে একটা লড়াই হয়ে গেছে। ক্ষুদেরা হয়তো নালসোদের নিকট পরাজিত হয়ে মাটির আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। যাহোক, ক্ষুদে পিঁপড়েদের অত্যাচার থেকে নালসো-পিঁপড়েগুলিকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে গাছটার চতুর্দিকে পরিখার মত করে সেটাকে জলে ভর্তি করে দিলাম। গাছটার ডালপালার সঙ্গে অন্য কোনও গাছের যোগাযোগ না থাকায় নালসোদের অন্য কোথাও চলে যাবার উপায় ছিল না। এখন ক্ষুদে পিঁপড়েদের সঙ্গে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে গুঁড়ির উপর দিয়ে নিচের দিকে নেমে আসাতে মাটির উপর দিয়ে অন্যত্র পলায়ন করবার আশঙ্কা ছিল। গাছের গোড়ার চতুর্দিকে জলের বেষ্টনী দেবার ফলে এক দিকে যেমন নালসোগুলির অন্যত্র পলায়নের পথ বন্ধ হলো, ক্ষুদে পিঁপড়েগুলির পক্ষেও তেমনি জল অতিক্রম করে গাছের নিকট পৌঁছাবার উপায় রইল না।
বেলা প্রায় একটার সময় ফিরে এসে দেখি – বেষ্টনীর জলের প্রায় অর্ধেকটা মাটিতে শুষে গেছে। বেষ্টনীর অপর পাড় পর্যন্ত ক্ষুদে পিঁপড়ের লাইনটা পূর্বের মতই বজায় আছে, কিন্তু জলের বাধার জন্যে পিঁপড়েরা অনেকেই নতুন রাস্তা বের করবার জন্যে বাঁধটার নানা স্থানে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় এই যে, গাছের গোড়ায় মাটির নিচে যে পিঁপড়েগুলি লুকিয়ে ছিল, তারা নালসোদের সঙ্গে অভিনব পরিখা-যুদ্ধ আরম্ভ করে দিয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে একে পরিখা-যুদ্ধ না বলে সুড়ঙ্গ-যুদ্ধ বলাই উচিত। কারণ উইপোকারা যেমন সুড়ঙ্গ নির্মাণ করে অগ্রসর হয়, এরাও সেরূপ মাটির বেষ্টনী তুলে গোড়াটার ৬/৭ ইঞ্চি উপর পর্যন্ত একটা দিক প্রায় ঢেকে ফেলেছে। নালসোদের সৈন্যসংস্থান পূর্বের মতোই রয়েছে বটে, কিন্তু পূর্বের অধিকৃত এলাকা থেকে প্রায় ৪/৫ ইঞ্চি পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
হাজার হাজার ক্ষুদে সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরে কাজ করছিল ; সুড়ঙ্গের প্রান্তভাগে তাদের মুখ ও শুঁড়গুলি ছাড়া আর কিছুই বড় একটা দেখা যাচ্ছিল না। নালসো-প্রহরীরা অতি সতর্কভাবে তাদের দিকে দৃষ্টি রেখেছে। দৈবাৎ এক-একটি ক্ষুদে বাইরে এসে পড়লে ছোঁ মেরে ধরে নিয়ে কেটে ফেলছে। সময় সময় দুই-একটা ক্ষুদে পিঁপড়েকে শুঁড় ধরে সুড়ঙ্গ থেকে টেনেও বের করছিল। তারা আবার পাল্টা আক্রমণে তার মুখে বা শুঁড়ে কামড়ে ধরছে। অবশেষে কামড়ের বিষে জর্জরিত হয়ে উভয়েই জড়াজড়ি করে নিচে পড়ে যাচ্ছে। এদিকে সুড়ঙ্গ ক্রমশ ঊর্ধ্ব দিকে অগ্রসর হয়ে চলেছে। বেলা তিনটার সময় সুড়ঙ্গটা প্রায় ১০ ইঞ্চি ঊর্ধ্বে উঠেছিল। এদিকে আর এক অদ্ভুত কাণ্ড দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বাঁধের জল প্রায় শুকিয়ে আসছিল। জলের মধ্যস্থলে খানিকটা উঁচু জায়গা দ্বীপের মতো জেগে উঠেছে। অপর পারের সেই ক্ষুদে পিঁপড়েরা একটা দুঃসাহসিক কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে। চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ না করলে এরূপ ঘটনার কথা হয়তো বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হতো না। ক্ষুদে পিঁপড়েরা একটার পিছনে আর একটা – এরূপভাবে সার বেঁধে জলের পাতলা আবরণের উপর দিয়ে অতি সন্তর্পণে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে দ্বীপটার উপর জড়ো হয়েছে। এখান থেকে গাছের গুঁড়ির দূরত্ব মাত্র দেড় ইঞ্চির কিছু বেশি ছিল। প্রায় আধ ঘন্টার মধ্যে দেখতে দেখতে তারা সকলে জড়াজড়ি করে একটা মোটা লাইনের মতো জলের উপর ভেসে পড়লো ; কিন্তু ব্যবধানটুকু অতিক্রম করতে পারলো না।
প্রায় ৫টার সময় দেখলাম গাছের গুঁড়িটার প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় উভয় পক্ষে ভীষণ লড়াই বেধে গেছে। বাঁধের মধ্যে স্থানে স্থানে সামান্য জল রয়েছে। সেই কর্দমাক্ত জমির উপর দিয়েই ক্ষুদে পিঁপড়েরা এবার মোটা লাইন বেঁধে গাছের গুঁড়ির উপর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। অগ্রবর্তী নালসোরা ক্ষুদে পিঁপড়েদের সঙ্গে মোটেই এঁটে উঠতে পারছিল না। প্রায় প্রত্যেকটা নালসোরই – শুঁড়ে, কারো পায়ে দু-তিনটা করে ক্ষুদে পিঁপড়ে কামড়ে ধরে ঝুলছিল। নালসোরা এক-একটা ক্ষুদেকে কামড়ে ধরা মাত্রই সেও আবার মুখ কামড়ে ধরে। নালসো তখন বিষের জ্বালায় মুখ ঘষতে ঘষতে একদিকে ছুটে পালাতে থাকে। ইতিমধ্যে আরও দু-চারটা ক্ষুদে পিঁপড়ে এসে তাকে কামড়ে ধরতেই শরীরটাকে ধনুকের মত বাঁকিয়ে সবাইকে নিয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। ক্ষুদেরা প্রবলবেগে আক্রমণ চালিয়েছে, এক-একটা নালসোকে ৪/৫ টা ক্ষুদে-পিঁপড়ে মিলে আক্রমণ করছে আর বাকিগুলি ফাঁকফন্দী দিয়ে বন্যার জলের মতো অগ্রসর হয়ে চলেছে।
প্রায় মিনিট দশেকের মধ্যেই অগণিত নালসো ও ক্ষুদে পিঁপড়ে হতাহত হয়ে ঝুপ ঝুপ করে নিচে পড়তে লাগলো। ক্ষুদে পিঁপড়েরা করছে এগিয়ে গিয়ে আক্রমণ আর নালসোরা করছে আত্মরক্ষা। ক্ষুদেদের একটা মারা পড়লে তার স্থলে দশটা এসে দাঁড়ায় আর নালসোরা চায় বাধা দিতে, যাতে শত্রুরা তাদের বাসায় প্রবেশ করতে না পারে। কাজেই নালসোরা পিছু হটে ঘর সামলাতে ব্যস্ত। যে ডালে বাসাটা ঝুলছিল, ক্ষুদে পিঁপড়েরা আরও প্রায় মিনিট পনেরোর মধ্যেই সেই ডাল ও কাণ্ডের সংযোগস্থলে এসে পৌঁছুলো। ক্ষুদেরা যাতে সেই ডালটায় আসতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে নালসোরা এবার প্রবলভাবে বাধা দিতে লাগলো। বাসা থেকে দলে দলে নালসোরা এসে সেই সংযোগস্থলে সমবেত হতে লাগলো। ক্ষুদে পিঁপড়েরা এস্থলে লাইন করে অগ্রসর হচ্ছিল, কাজেই সংকীর্ণ লাইনের সুবিধা পেয়ে নালসোরা তাদের ধারালো সাঁড়াশীর সাহায্যে এক-একটা করে ক্ষুদেগুলিকে ধরে কেটে ফেলতে লাগলো। কেউ কেউ আবার ক্ষুদেগুলিকে ধরে ঝুপঝাপ করে নিচে ফেলে দিচ্ছিল। অনেকে আবার জড়াজড়ি করে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। নালসোরা উত্তেজিতভাবে এত বিষাক্ত গ্যাস ছাড়ছিল যে, প্রায় দু-হাত তফাত থেকে বেশ ঝাঁঝালো গন্ধে এবং সমবেতভাবে প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়ে ক্ষুদেরা এবার মোটেই সুবিধা করতে পারছিল না। যে পথে অগ্রসর হয়েছিল তারা সেই পথে ফিরতে লাগলো। কিন্তু নালসোরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলো না। ডাল ও কাণ্ডের সংযোগ স্থলেই ঘাঁটি আগলে রইলো। তখনও ক্ষুদেরা সকলেই একেবারে চলে যায় নি, তবে খুবই অল্পসংখ্যক সৈন্য আনাগোনা করছিল। লড়াই চলবার সময় সম্মুখের ঘাঁটি ও ডালের প্রান্তভাগে অবস্থিত বাসা পর্যন্ত দীর্ঘ পথ জুড়ে বার্তাবাহকগুলিকে খুবই উত্তেজিতভাবে ছোটাছুটি করতে দেখা গেল।
বাসাটার মধ্যে কী হচ্ছিল তখন লক্ষ করবার অবসর পাই নি। এবার কাছে গিয়ে দেখলাম, যে স্থানে বাসাটা ঝুলছিল, তা থেকে প্রায় হাতখানেক তফাতে কতকগুলি পাতার উপর প্রায় চারপাঁচ শত নালসো একত্রিত হয়ে নতুন একটা বাসা নির্মাণ করতে শুরু করেছে। কতকগুলি নালসো সারবন্দীভাবে অবস্থান করে অনেকগুলি পাতাকে পরস্পর সংলগ্ন করে কামড়ে ধরে রয়েছে। এখনও সুতা বুনে সেগুলিকে জোড়া দেওয়া হয়নি। তারই পাশে আর একটা অপেক্ষাকৃত ছোট্ট বাসারও পত্তন করেছে। শত শত নালসো অতি দ্রুতগতিতে সেই অসম্পূর্ণ বাসার মধ্যেই তাদের ডিম ও বাচ্চাগুলিকে স্থানান্তরিত করছিল। যে ডালটার উপর দিয়ে ডিম, বাচ্চা প্রভৃতি স্থানান্তরিত করা হচ্ছিল, তার এক পাশে শতাধিক খাড়া পাহারা মোতায়েন রয়েছে। অগ্রবর্তী বুহ্য ভেদ করতে পারলেও শত্রুর পক্ষে এই ঘাঁটি ভেদ করা সহজ হতো না। সন্ধ্যার একটু পূর্বে দেখা গেল, বাচ্চার সাহায্যে সুতা বুনে নতুন বাসার জোড়া মুখগুলি আটকাবার ব্যবস্থা হচ্ছে।
তৃতীয় দিন বেলা একটা পর্যন্ত যুদ্ধ সম্পর্কে উভয় পক্ষের কোনও কর্মতৎপরতা দেখা গেল না। নালসোদের পাহারার ব্যবস্থায় একটু শৈথিল্য লক্ষিত হলো। কিন্তু তখনও তাদের ডিম, বাচ্চা অপসারণ পুর্ণোদ্যমে চলছিল। ক্ষুদে পিঁপড়েরা অন্য দিকের একটা ডালের গা বেয়ে উপরের দিকে লাইন করে চলছিল, অবশ্য নালসোদের অধিকৃত ডালটার আশেপাশেও দু-একটা ক্ষুদে পিঁপড়েকে আনাগোনা করতে দেখা গেল। ডালটার একটু কাছে যেতেই গোটা তিনেক পাহারাদার নালসো হঠাৎ যেন কেমন একটা ভয় পেয়ে উল্টোমুখে ছুটে গিয়ে খাড়া একটা ডালের উপর উঠলো। ক্ষুদে পিঁপড়েরা সেই ডালটার অপর পাশ দিয়েই উপরে যাতায়াত করছিল। দলভ্রষ্ট নালসোদের একটা ছুটতে ছুটতে গিয়ে তাদের লাইনে পড়লো। আর যায় কোথা ! পাঁচ-সাতটা ক্ষুদে মিলে সেটাকে কাবু করে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেললো এবং বিছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে বাসার দিকে বয়ে নিয়ে চললো। এই আকস্মিক ব্যাপারে ক্ষুদেদের লাইনের ভিতর একটা বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হলো। লাইন ছেড়ে অনেকেই ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে যেন অপরাপর দুষ্কৃতকারীদের সন্ধান করতে লাগলো। ইতিমধ্যে আর একটা নালসোর সঙ্গে হঠাৎ আবার ক্ষুদেদের দেখা হয়ে গেল। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে তাদের অধিকৃত স্থানে উপস্থিত হয়ে একেবারে বাসার মধ্যে ঢুকে পড়লো। ক্ষুদে পিঁপড়েরা নালসোর সঙ্গে সমান বেগে ছুটতে না পারলেও বোধ হয় তার গন্ধ অনুসরণ করে কিছুক্ষণ পরেই পূর্বোক্ত লড়াইয়ের স্থলে উপনীত হলো এবং কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে লাইনের মধ্যে ফিরে গেল। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পরে ক্ষুদেরা ঊর্ধ্বগামী লাইন থেকে খুব ক্ষীণ একটা লাইনে নালসোদের অধিকৃত ডালের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। নালসোদের ডালের মাঝামাঝি তারা কোনই বাধা পেল না। আর কিছুদুর অগ্রসর হতেই একটা টহলদার নালসো অগ্রবর্তী ক্ষুদে পিঁপড়েটাকে ধরে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেললো। আর একটাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হওয়া মাত্রই দুটা ক্ষুদে পিঁপড়ে তার দুই ঠ্যাং কামড়ে ধরলো। যন্ত্রণায় নালসোটা কিছুক্ষণ লাফালাফি করে অতি অল্প সময়েই নিস্তেজ হয়ে পড়লো। তখন একে একে ক্ষুদেরা অর্ধমৃত পিঁপড়েটাকে ঘিরে ধরলো। ক্ষুদেদের প্রধান লাইনে এই সংবাদ পৌঁছতে বিলম্ব হলো না। দেখতে দেখতে ক্ষুদে পিঁপড়েরা কাতারে কাতারে ডালটার দিকে অভিযান শুরু করে দিল। ডালটার ঠিক মধ্যস্থলে প্রায় হাতখানেক স্থান জুড়ে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলতে লাগলো।
ক্ষুদেদের প্রবল চাপ নালসোরা এবার সহ্য করতে পারছিল না ! বাধা দিতে দিতে তারা ক্রমেই পিছু হটতে লাগলো। দলে দলে নালসোরা প্রাণ দিতে লাগলো, কিন্তু ক্ষুদেদের সৈন্যসংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বোধ হলো যেন বিষাক্ত গ্যাসের গন্ধেই তারা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারছিল না। কারণ সে স্থলে বহু নালসো সমবেত হয়ে একযোগে গ্যাস ছাড়ছিল। প্রায় মিনিট পাঁচ-সাত এভাবে চলবার পর দেখা গেল, ক্ষুদে পিঁপড়েরা এক নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। পুরাতন বাসাটার প্রায় দুই ইঞ্চি উপরে অন্য ডালের একটা পাতার ডগা ঝুলছিল। উপরের ডাল ধরে ঘুরে গিয়ে ক্ষুদেরা সেই পাতাটার ডগা পর্যন্ত পৌঁচেছে ; কিন্তু যোগাযোগ না থাকায় নামতে পারছিল না। বাসাটা যে খুবই নিকটে, গন্ধে বোধহয় তা টের পেয়েছিল। কিছুক্ষণ ইতস্তত করবার পর অবশেষে ক্ষুদেরা একে একে ঝুপ ঝুপ করে বাসাটার উপর পড়তে লাগলো, যেন প্যারাসুটিস্টের অবতরণের মতো। অবতরণ করে বিনা বাধায় তাদের অনেকেই বাসাটার ছিন্ন অংশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। বাসার উপরেই এই অবতরণকারী সৈন্যদের কয়েকটার সঙ্গে নালসোদের ভীষণ ধ্বস্তাধ্বস্তিও চলছিল। প্রায় ৬০/৭০ টা ক্ষুদে পিঁপড়ে ভিতরে প্রবেশ করেছে। ভিতরে তখন কী ঘটছিল, বাইরে থেকে তা দেখবার উপায় ছিল না ; কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখা গেল নালসোরা বাসার বিভিন্ন বিছিন্ন অংশের ভিতর দিয়ে দ্রুতগতিতে যে দিকে পারে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। অনেকে আবার ডিম ও বাচ্চাগুলিকে মুখে নিয়ে বের হয়েছে। তাদের চালচলন ও গতিভঙ্গি দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারা গেল যে, তারা ভয়ানক ভয় পেয়ে গেছে। চতুর্দিকে একটা ভীষণ অরাজক কাণ্ড। এদিকে ডালের উপরের ক্ষুদে পিঁপড়েরা অগ্রগতিতে বাধা পেয়ে একটা নতুন পন্থা অবলম্বন করছে। এতক্ষণ ডালটার উপর দিকেই যুদ্ধ চলছিল। পাশে ও নিচের দিকে নালসোদের কোনও রক্ষণ ব্যবস্থা ছিল না। এই সুযোগে ক্ষুদেরা ডালটার নিচ ও পাশের দিক দিয়ে আরও দুটা নতুন লাইনে অগ্রসর হতে লাগলো। এই কৌশলে এক রকম বিনা বাধায় বহু সংখ্যক শত্রুসৈন্য নালসোদের বাসার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো। পূর্বেই বাসার মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। এখন অতর্কিতে বহু শত্রু সৈন্য বাসার প্রবেশ পথ ধরে আক্রমণ করবার ফলে বিশৃঙ্খলা চরমে উঠলো। মাঝখানে এক দল এবং বাসাটার নিকটে দু-তিন দলে বিচ্ছিন্ন ভাবে লড়াই চলতে লাগলো। নালসোদের মধ্যে যোগাযোগ একবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কাজেই প্রাণভয়ে সকলেই পালাতে ব্যস্ত। তারা এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে, অনেক পিঁপড়ে দিশাহারা হয়ে ছুটতে গিয়ে বাসার উপর থেকে ঝুপ ঝুপ করে নিচে পড়তে লাগলো। সেখানে তারা মাটিতে অবশিষ্ট ক্ষুদে-পিঁপড়েদের কবলে পরে প্রাণত্যাগ করতে বাধ্য হলো।
বাসাটার বাইরের দিকে একস্থানে দেখলাম, প্রায় ৪০/৫০ টা রানী এক সঙ্গে জড়াজড়ি করে ভয়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। নতুন বাসার মধ্যে অসংখ্য নালসো আশ্রয় গ্রহণ করলেও পুরাতন বাসায় তখনও কয়েক হাজার পিঁপড়ে অবস্থান করছিল। ডিম, বাচ্চা প্রভৃতিও কম ছিল না ; তাছাড়া পুরুষ ও রানী যথেষ্ট ছিল। সেগুলিকে তখনও নতুন বাসায় স্থানান্তরিত করা সম্ভব হয় নি। ক্ষুদেদের আক্রমণ থেকে এদের একটি প্রাণীও রক্ষা পেল না। প্রায় আধ ঘন্টা সময়ের মধ্যেই ক্ষুদেরা এই যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে জয়লাভ করলো। তখন বাসার উপরেও আশেপাশে নালসোদের অজস্র মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ছিল না ; অবশ্য ওদের সঙ্গে ক্ষুদে সৈন্যদের মৃতদেহও অনেক ছিল। যুদ্ধ আরম্ভ থেকে শেষ পর্যন্ত ক্ষুদেরা মৃতদেহগুলি খণ্ড খণ্ড করে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। যুদ্ধের পরেও দুই দিন পর্যন্ত এই মৃতদেহ, ডিম ও বাচ্চার অপসারণকার্য চলেছিল। এক স্থানে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। লড়াইয়ের সময় কতকগুলি নালসো উপরের একটা পাতা থেকে শিকল গেঁথে নিচের অন্য একটি ডালে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিল। ক্ষুদেদের আক্রমণ থেকে তারাও কেউই রেহাই পায় নি। জ্যান্ত পিঁপড়ের শিকলটি এখন কতকগুলি মৃতদেহের শিকলে পরিণত হয়ে ঝুলছিল। পুরাতন বাসাটা দখল করবার পর ক্ষুদেরা নতুন বাসাটা আক্রমণ করে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে ফেলে ; কিন্তু সেটা বিশেষ সুরক্ষিত থাকায় যুদ্ধ চলেছিল প্রায় দিন দুয়েরও বেশি।
(গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা এই প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতে পারার জন্য আমরা তাঁর পুত্রবধূ শুভা ভট্টাচার্য, দৌহিত্রী মালা চক্রবর্ত্তী, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য বিজ্ঞান প্রসার সমিতির সম্পাদক দীপক কুমার দাঁ এবং আকাশবাণী কলকাতার মানস প্রতিম দাস-র কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মূল গ্রন্থ থেকে লেখাটি টাইপ করেছেন ‘বিজ্ঞান’-এর স্বেচ্ছাসেবক, কুণাল চক্রবর্তী।)
গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের লেখা গ্রন্থ ‘বাংলার কীট-পতঙ্গ’ থেকে কিছু বাছাই করা প্রবন্ধ আমরা বিজ্ঞান-এর পাতায় নতুন করে প্রকাশ করছি। এখনো অব্দি প্রকাশিত লেখাগুলো এখানে পাবে। আর এরকম পর্যবেক্ষণে যদি তোমার নিজেরই উৎসাহ থাকে আর তুমিও এরকম অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা দেখে থাকো, তাহলে আমাদের সেই গল্প জানাও। কিভাবে, সেটা বিশদে দেখতে পাবে এখানে।